ছোট গল্প - রূপনারায়ণের ঘাট || লেখক - দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায় || Short story - Rupnarayaner Ghat || Written by Dorpona Gongopadhay


 


রূপনারায়ণের ঘাট

   দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়



নবগ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বাড়ি শুভদীপের পুরনো আমলের সাবেকি বাড়ি। রাম বিলাস বাবু শুভদীপের বাবা ।একদিক সারিয়ে দোতলার চারটি ঘরে বসবাস করেন।  শুভদীপ তার একমাত্র পুত্র ।

বাড়ির পশ্চিমে পুকুর ,পূর্বে বড় উঠোন ,দক্ষিণে ক্ষেত,

উত্তর দিকে রাস্তা ,-রাস্তার ওপারে আবার ক্ষেত সবুজে সবুজ।

রাম বিলাস বাবুর দাদুর আমল থেকেই বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল। তাই দেশভাগের পর নিচের ঘর গুলো বাংলাদেশ থেকে আসা পরিবারগুলোকে ভাড়া দিয়ে দেন।

 শুভদীপ দের নিচের ঘরেও বিগত পাঁচ বছর আগেও চারটি ঘরে চারটি ভাড়াটে ছিল।

অনেক কষ্ট করে উহাদের তুলে নিচের ঘর চারটে  সারানো হয়েছিল। প্রতিটি ঘরের কোলে বড় দালান যে যার ঘরের দালানে তারা রান্না করত, বাইরে পুকুর উঠোনে কুয়ো,এই ছিল জলের ব্যবস্থা। আজ থেকে 35 বছর আগে বাঁশ বাগানেই অপকর্ম চলত। দিন বদলালো সবাই বাথরুমের অভাব অনুভব করতে লাগলো। বিশেষ করে শহুরে নতুন বউ শুভদীপের  মায়ের, তাই ওপরের একটি ঘরে আলাদা করে প্যান বসিয়ে পাইপ নামে নিচে পাৎকো সিস্টেম করে পায়খানা ও জল জমার জন্য একটা গর্ত খুঁড়ে ড্রেনিং সিস্টেম এবং কূয়ো থেকে ছাদের উপরে জল তুলে ওপরে কলের বিশেষ ব্যবস্থা,

যখন শুভদীপের বাবা এসব করছিল তখন  ভাড়াটিয়ারা এসব পছন্দ করছিল না, ওরা সবাই মিলে যৌথভাবে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে শুভদীপের বাবার নামে নালিশ দিল। তাতে গ্রাম প্রধান ভাড়াটিয়াদের পক্ষ অবলম্বন করল ,শুভদীপের দাদু তখন কোর্টের দ্বারস্থ হলো সেই থেকে মামলা এত বছর বাদে মিটলো তাও কি ভাড়াটেদের এক ঘরের তিন কন্যার বিবাহ হয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে এবং কর্তা অসুস্থ হয়ে মারা গেছে গিন্নি ও অসুস্থ তাই তার বড় মেয়ে এসে তাকে নিয়ে গেল যখন চাবি এমনি দিয়ে গেল,শুভদীপের মাকে,কারন বড়ো মেয়ে শুভদীপের মায়ের বন্ধু ছিল।

দ্বিতীয়জন সরকারি চাকুরে ছিল সে বুঝতো যে আইন ওদের দিকেই তাই জিতবে না মামলা জেনে অন্যত্র বাড়ি করে এই ঘরে তালা দিয়ে চলে গিয়েছিল। অবশেষে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলে কেস ডিসমিস হয়ে যায় তৃতীয়জন স্বামী-স্ত্রী থাকতো তাদের দুই পুত্র পুত্রবধূ কেউই কখনো খোঁজ নিতে আসতো না আলাদা কোথাও থাকতো তাই তাদের এই অসহায় অবস্থা দেখে শুভদীপ ওদের বাঁধের পাড়ের বাড়িতে ওদের ব্যবস্থা করে দিল থাকার, আরেকটি ঘর চতুর্থ ঘর বিবাহ হবার পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরত মেয়ে এবং বিধবা মা থাকতো তাও তার বয়স ৪০ ঊর্ধ্ব এরাও অসহায়। তাই শুভদীপ এদেরও বাঁধের পাড়ের ঘরে নিয়ে গিয়ে থাকতে অনুরোধ করে এইভাবে নিচেটা খালি করে ওরা নিচেটা সারিয়ে নেয়। আর ওই বাঁধের পাড়ের বাড়িটার পাশে মন্দির আছে মন্দিরের পুরোহিত এবং দারোয়ান এই বাড়িটায় থাকতো বাঁধের পাড়ে বাড়িটায়, এখন অন্য টুরিস্টরা আসলেও থাকে। ফলে এই বাড়ি থেকে আয়ও হয় এইসব আয়ের টাকা দিয়ে এই নিচের তলাটা পুরোই সারিয়ে নেয় শুভদীপের বাবা। উঠোনের দক্ষিণ দিকে ঠাকুরদালান এবং ভোগ রান্নার ঘর সবটাই সারিয়ে নেয় আর উত্তর দিকে ঘর গুলোর অবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় ও দুটো ভেঙে পাঁচিল দিয়ে বড় গেট লাগিয়ে দেয়। বাকি পড়ে থাকে পূর্ব দিকে চারটি ঘর ,একতলা চারটি, দোতলায় চারটি। ঘর গুলো পিসিমার ভাগের ছিল, আগে পিসীমার ছেলে আসত ঘর পরিষ্কার করত ফসলের ভাগও নিয়ে যেত ইদানিং বছর দশেক আর আসেনা অনেক খোঁজ করে জানতে পারলো যে উনার মেয়ে এখনো বেঁচে আছে এবং শ্বশুর বাড়িতে আছে, শুভদীপ খোঁজ করে সেই পিসীমার ছেলের মেয়ে অর্থাৎ পিসিমার নাতনি শুভদীপের পিসি ঠাকুমা হয় তার বাড়ি গিয়ে হাজির হলো। গিয়ে দেখল খুব বড় কোলকাতা শহরে বাড়ি কোন জিনিস নেই, নেই--- সব জিনিসে ভর্তি কোন অভাবের চিহ্ন নেই। জিজ্ঞাসা করল। আপনার এসব মেন্টেন হয় কি করে আপনি খাওয়া-দাওয়া করেন কিভাবে আপনার চলে কিভাবে? --- উত্তরে একটু হেসে পিসি ঠাকুমা বললেন টাকার কোন অভাব নেই, তবুও আমার ছেলে মেয়ের অযথা টাকা রোজগারের নেশা ।ছেলে থাকে আমেরিকা তার বাবা মারা যেতেই সে আসেনি,--- বসে আছে মা ! মরে গেলেও সে আসবে না! আর মেয়ে থাকে বম্বেতে, মাঝে মাঝে ঘুরতে আসে ---!

 তোমাদের ওই জঙ্গলে বাড়ি। আমি নিয়ে কি করব আমার ছেলে মেয়েও কখনো যাবে না। ওরা তো কখনো দেখেইনি,--- আমি তবু বাবা-মায়ের হাত ধরে গেছি; চিনি, তোমার ঠাকুমা আমার বৌদি হন। বৌদির সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্যতা ছিল আমার একবার যাওয়ার ইচ্ছা হয়। তো চলনা পিসি ঠাকুমা আজই চলো আমি তোমায় গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছি আবার গাড়ি করে ফেরত দিয়ে যাব। যেমনি বলা তেমনি কাজ। একটা ওলা ডেকে শুভদীপের সঙ্গে বাড়িতে তালা দিয়ে পাশের বাড়িতে বলে পিসি ঠাকুমা নবগ্রামে এসে হাজির। তারপর যেন মনে হলো দুই কিশোরী মেয়ে নতুন দেখা হয়েছে। দুই ঠাকুমা শুভদীপের,--- গল্পে মেতেছে রান্নাবান্না শুভদীপের মা করছে, যথাসময়ে খেতে দিল এত আদর আর আপ্যায়ন দেখে বেশ আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ল,  পরের দিন দুজনে সারারাত জেগে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করল। দশটার সময় শুভদীপের দাদু পিসি মাকে ডাকিয়ে তালা ভেঙে দোতলার চারটে ঘর খোলালো তারপর ওরা পরিষ্কার করতে লাগলো মিস্ত্রি ডেকে। মিস্ত্রিরা দুটোর সময় গেল। তখন এসে পিসি মাকে বলে গেল যে বাড়ির অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, দেয়াল ফুটো হয়ে গেছে জানলা দরজা নষ্ট হয়ে গেছে, খাট বিছানা ঠিক নেই, দেখো কি নেবে আর কি ফেলবে, পিসেমা বলল পুরনো কিছুই আর নেব না সব নতুন করে সাজাবো তিনটে নাগাদ সবাই মিলে ওই চারটি ঘর পরিদর্শনে যাওয়া হলো। একে একে সব ঘরই ঘুরে দেখা হল। প্রতি ঘরেই অনেক আসবাবপত্র খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল দেরাজ টেবিল চেয়ার একটা ঘরে আগেকার পুরনো একটা কলের গানের মেশিন পিসি ঠাকুরমা বলল ওটা চালিয়ে দিতে। মিস্ত্রি চালিয়ে দিল। চলতে শুরু করল রবীন্দ্র সংগীত বাজতে লাগলো, বাড়ি গমগম করে উঠলো, শুভদীপের ঠাকুমা আষাঢ় ধানতোলার টাকায় এবার দুর্গা পুজো হবে ,অনেক লোক বলা হবে। তুমিও থেকে যাও। শুভদীপের ঠাকুরমা বলল যে দুর্গা পুজো কাটিয়ে যাবে। খুব আনন্দ হবে আগেকার মত। ঠিক এমন সময় একটি কবিতা আরম্ভ হলো কলের গানে --- "আমি গোপি বালা এইবারই ছোট বউ ছোট কথা ভীষণ অসুস্থ সবে ছয় মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে সবাই আমাকে ছোটকর্তার অসুখের জন্য দায়ী করছে। আমাকে অপয়া বলছে অথচ উনি নিশ্চিত আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন না হলে এই ছয় মাসের মধ্যে এত বড় অসুখ কি করে বাঁধে, আর ওনার অসুস্থতার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না! সকলেই বললে ছোটকর্তা মারা গেলে আমাকে সহমরণে যেতে হবে। অযথা যুবতীকে ঘরে রেখে কলঙ্কের দায় পরিবার নেবেনা!

মাছ ভেঙে পড়ল মাকে চিঠি পাঠালাম কিন্তু মায়ের থেকে কোন উত্তর এলো না। রাতদিন খাওয়া বন্ধ করে সকলের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলাম। স্বামীর জন্য হিন্দু ছেলে মুসলিম ফকির এবং মসজিদে গিয়ে মৌলভীর কাছে নানা ওষুধের খোঁজ করতে লাগলাম। একদিন মৌলবী বললে মা, যে কদিন উনি আছেন উনার সঙ্গে থাকো এভাবে রাস্তায় ছুটে কোন লাভ হবে না কিন্তু ওনার কাছে যাওয়ার অধিকার তো আমার ছিল না। সবাই উনাকে ঘিরে রাখত। কারণ ওনার অনেক টাকা পয়সা গয়না গাটি অবশেষে একদিন ওনার কাছে পৌঁছে গেলাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার কি দোষ উনি আমার দিকে চাইলেন বললেন পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তোমাকে আমি রাজরানী করে রাখবো এ জন্মে তুমি আমায় ক্ষমা করো বলেই তিনি চোখ বুঝলেন। সকলের রেড়ে করে উঠল। এই অপয়া মেয়েকে কে ঘরে ঢুকতে দিয়েছে আমাদের ছেলের প্রাণ নিয়ে নিল কি অপরাধ কি অপয়া বাপু!

সকলেই বিকট চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে লাগলো, বাড়ি মাথায় করে তুলল তারপর শোভাযাত্রা সাজিয়ে আমাকেও সাজগোজ করিয়ে সহমরণে নিয়ে গেল ঢাকঢোল খুব আস্তে লাগলো। কি সুন্দর ঘাঁট রূপনারায়ণ ঘাট। নিচে নেমে গেছে। চওড়া সিঁড়ি। জল টলটল করছে---

তারি  পাড়ে উঁচু চিতা সাজানো

সেই চিতার ওপর ধীরে ধীরে ছোট কর্তাকে শুইয়ে দেয়া হলো । তারপর নিয়মকানুন শেষ করে আমাকেও হাত-পা বেঁধে ওই জলন্ত চিতার উপর বসিয়ে দিল আমি খুব চিৎকার করতে লাগলাম সবাইকে বারে বারে বলতে লাগলাম আমি এখান থেকে চলে যাব, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করব না, কখনো আসবো না; আমাকে ছেড়ে দাও! জোরে জোরে ঢাক বাজতে লাগলো আমিও চিৎকার করতে লাগলাম জ্বলন্ত শরীরের জ্বালাপোড়া নিয়ে! হঠাৎ হাতের বাঁধন খুলে গেল তখন পায়ের বাঁধন খুলে রূপনারানের জলে ডুব দিলাম ভাবলাম বেঁচে গেছি কিন্তু না ওরা আমাকে তুলে আনলো তারপর টানতে টানতে নিয়ে আসছিল। হঠাৎ মাথায় একবাড়ি মারল,--- রক্ত ছিটকে গিয়ে লাগলো রূপনারায়ণের ঘাটের পাঁচিলে, 

তারপর সব চুপ! 

আজও তুমি পাবে ওই ধ্যাবড়ানো রক্তের দাগ যারা আমার গল্প শোনাবে। রূপনারায়নে কান পাতবে, ও তোমাদের আমার গল্প বলে দেবে। 

এখনো আমি এই ঘাটে অপেক্ষায়। 

তুমি আসবে তো!

ছোট বাবু!

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024