উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -14


 


বিধাতার নির্মম পরিহাস মানুষের জীবনকে মরুময় করে তোলে । শত চেষ্টা করেও কোন উগ্র পুরুষাকার ভাগ্য বিড়ম্বনার করাল কবল হতে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না । আমার জীবনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি । হারানো সলিলকে Medical Repre sentative পি . বিশ্বাসের মধ্যে খুঁজে পেলও তার প্রেমের নৈবিদ্য নতুন করে সাজালো । দিন দিন পি.বিশ্বাসের প্রতি শ্যামলী আকৃষ্ট হয়ে পড়ল । তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে তার জীবনের শ্রেয় ও প্রিয় বলে মনে হল।


 কি যে দৈব্যগুণে কারেন্টের মতো টানত ওর দিকে বুঝতে পারত না । এমনকি অভিসারিকা হয়ে পল্টু বিশ্বাসের কুঞ্জেও তার অবাধ যাওয়া আসা শুরু হল । ঐ ভাবে কয়েক মাস তাদের গোপন প্রেমের লীলা চাপল্য একদিন শ্যামলীর বাবার চোখে ধরা পড়ল । তিনি তাকে পি.বিশ্বাসের সঙ্গে এই মেলামেশার হেতু জিজুাসা করায় শ্যামলী অকপটে সত্য ঘটনা প্রকাশ করল।

কোন মতে রাজী হলেন না তিনি একজন Medical Representative এর সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে । নিজের আভিজাত্য বজায় রাখার জন্য তিনি সুপাত্রের সন্ধান করতে লাগলেন । তার বাবার এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে ছুটে গেল পল্টুর কাছে । তাকে সকাতরে জানালো , পল্টু যদি তাকে সত্য সত্যই জীবন সাথী রূপে নির্বাচিত করতে চায় , তাহলে অবিলম্বে সে যেন কালীঘাটে কিংবা অন্যত্র দেবমন্দিরে গিয়ে শুভ কার্য সম্পন্ন করে।

 ঐ দিন কালীঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে বজায় রেখে শ্যামলী তৈরী হতে গেল বাড়ীতে । দ্রব্য সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে পরদিন পল্টুর বাসাতে এসে উপস্থিত হল । আনন্দ উল্লাসে নৈশ ভোজন করার পর কখন যে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে ছিল তা জানে না । যখন জ্ঞান ফিরল , দেখল এক বারাঙ্গনালয়ে । পল্টু বিশ্বাসের প্রবঞ্চনা চিত্র তার চোখের সম্মুখে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । জানতে পারল পল্টু তাকে এখানে ৫০ হাজার টাকার বিক্রি করে গেছে।

এরপর থেকে তার জীবনের মেঘমুক্ত শারদ আকাশ আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হতে থাকল । এই ঘটনা বলার পর শ্যামলীদি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । অনেক চেষ্টা করেছিলাম এই কলুষিত জীবনের পরিবেশ হতে নিজেকে মুক্ত করার । সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হলো । কিন্তু কেন জানিনা , আমি অনিচ্ছা সত্বেও যৌবন ভাসতে ভাসতে এক অন্ধকারময় পরিণামের দিকে এগিয়ে চললাম।

সেই দিনটাকে কোন মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারিনি । শুধু দুঃখে অভিমানে মাথার চুল ছিঁড়েছি । কি ভুল করেছি আমি ! কেন বাবার কথা শুনিনি ? কেন শয়তানটাকে চিনতে পারিনি ? শ্যামলীদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

 ওকে কি বলে সান্ত্বনা দেব তার ভাষা পাচ্ছিলাম না । শুধু বললাম , আমিও তো তোমার দলভুক্ত হলাম দিদি । হঠাৎ মুখ দিয়ে তুমি বেরিয়ে এলো।

এরপর আমার পঙ্কিলময় জীবনের অধ্যায় হল শুরু । বিধাতার অভিশাপে এই সংসার বারবণিতা রূপে পরিগণিত হলাম । রমা নামের পরিবর্তে পদ্মা নামে আমি এই ক্লেদাক্ত জীবনের বোঝা বইতে শুরু করলাম । এক ধনী পুত্রের কন্যা হয়ে অকুণ্ঠ চিত্তে কখন যে পুরুষদের লালসার শিকার হলাম তা নিজেও বুঝতে পারিনি । ভাগ্য - বিড়ম্বনার কি নিদারুন পরিণতি !

 এবার অভিজ্ঞ পাঠকদের নিকট প্রশ্ন রাখি , যারা আমাদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন , আমাদের অন্তরে যে ব্যথা , যে অতৃপ্ত কামনা , যে নৈরাশ্য লুকিয়ে আছে , যাদের হৃদয়ের সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের বিনিময় চলে সেই সমস্ত মধুকর পুরুষগণ আমাদের অন্তরকে উৎঘাটন করেন এর সত্য স্বরূপটি জানতে চান কি ? জানতে চান না , ক্ষণিকের অতিথি হয়ে তারা অপাতত মধুর সুখের স্পর্শ লাভ করে ধন্য হন , কিন্তু যাবার সময় এমন কি আমাদিগকে শুস্ক ফুলের মালার মতো অবজ্ঞার স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে যান । এই তো আমাদের মধুময় জীবন ।

 তবে একথা অস্বীকার করব না , আমাদের পৃষ্ঠপোষকগণের বহুমূল্য উপহার সামগ্রী জীবনের কলঙ্ককে ঢেকে দিয়েছে , বিস্মৃত করে দিয়েছে আমাদের অতীত জীবনের আভিজাত্যকে । কি এক দুর্নিবার আকর্ষণে নিত্য নতুন জীবনের আস্বাদনে তখন আমরা মত্ত হয়ে ছুটে চলেছি । তখন আমাদের জীবনের আদর্শ , নীতিবোধ ও মানবিকতা ধূলায় লুণ্ঠিত ।

  Eat drink and be merry . এটাই ছিলো আমাদের জীবনের চরম কামনা । বেশ আনন্দেই আছি । সব লজ্জা , ঘেন্না কোথায় লুকিয়ে গেছে জানি না । এখন পুরোপুরি দেহপসারিনী হয়ে গেছি , পুরুষদের সাথে আমোদ করতে কোন কষ্ট হয় না । আমার সৌরভের গন্ধে পালে পালে পুরুষেরা এসে মাতোয়ারা হচ্ছে । মাঝে মাঝে পুরুষদের কথার ছলে খিলখিল করে হেসে উঠতাম । অনেকে আভার ভীষণ অশ্লীল কথা বলত , কিন্তু বস্তীর মাসিমা আদরিনী নারীদেহের ব্যবসায় যাতে ভাঁটা না পড়ে সেই সময় বহু পুরুষের অপমান ও বাড়াবাড়ি বিনা প্রতিবাদে নীরবে সহ্য করতাম । নিজের জীবনকে পণ্য সামগ্রী বা পুরুষের ভোগ্যবস্তু রূপে বিলিয়ে দিয়েছি । গভীর চিন্তা করার সময় পেতাম না , কেন এই পথ বেছে নিলাম । 

একদিন এক বিশিষ্ট ভদ্রলোক এলেন । তার গায়ের রং ভীষণ ফর্সা , বেশ সুপুরুষ ।


পরেন দামী শার্ট ও ফুল প্যান্ট , হাতে গোটা তিন সোনার আংটি , দাড়ি - গোঁফ কামানো মসৃণ গাল ,  ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি । 

ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম , তিনি আদরি মাসীকে কি যেন বলছিলেন শুনতে পেলাম । একটু পরে ধীরে ধীরে তিনি আদরী মাসীর সঙ্গে আমার কাছে এলেন ভাবলাম নবাগতের আগমনে আমার উদ্দেশ্য অনেকটা সিদ্ধ হবে । আদরী মাসীর ইচ্ছা ভদ্রলোকটির রুচিমত আমি যেন কাজ করি । ভদ্রলোককে গৃহাভ্যন্তরে নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য আতিথ্যে আপ্যায়িত করলাম । কিন্তু তিনি কুরুচি পূর্ণ ভদ্রলোক ছিলেন না । আমার আপ্যায়নে বাধা দিলেন । নিজের কাজের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন ।

 ভদ্রলোক বললেন , যদি আপনি আমার প্রতি সহৃদয় হয়ে থাকেন , তাহলে আমার অনেক উপকার হবে ।

 আমি সাগ্রহে বললাম , কি করতে হবে বলুন ?

 তখন ভদ্রলোক আমার কথার উত্তর না দিয়ে আমার আপাদমস্তক সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন । মনে হল , আমি যেন তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া প্রেমাস্পদ — যাকে তিনি যুগ যুগান্তর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছেন , এমনি তার মনোভাব । তার নীরবতায় আমি বিরক্ত হয়ে বললাম , কি মশাই , আমাকে নিয়ে আবার নতুন স্বর্গ রচনা করবেন বুঝি ? আপনার জীবনের অতৃপ্ত কামনাকে তৃপ্ত করার জন্য বুঝি এখানে এসেছেন? না। আমাকে কৌশলে এখান থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য এসেছেন?

 কিন্তু তার প্রসন্ন দৃষ্টি , নিষ্কলুষ মনের উদারতা করুণ চাহনি দেখে তাকে ঠক প্রবঞ্চক বলে মনে হলো না । কিন্তু তিনি আমার নিকট মনের গোপনীয়তা সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করলেন না । বাধ্য হয়ে সেদিন তাকে বিদায় দিয়েছিলাম । এই উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে মানুষের আসঙ্গলিপ্সা আমাকে শান্তি দিতে পারেনি । ভদ্রলোক সেদিনের মতো গুপ্ত মনের রহস্য নিয়েই বিদায় নিয়েছিলেন। 

এই ঘটনার পর আমার আদরী মাসী হাজির হলেন । জন্মের কয়েক বছর পর মাকে হারিয়েছিলাম । মনে হয় ভগবান আমার দুঃখময় জীবনের কথা চিন্তা করে এই আদরী মাসীকে দিয়ে মায়ের স্থান পূরণ করছেন । তিনি কাছে এসে সস্নেহে বললেন , পদ্মা ঐ ভদ্রলোকটিকে বিদায় করে খুব অবিবেচনার কাজ করলি । ধীরে ধীরে আদরী মাসীর কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ও গাম্ভীর্য্য দেখা দিল।

 আমি নাকি তার কামনার বাধার সৃষ্টি করলাম । ওর চড়া মেজাজ দেখে আর থাকতে না পেরে মাথা থেকে পা পর্য্যন্ত আমার জ্বলে উঠল । সমস্ত দেহটা উত্তেজনায় কেঁপে উঠলো । আর টাল সামলাতে না পেরে বলে উঠলাম , তোমার ক্ষতি হল তো আমার বাপের কি?





                             ক্রমশ...

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024