ছোট গল্প - তৃতীয় কৌরব || লেখক - দীপক কুমার মাইতি || Short story - Tritiyo Kourav || Written by Dipak Kumar Mayti

 




 তৃতীয় কৌরব

দীপক কুমার মাইতি 

 


সভাকক্ষ


তখনও তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে রয়েছে কর্ণ ,দুর্যোধন প্রভৃতির মুখে। একটু আগে দুঃশাসন রজস্বলা, একটি মাত্র বস্ত্র পরিহিতা দ্রৌপদীর কৃষ্ণকুঞ্চিত কেশ মুঠিতে ধরে টানতে টানতে ‘এই দাসী, দাসী’ বলতে বলতে সভায় নিয়ে এসেছে। দ্রৌপদী চিৎকার করে তাঁকে হেনস্থার বিচার চাইছিলেন। তখন দুর্যোধন অট্টহাসি হাসছেন – তোমার স্বামী তোমাকে পাশায় পণ রেখে হেরে গিয়েছেন। এখন আমি তোমার প্রভু। সভাসদের কী বলবেন?


      দ্রৌপদী পুনরায় বলেন – সভায় উপস্থিত কুরুরাজ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, পিতামহ ভীষ্ম, মহামন্ত্রী বিদুর, মহাগুরু দ্রোণ, পুজ্যপাদ কৃপাচার্য প্রভৃতির কাছে প্রশ্ন, এই কপটচারী,ধূর্ত-পাপাত্মারা ভাবে ছলে-কৌশলে ধর্মরাজকে পাশা খেলতে রাজি করিয়েছে। কপটভাবে তাঁর সর্বস্ব জিতে নিয়েছে। তিনি প্রথমে ভাইদের, পরে নিজেকে বাজি রেখে হেরে গিয়েছেন। তারপর আমাকে বাজি রেখে হেরেছেন। আমি জানতে চাই, নিজে হেরে যাওয়ার পর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের আমাকে পণ রাখার অধিকার কী তাঁর ছিল? এই পণ রাখা ধর্মানুসারে কী অনুমোদিত?


      সবাই চিন্তিত। মহামতী ভীষ্ম বললেন – ধর্মের গতি অতি দুর্বোধ্য। তাই এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।”


      অন্যরা নীরব। সেই মুহূর্তে কৌরবদের বিরুদ্ধাচর্ণ করার মতো কোন সাহসী সভায় ছিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন ধৃতরাষ্ট্র নন্দন তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ – সভাসদগণ! আমাদের সকলের বিচার বিবেচনা করে পূন্যাত্মা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত। কুরুকুল রক্ষাকারী পিতামহ ভীষ্ম আপনি দায় এড়াতে পারেন না। পিতা, কুরু-মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও মহামন্ত্রী বিদুর আপনারা কেন কোন উত্তর দিচ্ছেন না? মহাগুরু দ্রোণ ও কুরু বংশের প্রধান উপদেষ্টা কৃপাচার্য আপনারাও চুপ কেন? উপস্থিত রাজন্যরা আসক্তি পরিত্যাগ করে এই প্রশ্নের বিচার করুণ। পতিব্রতা রমণী দ্রৌপদীর প্রশ্নের পৃথকভাবে যথাযথ উত্তর দিন। আপনাদের সুচিন্তিত উত্তরই একমাত্র কুরুবংশকে তার পতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।”


      বিকর্ণ বারবার আবেদন করলেও সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলেন। বিকর্ণ ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়েন। রাগে হাতে হাত ঘসতে থাকেন – হে কৌরব সভাসদগণ আমি এ ব্যাপারে যা ন্যায়সঙ্গত মনে করি, তা না বলে থাকতে পারছি না। মৃগয়া, মদ্যপান, পাশাখেলা ও স্ত্রীসংসর্গ এই চারটেই রাজাদের কামজ বাসনা। এগুলিতে আসক্ত হলে মানুষের নীতি-ধর্মের সমস্ত চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় মত্ত মানুষেরা যে কাজ করে বা যে কথা বলে সেই সব কাজ বা কথা অকৃত বলেই ধরে নেন বুদ্ধিমান ও ধীমান ব্যক্তিরা। মহামতি যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় আসক্ত। তাঁর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধূর্ত পাশাড়েরা তাঁকে খেলায় প্রবৃত্ত করেছে। যুধিষ্ঠির পণ ধরেছিলেন প্রমত্ত অবস্থায়। তাই তিনি যে সমস্ত পণ ধরেছেন তা ধর্মানুসারে গণ্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই তিনি বা তাঁর ভ্রাতারা বা পতিব্রতা দ্রৌপদী কারো বিজিত সম্পদ হতে পারেন না।


      তবুও সভাসদেরা চুপ। বিকর্ণ প্রশ্ন তুললেন – মহারানী দ্রৌপদী কেবল মাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরের পত্নী নন। তাঁর অন্য চার পাণ্ডবভ্রাতাও দ্রৌপদীর স্বামী। তাঁদেরও দ্রৌপদীর উপর সমান অধিকার। তাঁদের অনুমতি ছাড়া দ্রৌপদীকে পণ রাখা যায়? এছাড়া মনে রাখবেন যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় নয়, কপট শকুনির প্ররোচনায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছিলেন। তাই এই ঘটনা কী ধর্মসম্মত? দ্রৌপদী জুয়াতে হারেননি। তিনি দাসী নন। রজস্বলা একবস্ত্রা মহান সতী দ্রৌপদীকে সভায় অপমান করা ধর্ম বিরোধী, অন্যায়, পাপকর্ম। সভায় উপস্থিত যাঁরা এই পাপকর্মকে সমর্থন করেন তাঁরা ক্ষত্রধর্ম বিরোধী। সকলেই মহাপাতকী হবেন।


      সভায় আলোড়ন শুরু হল। সকলে বিকর্ণের কথা সমর্থন করে তাঁর প্রসংশা করতে লাগলেন। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি সহ সকলের নিন্দা করতেও লাগলেন। নিজের অনুগত সভাসদের আচরণে হতবাক হলেন দুর্যোধন। কর্ণ বুঝলেন হাওয়া বেগতিক। দ্রৌপদী তাঁকে সুতপুত্র বলে স্বয়ংবর সভায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দ্রৌপদীকে হেনস্থা করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। কর্ণ ক্রোধ ভরে বিকর্ণের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলেন — সভায় তোমার অনেক গুরুজন রয়েছেন। ধর্ম ও অধর্ম ব্যাপারে তাঁরা তোমার থেকেও বিজ্ঞ। তাঁদের নীরবতার অর্থ, যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি ধরে কোন ভুল করেননি। তুমি নিতান্ত বালক। সভায় তোমার কথা বলার কোন অধিকার নেই। তুমি চুপকর। নীরব থাক।


      বিকর্ণ কর্ণের থেকে হাত মুক্ত করলেন। তাঁর কন্ঠস্বর শান্ত ও ধীর – ধিক আপনাকে অঙ্গরাজ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বয়সের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সাহসের। সেই সাহস আপনাদের নেই। আপনারা রাজানুগ্রহের আশায় অধর্মের কাছে বিক্রিত। আপনাদের হত বুদ্ধির জন্য কৌরব বংশ ধ্বংস হবে। আপনি পরম ধার্মিক ও দাতা কর্ণ বলে পরিচিত। আপনি কী এই নীতিশিক্ষা আমাকে দিতে চান যে অধর্ম জেনেও চুপ থাকব?


কর্ণের ধমকে ওঠেন – তুমি ধর্মের কী বোঝ? যুধিষ্ঠির সর্বস্ব পণ করে হেরেছেন। পত্নী স্বামীর সম্পদ, তাহলে দ্রৌপদীকে পণ রাখা অন্যায় কেন? যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন তখন অন্য পাণ্ডবেরা নীরব ছিলেন কেন? তাদের নীরবতাই সম্মতির লক্ষ্মণ। শাস্ত্রে পাঁচ পতির বিধান নেই। পাঁচপতির স্ত্রী দ্রৌপদী বহুগামী। দ্রৌপদী একজন বেশ্যা। বেশ্যা রজস্বলা না একবস্ত্রা তার গুরুত্ব নেই সমাজে। তোমার এতই যদি দরদ তবে অন্দরে গিয়ে রোদন কর।   


বিকর্ণকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে – কী হল দুঃসাশন! যাও দাস পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ


      থাকতে পারলেন না বিকর্ণ। মুহূর্তে সভাকক্ষ ত্যাগ করে ছুটে গেলেন মাতা গান্ধারীর কাছে। তাঁর পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। বিকর্ণকে বক্ষে তুলে বললেন – কী হয়েছে পুত্র! বিচলিত কেন?”


      বিকর্ণ মাতাকে পাশা খেলার সভাগৃহে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দেন – মাতা আপনার মতে মহারানি দ্রৌপদী মাতালক্ষ্মীর অংশজাত । যেদিন পাণ্ডব ভ্রাতারা দ্রৌপদীকে বিয়ে করে ফিরেছিলেন, সেদিন আপনার নির্দ্দেশে আমি ও চিত্রসেনা তাঁদের সসম্মানে বরণ করে রাজপুরীতে নিয়ে এসেছিলাম। শুধু তাই নয় আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘দ্রৌপদী যেন কোনদিন অসম্মানিত না হোন তার দিকে লক্ষ্য রাখবে।’ কিন্তু মাতা আজ কৌরবভ্রাতাদের হাতে কুরু-কুললক্ষ্মীর সম্মান লুন্ঠিত। মাতা ঘোর অমঙ্গল নিশ্চিত। কৌরব বংশের ধ্বংস অনিবার্য।


      ঠিক সেই সময় চারিদিকে নানা কুলক্ষণ দেখা দিল। গান্ধারী ভীত হয়ে পড়লেন। এমন সময় বিদুর গান্ধারীর কাছে ছুটে আসেন। দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করতে গিয়ে দুঃসাশন ব্যর্থতার কথা জানান। ভীমসেন ও দ্রৌপদী কি কি ভীষণ প্রতিজ্ঞা করেছেন তা নিবেদন করেন। তিনি গান্ধারীকে বলেন – এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের ও দ্রৌপদীকে তুষ্ট না করলে কৌরব বংশের বিনাশ অনিবার্য।


সব শুনে বিচলিত গান্ধারী বিদুরকে আজ্ঞা করেন— মহামন্ত্রী , আপনি মহারাজকে গিয়ে আমার বিনীত নিবেদন জানান। পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে তাদের ইন্দ্রপ্রস্থে সসম্মানে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা যেন গ্রহণ করেন।


      বিকর্ণ মাতাকে নতজানু হয়ে প্রণাম করে। কিছুপরেই উদ্বিগ্ন বিদুর ফিরে আসেন। চিন্তিত বিদুরের দিকে তাকান গান্ধারী।


      বিদুর বলেন – মহারানি, পাণ্ডবদের সমস্ত কিছু ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মহারাজ। তাঁরাও হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিয়েছেন। পুনরায় অনর্থ ঘটেছে। মন্ত্রণাদাতা শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বুঝিয়েছে যে সুযোগের অপব্যবহার করা উচিত নয়। পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় আমন্ত্রণ জানাতে। দুর্যোধন পিতাকে সেই অনুরোধ জানায়। পুত্রস্নেহে অন্ধ মহারাজ পিতামহ ভীষ্ম, অস্ত্রগুরু দ্রোণ, কৃপাচার্য প্রভৃতির পরামর্শ অগ্রাহ্য করে, পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনতে প্রতিহারী পাঠিয়েছেন।


      গান্ধারী হাতে হাত ঘষতে ঘষতে পায়চারি করতে লাগলেন। বিকর্ণ মাতার অনুমতি নিয়ে রথ নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পাণ্ডবদের গতি রোধ করে পুনরায় পাশা না খেলে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বিকর্ণ জানান এটাই মাতা গান্ধারীরও আদেশ। পাণ্ডবভ্রাতারা রাজি হলেও রাজি হলেন না যুধিষ্ঠির — আবার যদি পাশা খেলতে হয়, তাই খেলব। জানি, এতে বংশনাশ হবে। কিন্তু ভ্রাতা, মাতা গান্ধারীকে জানিও, বৃদ্ধ জ্যেষ্ঠতাত ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ উলঙ্ঘন করে অধর্ম করতে পারি না। মাতা যেন আমাকে ক্ষমা করেন।


 মহাবীর ভ্রাতাদের ও লক্ষ্মীস্বরূপা পত্নী দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠীর চলেছেন। হতাশ বিকর্ণ দাঁড়িয়ে শুনছেন কুরুবংশের ধ্বংসের পদধ্বনি। চোখ দিয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ে তাঁর।


 


 


মন্ত্রণাকক্ষ


     


কুরক্ষেত্র মহাযুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনের যুদ্ধের শেষ। অভিমন্যু নিহত। পাণ্ডব শিবির শোকে মুহ্যমান। কৌরব শিবিরে উল্লাস। কর্ণ, শকুনি, জয়দ্রথ, দ্রোণ ও দুর্যোধন বসেছেন গোপন শলাপরামর্শে। চতুর্দশ দিনে শোকাকুল পাণ্ডবদের পরাভূত করার ব্যূহ রচনার কৌশল নিয়ে আলোচনা চলছে। গুপ্তচর নীলভদ্র মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করে। নীলভদ্রকে দেখে দুর্যোধন বলেন – কী খবর নীলভদ্র? পাণ্ডবরা কী সন্ধির প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে?


      মাথা নিচু করে নীলভদ্র – না যুবরাজ, শোক কাটিয়ে পাণ্ডবেরা ক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছেন। অভিমন্যুর হত্যার জন্য সৌবীরাজ জয়দ্রথকেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন প্রতিজ্ঞা করেছেন, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে মহাবীর জয়দ্রথকে হত্যা করবেন। ব্যর্থ হলে তিনি অগ্নিতে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জন দেবেন।


      মন্ত্রণা কক্ষে নীরবতা নেমে আসে। সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। জয়দ্রথের ভীত কন্ঠস্বর – কুন্তীর গর্ভে কামুক ইন্দ্রের ঔরষে জন্ম অর্জুনের। অর্জুন আমাকে যমালয়ে পাঠাতে চায়! তোমাদের মঙ্গল হোক। আমি ফিরে যাচ্ছি নিজ রাজ্যে। সেখানেই আত্মগোপন করব। যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলে আমাকে অর্জুন বধ করতে পারবে না। তাছাড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা কাউকে হত্যা করার অধর্ম পান্ডবেরা করবে না। যুবরাজ ও সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণের কাছে আমার আবেদন আপনারা আমাকে অনুমতি দিন। আমি নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে চাই।”


      দুর্যোধন বলেন — তুমি ক্ষত্রিয় নরব্যাঘ্র। ভয় পেয়ে ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে চাও?”


      না ভ্রাতাশ্রী, আমি কোন হটকারিতা করতে রাজি নই। কৃষ্ণসখা অর্জুন। কৃষ্ণের সহায়তায় ছলে বলে কৌশলে আমাকে হত্যা করবেই। তোমরা অনুমতি দাও। আমি আত্মগোপন করি।


      তুমি আমাদের একমাত্র ভগ্নীর স্বামী। ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ঠ বীরগণের মাঝে তুমি থাকবে। কে তোমাকে আক্রমণ করবে? আমরা সসৈন্যে তোমাকে রক্ষা করব। আমি স্বয়ং রথীশ্রেষ্ঠ মহাবীর, তবুও তুমি পাণ্ডবদের ভয় করছো?


      শকুনি পুলকিত হন – এত আনন্দের সংবাদ। আমাদের যুদ্ধ জয় নিশ্চিত। কাল আমরা সর্বশক্তি দিয়ে জামাতা জয়দ্রথকে রক্ষা করব সূর্যাস্ত পর্যন্ত। ব্যস তারপরই অর্জুন প্রাণ বিসর্জন দেবে। তোমাদের ভগবান শ্রীকৃষ্ণও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অর্জুনহীন পাণ্ডবেরা এক লহমায় পরাজিত হবে বা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।”


      উরুতে হাত চাপড়ে অট্টহাসি হাসেন দুর্যোধন — মামাশ্রী আপনি ঠিক বলেছেন। সেনাপতি মহাগুরু দ্রোণাচার্য আপনার অভিমত কী?”


দ্রোণ বলেন – আমি তোমাদের সমভাবেই শিক্ষা দিয়েছি। যোগাভ্যাসে ও কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অর্জুন আধিকতর শক্তিশালী। তবুও আমি কথা দিচ্ছি আমি জয়দ্রথকে রক্ষা করবই। আমার সৃষ্ট অনেক ব্যূহ ভেদ করার কৌশল এখনও অর্জুন জানে না। আমি চক্রশকট ব্যূহ রচনা করব। ব্যূহের মুখ থেকে দুই ক্রোশ দূর পশ্চাতে পদ্মনাভ নামের এক গর্ভব্যূহ রচনা করা হবে। পদ্মনাভের মধ্যে থাকবে এক সূচিব্যূহ। যার মধ্যে জয়দ্রথ অবস্থান করবেন। পদ্মনাভের মুখে পাণ্ডবদের আক্রমণ প্রতিহত করবেন কর্ণ, শল্য, বৃষসেন ও কৃপাচার্য। দুঃশাসনসহ অন্য কৌরবভ্রাতারা সূচিব্যূহের মুখে থেকে সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করবেন। আমি নিজে শকটব্যূহের মুখে থাকব। অর্জুন এই ব্যূহ কিছুতেই ভেদ করতে পারবে না।


      দুর্যোধন বলেন — সৌবীরাজ তুমি এবার তো নিশ্চিন্ত? সেনাপতি দ্রোণাচার্যের কৌশলে তুমি নিরাপদ।


     


  দ্রোণের চিন্তিত কন্ঠস্বর – আমার ভয় শুধু একজনকেই। তিনি হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। একদিনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেবের বরে জয়দ্রথ অর্জুন ভিন্ন অন্য পাণ্ডবদের জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জয়দ্রথের এখন সে ক্ষমতা নেই। মায়াসুর প্রদত্ত বৃগোধন গদাধারী ভীমের কাছে সমস্ত ব্যূহ প্রাচীর নিমেষে ধ্বংস হয়ে যাবে। সমস্ত মহারথেরা অর্জুনকে রুখতে ব্যস্ত থাকলে ভীমসেনকে প্রতিহত করবেন কে?”


      কর্ণ বলেন – আছেন একজন মহারথ। তিনি ভীমের ন্যায় গদা যুদ্ধে সমান পারদর্শী। তিনি তৃতীয় কৌরব, মহারথ বিকর্ণ। তিনি পারবেন ভীমকে সহজে প্রতিহত করতে।


      হেসে ওঠেন দুর্যোধন – তুমি হাসালে সখা। বিকর্ণ প্রতিহত করবে ভীমসেনকে! যে কিনা চিরকাল পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট। ভীমের কাছেই গদা যুদ্ধের কৌশলের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছে। মাতা গান্ধারীর নির্দেশে বিকর্ণ কৌরব পক্ষে অস্ত্র ধারণ করেছে। বিকর্ণ করবে দ্বিতীয় পাণ্ডবকে প্রতিহত!


      কর্ণ বলেন – একথা ঠিক। এই ত্রয়োদশ দিন যুদ্ধ হয়েছে। দুই যোদ্ধা পরস্পরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। মনে করে দেখুন, পঞ্চম দিনে ভয়ঙ্কর ভীমকে বাণে বিধ্বস্ত করে বিকর্ণ আপনার পাঁচ ভ্রাতাকে রক্ষা করেছিলেন। দশম দিনে পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন ও শিখণ্ডীর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করছিলেন। কৃষ্ণের নির্দেশে দ্রুপদ বিকর্ণকে আক্রমণ করে অন্য দিকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তাই আমরা পিতামহকে হারিয়েছি। সেদিন বিকর্ণের হাতে পাণ্ডব পক্ষের এক অক্ষৌহিনী সেনাসহ বহু বীরের পতন হয়েছিল। মাতা গান্ধারীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিকর্ণ আপনার আদেশ অমান্য করতে পারবে না।     


শকুনি বলেন – ভাগ্নে তোমার ভ্রাতাদের মধ্যে একমাত্র বিকর্ণকেই ভীমসেন বেশি স্নেহ করেন। তিনি ভীমের কাছে গদা যুদ্ধের কৌশল শিখেছিলেন। গুরু শিষ্যের পরস্পরের দুর্বলতার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করবেন না ঠিক। সেটাই আমাদের লাভ। বিকর্ণ ভীমকে অন্যত্র সরিয়ে রাখলে অর্জুন একা ব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হবে না। কী মহাগুরু দ্রোণাচার্য আমি কী ভুল বললাম?


       দ্রোণ বললেন – আমরা বিকর্ণের উপর আস্থা রাখতে পারি।


 


দুর্যোধনের আহ্বানে বিকর্ণ মন্ত্রণা কক্ষে আসেন। যথাযথ সম্মান জানিয়ে তাঁকে বসতে দেওয়া হয়। বিকর্ণ জানতে চান তাঁকে কেন তলব করা হয়েছে। দুর্যোধন যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলেন – বীরশ্রেষ্ঠ মহারথ বিকর্ণ আমরা কালকের যুদ্ধে তোমার শক্তির উপর নির্ভরশীল । কালকের যুদ্ধে তুমি আমাদের সবার প্রিয় একমাত্র ভগ্নী দুঃশলাকে চরম দুঃখের হাত থেকে বাঁচাতে পার। আমরা সবাই সৌবীরাজ জয়দ্রথকে রক্ষা করব। কিন্তু তোমাকে কালকের যুদ্ধে ভীমসেনকে প্রতিহত করার দায়িত্ব দিতে চাই। তোমার রণকৌশল আমাদের কাঙ্ক্ষিত জয় এনে দিতে পারে। তোমার মতামত জানতে চাই।


বিকর্ণ একবার সভা কক্ষের সকলকে দেখলেন। কোনদিন তাঁকে কোন মন্ত্রণা সভায় ডাকা হয়নি। প্রতিহারি মারফত তাঁকে যুদ্ধের ভূমিকা জানান হত। এতক্ষণে তাঁকে ডাকার কারণ অনুধাবন করতে পারলেন। মুখে তাঁর তাচ্ছিল্যের হাসি – অগ্রজ, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করার জন্য আমি প্রতিজ্ঞা বদ্ধ। তবু আপনি আমার মত যখন জানতে চেয়েছেন, অনুরোধ করব জ্ঞাতিবিদ্বেষী এই অধর্ম যুদ্ধ আপনি বন্ধ করুন। এতে কৌরব-পাণ্ডব বংশের লাভ হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব পক্ষে। তিনি ধর্মের পক্ষে। তাঁর স্মরণ নিলে কৌরব বংশ বিনাশের হাত থেকে রক্ষা পাবে।


অট্টহাসি হেসে ওঠেন কর্ণ – তৃতীয় কৌরব কোনটিকে তুমি অধর্ম বলছ? নিজ বিজিত রাজ্য রক্ষা করাই ক্ষত্রধর্ম। পাণ্ডবেরা পাশা খেলায় হেরে গিয়ে রাজত্ব হারিয়েছিল। এখন তারা রাজ্যের দাবী করছে? ওরাই তো হানাদার। মহারাজ দুর্যোধন জয় করা রাজত্ব রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন। একে তুমি অধর্ম বলতে চাও?


বিদ্রুপের হাসি হাসেন বিকর্ণ – কপট পাশা খেলা, ভরা রাজসভায় কুলবধূকে বস্ত্রহরণের চেষ্টা অধর্ম নয়! শর্ত ছিল বনবাস ও অজ্ঞাতবাস সঠিক পালন করে ফিরে এলে পাণ্ডবদের রাজত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে। শর্ত লঙ্ঘন করা কী অধর্ম নয়?


শকুনি বলেন – প্রিয় ভাগিনেয়, বলবন, সুশাসক ও যে কোন যোদ্ধার থেকে ক্ষমতাবান তোমার পিতাকে কেবলমাত্র অন্ধত্বের কারণে সিংহাসন চ্যূত করা হয়েছিল, আমার ভগ্নী তোমাদের মাতা গান্ধারী কুন্তীর আগে গর্ভবতী হয়েও দৈব চক্রান্তে কুন্তীর আগে সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি। শুধু তাই নয় পিতামহ ভীষ্মকে অর্জুন কোন ধর্ম পালন করে পরাজিত করেছিলেন?


তাই কী আপনারা সপ্তরথী ঘিরে নিরস্ত্র অভিমন্যুকে বধ করেছিলেন?


কর্ণ বলে ওঠেন – তুমি ক্লীবের মত কথা বলছ তৃতীয় কৌরব। কোন যুক্তিতে কপট পাশা খেলা বলছো? সেদিন দক্ষ দ্যূতক্রীড়ক মামা শকুনির হাতে পরাজিত হয়েছিল অদক্ষ দ্যূতক্রীড়াপ্রিয় যুধিষ্ঠির। তুমি পাণ্ডব প্রীতিতে অন্ধ, তাই তুমি তেমনভাবে পাণ্ডবদেরকে আক্রমণ করনি। ভীমকে এড়িয়ে গেছ। ইতিমধ্যে তোমার বারজন ভ্রাতা ভীমের হাতে নিহত হয়েছে। ভ্রাতৃঘাতককে হত্যা করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ভীমসেনকে আক্রমণ করছো না, এটা কোন ক্ষত্রধর্মের নিদর্শন?


দুর্যোধন বলেন – বৃথা তর্ক করে কালক্ষেপের কারণ দেখছি না। এক রাজা তার সমকক্ষ শত্রুকে পরাজিত করার কৌশল করবে, এটাই রাজধর্ম। আমি তাই করে চলেছি। এখন তোমার ধর্ম তুমি রাজাদেশ মান্য করবে কিনা জানাও।


সভাকক্ষ নিস্তব্ধ। সকলের দৃষ্টি বিকর্ণের উপর। উঠে দাঁড়ান বিকর্ণ। দুর্যোধনের চোখে চোখ রেখেন – রাজাদেশ পালন করা ক্ষত্রধর্ম। ধর্ম ও অধর্ম এক সুক্ষ্ম ভেদের উপর দাঁড়িয়ে। তাই আমিও তর্ক করতে চাই না। শুধু আমার উপলব্ধি আপনাকে জানিয়েছি। যুদ্ধের পূর্বে মাতার কাছে আমরা সকল ভাই শপথ করেছিলাম, আপনার আদেশ বিনা তর্কে পালন করব। তাই মাতার নামে প্রতিজ্ঞা করছি, কালকের রণের শেষে আমার ও ভীমসেনের মধ্যে একজন জীবিত থাকবেন। দ্বিতীয় পাণ্ডবকে হত্যা না করে জীবিত অবস্থা শিবিরে ফিরব না।”


 সবাইকে অভিবাদন করে বীরদর্পে বিকর্ণ সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মন্ত্রণা কক্ষের সকলে বিকর্ণের প্রতিজ্ঞা শুনে উল্লসিত হয়ে পড়েন।


 


গান্ধারী সমীপে


রাজমাতা গান্ধারী একা অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন। বিকর্ণ কক্ষে প্রবেশ করে মাতার পদস্পর্শ করে প্রণাম করেন। গান্ধারী তাঁকে দুহাতে তুলে আলিঙ্গন বিকর্ণকে পাশে বসালেন – পুত্র তুমি কী কোন ব্যপারে চিন্তিত? কোন অশুভ সংবাদ আছে?


না মাতা, শেষবারের মত আপনার চরণ স্পর্শ করে বিদায় নিতে এলাম।


অজানা আশঙ্কায় চমকে ওঠেন গান্ধারী – কেন পুত্র, এমন আশঙ্কা করছো কেন?


যুবরাজের আদেশে কাল আমাকে দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেনকে প্রতিহত করতে হবে। এ যাবত বারজন কৌরব ভ্রাতা তাঁর হাতে নিহত হয়েছেন। তিনি তো শত কৌরব বধের প্রতিজ্ঞা করেছেন। তাঁর ক্ষমতার কথা আপনার জানা। তাই কালকের মহারণের ফলাফল নিয়ে কোন চিন্তার অবকাশ আছে কী মাতা?


পুত্র তুমি একজন মহারথ। আমার কথা নয়। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম কর্ণকে অধিরথ বলেছিলেন। কিন্তু তোমায় মহারথ বলেছিলেন, তুমি ক্ষত্রিয়, মহান কুরুবংশের রাজপুত্র। তোমার মুখে হতাশা মানায় না। তুমি কী ভীত পুত্র?


আমি মহারাজ শান্তনু ও মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বংশধর। আমি ভীত নই মাতা। শেষবারের মতো আপনাকে অনুরোধ জানাতে এসেছি, অগ্রজ দুর্যোধনকে সংযত করুন। তাঁকে অধর্মের পথ থেকে সরে আসতে বলুন।


পুত্র ধনুক থেকে তীর নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাকে কী তূণে ফিরিয়ে আনা যায়? আমার গর্ব ছিল আমি শতপুত্রের জননী। আমি পুত্র স্নেহে অন্ধ ছিলাম।কুন্তীকে হিংসে করতাম। পাণ্ডবদের শক্তিকে হেয় করেছি। ভাবতাম, আমার শতপুত্র মাত্র পঞ্চপাণ্ডবকে পরাজিত করবেই। মহারাজকে যেমন বোঝাতে পারিনি তেমনি দুর্যোধনকে নিবৃত্ত করার কোন চেষ্টা করিনি।


পাণ্ডবদের বারাণবতে পাঠানোর উদ্দেশ্য আপনাকে জানিয়েছিলাম। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে সতী দ্রৌপদীরর হেনস্থা রুখতে না পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছিলাম। আপনি চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। মাতা, শ্রীকৃষ্ণ সহায় পাণ্ডবরা অপরাজেয়। মাতা, ধর্মের পথে সকলকে ফিরাতে বাধ্য করুন।


তুমি তো ন্যায় ও ধর্মের পথে রয়েছো। তোমার তো ভয় পাওয়ার কথা নয়।


ম্লান হাসেন বিকর্ণ – ন্যায়ের পথে আছি। অন্যায় বা অধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছি। আবার অধর্মের পক্ষে যুদ্ধ করছি। তাই জয় সম্ভব নয়।


গান্ধারীর দৃঢ় কন্ঠস্বর – সম্ভব পুত্র। আঠারো বার জরাসন্ধ শ্রীকৃষ্ণকে পরাজিত করেছিলেন। ভীষ্ম তো চিরকাল ন্যায় বা ধর্মের পথে ছিলেন। তাঁদের দুজনকেই অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করা হয়েছে। তোমাকেও অন্যায় যুদ্ধে যাতে পরাজিত করতে পারে কৃষ্ণ ও তার সহায় পাণ্ডবরা। শুধু এই ভয় করছি। নয়ত তুমি বিজয়ী হবেই।


সে ভয় করি না। ভীমসেন কোন অধর্ম করবেন না। রণক্ষেত্রে ভীম-অর্জুন ছাড়া আমায় পরাজিত করার ক্ষমতাধারী কেউ নেই। নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না। চিন্তা কৌরব বংশের বিনাশ নিয়ে। চিন্তা যুদ্ধ শেষে স্বজনহারা পৃথিবীতে আপনার ও পিতার জীবনের দুর্দশাকে নিয়ে।


বিকর্ণের মাথায় সস্নেহে হাত রাখেন গান্ধারী – যাও পুত্র ক্ষত্রধর্ম পালন কর। আশীর্বাদ করি কালকের রণে তোমার বীরগাথা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।


বিকর্ণ মায়ের পদধূলি নিয়ে বীরদর্পে কক্ষ ত্যাগ করেন।


 


যুদ্ধক্ষেত্র


 


শকট ব্যূহ রচনা করে এগিয়ে চলেছে কৌরব সেনা। ব্যূহ মুখে রয়েছেন স্বয়ং দ্রোণাচার্য। পাণ্ডব সেনাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে চলেছেন অর্জুন। ব্যূহ মুখে দুই মহারথের সাক্ষাত হয়। গুরু-শিষ্যের তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। বৃথা কালক্ষেপ হচ্ছে দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে পরামর্শ দেন— সখা, ব্যূহের দক্ষিণ পার্শ্বে গজ সৈন্য নিয়ে কৌরব ভ্রাতা দুর্মর্ষন রয়েছেন। আমরা ঐ দিক দিয়ে ব্যূহ আক্রমণ করলে দ্রুত সফল হব।


তাঁরা দুর্মর্ষনকে পরাজিত করে এগোতে গেলে দুঃশাসনের মুখোমুখি হন। কিন্তু সহজে দুঃশাসন পরাজিত ও আহত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন। মহাদেবকে তুষ্ট করে দুর্যোধন পেয়েছিলেন কাঞ্চনময় কবজ। এই কবজ ধারন করলে তিনি একদিনের জন্য একজন পাণ্ডবকে সহজে প্রতিহত করতে পারবেন। তাই দুর্যোধন কবজ ধারণ করে অর্জুনকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেন। দুজনের প্রবল যুদ্ধ চলতে থাকে। কৃষ্ণ কবজের গুণ বুঝতে পেরে, অর্জুনকে সহায়তা করার জন্য ভীমকে আহ্বান করেন। অর্জুন ও ভীম একযোগে যুদ্ধ করে ব্যূহ ভেদ করে এগোতে চেষ্টা করেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে কৌরব ভ্রাতা বিন্দ, অনুবিন্দ,সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হন। ভীম ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে অর্জুনের সাথে এগোতে লাগলেন। কর্ণ উপলব্ধি করেন দুজনকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। না করলে সহজে অর্জুন জয়দ্রথের সম্মুখীন হয়ে যাবেন। তাই তিনি অর্জুনকে আক্রমণ করেন। তাঁর নির্দেশে বিকর্ণ ভীমকে আক্রমণ করেন। বিকর্ণ ভীমের মুখোমুখি হয়ে প্রবল শর নিক্ষেপ করে তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। ভীম চিৎকার করেন – প্রিয় বিকর্ণ ! আমার সম্মুখ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে আঘাত করতে চাই না। তুমি ধার্মিক, তুমি চিরকাল তোমার অধার্মিক অগ্রজকে ধিক্কার দিয়েছো। দ্যূতক্রীড়া কক্ষে একমাত্র তুমি আমাদের সমর্থন করেছিলে। সেই তুমি ধর্মের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে পাপাত্মা দুর্যোধনের হাত শক্ত করছো?


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, আমি ধর্ম অধর্ম বুঝি না। সেদিন যা করেছিলাম আমার কর্তব্য ভেবে করেছিলাম। আজ়ও কৌরব পক্ষে অস্ত্রধারণ করে আমার কর্তব্য পালন করছি।


নীতিহীনতার পক্ষে অস্ত্র ধারণ করা তোমার কর্তব্য!


হাসেন বিকর্ণ – আপনিও তো সব বিষয়ে আপনার অগ্রজের সাথে সহমত ছিলেন না। তবুও আপনি তাঁর বিরুদ্ধাচারণ করেননি। কারণ সেটাই আপনার কর্তব্য ছিল, তাই না?


বিকর্ণ আমি তোমায় মিনতি করছি তুমি আমার পথ থেকে সরে যাও। আমি তোমাকে বধ করতে চাই না।


হে দ্বিতীয় পাণ্ডব, ক্ষত্রিয় কখনও রণক্ষেত্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে না। আমাকে যদি এতই ভয়, তবে অস্ত্র ত্যাগ করে পরাজয় মেনে নেন। আজকের যুদ্ধে আমাদের একজন জীবিত থাকবে। হয় আমাকে পরাজিত করুন নয় নিজে পরাজয় বরণ করুন।


বলেই বিকর্ণ বাণ নিক্ষেপ করে ভীমের বাম হাতে আঘাত করেন। ভীমের রথ ভেঙে পড়ে ও অশ্বসকল নিহত হয়। ভীম গদা হাতে ‘তবে তাই হোক’ বলে বিকর্ণকে আক্রমণ করেন। দুই মহা যোদ্ধার ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হতে থাকে। একসময় ভীমের গদার আঘাতে বিকর্ণের গদা ছিটকে পড়ে। ভীম বিকর্ণের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। বিকর্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ভীমের হাত থেকে গদা খসে পড়ে। তিনি ছুটে চলে যান বিকর্ণের পাশে। কোলে তুলে নেন বিকর্ণের মাথা। পরম স্নেহে তাঁকে আদর করতে থাকেন। তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু।


বিকর্ণ চোখ খোলেন – ক্ষত্রিয়ের চোখে অশ্রু মানায় না অগ্রজ। এখন শোকের সময় নয়। এগিয়ে যান ভ্রাতা। মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন বিপদে। তাঁকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আপনি।


কাঁদতে কাঁদতে ভীম বলেন – হায় রে বিকর্ণ, তুমি ঠিক জানো ধর্ম কি। আনুগত্য ও মাতৃ-আজ্ঞায় বিবশ হয়ে আমরা লড়াই করছি। এই যুদ্ধ আমাদের জন্য অভিশাপ। যেখানে তোমার মত ধার্মিক এক পুরুষকে বধ করতে হল। হে আমার প্রিয় অনুজ আমাকে ক্ষমা করে দিও।


মৃদু হাসেন বিকর্ণ – হে আমার প্রিয় পুরুষ, এখন শোকের সময় নয়। আমরা মাতৃ আদেশে বিবশ। আমার কাজ শেষ। আপনি এগিয়ে যান। প্রিয় অনুজ অর্জুন বিপদগ্রস্থ। তাকে যে রক্ষা করতে হবে আপনাকে। মৃত্যুর পূর্বে আপনার স্নেহের স্পর্শ আমার সব কষ্ট লাঘব করেছে। আমার শেষ ইচ্ছে – আমার মৃত দেহের সৎকার যেন আপনার হাতে হয়।


ভীমের পদস্পর্শ করেই একট রুধির বমন করে মহাবীর ধার্মিক বিকর্ণ ঢলে পড়েন ভীমের কোলে। বুকফাটা আর্তনাদে চিৎকার করে ওঠেন ভীম। দুহাতে জড়িয়ে ধরেন বিকর্ণের দেহ।


সহসা পাঞ্চজন্যের আওয়াজ ও কৌরবদের সিংহনাদ শুনে ভীম বুঝতে পারেন অর্জুন বিপদগ্রস্থ। ধীরে ধীরে বিকর্ণের দেহ মাটিতে নামিয়ে ওঠে দাঁড়ান ভীমসেন। বাম হাতে চোখের অশ্রু মোছেন ও ডান হাতে গদা ধারণ করে এগিয়ে চলেন রণক্ষেত্রের দিকে। শেষবারের মত একবার ফিরে তাকান বিকর্ণের দেহের দিকে। দেখেন রণক্ষেত্রে পরম শান্তিতে শায়িত মহাবীর তৃতীয় কৌরব বিকর্ণ। ভীমসেনের বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে, কৌরবপক্ষের এক ধার্মিক, সত্যাশ্রয়ী পরম প্রিয় অনুজ ভ্রাতা তৃতীয় কৌরব – বিকর্ণের জন্য।


 



Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024

রাজ্যে নতুন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী নিয়োগ || WB ICDS Supervisor Recruitment 2024 || সুপারভাইজার ও হেলপার নতুন নিয়োগ