পঞ্চুদার পুকুরে পল্টু পুরকাইত - তপন তরফদার || Ponchudar pukure poltu purkaite - Tapan Tarafdar || ছোটগল্প || Short Story
পঞ্চুদার পুকুরে পল্টু পুরকাইত
তপন তরফদার
ভূতের ভয় অনেকেই পায়না তা গর্ব করে বলতে পিছপাও হয়না। তারাই আবার একটু রাত করে কবরস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে আসার সময় মনে মনে সেই মন্ত্রটাই আওড়ায় “ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি, রাম লক্ষণ বুকে আছে করবে আমার কি।“ কবরস্থানের ভূতেরা রাম-লক্ষণের নাম শুনেনি। ওরা অন্য ধর্মকে মান্যতা কেন দেবে? অবশ্য এখনো প্রমাণিত হয়নি ভূতরা অন্য ধর্মকর্মে দীক্ষিত হতে পারে কি? ভূতে বিশ্বাস না করলেও সবাই জীবনে শয়নে অথবা স্বপনে ভূতের দেখা পেয়েছে।
এখনো সমাজে বেশ কিছু লোক আছে, যেমন পল্টু পুরাকাইত যারা ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে মাথা ঘামায় না। ভূত একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ অতীত বা সত্তা বুঝায়। আমাদের পল্টু বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত। পল্টু নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে। পল্টু এখানকার অম্বিকা জুট মিলের মেকানিক। যে কোনো মেশিনের গন্ডোগোল হলে পল্টু ছাড়া গতি নেই। ওকেই সারাই করতে হয়। পল্টু অচল মেশিনটা পরীক্ষা করার সময় প্রায়শই বলে, ভূতের মতো কাজ করলে মেশিন বিগড়ে যাবেই। এখানে লক্ষণীয় ভূতের মতো কথাটি বলে কি বোঝতে চাইছে তা কেউ বুঝতে পারেনা। ভুতরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে পারে, আবার ভূতেরা কোনো নিয়মকানুন না মেনে কাজ করে। এই মেশিন খারাপ কি কারণে হয়েছে, পল্টু কোনদিন খোলসা করে বলেনি। এই পল্টু যেমন মেশিন সারাতে ওস্তাদ তেমনি মাছ ধরতে ওস্তাদ। ছোটবেলার থেকেই জেঠার নেওটা হয়ে মাছ ধরতে যেত। কবে যে এই মাছ ধরার নেশা রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে বুঝতে পারেনি। বোঝা গেল হরেন জেঠা মরার পর। আগে মাছ ধরতে যেত জেঠার সেন র্যালে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে। এখন যায় জেঠার সাইকেলটাই চালিয়ে।
কলকাতায় পুরানো গাড়ি চলাচলের প্রদর্শনী হয়, যাকে “ভিন্টেজ র্যালি” বলা হয়, পুরস্কার দেওয়া হয়। যদি পুরানো সাইকেলের প্রদর্শনী রেস করা হয় আমারা নিশ্চিত পল্টুর সাইকেল পুরস্কৃত হবেই। নতুন সাইকেলের থেকেও পল্টুর সাইকেল ঝকঝকে। কোন ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ নেই। সাইকেলের পিছনের চাকায় ছোট্ট ডায়নামো লাগান আছে। প্রয়োজনে আলো জ্বালিয়ে নিতে পারে। নিজেই সব যন্ত্রপাতিতে সঠিক তেল দিয়ে যত্ন করে। হবেই না কেন। নিজে একজন দক্ষ মেকানিক, তার নিজের সাইকেল যদি ঠিক না থাকে লোকে মেকানিক বলে মান্যতা দেবে কি?
এখন একটা প্রশ্ন আমাদের পাড়ায় ঘোরা ফেরা করে পল্টু কোনটায় বেশি পারদর্শী মেকানিক না মৎসশিকারী। মাছ ধরার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়। টিকিট কেটে মাছ ধরতে গিয়ে সুদে মূলে উশুল করে আনে। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন জলাশয় থেকে মাছ ধরে আনাই এখন মুখ্য নেশা। জুট মিলের ম্যানেজার সত্য কিঙ্কর সাহেব পল্টুকে বলে বামনগাছিতে সাহেবদের বানানো আদ্যিকালের পোড়ো নীলকুঠি আছে। চারদিক ঘেরা নীলকুঠির পিছনে বিরাট এক পুকুর আছে যাকে সরোবর ও বলা যেতে পারে। পুকুরে অনেক মাছ আছে জানা সত্বেও ভয়ে কেউ মাছ ধরেনা। পুকুরে ভূত আছে বলে মাছ ধরতে কেউ যায়না। পল্টু বলে এত ভূতের খারাপ করে দেওয়া মেশিন ঠিক করছি ওই ভূতদের ও ঠিক করে দেব।
পল্টু যে পাক্কা মৎস শিকারি তা সবাই স্বীকার করে। পল্টু তার খেল দেখিয়ে ধুরন্ধর মাছদের খেলিয়ে খেলিয়ে কেরামতি দেখিয়ে মাছকে বশে এনে ধরতে ভালোবাসে। বেশ কয়েক মাস ওই ত্যাঁদোড় বুদ্ধিমান মাছের সঙ্গে মোলাকাত হয়নি। পল্টু চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাছ ধরতে গেল একাই। সঙ্গে কেউ নেই। পল্টুর উপরে বিশ্বাস রাখা যায়, ও বাজার থেকে মাছ কিনে দাবি করবেনা এই মাছটা আমি ধরেছি।
মোরম দেওয়া রাস্তা কাঠের গেটে এসে শেষ হয়েছে। দুপাল্লার গেট। গেটে সাইকেলের লোহার চেন দিয়ে বাঁধা। ফাঁস দেওয়া চেনে পিতলের তালা লাগানো। গেট থেকেই দেখা যাচ্ছে জীর্ণ দেওয়ালের পাশেই দর্মার ছোট্ট ঘর। এই ঘরেই থাকে পঞ্চু। পঞ্চুর বয়সের গাছ পাথর নেই। পঞ্চুর গড়ন চিনাম্যানদের মত হলদেটে। উচ্চতা মেরে কেটে সাড়ে চার ফুট। মার্বেল গুলির মত কুতকুতে চোখ। নাক নেই বললেও চলে। গলার আওয়াজ কাকের মত। পঞ্চুরা কয়েক পুরুষ ধরে এইখানেই সেবা করে আসছে। শোনা যায় পঞ্চুর প্রপিতামহ কোনো এক সাহেবর খানসামা হয়ে সপরিবারে বার্মা থেকে এখানে এসেছিল। পঞ্চুর প্রকৃত নাম ছিল ওয়াঁচু পাবলিক নাম দিয়েছে পঞ্চু।
পল্টু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকে, কি বলে ডাকবে। একটু সময় নিয়ে ডাকতে শুরু করলো- পঞ্চুদা, পঞ্চুদা। একটা চাবিকাঠি হাতে নিয়ে থপ থপ করে পঞ্চুদা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দিয়ে আপাদমস্তক ছানবিন করে বাজখাঁই কর্কশ গলায় বললো, মছলি পাকড়াতে এসেছেন। ঢুকে পড়ুন আমি গেটে তালা লাগাবো। পল্টু ঢুকতেই তালায় চাবি দিয়ে বলে, হুঁশিয়ার হয়ে মছলি পাকড়াবে। কথাটা ঠিক কাক যেমন কা কা করে সাবধান করে দেয়, সেই রকমই শোনালো। পল্টুদা একটা এঁটো হাসি হেসে সাইকেলকে সঙ্গী করে পায়ে চলার রাস্তা ধরে হেঁটেই এগিয়ে যায়। এগাতে এগাতে ঝোপের মাঝে দেখে ইটালিয়ান মার্বেলের তৈরি এক পরির ডানদিকের ডানাটা কাটা, হেলে রয়েছে বেলগাছের গায়ে। বাগানের পথ দিয়ে এঁকে বেঁকে চলতে চলতে আরও ভগ্ন পরিদের দেখা পেল। গাদাগাদি করা ঝরাপাতারা মাটিতে শুয়ে থাকার ফলে মাটি দেখা যাচ্ছেনা। পাতার পাচার তীব্র উৎকট গন্ধ। সব বড়গাছকে জড়িয়ে রয়েছে পরগাছা এককালের সাজানো বাগান এখন জঙ্গল। যত্ন না করলে মানুষকে অমানুষিক দেখায়, সেই রকমই সাজানো বাগান জঙ্গলে পরিনত হয়। চারিদিকে ভুতুড়ে পরিবেশ। ভূতদের সংসার পাতার উপযুক্ত জায়গা। ভুতদের দেখা না পেলেও নানান রকমের পাখির দেখা গেল। তারা শিস দিয়ে পল্টুকে আহ্বান করছে না সাবধান করছে বোঝা গেলনা। দুর্বঘাষ পিশে পিশে পায়ে চলার রাস্তা। ওই রাষ্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পারে পৌঁছল পল্টু। পুকুরটা একসময়ে সৌখিন পুকুর ছিল। আগেকার দিনে ধনীরা নদীতে ভাসমান বজরায় স্ফুর্তীর ফোয়ারা বসাতো। আবার অনেকেই এই পুকুরকে সাজিয়ে গুজিয়ে পুকুরের ধারেই নন্দন কাননের আসর বসাতো। পুকুরের ধারে বাঁধানো ঘাট এখন ভাঙা চোরা হয়ে পড়ে আছে। আশ্চর্য জনক ভাবে ঘাটের দুদিকের লাল সিমেন্ট বাঁধানো বেঞ্চি অটুট আছে। মাঝখানে ধ্বসে গেছে। মনে হচ্ছে ভূমিকম্পের ফলে ধ্বসে গেছে। ইটের সিঁড়ি ধাপে ধাপে জলের গভীরে নেমে গেছে।
পুকুরের চারিধারেই প্রাচীন গাছেরা গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো বড়ো গাছের পাতার ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো কয়েকটি জায়গায় গোল ফোকাস হয়ে পড়ছে। পুকুরের মাঝখানের জল ঘন সবুজ ঝাঁজি জমে আরও জমাট সবুজের সমারোহ। পুকুরের নৈঋত কোনে এক আশ্যাওড়া গাছের ডাল পুকুরের জলকে ছুঁয়ে রয়েছে। রোদের দাপটে জল থেকে এক ভাপ উঠছে। পুকুরে গাছের পাতার ছায়া নড়ছে শিরশির করে আওয়াজ উঠলো
Comments