ছোট গল্প - এখনও সময় আছে || লেখক - সুমিত রায় || Short story - Ekhono Somoy Ache || Written by Sumit Roy

 



এখনও সময় আছে
সুমিত রায়



         কয়েকদিন ধরেই বিক্রম ক্লাসে উপস্থিত নেই।  অমিতাভ স্যারের নজরে এসেছে এটা।পড়াশোনায় ভালো যারা, তাদের উপর তিনি যেমন নজর রাখেন, তেমনি নজর রাখেন অন্যান্য ছেলেমেয়েদের উপরও। ক্লাসে অন্যান্য ছেলেদের দ্বারা বিক্রমের না আসার কারণ জানার চেষ্টা করেও, কোনো সদুত্তর পাননি-অমিতাভ স্যার।
       ছাত্রদের দ্বারা অনেক জমাটবাঁধা ইচ্ছা পূরণ করার কথা ভাবতে ভাবতে অমিতাভ স্যার বাড়ি ফিরছেন মাটির কাঁচা রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তা ব্যবহার করলে অনেকটাই তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছান অমিতাভ স্যার। মাটির রাস্তা বলে,সেই রাস্তা অনেকেই এড়িয়ে চলেন। লোকের চলাচল খুব একটা হয়না দেখে, রাস্তার ধারেই আড্ডা বসে এলাকার  নেশাগ্রস্ত ছেলেদের। অমিতাভ স্যারের সাইকেল কাদায় আটকে যায়। তিনি নেমে পড়েন। পাশে তাকাতেই, নজরে পড়ে কতগুলো ছেলের সাথে বিক্রম বসে আছে, খারাপ আড্ডায়। তিনি বিক্রমকে ডাকলেন। স্যারকে দেখে সে ভয়ে তটস্থ। অমিতাভ স্যার ছাত্রদের যেমন ভালবাসেন, তেমনি শাসনও করেন। এই কারণেই ভয়ে জড়োসড়ো বিক্রম স্যারের ডাকে কাছে আসতে চাইছে না। স্যারের  বারবার ডাকার ফলে একসময়  স্যারের সামনে এলো- বিক্রম। কাছে না আসার কারণ স্যার বুঝতে পারলেন- যখন সামনে এসে সে দাঁড়ালো। মুখ থেকে তখনো গাঁজার গন্ধ যায়নি। প্যান্টের পকেট উঁচু হয়ে আছে সিগারেটের প্যাকেটে। নেশায় টইটুম্বুর। চোখ লাল। ঠোঁট কালো হয়ে গেছে। বিক্রম দুষ্টু হলেও পড়াশোনায় খুব একটা খারাপ ছিল না। খারাপ সঙ্গ থেকে বিক্রমের আজ এই দশা। স্যার বললেন,-"তুমি স্কুলে আসো না কেন? কয়েকদিন পর তো তোমাদের ফাইনাল পরীক্ষা।"
        বিক্রম ক্লাস নাইনে পড়ে। ক্লাস ফাইভ থেকে অমিতাভ স্যার পড়িয়ে আসছেন তাকে। কাজেই তিনি বিক্রমের মেধা ভালোভাবেই জানেন।
        অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে বিক্রম। কোন জবাব দিচ্ছিল না। বারবার করতে থাকা স্যারের প্রশ্নে একসময় বলে উঠলো,-"বাবা পড়াশোনা করতে বারণ করেছে, বই খাতা সব পুড়িয়ে দিয়েছে!"
        কথাটা শুনে বিক্রমের বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হল স্যারের। তিনি বিক্রমকে আগামীকাল থেকে বিদ্যালয়ে আসতে বললেন, আর বললেন বাবা যেন স্যারের সাথে দেখা করে।
       স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়েছে। অমিতাভ স্যার তার পুরনো সাইকেলে চেপে স্কুল গেট পেরোতেই লক্ষ্য করলেন, এক ভদ্রলোক তার কাছে এগিয়ে আসছে। সাইকেল থামালেন। ভদ্রলোক বললেন,-"স্যার, আমি বিক্রমের বাবা, নিলয় দাস। আমাকে, আপনার সাথে দেখা করতে বলেছেন। আবার কী করেছে বিক্রম আপনার? কোন খারাপ আচরণ করেছে, নাকি কোন চুরি করেছে?"
কথাগুলো স্যারের কাছে একটু আশ্চর্য মনে হল।  -"চুরির কথা বলছে কেন?" স্বগতোক্তি করল স্যার।
নিলয় বাবুকে বললেন,-"আপনি এই  কথাগুলো বলছেন কেন? আমি আপনাকে ডেকেছি অন্য কারণে। বিক্রম বেশ কিছুদিন ধরে স্কুলে আসছে না, তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম- আপনি তাকে স্কুলে আসতে বারণ করেছেন। এর কারণ কী?
অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে থেকে, মাথা নিচু করে বললেন,-"স্যার, কি বলব আমার দুঃখের কথা। ছেলেটা আমার খারাপ সঙ্গ পেয়ে এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, সে বাড়ির অনেক জিনিস চুপ করে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে সেই টাকার নেশা করেছে। এমনকি এক প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে একটি মোবাইল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। সেদিন খুব অপমানিত হই আমি। পরবর্তীতে বুঝতে পারলাম, সে নেশায় আসক্ত হয়েছে। নেশার তাগিদে সে চুরি করা শুরু করেছে। একদিন খুব রাগারাগি করি। বিক্রমের মারও খুব কষ্ট, ছেলেটির এই অবস্থা দেখে। আমরা নিজেরাই ঠিক থাকতে পারিনি। ছেলেটি দেখলাম আমাদের হাতছাড়া হয়ে একেবারে বেলাইনে চলে গেছে। তাই একদিন রাগ করে নিজের বুকে পাথর চেপে  বলে ফেললাম,-"তোকে আর পড়াশোনা করতে হবে না, স্কুলে যেতে হবে না, তোর জীবন তুই বেছে নে।"
অমিতাভ স্যার শক্ত ভাবে বললেন,-"খুব অন্যায় করেছেন সেদিন। ' পড়াশোনা করতে হবে না,স্কুল যেতে হবে না।'- এই কথাগুলো খুব ভুল বলেছেন। আপনার এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এর ফল খুব খারাপ হতে বসেছে।"
      স্যার লক্ষ্য করলেন, ভদ্রলোকের চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মুখের কথা ভার হয়ে আসছে। তিনি নিলয় বাবুকে বললেন,-"দেখুন, এখনো সময় আছে আপনার ছেলেকে ঠিক করার। তার ভবিষ্যৎ এখনো অনেক বাকি। আপনি তার অতীত পরিবর্তন করতে পারবেন না, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ তো আপনার হাতেই রয়েছে। আপনি মনে করলে তার ভবিষ্যৎ  খুব ভালো বানাতে পারবেন। আপনি তাকে স্কুলে পাঠিয়ে দিন।"
       স্যারের কথাগুলি শুনে নিলয় বাবু সাইকেলে না চেপেই হেঁটে হেঁটে সামনের রাস্তার দিকে এগোচ্ছেন। ভেতরে নানান সম্ভাবনা উঁকি দিতে লাগল। অনিমেষ স্যার অনেকক্ষণ স্কুল গেটে দাঁড়িয়ে নিলয় বাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর নিজের সাইকেলের পেটেলে চাপ দিয়ে এগিয়ে চললেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। 
       বিকাল পাঁচটা। বাড়িতে এসে বিক্রমের বাবা নিলয় বাবু চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকলেন চেয়ারে। কিছুক্ষণ পর বললেন,-"বিক্রম বাড়িতে আসেনি?"
বিক্রমের খোঁজ করতে দেখে, স্ত্রী অনিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,-"কেন? আবার কোথাও কিছু কুকীর্তি করেছে নাকি ?"
       সব সময় বিক্রমকে নিয়ে বাবা-মা'র মধ্যে একটা ভয় কাজ করে চলত।
 "না না, সেরকম কিছু না। তবে জানো অনিমা-বিক্রম খুব খারাপ পথে চলে যাচ্ছে। তাকে সঠিক লাইনে আনতেই হবে। আজকে বিক্রম বাড়িতে এলে, আমি ঘুমিয়ে পড়লেও আমাকে ডেকে দিও, আমি তার সাথে কথা বলব।"
         বিকেল শেষে বিক্রম বাড়ি ফিরল। মা ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যাবাতি দিচ্ছে। বাবা তখনো চেয়ারে বসা। ছেলেকে দেখে বলে উঠলো,-"কোথায় গিয়েছিলি, বাবা? এত দেরি করে বাড়ি ফিরলি, দুপুরে কোথায় খেয়েছিস, বাবা?"
"তোমরা খেয়েছো তো.... আমার খাওয়ার কথা চিন্তা করতে হবে না।"-অন্যান্য দিনের মতোই কথাটা বলে ফেললো, বিক্রম।
"বিক্রম, তুই রাগ করছিস কেন? আমি তোর বাবা, আমি কখনোই তোর খারাপ চাইবো না। শোন বাবা- কাল থেকে তুই পড়াশোনা করবি, স্কুলে যাবি।"
কথাগুলো শুনে বিক্রম আকাশ থেকে পড়ল। "কি, আমি কাল থেকে স্কুলে যাব।"
"হ্যাঁ বাবা, তুই আগে কী করেছিস সব ভুলে যা। নতুন করে তুই জীবন শুরু কর- ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে।
"ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে"- শব্দদুটোতে বিক্রম থমকে যায়। অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা ভাবতে লাগলো। ''অমিতাভ স্যার স্কুলে যেতে বলছেন, আজকে বাবাও স্কুলে যেতে বলছে। সত্যি তো আমার একটা ভবিষ্যৎ আছে।''- স্বগতোক্তি করল বিক্রম।
       ছায়া  বদলে যাচ্ছে। আকাশে রংয়ের পরিবর্তন ঘটছে। বিক্রম বন্ধুদের ডাকে আজ সাড়া দিল না। তৈরি হল স্কুলের জন্য। মা বিক্রমের মধ্যে কয়েক মাস আগের বিক্রমকে দেখতে পেল। সে যেন বদলে যাচ্ছে। বইয়ের ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে স্কুলে রওনা হল বিক্রম।
       অমিতাভ স্যার বিক্রমকে ক্লাসে দেখলেন। কাছে গিয়ে বললেন,-"গত অনেকদিনের পড়া থেকে তুমি অনেকটাই পিছিয়ে গেছো বিক্রম। এখন তোমাকে একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। তুমি টিফিন পিরিয়ডে আমার সাথে দেখা করবে। আমি আগের হয়ে যাওয়াতে অধ্যায়গুলো বুঝিয়ে দেবো।"
        স্যারের  কথানুযায়ী বিক্রম, টিফিনের সময় বন্ধুদের সাথে না থেকে স্যারের কাছে চলে যেত। স্যার বুঝাতেন, একের পরে এক- আগের হয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলো। বিক্রমের মধ্যে স্যার ভালো রেজাল্ট করার প্রবণতা দেখতে পেলেন। বিক্রমকে বললেন,-"বিক্রম,তুমি তোমার অতীতকে পরিবর্তন করতে পারবে না,কিন্তু ভবিষ্যৎকে ভালো করার চাবিকাঠি তোমার হাতে রয়েছে। তাই তুমি জোর দিয়ে পড়াশোনা করো। এটাই তোমার উপযুক্ত সময়। আমি তোমার সাথে আছি।"
স্যারের এই কথাগুলোতে বিক্রম অনেক প্রেরনা পেল। অনেক ভরসাও পেল।বাড়িতে এসে বিক্রম পড়ার পেছনে অনেকটা সময় দিল। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলো বিক্রম। আগের দুঃস্বপ্নগুলো সে ভুলে যেতে লাগলো। বাবা-মা অবাক হলেন- বিক্রমের একাগ্রতায়। নবম শ্রেণিতে বিক্রম খুব ভালো রেজাল্ট করে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হল।
     আগামী বছর বিক্রম মাধ্যমিক দেবে। অমিতাভ স্যার এবং স্কুলের অন্যান্য স্যারের চেষ্টায় বিক্রম এগিয়ে চলছে-ভবিষ্যৎ-এর লক্ষ্যে। ইতিমধ্যে ক্লাসের ভালো ছেলেদের দলে, স্যারদের নজরের খাতায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে বিক্রম। মাধ্যমিকে যাতে ভালো ফল হয় সেই দিকে সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লক্ষ্য তার উপর। অমিতাভ স্যার, বিক্রমের মধ্যে দেখতে পেলেন মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার ক্ষমতা ক্রমশ বেড়েই চলছে।
        মাধ্যমিক পরীক্ষা। বিক্রম মনোযোগের সাথে পরীক্ষা দিয়ে চলছে। অবশেষে ফল প্রকাশের সময় জানা গেল-বিক্রম মাধ্যমিকে খুব ভালো ফল করেছে। খুশিতে অমিতাভ স্যার চোখের জল আটকাতে পারলেল না। তিনি প্রমাণ করতে পারলেন-অতীত পরিবর্তন কেউ পারেনা ঠিকই, কিন্তু চেষ্টা করলে ভবিষ্যৎ খুব ভালো করে গড়ে তুলতে পারে-যে কেউ।
      বিক্রম, অমিতাভ স্যারকে প্রণাম করে বলল,-"স্যার, আমি খুব খারাপ সঙ্গ পেয়ে খুব খারাপ পথে চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনার কথায় আমি ফিরে আসতে পেরেছি। আপনার যে কথাটা আজও আমার বুকে গেঁথে আছে, সেটি হলো -"অতীত পরিবর্তন করা যায় না কিন্তু ভবিষ্যৎ ইচ্ছামতন গড়ে তোলা যায়।
         অমিতাভ স্যার, বিক্রমের পিঠে হাত রেখে বললেন,-"তাহলে বিক্রম ,এখন তোমার ভবিষ্যতের লক্ষ্য কী?"
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মাথা উঁচু করে বিক্রম বলল,-"ভবিষ্যতে, আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই। আপনার মত মানুষ গড়ার কারিগর হতে চাই। আমি এগিয়ে যেতে চাই ভবিষ্যৎ লক্ষ্যকে সামনে রেখে। স্যার আপনি আমাকে আশীর্বাদ করবেন।"

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024