উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -42



 মা রমা, আমি একটু চমকে উঠলাম। তোমাকে পুত্র বধূ রূপে পেয়ে মা হারা ময়নার মরা গাঙে জোয়ার এনেছে এটা তোমার কম কৃতিত্বের কথা নয়। তুমি এক মহীয়সী নারী। তবে আমার অনুরোধ, দেবী যদি কোন দিন, কোনরূপ ভুল করে ফেলে তাহলে একটু মানিয়ে নিও।


ও কথা শুনে আমার ভেতরটা টন টন করে উঠলো। বাবাকে প্রণাম করে বলে উঠলাম, আমার আশীর্বাদ করুন, আমি যেন আপনাদের আশা আকাঙ্খাকে সার্থক করে তুলতে পারি। তিনি আশীর্বাদ করলেন ।

একটু পর এটাচী হতে একটা দামী সোনার গলার হার বের করে হাতে দিয়ে বললেন, বহু যত্ন সহকারে এই অলংকারটিকে তৈরী করিয়েছিলাম। নতুন বৌমাকে এমনি তো আশীর্বাদ করতে পারি না, তাই এই হারখানি নিয়ে এসেছি। কি পছন্দ আছে তো?

মনে মনে ভাবলাম, সোনার ছাড়া যদি অন্য কোন ধাতুর হার দিতেন তাতেও আমার মনোক্ষুন্ন হতো না। আপনার নিকট আমার একমাত্র কামনা, আপনার শ্রীচরণে একটুখানি আশ্রয় । গোপনে চোখের জল ফেলে হারখানি গলার মধ্যে আটকে রাখলাম।

ঈশ্বরকে কাতর স্বরে ডেকে বললাম, ঠাকুর এর অমর্যাদা কোন দিন যেন না হয়। জীবনে যে কষ্ট দিয়েছো নীরবে সহ্য করেছি। কোন দিন অভিযোগ করিনি । তাই এই হতভাগী বারবনিতাকে যখন অন্ধকার কূপ হতে উদ্ধার করে পবিত্র গঙ্গা জলে শুচিস্নাত করেছো, তখন বিগত দিনের মালিন্য ও কলুষতা যেন আমার মনের মুকুরে আর প্রতিবিম্বিত না হয়। দেবীর মনে একটা প্রেমের নিভৃত আসন করে নিতে পেরেছি সে আসন থেকে আর যেন আমি বিচ্যুত না হই - এটাই ভগবানের নিকট সকাতর প্রার্থনা জানালাম।

কিন্তু আমার কথা তিনি শুনেন নি। কারণ তার কয়েকদিন পরেই দেবী ও ময়নাকে ত্যাগ করে সেই গৃহ হতে নিশীথ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। একটু পরেই তা প্রকাশ করবো। হয়তো আমার ডায়রীতে আমার পঙ্কিলময় জীবনের রূপ রেখা ঠিক মতো ফুটে উঠছে কিনা জানি না। তবে যা ঘটেছিলো তা এখন সুন্দরভাবে স্মরণ রেখেছি।

পরের পর ঘটনাকে মালা করে গেঁথে রেখেছি। মনে হচ্ছে সেই মালার গাঁথা ফুল একটিও মনে পড়েনি। কেবল একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে।

আমাদের রেজেষ্টারী বিয়ে হয়েছে বলে বাবা মনোক্ষুন্ন হলেন না। তিনি মেনে নিয়েছেন আমাদের বিয়েকে। বিয়েতে কোন অনুষ্ঠান হয়নি বলে। তিনিও রাজ ভোজের আয়োজন করবেন। এই ভোজই হলো আমার জীবনের আরেকবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার অশনি সংকেত। পলকে পলকে আমি আগের মতোই দুঃখ যন্ত্রণায় কাতর হলাম।

শ্বশুর মশাই বাড়ীতে আসার পর কয়েকদিন আনন্দ উল্লাস ও গৃহ কর্মের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হলো। যত দিন গত হচ্ছিলো, ততই বাবার নিকট প্রিয় পাত্রী হয়ে আনন্দে মেতেছিলাম। আমাকে তার প্রয়োজনের সময় যদি না পেতো তাহলে স্থির থাকতে পারতেন না। আমিও তার কোন কাজে সাহায্য করতে ব্যর্থ মনোরথ হইনি। যখন যে বস্তুর দরকার হয়েছে আমার কাছে পেয়েছেন। সেইজন্য বাবা আমাকে আদর করে বলতেন গৃহলক্ষী।

আজ অনুষ্ঠান, অর্থাৎ বিবাহের প্রীতিভোজ। সকালে ঘুম হতে প্রাতঃরাশ সেরে দেবীর সাথে বাজারে গেলাম। ময়নাও গিয়েছিলো সাথে। ওর পছন্দ মতো দামী পোষাক নিলাম। পোষাক পরিচ্ছদ ছাড়া আরো বাজারের দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যখন বাড়ী ফিরছি।

হঠাৎ নজরে পড়লো ফুটপাতে বাসের অপেক্ষায় এক পরিচিত বন্ধু সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে আমার শরীর হিম শীতল হয়ে গেলো। বিশেষ করে এই জন্য সে কলহাস্যে বলে উঠল দেবীকে, হ্যালো ব্রাদার, কেমন আছিস ? আধঘন্টার উপর এখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছি, কোন ট্যাক্সি পাচ্ছি না। তোদের বাড়ী যাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি। গতকাল মামা বাবুর একখানা পত্র পেলাম যে আজ তিনি এক অনুষ্ঠান করবেন, যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকি মা ও আমি। মা'র তো ভীষণ শরীর খারাপ তাই আমাকেই আসতে হলো।

আমি ঘোমটা নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম, ঐ শয়তানটাকে আমার মুখ দেখাতে চাই না। কারণ ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আমার কপাল ভেঙ্গে যাবে। চুরমার হয়ে যাবে আমার ঘর বাঁধার স্বপ্ন। ঐ শয়তানটা যখন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে, তখন সে পুরানো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে ছাড়বে না। কাপুরুষরা যখন একটুখানি সুযোগ পেয়ে থাকে, সেই সুযোগে নিজেকে মহীয়ানের পরিচয় দিয়ে শত্রুর প্রতি বদলা নিতে ছাড়ে না।

বাহু বল না থাকলেও ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলে শত্রুকে পরাস্ত করার চেষ্টা করে। মনে হয় এই সুযোগ ছাড়বে না। আমাকে যে নিরীক্ষণ করেছে তা বুঝতে পেরেছি, এবং আমি যে দেবীর বৌ তা অনুমানে বুঝতে পেরেছে। বারংবার আড়চোখে আমার মুখ পানে তাকানো, তার প্রতিশোধের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

সেদিনের ঘটনা আজও মনে আছে। এই ভদ্র সন্তান, আমাদের আনন্দ কুঞ্জে একদিন অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আমি ও শ্যামলীদি ওর মুখ পানে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম এই সেই লোকটা যার শরীরে গুপ্ত রোগ বর্তমান। শ্যামলীদি ও আমি পাশাপাশি বসে আছি, হঠাৎ মদ খেয়ে টলতে টলতে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করল।

শ্যামলীদি বার বার অনুরোধ করল, এই বাড়ী হতে যেন বেরিয়ে যান।

সে কোন কথা কর্ণপাত না করে মদমত্ত গলায় বলল, আমি তোমাদের কাছে কিছু না নিয়ে তো যাবো না সুন্দরী। তোমাদের মধ্যে একজন আমার ক্ষণিকের সঙ্গিনী রূপে

পেতে চাই। ভয় নেই প্রচুর টাকা দেবো। মোট কথা একে (আমাকে) আমি চাই-ই। বললাম, আপনি এখন হতে বিদায় নেবেন কিনা জানতে চাইছি। যদি না নেবেন তাহলে কান ধরে বের করে দেবো ।

কি বললে, দেহ পসারিনী হয়ে এতো দেমাক ?

হ্যাঁ, তোমার বোন যদি এই পথে পা বাড়াতো তারও এরকম দেমাক হতো । কারণ আমরা বারবনিতা হতে পারি তবুও আমাদের সম্ভ্রম বোধ আছে। আপনি যে কত বড় সংক্রামক রোগ গ্রস্ত ব্যক্তি তা অজানা নয়। ভালো মানুষের মতো বেরিয়ে যান নতুবা গনেশকে ডেকে ঘাড় ধরে বের করে দেবো। 
লোকটা এক রোখা, কোন প্রকারে যেতে চাইছিলো না। গনেশকে ডেকে থাপ্পড় মারতে মারতে বের করে দিলাম।

যাবার সময় নানা অকথ্য ভাষায় গালি গালিগালাজ করছিলো। সে সুযোগ পেলে প্রতিশোধ নেবে ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছু ভাবছিলাম।

দেবীর ডাকে নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলাম। সে বলল, এর নাম অতীন, হাওড়াতে থাকে। আমার পিসীমার ছেলে। বড় ব্যবসা আছে, ভুরি ভুরি টাকার কারবার।

মনে মনে ভাবলাম অর্থের ভান্ডার পরিপূর্ণ বলে নিত্য নতুন পারিজাতের গন্ধ পেতে ভালোবাসে। এবং শরীরকে ব্যধির মন্দির করতে চায়।

ওর সাথে বেশী বাক্যালাপ না করে বাড়ীতে এসে উপস্থিত হলাম। স্নান সেরে মায়ের মন্দিরে এসে কর জোড়ে প্রার্থনা করলাম, মা আজ আর রেহাই নেই। আমার স্বরূপ উৎঘাটিত করে দেবার জন্য শয়তান উপস্থিত হয়েছে। আমার বিশ্বাস দেবীর বাবার কানে আমার কলঙ্কিত জীবনের পরিচয় দিয়ে আমার সুখের নীড়কে ধূলিসাৎ করবে। আমার আননে কাননে দাবানলে দহন এনে দেবে। এই লম্পটটা সহজে আমাকে রেহাই দেবে না। আমি কি করবো মা বলে দাও ।

আমার অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে দেখ মা, আমি কি কোন অপরাধ করেছি? হঠাৎ মনে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো এর জন্য চিন্তা করে কোন লাভ হবে না। দেবীর কাছে ঐ শয়তানটার চরিত্র প্রকাশ করলে ভয় কেটে যাবে।

কিন্তু দেবীকে বলার মতো কোন সুযোগই পেলাম না। দেবীদাস নিজ কর্তব্যে ব্যস্ত একবার সুযোগ পেয়ে দেবীকে কাছে ডেকে বললাম, দেবী তোমার সাথে আমার অত্যন্ত জরুরী কথা আছে।

দেবী বলল, বলো, তোমার জরুরী কথা কি ।

আমি গলা ঝাঁপিয়ে বললাম, তোমাকে পাঁচ মিনিট সময় বের করতে হবে এবং এই মুহুর্তে।

দেবী বলল, ঠিক আছে আমি সময় দিলাম।

তাহলে আমার সাথে শোবার ঘরে যেতে হবে। চলো। কয়েক পা এগোতেই করালী কাকু বাধা দিয় বলল, ছোটবাবুকে বিশেষ জরুরী দরকারে বড়বাবুর রুমে যেতে বললেন।

ঠিক আছে একটু পরে যাচ্ছি।

না এক্ষুনি যেতে হবে। দেরী করা চলবে না।

দেবী একটু পরে আসবে বলে করালী কাকুর সাথে বড় বাবুর রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমি স্থির হয়ে ওর গমন পানে তাকিয়ে রইলাম। চোখ ছাপিয়ে জল এলো। 
আর সুযোগ পাবো বলে আমার মনে হয় না। তাহলে-তাহলে দেবীকে মনের কথা বলবো কেমন করে, তাই বলা হলো না।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যে উত্তীর্ণ হলো। আমাদের বিরাট প্রাসাদে বিভিন্ন আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল। সকাল হতে সানাই এর সুরে গমগম করছিল। বাড়ীর প্রতিটি লোকের মনে আনন্দের জোয়ার। ধীরে ধীরে আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা আসতে শুরু করলেন। দেবী ও বাবা স্বয়ং প্রত্যেক অতিথিকে সম্মান করলেন।

দেবীও বাবার মনে আনন্দের শেষ নেই। শুধু আনন্দ নেই আমার। কেবল ঐ চিন্তা, যদি কোনরূপ অঘটন ঘটে তাহলে কি হবে। একবার ভেবেছিলাম ঐ শয়তানটার পায়ে ধরে ঝরঝর করে বলি আমার জীবনকে আর যেন কালো মেঘে ঢেকে না দেয়। অনেক নির্যাতন, যন্ত্রণা সহ্য করে একটুখানি আশ্রয় পেয়েছি, সুতরাং আমার করুন মুখপানে তাকিয়ে আমার জীবনকে মরুভূমির রুক্ষতায় পরিণত না করে।

না? ওকেও বলার কোন সুযোগ পেলাম না। অতিথিদের সামনে সাজগোছ করে দাঁড়াবার তাদের সাথে ইন্টারভিউ করার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। কিন্তু বাবার কথা কাটতে পারলাম না। বেদনাসিক্ত এবং চিন্তাশীল মন দিয়ে কোন প্রকারে অতিথিদের সামনে আসতে চাইছিলাম না। মনে সক্রিয় চেতনা, প্রফুল্লতার কোন আলোড়ন নেই যেখানে, সেখানে কিছুই ভালো লাগে না।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024