অবলাদের কথা - লিসা মাঝি || Obolader Kotha - Lisha majhi || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

             অবলাদের কথা

                        লিসা মাঝি 



দিনটা ছিল লক্ষ্মীবার অর্থাৎ বৃহস্পতিবার। তখন সবে একটা-দুটো করে তারারা আকাশের বুকে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে, নানানরঙের আবির তখনও চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, বসন্তের ঝিরিঝিরি হাওয়ার সাথে মাথা দোলাচ্ছে শিমুল, পলাশ, কামিনী, ও চম্পা। পাখিরাও সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে খাবার সংগ্রহ করে বাসায় ফিরছে। আস্তে আস্তে চাঁদ পৃথিবীর বুকে তার সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিচ্ছে, মেয়ে-বউরা তুলসি তলায় প্রদীপ দিয়ে শঙ্খধ্বনি করছে।  


এমন সময় মিত্র পরিবারের বড় কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র, বংশের কুলদেবী লক্ষ্মীর কাছে প্রার্থনা করছেন।


-মা মাগো তুই তো আমায় সব দিয়েছিস, তোর দয়ায় আজ বাড়ি-গাড়ি, ধন-সম্পত্তি কোনো কিছুর অভাব নেই, শুধু আমার নাতির অভাব ছিল, কিন্তু আজ দশ বছর পর অবশেষে তুই মুখ তুলে চেয়েছিস, আমার একমাত্র ছেলে কালী কিঙ্করের সন্তান আজ ভূমিষ্ঠ হতে চলেছে, মা আশীর্বাদ কর আমার যেন নাতিই হয়। 


জানিনা ঠিক, মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নাকি অতিরিক্ত আশীর্বাদে মিত্র পরিবারে ভূমিষ্ঠ হলো এক কন্যা সন্তান, মূহুর্তের মধ্যে মিত্র বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন সেই বাড়ির বড়ো কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র। না স্বয়ং বিধাতা পুরুষের ভাগ্যলিখনের জন্য ছয়দিন আর অপেক্ষা করতে হয়নি বোধকরি সেইক্ষণেই নবজাতিকার ভাগ্যলিখনের কাজ নিজ হস্তে তুলে নিয়েছিলেন মিত্র বাড়ির বড়ো কর্তা। অতঃপর সেই সদ্য প্রস্ফুটিত নবজাতিকার স্থান হয়েছিল বাড়ির এক কোণে।

 চারবছর পর বড় কর্তা নিজে সারা বাড়ি আলো দিয়ে সাজিয়ে তুললেন, এইবার মিত্র বংশে জন্ম নিল পুত্র সন্তান। আমরা যেমনভাবে গোলাপ-জুঁই খুব যত্ন করে বাগানে এনে বসাই, পরিচর্যা করি, ঠিক তেমনভাবেই বড় হতে শুরু করলো শিব কিঙ্করের একমাত্র নাতি কমল কিঙ্কর। আর অনাদর অবহেলা সত্ত্বেও বাগানে যেমনভাবে নাম না জানা গাছ বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমনভাবেই ধীরে ধীরে কমলিনী বড় হতে শুরু করলো। কমলিনী মানে পদ্ম, অবশ্যই পঙ্কিলে পদ্ম। তবে কমলিনীর মা সাধ করে নাকি বুড়ো কর্তার উপর বিদ্রুপ করে মেয়ের নাম কমলিনী রেখেছিলেন তা কিন্তু জানা যায় না। দাদু-ঠাকুমা, মা-বাবা আর ভাই এই হল কমলিনীর পরিবার। তবে ওই বাড়িতে কমলিনীর মা ছাড়া কমলিনীকে আর কেউ ভালোবাসে না, আর তাই তার যত আবদার সব শুধু তার মায়ের কাছেই।


ছোট্টো কমলিনী গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো।


-মা সবাই তো স্কুলে যাচ্ছে, আমি কি স্কুলে ভর্তি হবো না? আমি তো সব পারি অ আ, নামতা।

-হ্যাঁ কমু, তুই স্কুলে যাবি আমি তোকে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দেবো, আমি আজই তোর বাবার সাথে কথা বলবো। 


পান চিবোতে চিবোতে বড় গিন্নির প্রবেশ


-বলি মা-মেয়ে মিলে কি এতো কতা হচ্ছে শুনি?

-মা আসলে কুমুকে স্কুলে ভর্তি করার কথাই বলছিলাম।

-অ, তা ভালো। তবে মেয়েমানুষ নেকাপড়া শিকলেও

 তো আর ব্যাটাছেলে হবে নিকো।

-মা এখন সবারই একটু লেখাপড়া শেখা উচিত।

-অ..তাহলে যা ভালো বোঝো তাই করো। 


(দশদিন পর) 

আজকের দিনটা কমলিনীর কাছে খুব আনন্দের, কারণ আজ কমলিনী প্রথম স্কুলে যাবে। অন্য সব বাচ্চারা যেখানে স্কুল যেতে হবে বলে কাঁদে, সেখানে কমলিনী কখন স্কুলে যাবে, আর স্কুলে গিয়ে কি কি করবে, তা ভাবতে ভাবতেই রাত্রকালীন নিদ্রাসম্পন্ন করে আজ ভোর ভোর উঠে পড়েছে। 


-কমু শোন স্কুলে কিন্তু একদম লক্ষ্মী হয়ে থাকবি, সব পড়াশুনবি মন দিয়ে, স্যার-ম্যাম যা যা বলবেন তাই করবি, দুষ্টুমি করবি না। 

-আচ্ছা মা আমি মন দিয়ে সব পড়া করবো, একটুও দুষ্টুমি করবো না দেখো। 


কমলিনীর মা কমলিনীকে কোলে বসিয়ে চুমু খেয়ে বললেন--


-এইজন্যই তো বলি কমু আমার লক্ষ্মী মেয়ে। চল তোকে স্কুলে দিয়ে আসি। 

-হ্যাঁ চলো মা। 


বাদামী রঙের গেট, সেই গেট পেরিয়ে বড় বিল্ডিং, আর তার উপরেই শোভা পাচ্ছে শিশু শিক্ষা নিকেতন নামটি। সাদা-নীল ফ্রক পরা রঙিন প্রজাপতির মতো একঝাঁক ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে গেট পেরিয়ে হুড়মুড়িয়ে স্কুলে ঢুকছে, কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে আর কেউ কেউ হাসতে হাসতে। তবে কমলিনী ভীষণ খুশি, একসাথে এত মানুষ এর আগে সে কোনোদিন দেখেনি। পাখি যেমন দীর্ঘদিন ধরে খাঁচায় আটকে থাকার পর একসময় খাঁচা থেকে উড়ে গিয়ে প্রথম যেমনভাবে আকাশ দেখে, ঠিক তেমনভাবেই এত মানুষকে দেখে, স্কুল দেখে কমলিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আজ সে আনন্দে আত্মহারা।


-এই সবাই লাইন করে দাঁড়াও, হাত জোড় করো, এখুনি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শুরু হবে। 


ম্যামের ডাকে স্তম্ভিত ফিরে পায় কমলিনী। অন্যান্য বাচ্চাদের মতো সেও হাত জোড় করে গাইতে শুরু করলো। 


- জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারত ভাগ্যবিধাতা। 


এইভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকটি বছর। তবে কমলিনীর জগৎ বলতে শুধু স্কুল আর বাড়ি। তবে মায়ের অনুরোধে কমলিনীকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, তার জন্য অবশ্য কমলিনীর ঠাকুমা বাড়ির সব কাজের লোক ছাড়িয়ে কমলিনী আর তার মাকে দিয়ে সব কাজ করায়। এত কিছুর মাঝেও কমলিনী মন দিয়ে পড়াশোনা করে। কমলিনী যেমন পড়াশোনায় মেধাবী, তেমন গানের গলাও ভারি সুন্দর। প্রত্যেকবার সে স্কুলে যেমন প্রথম স্থান অধিকার করে, তেমন গানেও ডিস্টিংশন বাঁধা। এইবার সে জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা মাধ্যমিক দিলো, আজ তার ফলপ্রকাশ, তাই সকাল থেকেই কমলিনী আর তার মায়ের প্রত্যেকটা মূহুর্ত উৎকন্ঠার মধ্যে কাটছে। 


-মা কি হবে বলো তো? আমার না ভীষণ টেনশন হচ্ছে। আমি সত্যি ভালো রেজাল্ট করবো তো? আমার ভীষণ ভয় করছে মা। 

-ভয় পাচ্ছিস কেন মা। আমি বলছি তো তোর ভীষণ ভালো রেজাল্ট হবে। যা, বাবা, দাদু আর ঠাকুমাকে প্রণাম করে, স্কুলে যা। 

-হ্যাঁ মা এই তো এখুনি যাচ্ছি। 

-থাক থাক আর পেন্নাম করতে হবে না বাছা। বলি মেয়ের ফলপেকাশ হবে বলে কি সারা বাড়ি না খেয়ে থাকবে? যত সব আদিখ্যেতা।

-আমি তাহলে আসছি ঠাকুমা, মা আসছি। 

-হ্যাঁ মা আয় দুগ্গা দুগ্গা। 

-আমি এই স্কুলের হেডস্যার এবং আমার বলতে ভীষণ ভালো লাগছে আমাদের স্কুলের গর্ব একজন মেয়ে। কমলিনী মিত্র শুধু যে আমাদের স্কুলের গর্ব তাই নয় ও জেলারও গর্ব। এই বছর মাধ্যমিকে বর্ধমান জেলার মধ্যে ৬৭৫ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে কমলিনী মিত্র। 


পুরো স্কুল জুড়ে কমলিনীর উদ্দেশ্যে করতালি হচ্ছে, স্যার-ম্যাম থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী সবার মুখে শুধু আজ একটাই নাম কমলিনী মিত্র। 

কমলিনী রেজাল্ট নিয়ে ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে, মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। 


-কি হয়েছে মা কাঁদছিস কেন? কেমন রেজাল্ট হলো? 

-মা আমি পেরেছি, তোমার এতদিনের এত পরিশ্রম আমি বিফলে যেতে দিইনি। আমি জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছি। 

কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে কমলিনীর মা বললেন-


-যা কমু, বাবা, ঠাকুমা, দাদু সবাইকে গিয়ে এই খুশির সংবাদটা দিয়ে আয়।

-দেখুন এই বিয়েতে আমাদের তো কোনো আপত্তি নেই। মেয়ে দেখতে শুনতে মন্দ নয়, লেখাপড়াও জানে, গানও জানে, সংসারের সব কাজ জানে কিন্তু আমার আপত্তি বয়স নিয়ে, কমলিনীর বয়স বড্ড কম। আপনার মেয়ে প্রায় আমার ছেলের থেকে

 ১৫বছরের ছোটো, আপনার মেয়ে রাজি হবে তো? 

-সোনার আংটি আবার বাঁকা। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক রাজি হবে। তাছাড়া মেয়েমানুষের এতো পছন্দ-অপছন্দ কীসের? আমরা যাকে দেখে দেবো কমলিনী তাকেই বিয়ে করতে বাধ্য। 


রেজাল্ট জানাতে এসে এইরকম কিছু যে তার জন্য অপেক্ষা করছে, তা একেবারেই ভাবতে পারেনি কমলিনী, কথাগুলো শুনেই মূহুর্তের মধ্যে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।


-না আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না বাবা। আমি পড়তে চাই, আরও পড়তে চাই। 

-ঠিক আছে কালী কিঙ্কর মিত্র, তাহলে আজ আমরা উঠি, আপনারা নিজেদের মধ্যে এই ব্যাপারে কথা বলে পরে না হয় জানাবেন।

-দাঁড়ান। এই ব্যাপারে আমার কথাই শেষ কথা। কালী কিঙ্কর মিত্র একবার যা সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। 

-না বাবা তুমি আমার সাথে এটা কিছুতেই করতে পারো না। বাবা আমি পড়তে চাই, প্লিজ বাবা, আমি হাত জোর করে অনুরোধ করছি। 

-তুই আমার কথার অবমাননা কিছুতেই করতে পারিস না। একবার যখন বলে দিয়েছি বিয়েটা হবে, তার মানে বিয়েটা হবেই। 

-কমু চুপ কর দিকিনি। অনেককন ধরে তোর কতা শুনছি, বাব্বা বাক্যি যেন আর কিছুতেই শেষ হয় না। এত কতার কি আছে বাবু বুঝিনে। মেয়েমানুষ আজ না হয় কাল পরের বাড়ি যেতেই হবে। 

রান্নাঘর থেকে অনেকক্ষণ ধরেই এইসকল কথা কমলিনীর মায়ের কানে আসছিলো, কিন্তু এই বাড়িতে পুরুষদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা, তাই কমলিনীর মা কমলিনীর বিয়ের কথাটা শুনেও কিছুই বলতে পারছিলেন না। তিনি সবটাই অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে চোখের জল ফেলেছিলেন। বোধকরি ওই চোখের জলেই কমলিনীর ভবিষ্যৎ এইবার পরিষ্কার ভাবে ধরা দিল কমলিনীর মায়ের চোখে। তিনি আঁতকে ওঠেন, এবং ছুটে যান বসার ঘরে। 

- ক্ষমা করবেন এইভাবে আপনাদের কথার মাঝে কথা বলছি বলে, আসলে আপনাদের সকলের সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল। কমু তো এই সবে মাধ্যমিক দিল, ও এখন অনেকটাই ছোটো আর দু-একবছর যদি....


পুরো কথাটা শেষ করতে পারে না কমলিনীর মা। তার আগেই কালী কিঙ্করের রক্তচক্ষু দেখে কমলিনীর মা চুপ করে যায়। 


-আমি আবারও শেষবারের মতো বলছি আমি বিয়ে করবো না আমি পড়াশোনাই করবো। বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার, আর তা আমার জীবনের সাথে জড়িত, তাই আমি যদি না চাই তাহলে আমার অমতে তুমি এই বিয়ে কিছুতেই দিতে পারো না বাবা। মা চুপ করে গেলেও আজ আমি বলবো, বলবোই। আমি জানি এই বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী শুধু ছেলেরাই সব সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু আমি এই নিয়ম আমার ক্ষেত্রে মানি না। মেয়ে হয়েছি বলে কি আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই? 


একানাগাড়ে চিৎকার করতে করতে কথাগুলো বলতে থাকে কমলিনী। শত অবহেলা, অনাদর সত্ত্বেও যে কমলিনী কোনোদিন কারোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একটা কথাও কাউকে কোনোদিন বলেনি, সে আজ প্রতিবাদ করছে। একটা মানুষ বোধহয় ক্রমাগত কোণথাসা হতে হতে একদিন তার দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় আর তখনই বোধহয় সে প্রতিবাদ করতে শেখে। 


কমলিনীর বাবা, দাদু, কমলিনীর করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার বদলে, কমলিনীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আসলে বাজ পড়ার আগে যেমন চারিদিক নিস্তব্ধ থাকে, মিত্র বাড়িতেও এখন সেইরকমই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এই নিস্তব্ধতা ভাঙে পাত্রপক্ষের গলার আওয়াজে। 

-মিত্র মশাই আজ তাহলে আমরা আসি। আমরা আপনার বাড়ির মেয়েকে আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই না। আমরা মেয়েমানুষের এমন ঔদ্ধত্য কখনই বরদাস্ত করি না, তাই আমরা এই বিয়েটা ভেঙে দিলাম। 


রাগে অপমানে চোয়াল শক্ত হয়ে যায় কালী কিঙ্কর মিত্রের, চোখদুটো রক্তের মতো লাল। সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয় কমলিনীর গালে, চুলের মুটি ধরে হির হির করে টানতে টানতে চিলেকোঠার ঘরে আটকে দেয় কমলিনীকে। 


-থাক আটকে এখানে, তোকে কীভাবে সোজা করতে হয় তা আমার ভালোই জানা আছে। সবাই শুনে রাখো আজ থেকে কমলিনীর খাওয়া বন্ধ, আর কেউ যদি ওকে কোনোরকম ভাবে খাবার দেওয়ার চেষ্টা করো, তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। 

দুইদিন এইভাবেই কেটে গেল, তৃষ্ণায়-ক্ষুধায় কমলিনী বন্ধ ঘরের মধ্যে ছটফট করতে করতে প্রায় অচেতন হয়ে গেল। ওদিকে কমলিনীর মায়েরও একই অবস্থা, বদ্ধ ঘরের মধ্যে না থাকলেও মনটাতো তার মেয়ের কাছেই বদ্ধ হয়ে আছে। মা কি কখনও সন্তানকে না খাইয়ে খেতে পারে তাই সেও দুদিন ধরে না খেয়ে আছে, আর নিস্তব্ধে চোখের জল ফেলছে এবং এই সকল কিছুর জন্য অদৃষ্টকে দায়ী করেছে। 

-আমি বলি কি কালী, তুই এইবার কমলিনীকে বদ্ধ ঘর থেকে মুক্ত করে দে, আর শাস্তি দিস না। ও তো এইবার মরে যাবে। যতই হোক ও তো আমাদের বংশেরই মেয়ে। 


পরিবারের বড় কর্তা শিব কিঙ্কর মিত্র যার দাপটে এককালে শুধু মিত্র পরিবারই নয় পুরো গ্রাম ভয় পেত, সে আজ প্রথমবার নাতনির হয়ে কথা বললো। কি জানি নাতনির উপর দয়া করে নাকি অপরাধবোধ থেকে নাতনির সপক্ষে কথা বলেছিলেন তা ঠিক বোধগম্য হয়নি। 


-মরলে মরুক, অপয়া মেয়ে একটা। বাবা তুমি একটা জিনিস কোনোদিন ভেবে দেখেছো, কমলিনী যত বড় হচ্ছে তত আমাদের বিষয় সম্পত্তি যা কিছু ছিল, আস্তে আস্তে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে, দিন দিন ব্যবসায় লাভের থেকে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলছে, আর তা শুধু ওই মেয়ের জন্যই হচ্ছে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার উপর বোঝাটা একটু কম হতো, সংসারের একজনের খরচা বেঁচে যেত। তাছাড়া ওর সঙ্গে যদি রায় বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ে হতো, তাহলে সনাতন বাবু হয়তো আমাদের বিজনেস পার্টনার হতেন, এর ফলে আমরাও ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারতাম। 

হায় রে অদৃষ্ট, মেয়েরা নাকি বোঝা। একটু কিছু হলেই মেয়েরা অপয়া। বিয়ের সিদ্ধান্তটা, ঠিক অভাবের জন্য কিনা জানি না, তবে স্বভাবের জন্য তো বটেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই যুগে দাঁড়িয়েও আজও একটা মেয়েকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  


-কালী আমি তবুও বলবো, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। কমলিনীকে আটকে রাখলেই কি সনাতন রায় আবার তার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হবে? তার থেকে বরং ছেড়ে দে। তাছাড়া এখনও তো কমলিনীর বয়স আঠারো বছর হয়নি, তুই বরং দুইবছর পরেই বিয়ে দিস, তখন আর আমি তোকে আটকাবো না। 


দাদু শিব কিঙ্কর মিত্রের জন্যই সেইবারের মতো রেহাই পেয়েছিল কমলিনী। আসলে সিংহ যেমন বুড়ো হয়ে গেলেও সবসময়ই পশুরাজ হিসেবে মর্যাদা পায়, তেমনই শিব কিঙ্কর মিত্র বুড়ো হয়ে গেলেও এখনও তার কথার অমান্য কেউ করার সাহস পায় না। তবে কালী কিঙ্কর মিত্রের দাপটও কম নয়, তাই সে এতো সহজে দমবার পাত্র নয়, তার উপর আবার মানে আঘাত লেগেছে বলে কথা। তাই কালী কিঙ্কর ছোবল মারতে না পারলেও ফোঁস ফোঁস করেই যাচ্ছে।


 এইভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন....। আজ অনেক ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে পড়েছে কমলিনী আর তার মা। আজ খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সব কাজ সেরে স্কুলে যেতে হবে। ও বলতেই তো ভুলে গেছি আজ একাদশ শ্রেণিতে কমলিনী ভর্তি হবে। 

-যা কমু এইবার তুই স্নানটা সেরে আয়। তোকে আর কিছু করতে হবে না, মোটামুটি সব কাজই হয়ে গেছে, শুধু মাছের ঝালটুকু যা বাকি। 

-ঠিক আছে মা যাচ্ছি। কিন্তু....

-কিন্তু কীসের শুনি? কি হয়েছে রে তোর, কাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি, মুখটা কেমন যেন করে রেখেছিস, কোনো হাসি নেই মুখে। 

-মা তোমার তো ওই বালা জোড়াটুকুই শেষ সম্বল। আমার পড়াশোনার জন্য তুমি সেটাও বিক্রি করে দেবে? এমনিতেই তো তুমি বাবার বিজনেসের জন্য সব গয়নাই বিক্রি করে দিলে। তাই বলছিলাম কি বাড়ির কেউ যখন চায় না, আমি তাহলে আর পড়বো না। 

-তুই এই কথাটা বলতে পারলি কমু? তুই জানিস না আমার কত স্বপ্ন তোকে নিয়ে....তুই পড়াশোনা শিখে একদিন মস্ত বড় মানুষ হবি, বিরাট বড় চাকরি করবি। 

-আমার ভুল হয়ে গেছে মা, আর এইরকম কথা কোনোদিনও বলবো না। আমি তোমার সব স্বপ্ন পূরণ করবো দেখো। তোমায় তখন আর একটুও চোখের জল ফেলতে দেবো না, তুমি তখন সবসময় হাসবে। আর মা দেখো তোমায় আমি চাকরি পেয়েই সব গয়না গড়িয়ে দেবো। 

-এই তো আমার সোনা মেয়ের মতো কথা।.....এই রে দেখলি তো তুই বকবক করতে করতে আমার কত দেরী করিয়ে দিলি, যা এইবার তাড়াতাড়ি স্নানে যা নইলে আরও দেরী হয়ে যাবে। 


কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস। ঠাকুমা, বাবা-দাদু, আত্মীয় স্বজন সকলের কথা অগ্রাহ্য করে কমলিনী একাদশ শ্রেণিতে সায়েন্স বিভাগেই ভর্তি হয়েছে। তাদের বক্তব্য ছিল, মেয়েমানুষের মাথায় নাকি অঙ্ক ঢুকবে না, তাই সায়েন্স নিয়ে লোক না হাসিয়ে বরং আর্টস নে। এই কথা যে কতখানি ভুল তা একদিন ঠিকই প্রমাণ করে দেবে কমলিনী। যদিও তার কাছে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স সবই সমান। যে কোনো বিভাগেই, পড়াশোনা না করলে ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই শক্ত, আর পড়াশোনা করলে তা সহজ। 


সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে আজ স্কুলে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। কমলিনী সহ স্কুলের সকল শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এবার স্যার-ম্যামরাও নৃত্য এবং সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। তাই এইবারের অনুষ্ঠানটা একটু ভিন্ন স্বাদের হতে চলেছে। 


এবারে অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকছে এই বিদ্যালয়েরই দ্বাদশ শ্রেণির এক কৃতি ছাত্র অভিনন্দন চৌধুরী। 


-নমস্কার আমি অভিনন্দন চৌধুরী। এখানে উপস্থিত সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম এবং বাকিদের জানাই আমার ভালোবাসা। নলেন গুড় আর পিঠে পুলীর সনে অনেক হল শীতের মেলা, সরস্বতীর আরাধনার মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে এলো বিদায় বেলা, সাঙ্গ হল শীতের খেলা, তাই তো শীতের যাবার পালা। বসন্তেরই আসার পালা, আর তাই কোকিলের কুহুতান নিয়ে এসেছে সেই বার্তা। এই সরস্বতী পুজোর হাত ধরেই বসন্তের সূচনা হয়। যারা একটু শীতকাতুরে তারা যেন এই সময় একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বসন্তকাল মানেই ভোরের দিকে হালকা হালকা শীত ভাব, সকালে কোকিলের কুহু কুহু ডাকে ঘুম থেকে ওঠা। শীতে যেমন রুক্ষতা বেড়ে যায়, পাতা ঝরতে শুরু করে তেমনই বসন্তে গাছগুলোতে নতুন করে পাতা জন্মাতে শুরু করে। গাছগুলো যেন নতুন করে সেজে ওঠে, চিরসবুজ হয়ে যায়, আর তাই বসন্তকাল মানে আমার কাছে আশার আলো। এ তো গেলো শুধু সকালবেলার কথা, তবে বসন্তের বিকেলগুলোও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। গোধূলি বেলায় সূর্য যখন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় ঠিক সেই সময়ে প্রকৃতিতে এক নতুন রঙের সৃষ্টি হয়, নীল দিগন্তের সাথে ফুলের রঙ। আর তাই তো কবি গেয়ে ওঠেন নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো..


এইভাবেই অভিনন্দন চৌধুরীর মনমুগ্ধকর সঞ্চালনায় একের পর এক নৃত্য, আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশন হতে লাগলো। আর কমলিনী মন্ত্রমুগ্ধের মতো অভিনন্দন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইলো, সে এমনই মুগ্ধ হয়ে গেল যে, কোনো শব্দই তার আর কানে আসে না। আর তাই তো বারবার তার নাম অ্যানাউন্স করার পরও কমলিনীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। 

-কমলিনী মিত্র....কমলিনী মিত্র তুমি যেখানেই থাকো, এখুনি স্টেজে চলে এসো, আমরা নাহলে অনুষ্ঠানটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি না। 


কমলিনীর এক বন্ধু সুচেতনার ডাকে হুঁশ ফেরে কমলিনী। সে ধীর পায়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। 

-বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, হৃদয়ে দিয়েছো দোলা। রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে, একি তব হরি খেলা। 


চোখ বন্ধ করে গান গাইতে থাকে কমলিনী। এটা তার ছোটোবেলার অভ্যাস, আসলে কমলিনী মনে করে, চোখ বন্ধ না করলে সে মন দিয়ে গান গাইতে পারে না। কিন্তু, আজ সে চোখ বন্ধ করলেও ঠিক মন দিয়ে গান গাইতে পারছে না। চোখ বন্ধ করলেও সে আজ শুধু অভিনন্দন চৌধুরীকেই দেখতে পাচ্ছে। 

গান শেষ করে আবারও ধীর পায়ে স্টেজ থেকে নেমে আসে কমলিনী। এরপরই শুরু হয় অভিনন্দন চৌধুরীর আবৃত্তি। 


-যেমন আছো তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ। বেণী নাহয় এলিয়ে রবে, সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে,

নাইবা হলো পত্রলেখায়, সকল কারুকাজ। 


বেশ কিছুদিন পর.....একদিন স্কুলে--


-জানিস তো সুচেতনা, আমি না বুঝতেই পারছি না ছাই, আমার যে ঠিক কি হয়েছে.....আজকাল কোনো কাজেই আমার মন লাগে না, এমনকি পড়াশোনা করতেও ইচ্ছে করে না। আচ্ছা বল নারে, কেন আমার সবসময় অভিনন্দন দা কেই দেখতে ইচ্ছে করে..কই আগে তো এমন হতো না। অভিনন্দন দা তো আমাদের স্কুলেই পড়তো। 

-কবে থেকে তোর এমন হচ্ছে কমলিনী? 

-ওই যে সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানের দিন থেকেই। ওইদিন নীল-হলুদ পাঞ্জাবীতে খুব সুন্দর লাগছিল অভিনন্দন দাকে, তারপর স্টেজের ওই রকমারি আলোগুলো যখন অভিনন্দন দার মুখে এসে পড়ছিল, তখন খুব স্নিগ্ধ লাগছিল অভিনন্দন দাকে। 

-হুম বুঝলাম। তুই প্রেমে পড়েছিস।

-হ্যাট কি যে বলিস! 

-আমি ঠিকই বলছি, তুই যা দেরী না করে মনের কথাটা জানিয়ে দে। 

-ও বাবা আমি পারবো না। অভিনন্দন দা সামনে এলেই তো আমি লজ্জায় মুখ তুলে তাকাতে অবধি পারি না, বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুকুনি বেড়ে যায়। ছাড় এসব। বলছি শোন না তুই প্লিজ এই কথাটা কাউকে বলিস না। 

-আচ্ছা ঠিক আছে কাউকে বলবো না। 


একবছর পর....


কমলিনীর এখন ঠিক শ্রীরাধিকার মতো অবস্থা, যখনই সে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজ শোনে তখনই এক ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে যায়, খুঁজতে থাকে তার প্রিয়তমকে। সাইকেলের এই ক্রিং ক্রিং শব্দই যেন বাঁশির অনুরূপ। আসলে অভিনন্দনের সাথে এখন আর কমলিনীর দেখা হয় না। অভিনন্দন এখন কলেজে পড়ে আর কমলিনী উচ্চমাধ্যমিক দিলো। 


কিছু মাস পর....


-তাহলে ওই কথাই রইলো মিত্র মশাই, আগামী পড়শু আমার ছেলের সাথে কমলিনীর বিবাহ হবে। 


এবার আর কমলিনী কোনোভাবেই তার বিয়ে ভাঙতে পারলো না। এমনকি কমলিনীর মাও পাত্রের সরকারী চাকরী আছে বলে আর আপত্তি জানালেন না। বোধকরি তিনিও ভেবেছিলেন মেয়েমানুষকে রান্নাঘরেই মানায়। কমলিনী দৌড়ে গেল অভিনন্দনের কাছে, বোধহয় সে একবার তার স্বপ্ন পূরণের জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করতে চেয়েছিল। 


-কীরে কমলিনী কেমন আছিস? শুনলাম তোর নাকি বিয়ে? মেয়েদের জীবন কিন্তু সত্যিই সুখের, চাকরি করার কোনো দরকারই পড়ে না।  


কমলিনী সেই মূহুর্তে বুঝে গিয়েছিল, পৃথিবীর সকল পুরুষই এক। এরা কখনই নারীদের মনের গভীরতাকে আবিষ্কার করতে পারেনি। এরপর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কমলিনীর। অষ্টমঙ্গলায় সে বাপের বাড়ি এসে তার মাকে বলেছিল-


-গোটা পুরুষজাতির পৌরুষত্ব বোধহয় নারীদের গায়ে হাত তোলাতেই বজায় থাকে। 


উত্তরে তার মা তাকে বলেছিল- মানিয়ে নে মা। এই মানিয়ে নিতে নিতেই বিয়ের একবছরের মধ্যেই কমলিনীর প্রাণ বায়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত কমলিনী মরিয়া বাঁচিয়াছিল। যুগের পর যুগ কেটে যায় কিন্তু কমলিনীদের কথা কেউ জানতে চা

য় না, কেউ বুঝতে চায় না, তাই এইসকল কথা ডায়েরি বন্ধ হয়েই থেকে যায়। তাই আজ আমি নিজেই জানাতে এলাম। নমস্কার আমি কমলিনী।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024