ছোট গল্প - উপলব্ধি || লেখক - সিঞ্চিতা বসু || Short story - Upolobdhi || Written by Sinjita basu
উপলব্ধি
সিঞ্চিতা বসু
রান্নাবান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা চোখে পড়লো l দুর্গন্ধটা সকাল থেকেই নাকে লেগে আছে,কিন্তু এখন চোখে দেখে গা গুলিয়ে উঠলো পরমারl সমীর কর্মচারীদের তোয়াক্কা না করেই কাজে হাত,লাগিয়েছে l সামনে স্তূপীকৃত শুকনো গোবর,পাতা পচানো সার,ডিমের খোসা l দুজন লেবার ডিমের খোসাগুলোকে গুঁড়ো করছে l এছাড়া একটা বড়ো ড্রামে জমা আছে ফল সব্জির খোসা,মাছের আঁশ ইত্যাদি রান্নাঘরের ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে তৈরি কম্পোস্ট l ড্রামটা ঢেলে ফেলা হয়েছে উঠোনের মাঝখানে l বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে গেল পরমার- এতো বার বলা সত্ত্বেও সমীর গ্লাভস পড়েনি l দুহাতে গোবর মাখা,গামছা পরা সমীরকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না যে এই লোকটা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা l পাঁশকুড়া তে তাদের এই ফুল ফলের নার্সারী জন্ম সমীরের দাদুর হাতে l দুই পুরুষ ধরে তিল তিল করে বেড়ে ওঠা 'মহামায়া নার্সারি'র খ্যাতি অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে সমীরের হাত ধরে l শ্বশুর মশাই অবশ্য এটাই চেয়েছিলেন, আর সেজন্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিখে আসার জন্য ছেলেকে প্রায় জোর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য l নার্সারি টা সমীরের এখন শুধু পেশা নয় নেশাতেও পরিণত হয়েছে l নিত্যনতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ফুল ফলের আকার আয়তন বৃদ্ধি, গ্রাফটিং করে একটি জবা কাছে আরো তিন চার রকম রং এর জবাগাছের ডাল প্রতিস্থাপন করাতে মজে থাকে সমীর l সন্ধ্যের পর দেশ-বিদেশ থেকে প্রকাশিত হওয়া গাছপালা সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নালে ডুবে থাকে l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর থেকে পরমা প্রায় বোবা হয়ে গেছেl টিভিতে সিরিয়াল দেখতে ওর কোন কালেই ভালো লাগেনা, গান শুনেই বা কতটা সময় কাটানো যায়? মরীয়া হয়ে সমীরের সাথে এটা সেটা নিয়ে কথা বলতে চায় পরমা,কিন্তু ' হুঁ 'বা 'না 'এর বাইরে কোন শব্দই বেরোয় না তার মুখ থেকে l অথচ এই মানুষই যখন তার কাজকর্ম নিয়ে,হরমোনের প্রয়োগ,ছত্রাকের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করে, তখন কথার কোনো
অভাব হয় না l চেন্নাই, পুনে,ব্যাঙ্গালোরের কৃষিবিজ্ঞানীদের সাথেই বেশি আলোচনা হয় ওর l সমীরকে তো প্রায়ই ভিডিও কলিং করতে দেখা যায় ডক্টর মহেশ মঞ্জরেকার বা প্রফেসর নাইডুর সাথে l প্রথম প্রথম পরমার ও খুব আকর্ষণ জন্মেছিল বিভিন্ন ধরনের ফুল ফলের গাছপালা ও অর্কিডে l সময় পেলেই সে সমীরের কাছে শুনতে চাইত বিভিন্ন গাছের পরিচর্যা,শিখে নিতে চাইতো নানা ধরনের ফুল ফলের নাম ও প্রজাতি l রান্নাঘরের সবজি ফলের খোসা,ডিমের খোলা যত্ন করে একটা মুখ ঢাকা ড্রামে জমা করে রেখে দিতো l
ছোট থেকে শহরে মানুষ হওয়া,আশুতোষ কলেজে পড়া পরমার গ্রামে মানিয়ে নিতে যে খুব অসুবিধা হবে একথা বিয়ের আগের আত্মীয়-স্বজনের মুখে বহুবার শুনেছি সে l খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর কলামে বাবা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল,সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই যোগাযোগ l বেশিরভাগ বাবাদের যেমন চাহিদা থাকে মানে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার,সরকারি চাকুরীজীবি অগ্রগণ্য, বাবার দেওয়া বিজ্ঞাপনে কিন্তু তেমন কিছু লেখা ছিল না l শিক্ষিত,ভদ্র মোটামুটি রোজগেরে হলেই চলবে এমনই ছিল বিজ্ঞাপনের বয়ান l তাই শিক্ষিত,মার্জিত কথা বলা সমীরকে বাবার খুব পছন্দ হয়েছিল l
গ্রাম্য জীবনযাত্রা সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল পরমা l নিজেকে চেনে পরমা- বড্ড বেশি আবেগপ্রবণ সে l সেই আবেগের বশেই বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ও শান্ত আপাত গম্ভীর মানুষটার সম্বন্ধে অনেক আকাশকুসুম কল্পনা করে ফেলেছিল l বছর দুয়েকের মধ্যেই সেই মিথ্যে কল্পনার জাল ছিঁড়ে গিয়েছিল l কোন মানুষ তার নতুন বিবাহিত জীবন সম্পর্কে যে এত নিস্পৃহ থাকতে পারে তা সমীরকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না l কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পরমা নিজের বাবা দাদাকেও দেখেছে l কিন্তু কাজের সমুদ্রে শুধু অবগাহন করাই নয়,অন্তহীনভাবে এমন করে নিমজ্জিত থাকা হয়তো সমীরের পক্ষেই সম্ভব l অদ্ভুত অদ্ভুত উদ্ভিদের ও ফুলের ছবি কালেক্ট করে, তার বিজ্ঞানসম্মত নামসহ ডায়রির পাতায় আটকানোর আগ্রহ সর্বদাই পরমার সাথে দুটো কথা বলার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় সমীরের কাছে l সমীরের দুনিয়ায় পরমার কোন স্থান নেই,ইদানিং সে সমীরের জীবনে একেবারে অনাহুত হয়ে গেছে l শারীরিক আকর্ষণ ও এখন তলানিতে l আজকাল বেশিরভাগ রাতেই সমীর বেডরুমে আসে না,লাগোয়া স্টাডিরুমের ক্যাম্প খাটেই শুয়ে পড়ে l আগে পরমা এসব নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে চোখের জল বাঁধ মানতো না,রাতে ঘুম আসত না l পরে ধীরে ধীরে রাগ দুঃখ যন্ত্রণা সব স্তিমিত হয়ে এসেছে l দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে বুঝিয়েছে, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে এই বলে যে এই অনাসক্তির পিছনে অপর কোন নারীসঙ্গ নেই l এ ব্যাপারে পরমা একশো ভাগ নিশ্চিত l শাশুড়ি মা গত হওয়ার পর দুটি প্রাণীর জীবন পাশাপাশি সমান্তরালে বয়ে যাওয়া নদীর মত গতিময়,কিন্তু কখনো তাদের জলরাশি মেলে না l পরমার মাঝেমধ্যে সমীরের এই নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয় ও বুঝি এক ছদ্মবেশী সন্ন্যাসী,জাগতিকতাকে দূরে ঠেলে সাধনায় মগ্ন l দিনের বেলা তবুও বাগানে প্রচুর লোকজন কাজ করে, কিন্তু যেই নিঝুম রাত্রি নামে পরমাকে একাকীত্ব গিলতে আসে l তখন নিজেকে পৃথিবীতে ভীষণ অপ্রয়োজনীয় মনে হয় l বিয়ে ঠিক চার মাস পরে শাশুড়ি মার জেদাজেদি তে সমীর তার নিজস্ব গণ্ডী ছেড়ে বেরিয়ে ছিল l সেই প্রথম দুজনের ঘুরতে যাওয়া,সেটাই শেষ l কালিম্পং এর কাছে ছোটা মাংবার পাহাড়ে সেদিন সন্ধ্যে থেকেই অঝোরে বৃষ্টি ঝরছিল ,সাথে মুহুর্মুহু বজ্রপাত l হোমস্টের বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে ছিল পরমা l হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানি তে আশপাশের পরিমণ্ডল, তিস্তা কিছুটা নজরে আসছিল,আবার পরক্ষনেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল lসেই নৈঃশব্দের মাঝে অবিরাম বৃষ্টির শব্দ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলেছিলো তাকে l তখন সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটে l একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে নিজের দিকে টেনে এনেছিল l কথা বলার অবকাশ পায় নি পরমা,মনে হয়েছিল সেই চুম্বন বুঝি শেষ হবে না,তা বুঝি এই অবিরাম বারিধারার মত সারারাত চলবে l পরমার শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল l দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডিনারের জন্য ডেকে ফিরে গিয়েছিল হোমস্টের কেয়ারটেকার l রাত গভীর হল,জেগে রইল শুধু আলিঙ্গনাবদ্ধ দুটো শরীর l পরমার মনে,চেতনায় সেই স্মৃতি স্পষ্ট ও অমলিন l আসলে যে স্মৃতি বারবার রোমন্থিত হয় তা যে কিছুতেই ফিকে হয় না,ভিজে আঙুলে জড়িয়ে থাকা চুলের মতো মেখে থাকে l তারপর থেকে সমীরকে আর এমন করে ফিরে পায়নি পরমা lসেই কটা দিনের জন্য একান্ত নিজস্ব পরিসরে নতুন করে পাওয়া মানুষটা ফিরে এসে আবার নিজের চারপাশে গণ্ডী টেনে নিয়েছে lসেই গণ্ডী পার হওয়ার ক্ষমতা বা যোগ্যতা নেই পরমার l
আজ কিছুতেই ঘুম আসছে না, সেই উদ্দাম যৌনতার স্মৃতি আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে l মনে পড়লো - "আ লাইফ মেজার্ড ইন মেমোরিস " l
ধীর পায়ে উঠে এলো সে ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে,খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল নিজের আটত্রিশ বছরের শরীরটাকে l চামড়া নিভাঁজ,আলগা করে বাঁধা খোঁপা ভেঙ্গে এলিয়ে পড়া একঢাল চুল l না জানিয়েই সে ইতিমধ্যে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলেছে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা বা ডিপ্রেশন থেকে দূরে রাখার জন্য l অনেক ভেবেচিন্তে নাম দিয়েছে 'রাতজাগা তারা ' l সেই জেগে থাকা তারা কখনো তার নিজের মুখ দেখায় না l স্ক্রিনে বইতে থাকে উত্তরবঙ্গের তিস্তা তোর্সা,দাঁড়িয়ে থাকে পাইনের সারি,ফুটে থাকে রডোডেনড্রন এর গুচ্ছ,পেছনে থাকে নিশ্চল নিশ্চুপ মৈনাক lজেগে থাকা তারা তখন কখনো আবৃত্তি করে সুনীল গাঙ্গুলীর নীরা,কখনো বা পাঠ করে 'শেষের কবিতা 'থেকে l কোন কোন মন খারাপের রাতে সে বলে যায় কাদম্বরীদেবীর একাকিত্বের কথা l কেউ কেউ বাচিকশিল্পীকে চাক্ষুষ দেখারও ইচ্ছা প্রকাশ করে l
পরমা দমবন্ধ করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে অবদমিত করে শরীর মনের তৃষ্ণা l দাঁতের প্রবল চাপে পাতলা ঠোঁটে রক্তবিন্দু ফুটে ওঠে,হালকা হয়ে আসে শরীরের শিহরণ,মনের আলোড়ণ l মুখে ঘাড়ে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিতে হবে,তাই চান ঘরের দিকে এগোলো পরমা l নভেম্বরের মাঝামাঝি, বাতাসে একটা শিরশিরে ভাব -তবুও পরমার কপালে নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম l বাথরুম থেকে ফেরার সময় প্যাসেজ এর জানালার গ্রিলে নাক ঠেকিয়ে বাইরেটা দেখলো পরমা l কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের নিস্তব্ধতা কে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা আওয়াজ, বাতাস মাতোয়ারা উঠোনের লেবু ফুলের গন্ধে l আনমনেই দাঁড়ালো সে সমীরের ঘরের সামনে, দরজাটা সামান্য ফাঁক করা,ভেতরের আলোর ভগ্নাংশ পরিমাণ বাইরে এসে পড়েছে l তবে কি সমীর এখনো কাজে ব্যস্ত বা পড়ছে কিছু?দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই হোঁচট খেতে হল l স্তূপীকৃত কীটনাশক ও ছত্রাকনাশকের কৌটো এলোমেলোভাবে রাখা আছে l কি ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে ঘরটাl একটা ছোট গোলটেবিলে স্তুপিকৃত কাগজপত্র পাশেই ইলেকট্রিক কেটলি, চায়ের দাগ লাগা খান চারেক কাপ l প্রায় চারমাস সে এ ঘরে ঢোকে নি,ঘর মোছার জন্য রানীদিকেও ঢোকানো যায়নি,কারণ সমীরের একেবারে অপছন্দ তার জিনিসপত্রে কেউ হাত দিক l পরমা দেখল বড় টেবিলটাতে হাতের উপর মাথা দিয়ে সমীর ঘুমাচ্ছে l টেবিল ল্যাম্প এর আলো তার মুখে পড়েছে l কম্পিউটারের স্ক্রিন তখনও জ্বলজ্বল করছে l সেখানে একটা অসাধারণ একটা জবা গাছের ছবিl গাছটির পাঁচটি ডালে পাঁচ রঙের ফুল ফুটে আছে l নিচে তার বর্ণনা -গ্রাফটিং করার জন্য মাদার প্লান্টের নাম, গ্রাফটিং এর পদ্ধতি, হরমোনের নাম ও সংকেত ইত্যাদি তালিকাবদ্ধ করা l একদম নিচে হাইলাইট করা আছে সমীরের দেওয়া গাছটির নাম -'রাত জাগা তারা'l
Comments