ঝড়ঝঞ্ঝার আন্দামানে - সামসুজ জামান || Jharjonjhar Andamane - Samsuz zaman || Short Story || ছোটগল্প
ঝড়ঝঞ্ঝার আন্দামানে
সামসুজ জামান
একেবারে ছোট্টবেলার ঝড়ের যে ছবি মনে আঁকা আছে তা বাড়ির খুব কাছেই মসজিদ তলার আম গাছের আম কুড়োনোর সাথে যুক্ত হয়ে আছে। আরেকটু বড় হয়ে সেই ছবি কিভাবে, কোথায় অপু আর দুর্গার আম কুড়ানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে তা বোঝার উপায় নেই।
আরেকবার ঝড় হল আচমকা। আশেপাশের গ্রামে তেমন কিছুই হলো না কিন্তু আমাদের বর্ধমান জেলার কালনা থানার টোলা গ্রামের উপর দিয়েই যেন তার যাবার ইচ্ছে হল। আর সে দানব যাবার সময় গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে পশ্চিম ডাঙ্গার বটতলার পুরনো বটগাছ আর গ্রামের উত্তরপ্রান্তে খন্দকার পীরের আস্তানার বিশাল বটগাছের দুটো গাছেরই বেশিরভাগ ডালপালা ভেঙে, গাছ উপড়ে একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেল।
তারপর কর্মসূত্রে চলে গেলাম আন্দামানে। আর আন্দামানে থাকবো অথচ ঝড়ের অভিজ্ঞতা হবে না তা তো আর হয় না। সাধারণভাবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কালবৈশাখীর মতো হঠাৎ ঝড় ওখানে নেই। কিন্তু আবহাওয়ার দুর্যোগের কারণে বিশেষ করে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে যখন তখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়ংকর আকার ধারণ করে। আর সেই প্রচন্ড ঝড়ে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার অবস্থা যারা না দেখেছেন তাদের কাছে ব্যাপারটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। একবার তো ঝড়ের ভয়ংকর অবস্থার ছবি তুলতে কারবাইন্স কোভের সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় গিয়েছিলাম চার-চাকা নিয়েই। তবে কিনা মাঝখানে এমন অবস্থা মনে হচ্ছিল না সেই চার চাকা আর মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। এই বিপজ্জনক অবস্থা কাটিয়ে কোনরকমে প্রাণ হাতে করে ফিরেছিলাম। তবে আমার পাঠানো সেই ভিডিওগ্রাফির কিছু অংশ অন্ততঃ কলকাতা টিভির পর্দায় দেখানো হয়েছিল – এটাই যা সান্ত্বনার কথা।
এছাড়া পর্যটকেরা হয়তো দ্বীপ দ্বীপান্তরে ভ্রমনে গেছেন হঠাৎই এমন সময় মাঝেমধ্যে এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির সুচনা হলো তখন তাদের ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি’-র অবস্থা। হঠাৎই তারা হয়তো শুনলেন রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে ফেরার সমস্ত যোগাযোগ একেবারেই অচল। কলকাতা যাওয়ার বিমান বন্ধ। ভ্রমণার্থীদের কান্নাকাটি, হা হুতাশ! তবে আন্দামান-নিকোবর প্রশাসন এসব ক্ষেত্রে খুব যোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ ক’রে ভ্রমনার্থীদের উদ্ধার, ফেরা বা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির যথাযোগ্য ব্যবস্থা করেন। কতবারই এমন হলো। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় যাত্রীরা বিপদে পড়েন নি তেমন, কোনো দিনই। প্রশাসনের সর্বোচ্চ প্রশাসক স্বয়ং উপরাজ্যপালের তড়িঘড়ি নির্দেশে পর্যটকদের জন্যে সর্বতোভাবে তাৎক্ষণিক উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্থ করা হয়।
তবে জানো বন্ধু একবার ২০শে জুলাই কলকাতা থেকে যাত্রা করেছিলাম আন্দামানের উদ্দ্যেশ্যে। সে বারে জাহাজে ছিলাম ব্যক্তিগত ভাবে আমি একা। আচমকা দ্বিতীয় দিন থেকেই সমুদ্রের মেজাজ খাপ্পা! উঠল ঝোড়ো বাতাস। ভয়ঙ্কর অবস্থা। যে যেখানে পারছে বমি করতে করতে জাহাজে লুটিয়ে পড়ছে। আমার তেমন বমির ধাত নেই কোনদিনই তাই কিছুটা রক্ষে। কিন্তু মন খুব খারাপ। মনে পড়ছে পরদিন বিবাহবার্ষিকী। হয়ত সে কারণেই আমার তখন সেই অবস্থাতেও মনে জাগছে রবিঠাকুরের গান – “ আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে / দোলাও দোলাও দোলাও আমার হৃদয়”। জাহাজের ক্রু দের বারণ সত্তেও একেবারে জাহাজের উপরের ডেকে দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল দৈত্যের মতো ছুটে আসা ঢেউয়ের মধ্যে জাহাজের সম্মুখভাগ যেন তলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছেএবার জাহাজডুবি অনিবার্য! ওমা! আবার দেখি জাহাজ ভেসে ওঠে। বড় বড় ঢেউ একেবারে জাহাজের মাস্তুলে আঘাত করার মত ব্যাপার। সেই স্মৃতি কি ভোলা যায়?
আরেকবার গ্রীষ্মের ছুটিতে ফেরার সময় প্রচন্ড দুর্যোগ। সব ঠিকঠাকই চলছিল। দুদিন বাদে ঘোষণা করা হল- জাহাজ কলকাতার দিকে যেতে পারবেনা, ভয়ানক তুফান চলছে। অগত্মা জাহাজ যাবে ভাইজাগ বন্দরে। আবার চলল জাহাজ। এক দিন বাদে আবার ঘোষণা হল সেখানেও নাকি ভয়ানক দুর্বিপাক, তাই জাহাজ যাবে চেন্নাইতে। আবার দুলতে দুলতে যেতে লাগলাম বাধ্য হয়ে। চেন্নাইয়ের কাছাকাছি গিয়ে খবর এলো কলকাতায় আবহাওয়া ঠিক হয়ে গেছে তাই জাহাজ আবার ফেরত যাবে সেখানে। ইতিমধ্যে নামার তাড়ায় দুই মহিলা যাত্রী সোজা ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে হুমকি দিতে লাগল - কলকাতার দিকে জাহাজ ঘোরালে আমরা জলে ঝাঁপ দেবো। আমাদের চেন্নাইতে নামানো হোক। বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন চেন্নাইয়েই যাওয়া হবে। যাদের জরুরী প্রয়োজন তারা নেমে পড়বেন আর যাদের কলকাতা ফেরার দরকার তারা জাহাজেই থাকবেন। দীর্ঘদিনের যাত্রায় লোকের খাবার পুঁজি শেষ। তখন জাহাজ থেকে বিনা পয়সায় খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এভাবে ঝড়ের তাড়নায় মোট দশ দিনের মাথায় আমরা একদিন রাত দুপুরে এসে কলকাতায় নামলাম। এতরাত্রে খিদিরপুর ডকে যাত্রীদের কখনও নামানো হয়না তবে সেবারে – “ কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি”- দেখে কর্তৃপক্ষ আর দ্বিরুক্তি করেন নি। আর সকলেই নিজের নিজের বাড়ি ফেরার তাড়ায় সেই রাতেই হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতেই আমাদের হতদৈন্য অবস্থার কথা শুনে আর জাহাজ যাত্রার দশদিনের শংসাপত্র দেখে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ মানবিকতা দেখিয়ে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে আমাদের থাকার সুন্দর ব্যবস্থা করেছিলেন।
পরদিন ভোরে আমরা যে যার গন্তব্যে পোঁছে তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
---------------------
Comments