ছোট গল্প - লক ডাউন || লেখক - অমিতাভ ভট্টাচার্য্য || Short story - Lockdown || Written by Amitabh Bhattacharya


 

লক ডাউন

অমিতাভ ভট্টাচার্য্য


সকালবেলা চা খেতে খেতে প্রণবেশ ওর ফোনে পর পর দু’টো মিস কল দেখতে পেল। দেবাশিষ ফোন করেছিল ভোর পাঁচটার সময়। এতো সকালে ফোন করল কেন? কোন খারাপ খবর নয়তো? প্রণবেশ বরাবরই ভীতু স্বভাবের। খুব ঘাবড়ে গেল। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। মৈণাক আর বিদীপ্তা এই সময় ঘুম থেকে ওঠেনা। অনেক রাত পর্য্যন্ত জেগে ওরা কাজ করে। আজকাল বাড়িতে বসে কাজ করার একটা সুন্দর নাম হয়েছে; ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। ওরা দুজনেই আইটি সেক্টরে কাজ করে। বিশ্ব জুড়ে অতিমারির প্রকোপে অফিসগুলো সব বন্ধ রয়েছে। আইটি সেক্টরে কাজ করে বলে ওদের দুজনের চাকরিটা এখনও টিঁকে আছে। দেবাশিষের একমাত্র মেয়ে সুদেষ্ণার চাকরিটা আর নেই। ও একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে এইচ আর ম্যানেজারের পোষ্টে চাকরি করত। লক ডাউনের জন্য বেশ কিছুদিন অফিস বন্ধ ছিল। তারপর কোম্পানি কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। যাদের ছাঁটাই করল, তাদের যে ক’মাস বসিয়ে রেখেছিল সেই মাসগুলোর মাইনেও দিলো না। দেবাশিষের মেয়ে সুদেষ্ণা ছিল ঐ ছাঁটাইয়ের দলে। একমাত্র দেবাশিষের পেনশন এখন ওদের ভরসা। ওর কি টাকার দরকার পড়ল? 



প্রণবেশের সাথে দেবাশিষের পরিচয় হয় মর্নিং ওয়াক করার সময়। প্রণবেশ ছোটবেলা থেকে যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন। স্কুল জীবন থেকে ওর খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টা খানেক ঢাকুরিয়া লেকে অনেকদিন পর্য‍্যন্ত দৌড়েছে। ভোরবেলা দৌড়নোর ফলে ওর সারাদিন মনটাও খুব ভালো থাকতো। এক সময় ভোরবেলা দৌড়নো বন্ধ করে হাঁটা শুরু করে। একদিন সকালবেলা দেবাশিষ হাঁটতে হাঁটতে এসে প্রণবেশের সাথে আলাপ করে। তখন থেকে ওরা দুজনে দুজনের বন্ধু হয়ে গেছে। 


 


ওরা মর্নিং ওয়াক শেষ করে বাজারের কাছে একটা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। বিশ্রাম নেওয়া মানে চায়ের দোকানে বসে সকালবেলার প্রথম চা খাওয়া। চা খেতে খেতে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই আলোচনা তুমুল বিতর্কে পরিণত হয়। রোজ একই রকম ঘটনা ঘটত। বিতর্ক যখন উচ্চগ্রামে তখন হঠাৎ চুপ করে যেত। তারপর যে যার বাজারের থলে দোকানের এক কোণে রাখা চেয়ারের ওপর থেকে তুলে নিয়ে, নিজের নিজের চায়ের দাম মিটিয়ে তারাতারি বাড়ির দিকে পা বাড়াত। প্রত্যেকদিন সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে এটা ঘটত। একদিন ওরা চাকরি থেকে অবসর নেয়। মর্নিং ওয়াক সেরে তারাতারি বাজার করে বাড়ি ফেরার তাড়া ওদের আর নেই। চায়ের কাপে তুফান তুলে কখনো ওরা কোনো নেতার বক্তব্যের বিপক্ষ্যে যুক্তি খাড়া করে; কখনো বা কুড়িটা সেঞ্চুরি করা খেলোয়াড়ের কি ভাবে খেলা উচিৎ সেটা দেখিয়ে দেয়। ফুটবল খেলায় ডিফেন্সকে কাটিয়ে গোল দেওয়া যে কত সহজ তা খেলার মাঠে যারা খেলে তাদের থেকে ওরা ভালো জানে। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ি থেকে ফোন না আসা পর্য্যন্ত ওদের আলোচনা চলতে থাকতো।   



কিছুদিন হল প্রণবেশ আর ওর বন্ধু দেবাশিষ বাড়ির বাইরে বেরনো একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। ভোরবেলা মুখে মাস্ক লাগিয়ে নিজেদের বাড়ির ছাদে ওরা মর্নিং ওয়াক করে। এমন একটা রোগ সারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে গেছে যে, তার জেরে প্রায় সবার মনের মধ্যে একটা ভীতি বাসা বেঁধেছে। এই মারণ ভাইরাসকে ঠেকাতে সব দেশ কিছুদিনের জন্যে তাদের অফিস-কাছারি, দোকান-পাট, বাজার-হাট সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এতে এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ আটকানো যাবে। কারোর সাথেই আজকাল আর দেখা হয় না। প্রথম দিকে ফোন করে সকলের খোঁজ খবর নিত প্রণবেশ। আজকাল আর ফোন করা হয়ে ওঠেনা। কেমন একটা আলস্য ছেয়ে গেছে ওর মনের মধ্যে। প্রতিদিন টিভি খুললে আর খবরের কাগজের পাতা ওলটালে ‘আক্রান্ত’ আর ‘মৃত্যু’র খবর। ডাক্তাররা বলছে ষাটের বেশী যাদের বয়স, তারা যেন বেশী সতর্ক থাকে। প্রণবেশের তেষট্টি চলছে। দেবাশিষের নিজের বা ওর বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েনি তো? ওর বয়সও তো ষাট পেরিয়েছে।   



লক ডাউনের জন্যে বাজার বন্ধ। সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালারা পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়েছে সকাল থেকে। ‘সব্জি’‘সব্জি’ বলে সুর করে ডাকে ওরা। তাই শুনে প্রণবেশ ছাদ থেকে নীচে নেমে আসে মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে। অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে সব্জিওয়ালাকে বলে দেয় কোনটা ওর চাই। সতর্কতার সাথে সব্জিওয়ালার কাছ থেকে জিনিস নিয়ে দাম মিটিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। তারপর সোজা রান্না ঘরের সিঙ্কে থলেটা উল্টে খালি করে দেয়। প্রথমে থলেটা ধুয়ে বারান্দায় মেলে দেয়। তারপর সব্জিগুলোকে ভালো করে ধুয়ে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে রেখে দেয় জল ঝরানোর জন্য। প্রণবেশ যার কাছ থেকে সব্জি কেনে, সে গত পড়শুর আগের দিন থেকে গতকাল পর্য্যন্ত আসেনি। প্রণবেশ তাকে বলল, তিনদিন ধরে আসছ না। শরীর খারাপ নাকি?  সব্জিওয়ালা বলল, আমার কথা আর বলবেন না কাকা। সবই আমার কপাল। 

কেন? কপালের আবার কি হল ? 

আমিতো রাত থাকতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সকাল ন’টা নাগাদ ওরা আমার পথ আটকালো। লক ডাউনে ‘মাক্স’ না পরে বাইরে বেরিয়েছিস? বলে ওরা সবাই মিলে আমার এই ভ্যানটাকে উলটে চাকাগুলোর হাওয়া খুলে দিল। আমার সব সব্জি রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। ওরা পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট কোরে চলে গেল।

কারা এইসব করল?

ভোটের বাবুরা। 

ওরা সবাই মাস্ক পরেছিল? 

‘মাক্স’ ওদের গলায় আর দাড়িতে ঝুলছিল। 

তুমি একটা মাস্ক ওদের মতন ঝুলিয়ে রাখলে তো পারতে। তাহলে আর এত ঝামেলা পোহাতে হতনা।

আমি ‘মাক্স’ কিনব কি দিয়ে? সারাদিনে যা রোজগার হয় তার থেকে বাজে খরচ করতে মন চায় না। ওরা কোন কথাই তো শুনলো না।

প্রণবেশের খুব মন খারাপ হয়ে গেল সব্জিওয়ালার কথা শুনে। মাস্ক পরার দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু মাস্ক পরেনি বলে এমন সাজা না দিয়ে একটা মাস্ক তো কিনেও দেওয়া যেত। 


ওর কাছ থেকে সব্জি নিয়ে সেগুলো ধুয়ে জায়গা মত রাখতে গিয়ে খেয়াল হল নীলিমা এখনও রান্না ঘরে আসেনি। এত দেরিতো করে না ঘুম থেকে উঠতে। সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সাতটার মধ্যে সকলের জন্য জলখাবার তৈরি করে ফেলে। প্রণবেশ শোবার ঘরে গেল। নীলিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে প্রণবেশ ভয় হল। করোনা আক্রান্ত হল না কি? তাহলে তো মৃত্যু অনিবার্য। প্রণবেশের আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে বেশী বয়স্ক যারা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেছে, তারা আর ফেরেনি। নীলিমার কপালে হাত দিয়ে দেখল তাপমাত্রা স্বাভাবিক। নীলিমা বলল, আমার কিছু হয়নি। প্রণবেশ অবাক হয়ে বলল, তাহলে শুয়ে আছো কেন? আলস্য ভরে পাশ ফিরে শুতে শুতে নীলিমা উত্তর দিল, আমার মনটা আজ ভাল নেই। সেজ বৌদিকে ওরা বাঁচাতে পারলনা।

কি বলছ কি?

হ্যাঁ। কদিন ধরে জ্বর আর শ্বাস কষ্ট দেখে সেজদা আরটি পিসিআর টেষ্ট করাল। রিপোর্ট পজিটিভ। ওর যা অবস্থা ছিল, তাতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। করোনা হয়েছে বলে কোন গাড়ি পাচ্ছিলনা প্রথমে। একটা এ্যাম্বুলেন্স যাও বা যোগাড় হল, অনেক টাকা চেয়ে বসল ড্রাইভার। শেষে একটা রিক্সা পেল হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্যে। 

তারপর?

হাসপাতালে পৌঁছলে হাসপাতাল থেকে জানাল ‘বেঁচে নেই’। 

প্রণবেশ এই খবরে খুব ভয় পেয়ে গেল। ওদেরও যদি এই রকম পরিস্থিতি হয় তখন কি করবে?   

 

প্রণবেশ ভোরবেলা ছাদে হাঁটতে যাবার পর নীলিমা প্রতিদিনের মতো আজও বিছানা থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেল। প্রথমে ঋকের খাবারটা তৈরী করল। ঘুম থেকে উঠে ঋক প্রথমে রান্নাঘরে ঠামীর কাছে যায়। নীলিমা ওর চোখমুখ ধুইয়ে গল্প বলতে বলতে খাইয়ে দিত। তখন ঋককে ছোট্ট মৈণাকের মত লাগতো। অতিমারির কারণে বেশ কিছুদিন হল ওর স্কুল বন্ধ রয়েছে। কাল থেকে আর স্কুলে যেতে হবে না, এই খবরটা পেয়ে ঋকের খুব ভালো লেগেছিলো। ভোরবেলা ঘুম ঘুম চোখে বাবার হাত ধরে স্কুল বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে ওর ভালো লাগতো না। ছুটির দিনে বাবা-মাকে কাছে পাওয়া যায়। বাবার সাথে খেলা করা যায়। প্রথম প্রথম বাবার কাজের ঘরে গেলে বাবা কোলে তুলে নিত; কত গল্প করতো। আজকাল কথাই বলতে চায় না। মার কাছে যেতেই পারে না। ঘরে ঢুকলেই মা চোখ বড়ো বড়ো করে এমন ভাবে তাকায়, ঋকের ভালো লাগেনা। ঘুম থেকে উঠে নীলিমার কাছে গিয়ে বলল, ‘ঠামী, আমি ইস্কুলে যাব।’ নীলিমা ওকে খাওয়াতে খাওয়াতে অনেক গল্প শোনাল। কিন্তু ঋকের গল্প শোনার দিকে মন নেই। সে বারবার তার ঠামীকে ইস্কুলে যাবে বলে বায়না করতে লাগল। খাওয়ানো শেষ হয়ে গেলে নীলিমা ঋককে বলল, তোমার চোখে এখনও ঘুম রয়েছে, দাদুভাই। যাও, মার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। নাতিকে তার মায়ের কাছে শুতে পাঠানোর সময় ঐ খারাপ খবরটা এলো নীলিমার ফোনে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। সেজ বৌদির সঙ্গে নীলিমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। রান্নাঘর থেকে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল নীলিমা।



ঠামীর কথামত ঋক মার পাশে গিয়ে শুয়ে বাঁ পাটা মায়ের গায়ে তুলে দিয়ে বাঁ হাত দিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল। বিদীপ্তা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঋক চোখ বন্ধ করতেই ইস্কুলের বন্ধুদের সাথে খেলার দৃশ্যগুলো ছবির মতো ওর মনে ভেসে বেড়াতে লাগলো। চোখ বন্ধ করলে ও ইস্কুলের বন্ধুদের দেখতে পায়। তখন ওর মনটা খুশীতে নেচে ওঠে। বাড়িতে ওর খেলার সাথী তেমন করে কেউ নেই। সবাই ব্যস্ত। দাদুর কাছে গিয়ে কিছু বলতে গেলে দাদু বলে, এখন যাও, এখন যাও। পরে তোমার সাথে খেলবো। ঠামী প্রায় সারাদিন রান্না ঘরে থাকে। ঠামীর কাছে মাঝে মাঝে ও গল্প শোনার জন্য যায়। ঠামী কাজ সারতে সারতে রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শোনায় ওকে। ওর ভালো লাগেনা রাক্ষস-খোক্কসদের গল্প শুনতে। ঋক ঠামীকে বলে, তুমি ডাইনোসরাসের গল্প, রোবটের গল্প জানো না? নীলিমা ঐসব গল্প জানে না। নাতিকে তার পছন্দের গল্প শোনাতে না পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সারাদিন দস্যিপণা করে চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে। একটু দুধ খেয়ে নাও তো তারাতারি। এই কথা বলে এক গ্লাস দুধ ওর মুখের কাছে ধরে। ঠাকুমার কথায় এক গ্লাস দুধ খেতে হয় ওকে। দুধ খেতে ওর একদম ভালো লাগে না। তবুও ঠাকুমার কাছে যেতে ওর আপত্তি নেই।



ঋকের মধ্যে একটা পরিবর্তন কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছে মৈণাক। আগের মত চনমনে ভাব ওর মধ্যে নেই। কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকে সব সময়। বিদীপ্তা এসে মৈণাককে বলল, আজ আমি ছুটি নিচ্ছি।


কেন?


তোমার মা’র শরীর খারাপ।


আমিও ছুটি নিয়ে নিই তাহলে।


মা কেমন আছে জানতে মা’র ঘরে গেল মৈণাক। অনেকদিন পরে ছেলে সকাল বেলা মা’র কাছে এসেছে। নীলিমা মৈণাকের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে আদর করল। তাই দেখে ঋক ঠামীর দিকে নিজের কপালটা এগিয়ে দেয়।



মৈণাক ঋককে বাইরে বেরোবার জামাপ্যান্ট পরাতে পরাতে বলল, চল আমরা পার্কে গিয়ে খেলা করি। বাবার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে ঋকের খুব ভালো লাগল। বড় রাস্তার ওপারেই একটা পার্ক আছে। দোলনা আছে ঐ পার্কে। ঋক দোলনা চড়তে খুব ভালবাসে। রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা ডান দিকে গেলে পার্কে ঢোকার মেইন গেট। ঋককে নিয়ে মৈণাক মেইন গেটে পৌঁছে দেখতে পেল তালা ঝুলছে। দুজন পুলিশ হাতে লাঠি নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। মৈণাক তাদের কাছে গিয়ে বলল, পার্ক বন্ধ কেন?


করোনার জন্য পার্ক এখন বন্ধ রাখা হয়েছে।


বাচ্ছাগুলো খেলবে কোথায়?


এখন কিছুদিন বাড়িতেই খেলাধুলা করুক।


ছোটদের জন্য স্কুলও বন্ধ, পার্কও বন্ধ। ওরা কোথায় যাবে?


কি করবেন বলুন? পরিস্থিতি যা পড়েছে, কিচ্ছু করার নেই। লক ডাউন সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


শুধু ভোটের মিছিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, তাই না?


কি বলতে চাইছেন আপনি?


আমি বলতে চাইছি, স্কুলও বন্ধ পার্কও বন্ধ। কিন্তু গত তিন মাস ধরে মিটিং মিছিল তো বন্ধ হতে দেখলাম না?


এই ব্যাপারে আমরা কিছু বলতে পারবো না।


মৈণাক ছেলেকে নিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তা পার হয়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকল।



প্রণবেশের ফোনটা আবার বেজে উঠল। দেবাশিষ ফোন করেছে। কোন এক অজানা আশঙ্কায় ওর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ফোনটা অন করতেই দেবাশিষের গলা শুনতে পেল, হ্যালো, সেই সকালবেলা দু’তিনবার ফোন করলাম। ধরলেও না, রিং ব্যাকও করলে না।


সকাল সকাল একটা খারাপ খবর পেয়ে মনটা ভাল নেই। তোমরা ভাল আছ তো?


এখনও পর্য্যন্ত তো আছি। পরে কি হবে জানি না।


ও কথা বোলোনা। কেন ফোন করেছিলে বল।


আরে ভাই, আজকে ভোট দেবার ব্যাপার আছে, ভুলে গেছ? সকাল সকাল এক সাথে ভোট দিতে যাবো বলে ফোন করেছিলাম।


গতকাল রাতেও মনে ছিল। সকালে খারাপ খবরটা পাবার পর নীলিমা অসুস্থ বোধ করে। তাই একদম ভুলে গেছি ভোট দেবার কথা।


তাই নাকি? এখন কেমন আছেন তোমার গিন্নী? সুস্থ থাকলে যাবে নাকি ভোট দিতে?


আমরা যে কি করব বুঝতে পারছি না। তোমরা বরং দিয়েই এসো। পরে যদি সম্ভব হয় আমরা যাবো।


না, না, ‘যদি সম্ভব হয়’ বোলোনা। কষ্ট কোরে হলেও, ভোটটা দিয়েই এসো। ভোট দেওয়া তোমার সাংবিধানিক অধিকার প্রণবেশ। এটাকে নষ্ট কোরোনা।


আচ্ছা। বলছ যখন, আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। এখন রাখি, কেমন?



ঋককে নিয়ে মৈণাক বাড়িতে ঢুকে মা’র বিছানার কাছে এসে বসল। প্রণবেশ মৈণাককে বলল একটা রিক্সা ডেকে আনতে।


এখন রিক্সা করে কোথায় যাবে, বাবা?


তোর মা’কে নিয়ে যাবো ভোট দেবার জন্যে।


মা’র শরীর, মন ভালো নেই। এই অবস্থায় ভোট দিতে যাওয়াটা কি ঠিক হবে ?


কিন্তু দেবাশিষ যে বলল, ভোট দেওয়া আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার নষ্ট করা উচিৎ নয়।


সেজোমামা সারা জীবন তার সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করে নিজের স্ত্রীকে বেঘোরে হারালো।


মৃত্যু কি আর আমাদের হাতে? যা হবার তা তো হবেই।


তোমার ঐ সব্জিওয়ালাকে মার খেতে হল। তার কি মার খাবার কথা ?


তোর কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছিনা। কিন্তু সাংবিধানিক অধিকারের ব্যাপারটাও উপেক্ষা করা যায় না।


আমাদের পাশের এই হাউসিং কমপ্লেক্সের এক ভদ্রমহিলা হাসপাতালের নার্স। গতকাল মাঝরাতে তিনি ডিউটি থেকে ফিরলে তাকে ঢুকতে দেয়নি ঐ কমপ্লেক্সের লোকেরা। তাঁর অপরাধ তিনি কোভিড রোগীদের শুশ্রূষা করেন। দশ দিন পরে বাড়ি ফিরছেন একটু বিশ্রামের জন্যে। ঘরে তাঁর একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। সে দশদিন ধরে মা’কে কাছে পায়নি। আবাসিকদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার কি তাঁর পাওয়ার কথা?



ছেলের কাছ থেকে এইসব কথা শুনে প্রণবেশের অবাক হবার পালা। কী হচ্ছে চারদিকে? মনুষ্যত্বটাই চলে গেছে মানুষের মধ্যে থেকে। রইলটা কি তাহলে? এখন কি করণীয় আমাদের? প্রণবেশ ছেলের কাছে জানতে চাইল। ওরাই ঠিক করুক আগামী দিনে্র জন্যে কি ভাবে সাজাবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই পৃথিবীকে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024