উপন্যাস - তান্ত্রিক পিসেমশাই ও আমরা দুজন || সুদীপ ঘোষাল || Tantrik Pisemosay oo Amra by Sudip Ghoshal || Fiction - Tantrik Pisemosay oo Amra Dujon Part -5


 


দাদু বললে, কি করে মাঠে এত জল  এল  আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। শরীরটা ছিল।সে সম্ভোগে ব্যস্ত।দেহের অণু পরমাণু  অংশ ভিজে।কিন্তু মন যে শুষ্ক।মনের শূণ্য অংশও অধিকারে নেই তার।সে ছুটেছে পদ্মবনে। সেখানে তার রূপ দর্শনে মোহিত তার মন। এদিকে শরীরলোভি সে খবর রাখে না। ভিজে ভিজে ভালোলাগা শেষে বিরক্তির বিশ্রাম।আর মনলোভি নাগর দখল করে নেয় প্রিয়ার মন। শরীরে তার আসক্তি নেই।ক্ষণিকের আনন্দ নয়, অসীম আনন্দের অনুসন্ধানী তার মন। 

মনোজকে চিনু একটা রাজার গল্প বলেছিল। চিনু বলেছিলো,

এক ছিলো রাজা।সে প্রজাদের রক্ত খেতো।তাদের পরিশ্রমের ফসলের সবটুকু হরণ করে নিত।প্রজারা বেঁচে থাকার জন্য পালিয়ে যেতে  শুরু করলো।শয়তান, রাজাকে অন্ধকার জগতে নিয়ে যেত।সে ঝগড়া কলহ নিয়েই ভালো থাকত।প্রজারা তার অন্ধকারের দাসত্ব স্বীকার না করলেই তাকে সুস্থভাবে বাঁচতে দিত না।আলোর পরশ সহ্য করার ক্ষমতা রাজার ছিলো না।অত্যাচারী,ভন্ড ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠলো। একদিন প্রজাদের প্রার্থনায়  এলো আলোর ফেরিওয়ালা।তার আলোতে আলোকিত প্রজারা তার কাছে ভালো পরামর্শ পেতো।মানুষকে শান্তিতে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতো সে।  একদিন আলোর ফেরিওয়ালাও বন্দি হলো রাজার কারাগারে,নিষ্ঠুর অন্ধকারের অন্তরালে। রাজার কর্মচারিরাও আলোর ফেরিওয়ালার প্রেম পরশে চেতনা ফিরে পেলো।তারা প্রতিজ্ঞা করলো,আমরা বাঁচার মত বাঁচবো।শয়তানকে বন্দি করবো।রাজা একা হয়ে পড়লো।কারণ আলোর পরশ পেয়ে সকলের মনের অন্ধকার দূর হয়েছে।তারা ভালো মন্দের পার্থক্য বুঝতে পেরেছে।সুস্থ জীবনের সন্ধান পেয়েছে।অবশেষে অত্যাচারী রাজা আলোর কাছে পরাজিত হলো।আলোর প্রাচুর্যে অন্ধকারের রাজার অন্তর আলোকিত হলো।

রাজা বুঝতে পারলেন,শান্তিতে বেঁচে থাকার  জন্য  পৃথিবীতে আলোর বিশেষ প্রয়োজন। সরল দে একজন সরল মানুষ। সে সস্তায় জীবন ধারণ করার জন্য ফুটপাতের সস্তা পোশাক ব্যবহার করেন। বাড়িতে এসে জামা পরতে গিয়ে দেখে সাইজে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার সস্তায় দর্জির দোকানে সেলাই করে ঠিক করে জামা। আবার জামা কাচাকাচি করার পরে ছোটো হয়ে যায়।  সরল সস্তায় খাবার খোঁজে। মুরগীর রোগ হলে সস্তায় কিনে খায়।   সস্তার শরীর সরলের, জোর কিন্তু বাড়ে। জমিতে ফসল ফলায়। খোলা আকাশের নিচে আনন্দে থাকে।    সস্তায় তার জীবন চলে বলে সকলে তাকে সস্তা সরল বলেই ডাকে। সরল এতে রাগ করে না। কারণ লোকে ঠিকই বলে। সস্তায় কোনো কিছু পেলে সে বাড়ি নিয়ে যায়। তারপর বকুনি খায়। সস্তায় একবার একটা প্যান্ট কিনে সে বাড়ি গিয়ে কাচার পরে দেখে সেটা আর পরণের উপযুক্ত নয়। তবু সে পরে। সে বলে, যতই হোক টাকা দিয়ে কেনা। একবার সরল রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে রইলো সস্তা মুরগীর মত রক্তাক্ত অবস্থায়। দামি কেউ নেই। তারা তাদের দামি জীবন নিয়েই ব্যস্ত। সস্তা জীবনের জন্য তাদের সময় নেই। 

কিন্তু সস্তা সরল রাস্তায় পড়ে থাকা  সস্তা রক্তাক্ত ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। চিনু নানারকম গল্প শোনাত। ভাল মানুষের, শিল্পী মানুষের। চিনু বলেছিল, ডাক্তারবাবু বললেন, রক্ত লাগবে। কিন্তু আমাদের স্টকে রক্ত নেই। সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ পরীক্ষায় সস্তা রক্তের সাথে সস্তা রক্ত মিলে গেলো। সরল তার সস্তা  রক্ত দিলো  । ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। সরল রাস্তায় নেমে আবার একটা সস্তা মূল্যে পাঁউরুটি কিনে   খেতে শুরু করলো। দুপাশের মূল্যবান জীবন প্রবাহ,  সরলকে দেখে হাসতে থাকলো পোকা লাগা দেঁতো হাসির মত নিয়মিত সুরে। 


চিনুর বোন সীমার ইচ্ছে ছিলো নদী হবে। কুলু কুলু বয়ে যাবে নিরন্তর। পাড় উপচে ভাসানো ঢেউ মনে রোমাঞ্চ জাগাবে। কিন্তু কিছু লোকের বদখেয়ালে আর অর্থের লালসায় সব ইতিহাস চাপা পড়ে যায়।মিতা তার বাল্যবন্ধু। সে বলে, চাপা ইতিহাস ফুঁড়ে বেরোয় বটগাছের রূপ নিয়ে। একদিন রোদ ছিলো, সবুজ গাছ ছিলো। কিছু কাঁটাঝোপ থাকা স্বাভাবিক। সেই বাধা পেরিয়ে অনেকটা পথ একা হেঁটেছে সীমা। সঙ্গে ছিলো অদম্য ইচ্ছে। আজ সত্তরের তরুণী সীমা সফল। ইতিহাস কথা বলে মৃদুস্বরে। বেশ    কিছু  প্রকাশিত গ্রন্থে তার সমস্ত ইচ্ছে, সাধনা নিঙড়ে দিয়েছে মন। আজ সকালেই সে পেয়ে গেলো জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার পাওয়ার সংবাদ। সত্য, সুন্দর । চিনুর বয়স হল পঁচাত্তর। কুষ্ঠিতে আছে চিনু উনআশি বয়সে মরে স্বর্গে যাবে। চিনু মনোজকে খুব ভালবাসত। সে তাকে দেখলেই পুরোনো দিনের গল্প শোনাত। চিনু বলত, ন্যারোগেজ লাইনের ট্রেন ধরে চলে গেলাম কুমোরপুর হাটতলা হল্ট। মনে করলাম, তাড়াতাড়ি চলে আসব, দুপুরের আগে। পরীক্ষা হয়ে গেছে। বাড়িতে শাসনের দড়িটা একটু ঢিলে হয়েছে। মা বলেছেন, খাওয়ার সময় যেন ডাকাডাকি করতে হয় না। আর সবসময় স্বাধীন এই কটা দিন। বন্ধুরা ডাকল ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য। আমাদের ফুল টিম খেলা দেখতে চলে এলাম কুমোরপুর হল্টে বিনা টিকিটে। ভাবলাম খাওয়ার সময়ের আগে বেলা দুটোর সময় হাজির হয়ে যাব মায়ের কাছে। কিন্তু সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেল।একটা টিম খেলতে আসে নি। এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে ভেবে আমরা কমিটির কাছে একশ টাকা দিয়ে আবেদন করলাম। কমিটি রাজি হল। আমরা মাঠে নামলাম ফুল টিম নিয়ে। পরপর অনেক টিমকে হারিয়ে আমরা ফাইনালে উঠলাম।  ফাইনাল খেলা শুরু হবে বিকেল তিনটের সময়। এখন দুটো বাজে। মায়ের মুখটা মনে পরছে। ভাতের থালা সাজিয়ে বসে আছেন নিজে না খেয়ে। যেতে পারলাম না বাড়ি। খিদে লেগেছে খুব । পাশের বাড়ির কাকিমা মাঠের ধারেই বাড়ি। কাকু, কাকিমা দুজনে এসে বললেন, তোমাদের খেলা দেখে ভাল লেগেছে আমাদের। আমরা তোমাদের সাপোর্টারস। এই নাও এক থালা পিঠে তোমরা খাও। আমরা ভালোবেসে বানিয়েছি। আহা খিদে পেটে  অই পিঠে একদম অমৃত। পেট ভরে খেলাম। আমার ভাই বাবু বলল, দাদা আজ বাবা চামড়া তুলবে পিটিয়ে। আমি বললাম, কি আর করা যাবে। অন্যায় করলে তো কেউ ছাড়বে না।তারপর ফাইনালে জিতে শিল্ড নিয়ে আমরা ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরলাম। আমাদের বিজয় নাচ দেখতে হাজির হল গ্রামের লোকজন। বাবাকেও ভিড়ে দেখলাম। লাঠি হাতে চিৎকার করছিলেন। শিল্ড দেখে চুপ করে গেলেন। মাকে ডেকে দিয়ে নিজে চলে গেলেন ছাদে।তারপর বাড়ি ঢুকলাম সন্ধ্যাবেলায়। মা তখনও উপোসি। একসঙ্গে খেলাম পিঠে আর খেজুর গুড়। মা পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের বাবা খুব খুশি। আমাকে ডেকে দিয়ে বললেন, যাও দেখ গিয়ে গ্রামের ছেলেরা খেলে শিল্ড এনেছে। গর্বের খবর গো।তারপর থেকে বাবা আমাদের আর কোনদিন গায়ে হাত দেন নি। চিনু ভাদু জেলের কথা বলত, মাটির মানুষের কথা, ভাদু জেলে মাছ ধরে। তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন। বাড়ির পাশেই কাঁদর। অনেকে বলেন ঈশানী নদী। ভাদু অত কিছু জানে না। কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার। একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য। ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয়। ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু। তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে ভ'রে মাছ বিক্রি   করত গ্রামে গ্রামে। ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে। এখন সে হাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস। খুব ফাঁকিবাজ। এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে। ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না। সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায়। সেখানে হরিনাম হয়। ভাদু হারমনিয়াম     বাজায়। বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে। এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে। পড়াশোনা তার ভাল লাগে না। কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায়। অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস। ভোলা বলে, এই সবুজ আমাকে বড় টানে। এই জল আমাকে শান্তি দেয়। চান করার সময় এক ডুবে সে কাঁদর পেরিয়ে যায়। অনিল ভোলার খুব ভাল বন্ধু। সে সবসময় ভোলার সঙ্গে থাকে, থাকতে ভালবাসে। ভোলা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করল। ভাদু বলল, আর স্কুলে যেয়ে লাভ নাই রে ভোলা। রোজগারের ধান্দা কর। ভোলা তাই চাইছিল। সে বলল,বাবা আমি জাল ফেলা শিখব। তার বাবা ভাদু বলল,তা শেখ। কিন্তু তুই তো ভালই জাল ফেলিস। আমি চাইছিলাম রামের সঙ্গে তু কেরালা যা। সোনার দোকানে কাজ শিখে লেগা। তারপর এখানে এসে একটা দোকান খুলবি। কত নাম হবে তখন তোর দেখবি। ভোলা বলল,না বাবা আমি কেরালা যাব না। বাবা ভাদু বলল,আমি সব ঠিক করে ফেলেছি। তু আর অনিল কাল কেরালা চলে যা। মেলা পয়সা হবে, নামডাক হবে। তা না হলে জলে পচে মরবি। বাবার ভয়ে তারা কেরালায় চলে এল। দোকানে কাজ করে, কাজ শেখে। তাদের দোকান বাজার, কেনাকাটা সব কাজ করতে হয় ভোলাকে। বাঁশি বাজাতে দেয় না। তার মনে পড়ে কাঁদরের ধারে গেলেই মনটা ঘাসের গন্ধে ভুরভুর করে উঠত। একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা তুলে দিত। বাঁশির সুরে কাঁদরের জল নেচে উঠত। ভোলার বাবা, মার কথা মনে পড়ত। কিছু ভাল লাগত না। তার বন্ধু অনিল কাজ করে অনেক দূরে আর একটা দোকানে। সন্ধ্যা হলে দুজনের কথা হত। অনিল বলত, ভাল করে থাক। অনেক পয়সা নিয়ে বাড়ি যাব। কত খাতির হবে, দেখবি, অনিলের বাবা, মা নেই। সে ছোট থেকে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে। তাই তার পিছুটান কম। সে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে। কিন্তু ভোলার কিচ্ছু ভাল লাগে না। প্রায় দুমাস পরে সে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হল। মালিক বেগতিক বুঝে অনিলকে সঙ্গে করে ভোলাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়িতে এসে ভোলা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। অনিল মামার বাড়ি গেল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে। ভোলা কিছুই আনতে পারে নি। সে রোগে ভুগে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে। মা তার বাবার ওপর রেগে গিয়ে বললেন, আবার যদি তুমি ওকে কেরালা পাঠাও তো আমার দিব্যি রইল। বাবা ভাদু আর ভোলাকে কেরালা যেতে বলেনি। শুধু বলেছিল, এখানে ও খাবে কি?  আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না। তার মা বলেছিল, আমাদের একমুঠো জুটলে ওরও জুটবে। তারপর অনিল আবার কেরালা চলে গেল। ভোলা দুমাস বিছানায় পড়ে রইল। তারপর মায়ের সেবাযত্নে সে সুস্থ হয়ে উঠল। তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল। ভাদু জেলে মরে গেল। তার হরিনামের দল তাকে উদ্ধারণপুর নিয়ে গেল ট্রাকটরে চাপিয়ে। ভোলা সেই হরিনামের দলে ভাল বাঁশি বাজিয়েছিল। সবাই বলল, সন্দেবেলায় পেত্যেকদিন হরিনামের আসরে যাবি। বাঁশি বাজাবি। আজ অনিল এসেছে পাঁচবছর পরে। গ্রামের মোহিনী ঠাকরুণ বলল, মামার একটু জায়গা নিয়ে গ্রামে সোনারূপোর দোকান কর। আমরা তোর খদ্দের হব। অনিল এইরকম    কিছু একটা করার কথা ভাবছিল। মামাকে বলে একটা ঘর করল রাস্তার ধারে। তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকানের শুভ উদ্বোধন হল। খুব ধূমধাম করে দোকান শুরু হল। এদিকে ভোলা কাঁদরে জাল ফেলে মাছ ধরছে ডোঙায় চেপে। পাশ দিয়ে কাঠগোলার বড়বাবু যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ও জেলে ভাই মাছ পেলে?  ভোলা মাথাটা উঁচু করে বলল, পেয়েছি বাবু একটা কাতলা। তা কেজি খানেক হবে। বড়বাবু একটা দুশ টাকার নোট বার করে মাছটা নিলেন। তারপর চলে গেলেন। ভোলা টাকাটা কোঁচরে গুঁজে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল। সুরে সুরে আকাশ ভরে গেল



।১০


চন্ডীদাসের মত ছিপ ফেলে বিপিন মাছ ধরা দেখছে ফাতনার কথা ভুলে। বাউরি বৌ গুগুলি আর  ঝিনুক ধরছ জলের তলা থেকে। তার সুডৌল স্তন ঝুঁকে পরেছে জল ছুঁয়ে। জল কখনও সখনও রসে ডুবিয়ে দিচ্ছে যুবতী হৃদয়। বিপিন দেখছে ভিজে নিতম্ব ফুটে উঠেছে  খাজুরাহের ছবির মত। বিপিন ভাবছে ঝিনুক, গুগুলির জীবন বাউরি বৌকে স্বামী সোহাগী করে তুলেছে কোমল দেহসৌষ্ঠবের মাধ্যমে। পুকুরের পাড়ে গাছ গাছালির স্নেহচ্ছায়া। এই দুপুর হয়ে উঠেছে বসন্তমায়া। কোন এক অদৃশ্য মায়ায় বৌ মাঝে মাঝে তাকায় বিপিনের দিকে। কেউ কোথাও নেই। দুপুরের অবসর বাউরি বৌ ধরে শামুক, ঝিনুক। অলস স্বামীর খপ্পরে পরে জীবনে তার লড়াই প্রকট হয়ে উঠেছে। বিপিন বেকার যুবক। তাই ছিপ নিয়ে বসে এই সময়ে বাউরিবৌকে দেখার লোভে। সুন্দরী বাউরি বৌ ভোলে না এই বসন্তসময়। কি বর্ষা, কি শীত বা গ্রীষ্ম দুজনের বসন্তসময় কেড়ে নিতে পারে না। আজ বিপিন জলে নেমেছে। বাউরিবৌ কাপড় ঝেড়ে জলে ধুয়ে নিচ্ছে। দুজনেই ডুবে আছে আকন্ঠ শীতল জলিয় আবরণে। জলের নিচে চলে জলকেলি। একটা পানকৌড়ি ডুবে ডুবে   মাছ ধরার কৌশল দেখায় দুজন প্রেমিক প্রেমিকাকে। ছিপ ডাঙায় তুলে দেখল বিপিন একটা বড় রুই ধরা পড়েছে বড়শিতে। বাউরিবৌ সোহাগী আঁচলে তুলে নেয় বিপিনের প্রেম।      যে ছেলেটা পূর্ণিমা পুকুরের জ্যোৎস্না ভিজে চাঁদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সে চাঁদ ছুঁতে পারেনি।সমস্ত যোগ্যতার ফানুস সে উড়িয়ে দিয়েছিলো ঘাসের শিশিরে,বাতসের খেলায়।হেলায় সে হয়েছিলো ফাঁকা মাঠের রাজা।আলপথের মাটির গন্ধে তার যোগ্য সম্মানের ঘ্রাণ নিতো প্রাণভরে।সমস্ত চাওয়া পাওয়ার বাইরে অনুভূতির জগতে তার আসা যাওয়া।বন্ধু বলতো,তোর ধনী হতে ইচ্ছে হয় না?ছেলেটিসে বলে, তার আপন জগতে সে শুধু রাজা নয়, সম্রাট।তাই সে অবহেলায় যাপন করতো সাধারণ জীবন।সে জানে তার মত ধনী কমই আছে।বাতাসের রেণু,আকাশের হৃদয় আর সবুজের হাতছানিতে সে ছুটে চলে যেতো।সেখানে গিয়ে সে কথা বলতো আপন মগ্নতায়।তার কথাগুলো হয়ে যেতো কবিতার পান্ডুলিপি..কাটোয়া থেকে ট্রেনে চেপে নবদ্বীপ যেতে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম। ইন্টারসিটি ধরে যাচ্ছিলাম।    একবার প্রয়োজনে বাথরুমে  ঢুকলাম। ঢুকেই চোখ দুটি স্থির হয়ে গেলো আমার। পা নাড়াতে পারছি না। দেখলাম একটা ছোটো ভূতের বড় মানুষের মত বড় বড় দাঁত। দাঁত কেলিয়ে হাঁসছে। ভয়ে বুকের লাবডুব  এত জোরে হচ্ছে যে নিজেই শুনতে পাচ্ছি।কোনোরকমে বাইরে এলাম। অন্যান্য যাত্রীদের বললাম। তিনজন বাথরুমে ঢুকলো।কিছু দেখতে না পেয়ে রেগে গিয়ে বললো,রাতে কি খেয়েছিলেন?  গ্যাস হয়েছে।যত পাগল, ছাগল নিয়ে কারবার।যান নিজের কাজে যান।  আমি আবার একবার ঢুকলাম ভিতরে। দেখলাম  ভূতটি সেইরকমই হাঁসছে। দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। রাগে বলে বসলাম,এত ভিতু কেন?পালিয়েছিলি কেন? ভূতটা সঙ্গে সঙ্গে আমার গালে এক চড় মেরে জানালার ফাঁক গলে লাফিয়ে পড়লো।ভূতের কি অপরিসীম ক্ষমতা।   পরে জেনেছি আমি অজ্ঞান হয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ফলে গন্তব্যে না গিয়ে হাওড়া চলে গেছিলাম । আমার ঘুম ভাঙলো হাওড়া স্টেশনে। বাথরুমে নোংরা পরিবেশে শুয়ে থাকতে দেখে অনেকে বাথরুমে ঢোকে নি। হয়ত লাশ মনে করেছে। একটা ঝাড়ুদার বললো,পাগল কাঁহিকা। নিকালো শালা। বাথরুমমে শোতা হ্যায় চুতিয়া। তখন থেকেই আমাকে ভুতে ধরেছিল তারপর এই লাইনে কাটা পড়লাম ভুতের জন্য। চিনু বলেছিল মধু বা স কন্ডাকটার। খড়ের চাল ফুটো। মাটির ঘর। মাটির মানুষ। তবু তার অবসর সময়ে সে পড়ে। তার আশা পড়াশোনা করে সে বড় হবে। কালো কালো অক্ষরগুলো তার চোখে আলো জ্বালে। সে চলে যায় অন্য এক জগতে। আশায় আশায় বাড়ে তার বয়স। বাড়ি থেকে বলে, এবার বিয়ে থা করে নে। ভালো আয় করিস। তোর আর চিন্তা কিসের?  মধু বলে, না বিয়ে করলেই সব শেষ। পড়াশোনা, আশা সব শেষ হয়ে যায় সংসারের জালে। সে জাল কেটে বের হওয়া কঠিন ব্যাপার। কোনোকালে কেউ পারে নি। মহাপুরুষ হলে আলাদা ব্যাপার।মধু ভাবে অবসর সময়ে, সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে  কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে  টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে  শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়।শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে  । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়।  মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়।   বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে।  কত বসন্ত এল গেল। মধুর এখনও শীতসময়। ঝরা পাতার সময়ে সে মগ্ন হত  সরব পাঠে। পাড়ার বন্ধুরা বলত, বুড়ো বয়সে পাঠশালায় পড়াশোনার ভিমরতি। এ ঘোড়া ঘুরে ঘাস খাবে না। মধুর মন খারাপ হত। বই গুটিয়ে বসে পড়ুত মাটির বারান্দায়। একটা পায়রা দেখত সে। একটা একটা করে কাঠি সংগ্রহ করে বাসা বুনত। প্রথমে কাঠিগুলো ঠোঁট থেকে পড়ে যেত। আবার সে চেষ্টা করত। এইভাবে পায়রাটি সফল হত তার কাজে। মধু ভাবত, সে মানুষ। প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ জীব। তাহলে, একটা পাখি যদি পারে সে পারবে না কেন?  সে শক্ত দড়িতে হৃদয় বেঁধে লেগে পড়ত কাজে। পড়াশুনা করত মনযোগ দিয়ে।সকাল হলেই বেড়িয়ে পড়ত কাজে। কাঁধে বাস কন্ডাকটারের ব্যাগ। বাসে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হত। কেউ কেউ অসম্মানও করত। ভাড়া না দিয়ে নেমে পড়ত। বলতে গেলে ভয় দেখাত। মধু মনে মনে পড়ার বিষয়গুলো মনে মনে আউড়াত। অনেকে বলত, ছেলেটা পাগল নাকি?  একমাত্র গাড়ির খালাসি জানত তার বিষয়টি। সে মধুর বন্ধু। সে বলত, তোর কাজের চাপ হলে আমাকে বলবি। আমি তোকে সাহায্য করব। বাসের ভিতরে বাসস্টপে সে পড়ত মাঝে মাঝে। মধু পড়াশোনা করে যখন, সে শুনতে পায় আলোর আগমনী সংগীত। আর কেউ শুনতে পায় না। আলোময় চোখে আশার আলো দেখতে দেখতেই সে বিভিন্ন পরীক্ষায় বসে। হয় না। বিফলতাগুলো তার আশার আলো নেভাতে পারে না। বিফল হতে হতে সেএকদিন আই এ এস পরীক্ষায় সফল হল। চারিদিকে ঢাকের কাঠি পড়তে লাগল। শুধু প্রশংসার বন্যা। কিন্তু মধুএ বন্যায় হারিয়ে যাওয়ার ছেলে নয়। বিফলতাগুলো তার মনের তার শক্ত করে বেঁধেছে। সহজে তা ছেঁড়া যাবে না।



                                     ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024