উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -17
শ্যামলীদির মুখপানে তাকাতে তাকাতে এক সময় ওর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। মনে তবুও ভয়, জানিনা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। শ্যামলীদিকে
বার বার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি শুধু ওর মুখ দিয়ে একথা শুনতে পেয়েছিলাম ওখানে গিয়ে দেখতে পাবো ।
দেবীবাবু নিজে ড্রাইভ করছেন । সোঁ সোঁ শব্দে পাশের বড় বড় মাথা উঁচু করে প্রতিযোগিতায় সামিল হওয়া বাড়ীগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে । হাজার হাজার মানুষের মিছিলকে দুফাক করে তীরের মতো চলে যাচ্ছে গাড়ীখানা । বড্ড পাকা হাত দেবীবাবুর । ভয় যে পাচ্ছিলাম না তা নয় । ধীরে ড্রাইভ করতে বললাম । হয়তো আমার কথা তিনি শুনতে পেলেন না ।
দেখতে দেখতে একসময়ে একটা প্রকাণ্ড বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ীখানা । দেবীবাবু আমাকে নেমে আসতে বললেন । আমি গাড়ী হতে মাটিতে নেমে প্রকাণ্ড বাড়ীটার পানে তাকিয়ে ভাবতে থাকি এখানে কিসের জন্য এলাম । ওর কথায় ভাবনাকে দূরে সরিয়ে ওকে অনুসরণ করতে করতে হাজির হলাম ঐ প্রকাণ্ড বাড়ীটার তিন তলার উপরে । আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে , কি কারণে , তা জানার জন্য মনে কোন স্পৃহা জাগেনি । ওকে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মনে করে ওকে অনুসরণ করে যাচ্ছি ।
দেখলাম তিন তলার উপরে বহু নরনারীর সমাবেশ । কিন্তু সকলে কাজে ব্যস্ত । মাঝে মাঝে অড় চোখে তাকাচ্ছিলাম । কেউ কেউ আমার পানে তাকিয়ে পুনরায় মুখ নামিয়ে নিচ্ছিলো । হঠাৎ দুটো নার্স এর প্রতি দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলাম । তবে কি এটা কোন ডাক্তারখানা বা নার্সিহোম ? কিন্তু ডাক্তারখানার কোন নিদর্শন দেখছি না ।
নার্স দুজন এগিয়ে এসে দেবীবাবুকে কিছু বলার চেষ্টা করলেন , কিন্তু দেবীবাবু বাধা দিতেই মুখ বন্ধ করল । আমার মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল । মনে হচ্ছে আমি যেন কোন ইন্দ্রজালে আবদ্ধ হয়েছি যার ফলে কিছু করতে পারছি না ।
এক সময় দেবীবাবু বলে উঠলেন , ঐ রুমটার ভেতরে যান আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি ।
ওকথা শুনে আমি কোন এক অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলাম । আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল ।
দেবীবাবু বললেন , কোন ভয় নেই , এটা নার্সিংহোম , কেউ আপনার ক্ষতি করবে না।
আমি জেদ নিলাম আমি একা যাবো না । দেবীবাবু কথা না বাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন , আমিও করলাম ।
আমি যেই মাত্র প্রবেশ করেছি , একটা ছোট মেয়ে বয়স বছর পাঁচ ছয়ের কাছাকাছি , ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো পরিস্কার গায়ের রঙ তার , আমার চোখ ওর চোখ এক হতেই মেয়েটা বিছানা হতে নেমে আমার আঁচল ধরে টানতে লাগলো ও কাঁদতে কাঁদতে বলল , মামনি , কেন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে মামনি , কেন আমাকে সাথে নিয়ে যাওনি মামনি , মামনি কথা বল মামনি ।
কি করব ভাবছি। ওর কথা শুনে শরীরটা তো শীতল হয়ে গেলো । সহজ , সরল শিশুর কোমল স্পর্শে আমার হৃদয়ে মাতৃত্ব জেগে উঠলো অনাস্বাদিত পূর্ণ মাতৃত্বের কোমল স্পর্শ আমার অন্তরকে স্বর্গীয় আনন্দে অভিভূত করে তুলল । ভুলে গেলাম আমি বারবণিতা রমা ।
মা তুমি কথা বলছ না কেন ? মেয়েটি কথা বলতে বলতে ওর ফুলের কুঁড়ির মতো ঠোঁট দুটো কাঁপতে থাকল ।
বিলম্ব না করে মেয়েটিকে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলাম । বার বার ওর ঠোঁটে চুমু খেতে থাকলাম । আমি তোকে ছেড়ে আর যাবো না মামনি । আর কোন দিন তোকে কষ্ট দেব নারে । গভীর অপত্য স্নেহে কচি শিশুটির মুখে আমার মুখ ঘষতে থাকলাম । ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমি দারুন অন্তর্বেদনায় চিন্তা করতে লাগলাম । মা হতে তো জীবনে পারব না । মা হবার আশা অনেক আগে মুছে ফেলেছি কিন্তু একে কি মেয়ে বলে বুকে টানতে পারব না ? বারবনিতা বলে কি মাতৃত্বের সুকুমার প্রবৃত্তি কোন অংশ আমার দেহে নেই ?
মেয়েটি কে- তা একটু পরেই জানতে পারবো । তার আগে আমার হৃদয় মরুভূমিতে মরুদ্যানের সজীবতা নিয়ে আসি । দেবীবাবু দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । জানি না তার অন্তরে কিরূপ প্রবাহ চলছিল ।
ধীরে ধীরে মেয়েটিকে কোলে তুলে ওর বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওকে আদর করতে থাকলাম । এমন সময় একজন নার্স প্রবেশ করে বললেন , এবার তোমার মাকে ফিরে পেয়েছো ময়না , এই দুধটুকু খেয়ে নাও ।
ময়না যে মেয়েটির নাম তা জানতে পারলাম । ময়না বলল , সে আমার হাতে দুধ খাবে । নার্স স্বপ্নাদেবী আমাকে দুধের গ্লাসটা ধরিয়ে বেশ সুমিষ্টি কণ্ঠে বললেন , আপনি ওকে খাইয়ে দিন । বেচারা কোন দিন আমার হাতে কোন খাবার খেতে চায় না । এখন আসি ময়না , তোমার মা তোমাকে অনেক আদর করবে । স্বপ্নাদেবী অপেক্ষা না করে দেবীবাবুকে কি যেন বলে বাইরে বেরিয়ে গেল ।
যত্ন সহকারে ময়নাকে দুধ খাইয়ে ওকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করলাম । ঘুমপাড়ানির গান আমার জানা নেই , তাহলে উপায় । ময়নার গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে তার অবসন্ন দেহটা এক সময় ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে গেল । ধীরে ধীরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেবীবাবুর কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম মেয়েটি কে ? আর কেনই বা আমাকে ওর মা মনে করল ।
দেবীবাবু অশ্রুসিক্ত চোখ দুটোকে রুমাল দিয়ে মুছে নম্র কণ্ঠে বললেন , বাইরে আসুন বলছি । ওর পিছনে গিয়ে একটা রুমের মধ্যে প্রবেশ করলাম । বললেন , ময়না আমার মেয়ে । নিজের অন্যায় অত্যাচারের জন্য সব কিছু হারিয়েছি । ময়নার মাঝে হারিয়েছি , বাবাকেও হারাতে বসেছি , জানি না ভাগ্য এরপর কতখানি সুপ্রসন্ন । যদি আপনার সাথে সাক্ষাৎ না হতো তাহলে মনে হয় অবলা সরল এক নিষ্পাপ শিশুকে হারাতে বসেছিলাম । আমার অন্যায় অত্যাচারের কথা সময় হলে একদিন বলবো । ময়নার মা যেদিন আত্মহত্যা করল , পরদিন হতে মাতৃস্নেহে বঞ্চিত অবোধ শিশুটি অস্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো । যাকে বলে সাইকিয়াট্রিক ভিস ওর্ডার । মায়ের আদর আবদারে সে পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কোন আপনজনকে চিনতো না , আমার সংস্পর্শেও থাকতো না । কারো সাথে কথা বলতো না । যদি জোরপূৰ্ব্বক কথা বলতে চেষ্টা করতাম , তাহলে শ্রাবণের বর্ষণের মতো চোখ ফেটে দরদর ধারে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।
ক্রমশ...
Comments