ক্লিওপেট্রার নাতি - প্রদীপ সেনগুপ্ত || Kliopetrar Nati - Pradip Sengupta || Short Story || ছোটগল্প
ক্লিওপেট্রার নাতি
প্রদীপ সেনগুপ্ত
তাকে দেখি রোজ, বাস স্ট্যান্ডের শেডের কোনে। নিজস্ব পরিপাটি সংসার। গুটি কয়েক ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, একটা ছেঁড়া মশারী।
লোকে ওকে দুরছাই করলেও
আমি ওকে বেশ পছন্দ করতাম।
ওকে দেখলে আমার মনে হত এক ক্লান্ত রাজ রমনী - বিশ্রাম নিচ্ছে প্রাসাদের অলিন্দে।
আমি ওর সম্পর্কে কিছু বললে ক্লিওপেট্রা বলেই উল্লেখ করতাম।
তাকে কখনই ভিক্ষা নিতে দেখি নি,
বরং, ওর দিকে ছুঁড়ে ফেলা পয়সা
নির্বিবাদে নিয়ে যেত কিছু ক্ষুদে ভিখারী,
ও কিন্তু কোন দিন ফুঁসে ওঠে নি,
কোন দিন অশ্লীল গালও দেয় নি তাদের উদ্দেশ্যে -বরং সম্রাজ্ঞীর মতই তাকিয়েছে এক বুক তৃপ্তি গায়ে মেখে ।
শুধু, একটা ব্যাপার খুব নাড়া দিত ,
পরণের কাপড়টা।
একদিন, বৌয়ের কাছ থেকে
একটা সিল্কের কাপড় নিয়ে এলাম।
ওর হাতে দিতেই এমন ভাবে তাকালো -
যেন, এ' কাপড় কোন সম্রাজ্ঞীর যোগ্যই নয়!
কিন্তু, পরদিন দেখি কাপড়টা মাঝখান থেকে কেটে দুই ভাগ করে একভাগ এক অদ্ভুত দক্ষতায় নিজের শরীরটাকে
আবৃত করেছে, অন্য অর্ধেক কোথাও হয় তো ফেলেই দিয়েছে, অপ্রয়োজনীয় মনে করে ! ও এখন আমাকে ওর কাছের জন বলেই মনে করে বোধহয় -
সে টা আমি ওর দৃষ্টি দেখেই বুঝি।
সেদিন সারাটা সকাল মেঘলাই ছিল, তবে বৃষ্টি আসার কোন ইংগীত ছিল না। বাড়ি ফেরার সময়ে হঠাৎই বিনা ইশারাতেই বৃষ্টি শুরু হল। দৌড়ে বাস স্ট্যান্ডেই দাঁড়ালাম। রোজকার মতই সে তার জায়গায় বসা, তবে বেশ বিচলিত । এক পুলিশ কর্মী দাঁড়িয়ে পুল ভ্যানের অপেক্ষায়। অধ্যাপক মিত্র বাসের জন্য আর দুটি ছেলে মেয়ে কলেজে যাবার জন্য। হঠাৎ খেয়াল হল সবার পিছনে একটি মেয়ে সামনে ঝুঁকে দুটো হাত শানের উপরে দুই দিকে প্রসারিত করে বসে আর ক্লিওপেট্রার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার উপর। বুঝতে কষ্ট হল না মেয়েটির পূর্ণ গর্ভাবস্থা।খেয়াল করলাম আমি আসার আগেই উপস্থিত সবাই ব্যাপারটা বুঝে গেছে। কিন্তু, এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় তারা তখনও অপেক্ষা করছে গন্তব্যে যাবার জন্য। হঠাৎই মেয়েটি প্রবল চিৎকার করে উঠল এবং সবাইকে চমকিত করে অনায়াসে আমার ক্লিওপেট্রা দ্বিধাহীন ভাবে এক টানে নিজের পরণে আমার দেওয়া শাড়ির অর্ধেক খুলে ওর সামনে দাঁড়িয়ে নিখুত ভাবে ঝুঁকে পড়ল মেয়েটি শরীরের নিচের দিকে। অসম্ভব ক্ষ্রিপ্ততায় কি যেন টেনে তুলল উপরের দিকে - দু'তিন সেকেণ্ডের মধ্যে সমস্ত স্ট্যান্ড মুখরিত হল এক নবজাতকের ক্ষীণ কান্নায়! চারিদিকের সবাই পরাজিত সৈনিকের মত দাঁড়িয়ে! শুধু সম্রাজ্ঞীর কণ্ঠস্বর সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। দুই হাতে রক্ত মাখা, অসম্ভব দৃঢ়তায় শূণ্যে শিশুটাকে নিয়ে চিৎকার করতে লাগল,
' আর ভয় নেই! রাজা এসে গেছে, আমার নাতি! তোমরা সবাই নেমে দাঁড়াও, জায়গা ছেড়ে দাও ওর ! '
এক হুঙ্কারেই যেন রাস্তায় নেমে দাঁড়াল প্রশাসন, নেমে দাঁড়াল শিক্ষা আর আধুনিক সমাজ!
সমস্ত সমাজের মুখে যে থাপ্পর এসে পড়ল -- তার জ্বালা ভুলতে বহু কাল লাগবে।
বাড়ি ফিরলাম মিষ্টি নিয়ে, গৃহিনীকে বললাম,
' নাও, মিষ্টি মুখ করো - ক্লিওপেট্রার নাতি হয়েছে। অনেক কাজ বেড়ে গেল আমাদের। '
Comments