দিদিমণি - দেবাংশু সরকার || DidiMoni - Debangsu Sarkar || মুক্ত গদ্য || রম্যরচনা || Rommo rochona

       দিদিমণি

              দেবাংশু সরকার





     কয়েক বছর হলো শ্যামা সুন্দরী বালিকা বিদ্যালয় বেশ সুনাম অর্জন করেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে বেশ ভাল ফল করেছে স্কুলের ছাত্রীরা। বড় দিদিমণি কমলিকা রায়ের কঠোর পরিশ্রমের জন্যই এই সাফল্য এসেছে। কমলিকা রায়ের বড় দিদিমণি হওয়ার আগে স্কুলটা যথেষ্ট এলোমেলো ছিল। পড়াশোনা একেবারেই হত না। বিভিন্ন পরীক্ষার ফল হত বেশ খারাপ। দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছিল স্কুলটার। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের এই স্কুলে পাঠাতে চাইতেন না। ক্রমশ ছাত্রী সংখ্যা কমতে শুরু করেছিল।


      ঠিক এই সময় এক সঙ্গে কয়েকজন দিদিমণি অবসর গ্রহণ করলেন। তাদের জায়গা নিলেন কয়েকজন কমবয়সী দিদিমণি। প্রমোশন পেয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন বড় দিদিমণি কমলিকা রায়।


      প্রথম জীবনটা কমলিকার বেশ কষ্টে কেটেছিল। বিধবা মায়ের সামান্য পেনশনের টাকায় সংসার চলতো না। পিতৃহীনা কমলিকা ছাত্রাবস্থাতেই প্রচুর টিউশনি করে নিজের এবং তার ভাইয়ের পড়ার খরচ চালাতেন। সেই সঙ্গে সংসার খরচের অনেকটা সামাল দিতেন। এইভাবে লড়াই করতে করতে কলেজ, ইউনিভার্সিটির গন্ডি টপকানোর কিছুদিন পরে স্কুলের চাকরি পেতে হাল ফেরে তাদের সংসারের। তার একমাত্র ভাইকে বি টেক পড়ার জন্য পাঠান বেঙ্গালুরুতে। বি টেক পড়ার পর তার ভাই বেঙ্গালুরুতে একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়ে সেখানেই থেকে যায়। বিয়েও করে বেঙ্গালুরুতে। কমলিকা কলকাতায় থেকে যান তার মাকে নিয়ে। এরমধ্যে তার ভাইয়ের বউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায়, তাকে দেখাশোনার জন্য তার মা বেঙ্গালুরুতে যেতে বাধ্য হলেন। এবার কমলিকা পুরোপুরি একা হয়ে পড়েন।


      এরপর বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। সাধারণ শিক্ষিকা থেকে প্রধান শিক্ষিকা পদে উন্নীত হয়েছেন কমলিকা। বেড়েছে দায়িত্ব। আরো ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। স্কুলের দায়িত্বভারের প্রভাবে হাসিখুশি কমলিকা দিদিমণি ক্রমশ গুরু গম্ভীর বড়দিতে পরিনত হন। স্কুলের পাহাড় প্রমাণ দায়িত্ব সামলাতে সামলাতে সম্ভবত নিজের কথা, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভুলে গিয়েছিলেন। সময় এগিয়ে চলে, বয়স বেড়ে চলে। এবার তিনি কর্মজীবন থেকে অবসরের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন।


      প্রায় ত্রিশ বছরের কর্মজীবন শেষে আজ অবসর নিতে চলেছেন বড়দি। ছেদ পড়তে চলেছে তার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের। আজ স্কুলের হল ঘরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার ফেয়ার ওয়েল অনুষ্ঠান। নিজের ফেয়ার ওয়েল অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন বড়দি। মাউথ পিস হাতে নিয়েছেন কথা বলার জন্য। কিন্ত কথা বলতে পারছেন না। গলা ধরে আসছে। চোখের কোন চিকচিক করছে। একটু থমকালেন, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। যেন নিজেকে বোঝালেন - আজ চোখের জলের দিন নয়। আজ মন খারাপ করার দিন নয়। আজ হাসির দিন। আজ মজা করার দিন। ক্ষনিকের জড়তা কাটিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, "আজ আমি কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে অন্য জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে চলেছি। অর্থাৎ বিয়ে করতে চলেছি। গতকাল উকিলকে নোটিশ দিয়েছি। আজ সন্ধ্যায় সই করবো। যাকে বিয়ে করছি, তার সঙ্গে আমার পঁচিশ বছর বয়সের তফাৎ।"


      ইংরাজির দিদিমণি পারমিতা অবাক হয়ে বললেন, "তার মানে আমাদের জামাই বাবুর বয়স এখন ষাট প্লাস পঁচিশ মানে পঁচাশি বছর!"


      - "দুর বোকা, আমি কি বলেছি আমার থেকে পঁচিশ বছরের বড়? আমি বলেছি বয়সের তফাৎ। এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ বছর। এবার দেখবি আমার মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসছে। আর আগের সেই খিটখিটে, বদমেজাজি বড়দিকে তোরা খুঁজে পাবি না। এবার থেকে দেখবি আমি অলওয়েজ দাঁত ক্যালাচ্ছি।"


      বড়দির মুখের ভাষা শুনে হকচকিয়ে যান অন্যান্য দিদিনণিরা।


      একটু থেমে আবার বলতে থাকেন বড়দি, "এক্ষুনি তোদের আলাপ করাচ্ছি ত্যানার সঙ্গে।" কথা থামিয়ে, ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কারো সাথে কথা বললেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক অতি শীর্ণকায় অবয়ব স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে, পুর্ব নির্দেশিত হল ঘরে এসে বড়দির পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন।


      বড়দি অন্যান্য দিদিমণিদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, "এই হলো আমার পাঁচু ডার্লিং। এর অবশ্য একটা ভাল নাম আছে, পঙ্কজ। তবে আমি ভালোবেসে পাঁচু বলেই ডাকি। পাঁচুও একজন টিচার। তবে পড়াশোনার নয়। ও একজন গানের মাস্টার। জীবনের অর্ধেকটা গান গেয়ে আর আমার সঙ্গে লাইন মেরে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন বিয়ে করার শখ জেগেছে।"


      পাঁচুকে দেখে অবাক হয়ে যান পারমিতা, বলেন, "একেতো আগেও দেখেছি স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমাকে দেখতো। আমি ভাবতাম হয়তো আমাকে...।"


      পারমিতাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে হিন্দির দিদিমণি গায়ত্রী বলেন, "হাঁ, হাঁ, হামিভি দেখেছে ইনকো স্কুলের গেটের বগলমে। লেড়কা থোড়া দুবলা হ্যায়। লেকিন চিকনা ভি হ্যায়। হামি শোচতাম হামাকে লাইক করছে। একদিন জরুর হামাকে প্রপোজ করেঙ্গে। লেকিন দিন গায়ে, মাহিনা গায়ে, বরষো গায়ে, ও লেড়কা বিলকুল পাত্থরকে ত্বরা খামোস থা। ইসকে বাদ হামার শাদী হলো, হানিমুন হলো, বাচ্চা ভি পয়দা হলো। উসকে বাদ ভি হামি দেখলাম ও লেড়কা স্কুলের বাহার ইন্তেজার কর রাহাথা! হামি বিলকুল পরিশান হোগায়িথি। সমজমে নেহি আরাহিথি ও লেড়কা আখের কেয়া চাহেতেথে! আভ সামঝি ও হররোজ কিসকে লিয়ে স্কুলকে বাহার ইন্তেজার কর রাহাথা।"


      পারমিতা বলেন, "আমিও তাই ভেবেছিলাম। এই ছেলেটা মনে হয় আমাকে দেখছে। প্রথম প্রথম অনেক কিছু ভাবতাম। পরে আর গুরুত্ব দিতাম না। এখন বুঝতে পারছি উনি বড় গাছে আঁকশি দিয়েছেন।"


      - "থাম থাম। এবার থাম তোরা। বেশ বুঝতে পারছি তোরা বিলকুল ঘাবড়ে গেছিস।" আবার বলতে থাকেন বড়দি, "তোদের নাকের ডগায় আমি দশ বছর ধরে লাইন মারছি, তোরা টের পেলি না। এইজন্য আমি বড়দি, আর তোরা ছোটো। মা বেঙ্গালুরুতে চলে যাওয়ার পর একদম একা হয়ে গেলাম। স্কুল ছুটির পর আর সময় কাটতো না। এভাবে দিনের পর দিন থাকা যায় না। নিঃসঙ্গ জীবন যে কি কষ্টের তোদের বোঝাতে পারবো না। সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। একদিন স্কুলে আসার পথে পাঁচুর সঙ্গে চোখাচুখি হয়ে গেল। পাঁচু তখন পঁচিশ বছরের কাঁচা আম হলে কি হবে, আমি তখন পঞ্চাশের পাকা ঢ্যাঁড়শ। বেশ বুঝতে পারলাম আমার চাঁদ পানা মুখটা দেখে ওর শরীরের কোনো কোনো অর্গান অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে দিয়েছে। বুঝতে পেরেই দিলাম আগুনে ঘি ঢেলে, চটাস পটাস করে...।"


      - "সেকি বড়দি তুমিতো তোমার ছাত্রীদেরও মারধর করো না। আর একজন স্রেফ তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে তুমি তাকে পিটিয়ে দিলে!" পারমিতা বলতে থাকেন, "এটা একদম ঠিক হয়নি।"


      - "দুর বোকা পেটাবো কেন? প্রেম ভালোবাসাতে আবার পেটাপেটি, মারামারি চলে?" হাসতে হাসতে বড়দি বলতে থাকেন, "তোরা কি তোদের লক্কা পায়রাগুলোকে কথায় কথায় পেটাস?"


      পারমিতা মৃদু প্রতিবাদ করে বলেন, "না বড়দি, আমাদের ওরকম কেউ নেই। আমরা সব ভালো মেয়ে।"


      - "এই চপ।" ধমকে ওঠেন বড়দি, "আর যদি মিথ্যে কথা বলিস আবার আগের মত রাগী হয়ে যাবো। জানি জানি সব জানি। স্কুল ছুটির পর তোরা কে কোন পার্কে, কোন গাছের তলায়, কোন ঝোপের আড়ালে বসে কার সঙ্গে প্রেম গ্রন্থ পাঠ করিস সব জানি আমি। সব খবর আছে আমার কাছে। এবার শোন চটাস পটাসের রহস্য। যখন দেখলাম পাঁচু আমাকে দেখে বেসামাল হয়ে গেছে। শূণ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর পায়ে পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, দিলাম চটাস পটাস করে কয়েকবার চোখ মেরে। ব্যস কেল্লা ফলে, পাঁচু আমার হাতে। তারপর মজাই মজা। স্কুলের ছুটির পর উড়ে বেড়াতে লাগলাম পাঁচুর সঙ্গে। সারা সন্ধ্যা আমার সঙ্গে কাটিয়েও মন ভরতো না পাঁচু বাবুর। আমাকে দেখার জন্য সকাল বেলাতেই হাজির হত স্কুলের গেটে।"


      বড়দির প্রেম কাহিনী শুনে সাহিত্যের দিদিমণি কবিরাণী ছন্দ মিলিয়ে বলে ওঠেন,


      "এই বয়সে প্রেম!

       নিন্দুকে কয় সেম।"


      আমাদের বড়দি কোনো অংশে কম নন কারো থেকে। তিনিও দিলেন ছন্দ মিলিয়ে,


      "তুইও নে অ্যাটেম,

       দেখ কি মজার গেম।"


      অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর পাঁচু বললেন, "আপনাদের বড়দির সঙ্গে আমি দশ বছর ধরে কেবল প্রেম করিনি। আপনাদের বড়দি আমাকে জীবন যুদ্ধের অনেক পাঠ পড়িয়েছেন। সেই সব পাঠ পড়ে আমি পিজন হার্টেড পাঁচু থেকে লায়ন হার্টেড পঙ্কজে পরিনত হয়ে এই ভয়ঙ্কর ভিসিশন নিয়েছি। বিয়ে করার ডিসিশন।"


      পারমিতা পাঁচুর উদ্দেশ্যে বললেন, "আমি যদি ছেলে হতাম, কবে আমাদের সুন্দরী বড়দিকে বিয়ে করে নার্সিংহোমের ভাত খাইয়ে দিতাম। আপনি বলে এতদিন ধরে বসে ছিলেন।"


     বিস্মিত পাঁচুর পাল্টা প্রশ্ন, "ধরে বসেছিলাম! কি ধরে বসেছিলাম?"


      একটু বিরক্ত হন পারমিতা, "কি আবার ধৈর্য।"


     - "আমার পাঁচু ডার্লিং" বড়দি প্রায় জড়িয়ে ধরেছেন পাঁচুকে। বলছেন, "গত দশ বছর ধরে বেচারা পাঁচু ফিল্ডিং করে গেছে। আজ থেকে ব্যাট করার সুযোগ পাবে। দেখা যাক কত রান করতে পারে!"


      অকপটে নিজের মনের কথা বলে চলেছেন বড়দি। বড়দির বলা কথাগুলো যে যার মত করে ভেবে চলেছেন, অন্যান্য দিদিমণিরা। ভাবতে ভাবতে দিদিমণিদের ফর্সা মুখগুলো ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে।


      কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বড়দি বলে চলেছেন, "সারারাত ধরে ব্যাট করবে পাঁচু। সেকি কম ধকলের কাজ! ব্যাট করতে করতে কখনো ডানদিকে হেলবে, কখনো বাঁয়ে হেলবে, কখনো চিৎ হয়ে যাবে, কখনো কাৎ হয়ে যাবে, কখনো উপুড় হয়ে যাবে। সারারাত ধরে কসরত করবে। খাট জুড়ে লাফালাফি, দাপাদাপি করবে। এসব এক রাতের ব্যাপার নয়। রাতের পর রাত এসব করতে হবে। ধকল নিতে হবে। ধকল নেওয়ার জন্য দরকার শক্তপোক্ত শরীর। সেইজন্য পাঁচু সকালে বিকালে শরীর চর্চা শুরু করেছে। রোজ সকালে ত্রিশ কিলোমিটার দৌড়চ্ছে। বিকালে জিমে গিয়ে তিনশো পাউন্ডের বারবেল তুলছে। তারপর জিম থেকে বাড়ি ফিরে তিন হাজার করে ডন বৈঠক দিচ্ছে। আমি পাঁচুর ডায়েট চার্ট পাল্টে দিয়েছি। আজ সকালে পাঁচু কি খেয়েছে জানিস? ব্রেকফাস্ট করেছে ছটা কলা, ছটা ডিম, আর ছয় গ্লাস দুধ দিয়ে। দশটার সময়ে খেয়েছে ছয় গ্লাস হেল্থ ড্রিঙ্ক। লাঞ্চে খেয়েছে...।" 


      বড়দির কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে যান দিদিমণিরা। কবিরাণী কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করতে থাকেন, "বড়দিগো, কোন ছারপোকাতে তোমাকে কামড়ালোগো? তুমি কি করে এই বয়সে এতটা বিগড়ে গেলেগো? তোমার ছাত্রীরাও এতটা ত্যাঁদড়ামো করেনাগো, যা তুমি এখন শুরু করছোগো।..."


      কারো কথায় কান না দিয়ে বড়দি বলে চলেছেন, "বিয়েতো কেবল আমার একার হচ্ছে না, পাঁচুরও হচ্ছে। তাই পাঁচুর জন্য একটা গিফ্ট কিনেছি। কয়েক দিন আগেই কিনেছিলাম, কিন্ত বিয়ের আগেতো কাজে লাগবে না তাই দিইনি। অবশ্য এসব পার্সোনাল কথা কেউ কাউকে বলে না। বিয়ের পর পাঁচু রাত জেগে বিছানায় কি করবে সে সব কথা অন্য কাউকে বলা যায় না। কিন্ত তোদের ব্যাপারটা আলাদা, তোদের কাছে কোনোদিন কোনো কিছু গোপন করিনি, আজও করবো না।" একটু থামলেন, বেশ বড় একটা গিফ্ট প্যাক বের করে মিষ্টি সুরে, আদুরে গলায় অনুমতি নেওয়ার ভঙ্গিতে পাঁচুকে বললেন, "ওদের দেখাই?"


      হতভম্ব পাঁচুর মুখ থেকে অস্ফুটে 'হুঁ' বা 'উঁ' জাতীয় একটা শব্দ নির্গত হলো। গিফ্ট প্যাক দেখে দিদিমণিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, 


      - "কি আছে বলতো?"


      - "বলছেতো বিয়ের পর কাজে লাগবে। তারমানে ঐসব...। দেখিস না টিভিতে বিজ্ঞাপন দেয়।"


      - "কিন্ত সেতো ছোটো প্যাকেট হয়।"


      - "মনে হয় সস্তায় পেয়ে অনেকগুলো কিনেছে। মনে হয় এক বছরের জন্য কিনেছে।"


      - "বড়দি এটা পারলো! এই বয়সে দোকানে গিয়ে প্রকাশ্যে এসব কিনতে পারলো! একটুও লজ্জা করলো না!"


      - "না রে ওসব লজ্জা ঘেন্না আর বড়দির মধ্যে নেই। আমাদের বড়দি আর এই জগতের প্রাণী নয়। মনে হচ্ছে কোনো ভিন গ্রহের এলিয়েন হয়ে গেছে।"


      - "আমারতো প্রেতাত্মা মনে হচ্ছে। যখন হিঁ হিঁ করে হাসছে, মনে হচ্ছে একটা শাঁকচুন্নি। ওসব আমি দেখতে পারবো না। আমি চোখ বন্ধ করলাম।"


      - "আমিও চোখ বন্ধ করলাম।"


      আবার বড়দির গলা শোনা গেল, "এই দ্যাখ, চোখ খুলে দ্যাখ সবাই।" আস্তে আস্তে চোখ খুললেন দিদিমণিরা। দেখলেন একমুখ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বড়দি। মা কালীর খাঁড়ার মত উঁচু করে ধরে আছেন একটা মসকুইটো ব্যাট। বলছেন, "দ্যাখ দ্যাখ, ভাল করে দ্যাখ, এই ব্যাট দিয়ে পাঁচু বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের রেকর্ড ভাঙবে। আসলে হয়েছে কি আমাদের এলাকায় ভীষণ মশার উৎপাত। রাতে ঘুমোতে দেয় না। আজ থেকে সারারাত পাঁচু ব্যাট হাতে মশা মারবে, আর আমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোবো।"


      কথা বলতে বলতে বড়দি খেয়াল করলেন আশেপাশে পাঁচু নেই। এদিকে ওদিকে তাকাতে তাকাতে পাঁচুকে আবিষ্কার করলেন একটা টেবিলের নিচে। সম্ভবত কোনো আপত্তিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য পাঁচু আত্মগোপন করেছেন টেবিলের নিচে। পাঁচুর শীর্ণ কোমর এবং কোমর বন্ধনী এক সঙ্গে ধরে টেবিলের তলা থেকে তাকে টেনে বের করে আনলেন বড়দি। দাঁড় করিয়ে দিলেন নিজের পাশে। আহা কি সুন্দর লাগছে দুজনকে , ঠিক যেন স্বর্ণবর্ণা রাধারাণীর পাশে নব দুর্বাদলশ্যাম। 


      আচমকাই কেঁদে উঠলেন কবিরাণী, "বড়দি তুমি যতই ইয়ার্কি কর, আমার একদম ভালো লাগছে না। কাল থেকে তোমাকে দেখতে পাবো না!"


     বড়দি বললেন, "দুর পাগলি, দেখতে পাবি না মানে? খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের একটা বড় রিসেপশন হবে। সব দায়িত্ব তোদের। তারপর হানিমুন। একবার হানিমুনে যেতে দে, তারপর দেখবি তোদের বড়দি কি করতে পারে! তারপরতো পরপর অনুষ্ঠান। সাদ ভোক্ষন, ষষ্ঠী পুজো, অন্নপ্রাশন। ছেলে হলে উপনয়ন, আর মেয়ে হলেতো কথাই নেই, তোদের হাতে তুলে দেবো। মানুষ করার পুরো দায়িত্ব তোদের। আর তুই ভাবছিস আর দেখা হবে না!"


      - "ইস উমর মে ভি বাচ্চা পয়দা করনেকি উম্মীদ! বহুৎ জান হ্যায়। বহুল জোসীলে হ্যায় হামারি বড়দি।" বলে ওঠেন গায়ত্রী। 


      - "লেকিন জোস অউর জবানীমে থোড়ি ফারাক হ্যায় এতো খ্যাল কর মেরি নানী।" বলেন পারমিতা।


      - "ফিরভি বহুৎ জোস হ্যায়।" কথা বলতে বলতে গুনগুনিয়ে ওঠেন গায়ত্রী,


      "ইতনি শক্তি হামে দেনা দাতা,

       মনকা বিশওয়াশ কমজোর হোনা।"


      "ওরে গায়ত্রী, তুই জানিস না তোদের বড়দি কত বড় খেলোয়াড়! অপেক্ষা কর একদিন দেখতে পাবি তোদের বড়দি পুরানো হয়ে যাওয়া স্পিনের পিচেও ব্যাট করতে পারে। সেঞ্চুরি করতে পারে।" বললেন বড়দি।


      আনপ্রেডিক্টেবেল বড়দির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সম্ভাব্য কোনো অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য পাঁচু বলে ওঠেন, "অনেক কথা হলো। বলার মত আর কোনো কথা অবশিষ্ট নেই। এবার যদি বলতে হয় গানে গানে বলতে হবে।"


      সঙ্গে সঙ্গে গান শোনানোর জন্য সমবেত অনুরোধ এবং দাবি ওঠে। সেই দাবি মেনে গান ধরলেন পাঁচু,


      "সুনীল সাগরের, শ্যামল কিনারে,

      দেখেছি পথে যেতে, তুলনাহীনারে..."


     চমৎকার গানের গলা পাঁচু মাস্টারের। মন্ত্র মুগ্ধের মত গান শুনছেন দিদিমণিরা। উদাত্ত কন্ঠে গেয়ে চলেছেন গানের মাস্টার পাঁচু,


      "...চকিতে ক্ষণে ক্ষণে পাবো যে তাহাকে,

           ইবনে কেদারায় বেহাগে বাহারে..."


      হবু বরের গান শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বড়দি। আবেগের স্রোতে ভাসতে ভাসতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। দু হাত শূন্যে তুলে গেয়ে ওঠেন,


      "ভালো লেগেছিল তাই, মেরেছে ঝাড়ি তারে

       সুনীল সাগরের, শ্যামল কিনারে..."


      দিদিমণিরা ভাবছেন বড়দিকে কি আর গান গাইতে দেওয়া ঠিক হবে? নাকি জোরে হাততালি দিয়ে থামানোর চেষ্টা করা হবে?


      তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়লো হল ঘর। গান বাজনা থামলো। এবার ফেরার পালা। হল ঘর থেকে বের হতে হতে বড়দি ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, "আমি তোদের থেকে অনেক পাকা প্লেয়ার। তাই পুরানো হয়ে যাওয়া স্পিনের পিচেও ব্যাট করতে পারবো। কিন্ত তোরাতো কাঁচা প্লেয়ার, তাই বলছি, পিচ ভালো থাকতে থাকতে যতটা পারবি রান করে নিবি। অকারণে দেরি করবি না। অকারণে দেরি করলে ভুল হয়ে যায় রে, খুব ভুল হয়ে যায়!" কথা শেষ করেই বড়দি পাঁচু মাস্টারের হাত ধরে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।


      বড়দি কি সত্যিই পাল্টে গেলেন? গুরু গম্ভীর বড়দি কি কর্মজীবনের শেষ দিনটা নিছক মজা করে কাটালেন? নাকি জীবনে অনেক কিছু না পাওয়ার অব্যক্ত যন্ত্রণাটাকে হাসি, মজা, বেসুরো গান দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা করলেন? ঠিক বোঝা গেল না!


                         

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024