মাতৃরূপেণ - তিলোত্তমা চ্যাটার্জি || Matrirupeno - Tilottama Chatterjee || মুক্ত গদ্য || রম্যরচনা || Rommo rochona
মাতৃরূপেণ
তিলোত্তমা চ্যাটার্জি
দূরে ঢাকের শব্দ ভেসে আসছে ,বাইরের মাঠে দুলতে থাকা কাশগুলোর দিকে জানলা দিয়ে তাকিয়ে ছিল দেবদত্তা ।এমনিতে সব গুরু চেলাদের মধ্যে সে মানিয়ে নিয়েছিল একপ্রকার, আগে ভয় পেত বালিশে মুখ চেপে কাঁদতো কয়েক রাত ...কিন্তু এখন সে সব হয় না। হয়তো জীবনের এত ওঠা পডাতে নার্ভগুলো ওর স্ট্রং হয়ে গেছে। পুজো এসে গেছে নিঃসন্দেহে, চারিদিক আলোর রোশনাইতে সেজে উঠেছে এটাও ঠিক, কিন্তু ওর জীবনে আলো আসেনি এখনো বলা ভাল ওদের জীবনে..। হঠাৎ করে দমকা হওয়ার মত পুরনো স্মৃতিগুলো ভিড় করে দাঁড়ায় চোখের সামনে। ওর জন্মটা কিন্তু আমার আপনার মতই স্বাভাবিকভাবে হয়েছিল, এমনকি দুর্গাপূজা ওর খুব ভালোই কাটতো একসময় ,ব্রাহ্মণ বাড়ির প্রথম ছেলে সন্তান হলে যা হয় অবস্থা ।ওর স্মৃতিরা কথা বলতে চায় তারা মনে করিয়ে দেয় ওদের পরিবারে মা দূর্গার আশীর্বাদে এই প্রথম পুরুষ সন্তান এসেছিল ঘর আলো করে ঠাকুরমা তাই নাম রেখেছিলেন 'দেবদত্ত'। কিন্তু জীবন তো আর ওয়াই ইজ ইকুয়াল টু এম এক্স ফলো করা সরলরেখা নয় ,সমস্যাটা ধরা পরল আদরের দেবদত্ত যখন বড় হল ।প্রকৃতির আলো বাতাসে এই মায়ার সংসারে বেড়ে ওঠা দেবদত্ত পরিষ্কার বুঝতে পারছিল পুরুষ নয় তার ভেতর থেকে ডানা মেলছে একজন নারী। ছোটবেলা থেকে তার ইনস্পিরেশন ছিল তার মা মাকে সব দিক সামলে সংসার করতে দেখে সে খুব আকৃষ্ট হতো। ঠিক যেন দশ হাতের জ্যান্ত দুর্গা ছোটবেলায় প্রায় সবাই জিজ্ঞেস করত 'তুই বড় হয়ে কি হতে চাস রে?' বহু বার ই সে নিঃসংকচে বলেছে 'মা হতে চাই মায়ের মত সব কাজ সামলাতে চাই একা।' ছোট বলে ব্যাপারটা কেউ আমল না দিলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে তার ইচ্ছেটা বদলে যায়নি বরং তার ভিত আরো মজবুত হয়েছে ।দিদিরা , ওকে নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করেছে, দেবদত্তার মনে পড়ে সেজো দিদি বলেছিল 'ছেলে হয়ে মা হবে পাগল একটা!' ও তখন প্রতিবাদ করে বলেছিল" কেন তোমরা সবাই মা হতে পারো আর আমি পারিনা?" ছোট দিদি টিপপনি কেটে বলেছিল," সাবধান ভাই আমাদের বলেছিস ঠিক আছে আর কাউকে বলিস না গালাগাল খাবি কিন্তু।"হ্যাঁ তারপর সে গালাগালি খেয়েছিল যথেষ্টই ইভেন এখনো খেয়েই যাচ্ছে.... সমাজের কাছ থেকে। কিন্তু সেদিনের দেবদত্ত ভালোই বুঝতে পেরেছিল শরীর আর মনটা তার কিছুতেই এক নয় ;ক্রিকেট ব্যাট সে কখনো ছুঁয়েও দেখেনি এমন নয় তবে মায়ের মত করে কডাই খুন্তি ধরে রান্না করার মধ্যে সে এক অদ্ভুত টান খুঁজে পায়। দেবদত্ত বুঝতে পারে চুল ক্রমশ ঘাড় বেয়ে কাঁধের উপর ঝুঁকে পড়ছে। চামড়ায় অদ্ভুত এক লালিত ও মসৃণতা শরীরের কিছু অংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে যদিও ওর কখনোই এই কোন কিছুকে অস্বাভাবিক মনে হয়নি অস্বস্তিও হয়নি এক ফোটা বরং এই সবকিছুকে তার বড্ড আপন মনে হয়েছে বারংবার ,কারণ সেই একমাত্র জানে, আদতে সে একজন 'মেয়ে 'এবং তার এই নারী সত্তা গুপ্ত রাখতে চাযনি সে সমাজের কাছেও দিব্যি মনে পড়ছে জীবনের প্রথম আদর্শ মা কেই জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতিটা সে প্রথম জানিয়েছিল হতভম্ব মা বলেছিলেন "নানা তুই ভুল বুঝছিস,বাবু অনেক ছেলেদের এরকম বড় বড় চুল থাকে, আচ্ছা বেশ আমি তোকে গিয়ে চুল কাটিয়ে আনবো কেমন তুই আমার ছেলে আমার একমাত্র ছেলে।" "কিন্তু মা আমার মন ..... "তার মা মুখ কঠিন করে বলেছিলেন "একটা কথাও না, বাড়ির এই মেয়েলি পরিবেশে থাকতে থাকতে তোমার এই অবস্থা। বাবাকে বলে আমি তোমায় হোস্টেলে পাঠানোর বন্দোবস্ত করছি আর যেন দ্বিতীয়বার তোমার মুখে আমি একথা না শুনি।" চোখ রাঙিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মা। দেবদত্তের চোখের জলের সাক্ষী রইল চারটি দেওয়াল... জীবনে প্রথমবার তার নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হচ্ছিল নির্ভেজাল 'ওর' স্থান কারোর মনে নেই কিন্তু নারী হওয়া থেকে ওকে স্বয়ং ও প্রচুর শাসন করেও আটকাতে পারেনি। সবার অলক্ষে মায়ের শাড়ি -টিপ -গয়নাই হয়ে উঠতো তার আত্মার সাজ পোশাক, এর থেকে বেশি শান্তি ও যেন পৃথিবীতে পাবে না। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না মায়ের চোখে একদিন ধরা পরল ঠিকই ও চোখে আগুন ছিল ঝড়ো হাওয়ার মতো ঘরে ঢুকে মা সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেন তাকে,সবটা গুলিয়ে যায় তার শুধু এইটুকু মনে আছে মা চিৎকার করে বলেছিল "তোদের মত মানুষদের কি বলে জানিস? হিজরা থার্ড জেন্ডার "সেদিনের দেবদত্ত বা আজকের দেবদত্তার র মনে একটাই প্রশ্ন এই জেন্ডারের ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড ভাগ করার মালিক টা কে আর ভিত্তি টাই বা কি!" যদি উত্তরটা এখনো অজানা।ছেলের এই কুকীর্তি মার হাত হয়ে বাবার কাছে যায় সব কিছু পরিষ্কার মনে না পড়লেও ওর এটা বেশ মনে পড়ে ও বলেছিল "আমি আসলে মেয়ে তোমরা বুঝতে পারছ না" থাক এরপরের ঘটনাটা আর না বললেও হবে। সবার জানা ।চোখের কোলটা ভরে আসে জলে চোখের পাতাগুলো ভিজে যায় ।বুকে পেটে হাতে বাবার বেল্টের কালশিটে পড়ে যাওয়া দাগ গুলোর দিকে এক পলক তাকায় দেবদত্তা। জীবনের এক বীভৎসরাতের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে এরা এখনো ।১৮ বছর বয়সে দেবদত্ত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে তবে শুধু বাড়ি নয় স্কুল, খেলার মাঠ, রান্নাঘর ,ঠাকুর দালান- তার চেনা জগৎটা থেকে সে বেরিয়ে আসে; স্কুলেও তাকে কম টোন টিটকারী সহ্য করতে হয়নি। তবু কাউকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেনি, কারন সে জানতো যে বাড়িতে সে জন্মগ্রহণ করেছে খোদ সেই বাড়ির লোকেদের কাছে যখন সে অবাঞ্ছিত নিশ্চয় সমাজের কাছে সে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হবে না ।শুরু হয় এক নতুন লড়াই একদা অভাব শব্দের অর্থ না বোঝা দেবদত্তের বেশিরভাগ দিনগুলো কেটেছিল অ-ভাবেই। এই প্রথম ও বুঝেছিল শুধুমাত্র টাকা দিয়ে হয়তো পৃথিবী চলে না নইলে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও ও হোটেলে রুম পায়নি ,খাওয়ার পাযনি ,বৃষ্টির দিনের ছাতা আর শীতের দিনে গায়ের কম্বল কোনটাই পাযনি। দেবদত্তার খুব মনে পড়ে এক হোটেল ওয়ালা বলেছিল "মাসি টাকা নাও আশীর্বাদ দাও খাবার দিতে পারবো না।" কঠোর শাসন করে বেঁধে রাখা চোখের জল গুলোকে আটকাতে পারল না দেবদত্তা বুঝতে পারল গাল দুটো ভিজে যাচ্ছে ক্রমশ ।ঠিক আর পাঁচজন ট্রান্সজেন্ডার এর মত ওর ও ঠিকানা হল আজকের এই দোতলার ঘরটায় যেখানে ও তার নিজের গুরু ভাইদের সাথে গুরুর সাথে আছে একরকম। এরপরের জার্নিটা আমাদের সমাজের ভীষণ প্রিয়। বাকিদের মতো দেবদত্তের শুরুটা হয় ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে শয় শয় অসুস্থ দেবদত্তারা ভিড় জমায় তথাকথিত সুস্থ সমাজের আনন্দ অনুষ্ঠানগুলোতে তারা তালি বাজায়, ভিক্ষা চায় আর এই স্বাভাবিক আমরা নিঃসন্দেহে ওদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিই ওরা কতটা অস্বাভাবিক। দেবদত্তারা এরকম চলছিল দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জুটে যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গিয়েছিল সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে দেবদত্তার একদিন মনে হল এরকমটা বেশিদিন চলতে পারে না এরকমটা হয় না সে বা তারা তো ভগবানেরই সৃষ্টি সেই সৃষ্টিতে এতটা খাদ মিশে নেই যে তার ভয়াবহতা টা এইরকম। শুধু তাদের প্রকৃত আত্মাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এত নোংরা পথ তারা বেছে নিতে পারেনা ট্রাফিকে হাত বের করে টাকা চাওয়া ,বাচ্চা নাচানো ,অস্ত্রাব্য গালিগালাজ কখনো জীবন হতে পারে না তাই একদা স্কুল পালানো দেবদত্ত বুকে সাহস এনে সমস্ত প্রতিকূলতাকে সঙ্গি করে আজকের দেবদত্তা হয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করে ,কারণ দেবদত্ত জানে হয়তো ওর অনেক কিছু খারাপ কিন্তু মাথাটা খারাপ নয়। জীবনে আরও একটা সংগ্রামের অধ্যায় শুরু হয়। নাহ,এই সংগ্রামটা বিফলে যায়নি। স্কুল লেভেলের পর পিজি লেভেলের পড়াশুনা শেষ করে বর্তমানে সেএকজন শিক্ষিকা। খুব মনে পডে চাকরির প্রথম দিনটা। শাড়ি পরিহিত দেবদত্তাকে দেখে গোটা স্কুলের বাকিদের ভাবখানা এমন ছিল যেন পৃথিবীতে এলিয়েন দেখে ফেলেছে! অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ওরা দেবদত্তার থেকে সোশ্যাল এবং মেন্টাল ডিসটেন্স মেন্টেন করেছিল। স্কুলে যোগদানের পর হেডমাস্টার মশায়ের ঘরে ইন্টারভিউ দিতে হতো তাতে পাস হলে তবেই সেই স্কুলে সে চাকরি করতে পারবে। পাসও করেছিল কিন্তু তার কিছু মুহূর্ত আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ছিল চিরস্মরণীয়। যথাসময়ে এইচ এমের ঘরে অপেক্ষারত ছিল সে অ্যাসিস্ট্যান্ট এইচ এম কে তার এপয়েন্টমেন্ট লেটার টাও দেখায। উনি হতভম্ব হলেও কিছু বলেন না ।এরপর এইচ এম এলেন এবং তার উল্টো দিকে বসে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন পনেরো মিনিট পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট বললেন" স্যার ইন্টারভিউয়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে" এইচ এম মহাশয় অবলীলা ক্রমে উত্তর দেন" হ্যাঁ, নতুন টিচার আসুক তারপর তো প্রশ্ন করব!" এইচএম এর উত্তর শুনে অবাক বিস্ময় প্রশ্ন করে দেবদত্তা "সো হু এম আই স্যার ?"অ্যাসিস্ট্যান্ট এইচএম বাধা দিয়ে বলেন "স্যার ..... "বিরক্তি ভরা কন্ঠে এইচএম বলে ওঠেন "কি স্যার ?রতন তুমি দেখে নাও এদের কি দাবি দাওয়া আছে মিটিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় কর সকাল সকাল যত রাজ্যের ঝামেলা ।"চোখমুখ লাল হয়ে উঠে দেবদত্তার। নাক থেকে গরম নিঃশ্বাস বেরতে থাকে। অ্যাসিস্ট্যান্ট এইচএম মুখ নিচু করে বলেন "স্যার ইনি আমাদের নতুন টিচার ।"নিজেকে কোনোভাবে সামলে নিজের কোয়ালিফিকেশন ও এপয়েন্টমেন্ট লেটারটা এগিয়ে দেয় ও,এইচ এম এর সামনে। উনি খুঁজে পান না তার কি করা উচিত উনি দেবদত্তার ডিটেল্স গুলো বারবার করে পড়েন একবার চশমা পরে,ও একবার চশমা খুলে। একজোড়া চোখেরও যেন বিশ্বাস হতে চায় না এইরকম অলৌকিক ঘটনা। তিনি বার কয়েক তুতলিয়ে বলেন "ইয়ে ...ম্যাডাম মানে আমি ঠিক মানে আমি আর কি ভাবতেই পারিনি যে আপনারা...." দেবদত্তা বুঝতে পারে সামনের মানুষটার কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে পড়ছে ক্রমশ বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি দেবদত্তা ছোট্ট করে বলে "ঠিক আছে।" কিন্তু দেবদত্তাদের লড়াইটা কখনো এইটুকু নয় সারা জীবন শিক্ষক থেকে ছাত্র সমাজে তার প্রতি যে একটা নয় একটা গালাগালি বরাদ্দ তা সে ভালো মতই জানে। শুধু জানে না এই অসম ব্যবহারের কারণ যে মানুষ মেধায় আর পাঁচজনের সমান ,বুদ্ধিতে আর পাঁচ জনের সমান ,জ্ঞান এ আর পাঁচজনের সমান, শুধু একটি দেবদত্ত ত্রুটির কারণে সে সবার কাছে অস্পৃশ্য?! সত্যি কি নিজের ভাগ্যের জন্য কেউ নিজে দায়ী হয়! জানেনা দেবদত্তা এমনকি জানতে চাযে ও না কারণ সে জানে সে তার নিজের কাছে পরিণিতা ।যেমন হাসপাতালে ,পুলিশ স্টেশনে, সমাজে দেবদত্তাদের জন্য কোন স্থান নেই ঠিক তেমনি নেই স্কুলের কমন টিচার্স রুমে কেউ রাজি হয়নি তার সাথে রুম শেয়ার করতে ।একটা বন্ধ ঘরে ভাঙা আসবাবপত্রের মাঝেই দেওয়া হয়েছে তার চেয়ার টেবিল। নাহ এখন আর কষ্ট হয় না দেবদত্তার আগে হতো খুব হতো। এখন বলা চলে সয়ে গেছে কিন্তু দেবদত্তার স্বপ্নটা আজও বাস্তবে মাটি ছুঁতে পারেনি। 'মা' সে আজ হয়ে উঠতে পারেনি। হ্যাঁ ওদের সংস্থার একটা এনজিও আছে তার খুব একটিভ সদস্য দেবদত্তা সেই এনজিওর উদ্যোগে ওরা নিজেদের সাধ্যমত একটা অনাথ আশ্রম চালায়। পৃথিবীতে যেমন অভিশপ্ত ওরা তেমনি আরো কিছু অভিশপ্ত প্রাণীর বিকাশে যাতে কোন ত্রুটি না থাকে সেই কর্মে ব্রতী ওরা। যে সকল শিশুরা তথাকথিত সভ্য সমাজে অবাঞ্ছিত, যে সকল কন্যা সন্তানদের কপালে সকাল বিকাল কিছু অবহেলায় জোটে, তাদের আপন করে নিয়েছে দেবদত্তারা ।এছাড়া শহরজোড়া রেড লাইট এরিয়া গুলোতে সভ্য সমাজের কলঙ্ক হয়ে বেড়ে ওঠা, সন্তানদের শিক্ষা থেকে খাওয়া পড়ার ভার নিয়েছে একমাত্র ওরাই আর যেসব নারী সন্তানেরা পরিবারের বোঝা হওয়ার আগে সদ্যোজাত অবস্থায় হাসপাতালে পরিতক্ত হয়ে ডাস্টবিনের পাশে পড়ে থাকে তাদের দায় তথাকথিত সভ্য সমাজ ঝেরে ফেলতে পারলেও পারেনা একমাত্র দেবদত্তারা। নিজেদের যথাসাধ্য সামর্থ্য দিয়ে ওই বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোর মুখে যে হাসিটুকু তারা ফোটাতে পারে সেই হাসিটা অমূল্য নিঃসন্দেহে !বাচ্চা গুলো কেউবা ওকে মাসি বলে ডাকে কেউবা মামনি এতশত লড়েও 'মা' ডাক শোনা হলো কই !আর শুনবেই বা কি করে পোড়া কপাল নিয়ে কি আর মা হওয়া যায় !কিন্তু মাতৃত্ব টা সেটা তো মিথ্যে নয় না খোদার উপর খোদকারী করতে বিশ্বাসী নয় দেবদত্তা ভগবান তাকে যেমন সৃষ্টি করেছে সেই প্রকৃত 'সে' ই মান্যতা লাভ করেছে অন্ততপক্ষে তার নিজের কাছে !জগৎ জননীর কাছে খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে সত্যিই কি শুধু মাতৃসত্ত্বা নিয়ে শারীরিক অঙ্গ নিজের মা হওয়া যায় না?!
(2)
"শুভ ষষ্ঠী অম্বিকা মা কেমন আছো তোমরা?" ফোনের ওপার থেকে কাকিমার গলা শুনতে পেয়ে খুশি হল অম্বিকা বলল "শুভ ষষ্ঠী কাকিমা। আমরা ভালোই আছি, আপনি কেমন আছেন?" "এইতো চলে যাচ্ছে মা বুঝতেই পারছ বয়স হচ্ছে" কাকিমাকে কথা বাড়াতে না দিয়ে অম্বিকা প্রশ্ন করে "কাকিমা, আপনার আর কাকাবাবুর পূজোর জামা কাপড় পছন্দ হয়েছে তো?"-"খুব হয়েছে মা,তোমার আর বাবুর কেনাকাটা শেষ তো ?"অম্বিকা মৃদুস্বরে বলে "হ্যাঁ এই শেষ হল।" খানিক বিরতি দেন কাকিমা তারপরেই শুরু করেন "পূজো মানেই তো বোঝো মা বাড়ি ভর্তি লোকজন নাতি-নাতনিদের ভিড় হই হই রই রই... তোমার কাকু তো প্রায়ই বলে বাবুর একটা কিছু দেখে যেতে পারলে..." অম্বিকা বুঝতে পারে প্রসঙ্গ পাল্টে যাচ্ছে ফোনের ওপার থেকে কাকিমার গলার স্বর ভেসেআসে "কিছু মনে করো না মা দেখতে দেখতে ছয বছর তো হয়ে গেল আমাদের ছোটু বাবুর থেকে কত ছোট্ট বল ওরও দুটো ছেলে মেয়ে হয়ে গেল তোমরা কিন্তু ভাবো মা" অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দেয় অম্বিকা,"মানে, আপনি কি বলতে চাইছেন কাকিমা?" কাকিমা অনেকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন "বাছা, এবার ঠাকুর ঠাকুর করে তোমরা নিয়ে নাও ।"অম্বিকা জিজ্ঞেস করে" কি বলছেন কাকিমা ?শোনা যাচ্ছে না" ফোনের এ প্রান্ত থেকে কাকিমা বলে" বাচ্চা নেওয়ার কথা বলছি মা" পুনরায় অম্বিকা বলে "কিছু শোনা যাচ্ছে না কি নিতে বলছেন ?"কাকিমার তীব্র চিৎকার অম্বিকার কানের পর্দা বিদীর্ণ করে দেয় "বাচ্চার কথা বলছি শুনতে পারছো বাচ্চা... "অম্বিকা বলে, "না কাকিমা নট ভেরি ক্লিয়ার নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা এখন আমি রাখি কেমন!" কথাটা বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দেয় অম্বিকা। কথাগুলো অম্বিকা শুনতে পেয়েছিল ভালোভাবেই কিন্তু 6বছর ধরে যেখানে হোক দেখা হলেই এরকম হাজার জন কাকিমাকে নিত্যনতুন কৈফিয়ত দিতে দিতে একপ্রকার ক্লান্ত সে আর ওগলি দিয়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে না তার। ষষ্ঠীর বিকেলটা কেন কে জানে মেঘলা গুমোট,ঠিক অম্বিকার মনের মতই। সাকসেসের মোড়া জীবনে এই এক অপূর্ণতা। পর্দার আলোর ঝলকানি লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের মাঝে নিজের নারীত্বকে যেন কেমন হারিয়ে ফেলেছেও ।এই গোটা 6 বছরের দাম্পত্যে একবারও ও এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি এমনটা নয়। প্রথমদিকে প্রায়ই এই ভাবনাটা আসত কিন্তু কাজের আড়ালে এই অপ্রয়োজনীয় ভাবনা চিন্তাগুলো চাপা পড়ে গিয়েছিল একবার রনজিতকে আবেগের বশে বলেও ফেলেছিল কিন্তু ওর খালি এই কাজ আর ও কাজ নয় সে কাজ। পুরোদস্তুর একটা কাজের মানুষ রনজিত। এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের এক অ প্রিয় স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে অম্বিকা চিন্তার ভাঁজ পরে কপালে নিমিষে সমগ্র মুখটা জুড়ে যেন এক গভীর অন্ধকার ছেয়ে যায় তার। অভিনেত্রী অম্বিকা সেনের জাঁকজমকের আড়ালে এই অবসাদগ্রস্ত নারীকে চেনে না বাকি পৃথিবীটা ,কষ্টটাকে বাড়তে দেয় না অম্বিকা। চোখ পরে দেয়ালে বাঁধানো দম্পতির ছবিগুলোর দিকে, ওদের বিয়ের ফটো। রনজিত কে বিয়ে করে একপ্রকার খুশি অম্বিকা। রনজিত আর ও কলেজ ফ্রেন্ড দুজনেরই একসাথে পড়াশোনা প্রায় একই পথে হেঁটে আজ সাকসেসফুল ডিরেক্টর এবং অম্বিকা তারই গ্ল্যামারাস হিরোইন দুজনেই পছন্দ করে বিয়ে করলেও দু বাড়ি থেকে বাধা দেয়নি কেউ, মিচকি হাসে অম্বিকা। এমনিতে তারা সুখী পরিবারই... একটা খুঁত ছাড়া ।এই এতদিনের অনেক রংবেরঙের মুহূর্তরা ভিড় জমায় অম্বিকার মনের ক্যানভাসে হঠাৎই ডোর বেল শুনে প্রথমটা চমকে গিয়ে পরে বুঝতে পারে রন টেক্সট করেছিল আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে দরজা খুলে অফিস ব্যাগ আর বিয়ারের বোতলটা হাতে নিয়ে ঢুকলো রনজিত ।কম বয়সে সুন্দর সুন্দর ফিল্ম বানিয়ে তার নামটা যথেষ্টই পরিচিত। ওকে চেঞ্জ করতে বলে কিচেনে ডিনার সার্ভ করতে গেল অম্বিকা ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নটা ,হঠাৎই পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে রন, কানের কাছে মুখ এনে বলে "কি ব্যাপার ম্যাডাম মুড অফ নাকি?" যদিও স্পর্শটা চেনা তবুও অস্বস্তি হচ্ছিল অম্বিকার। রণকে আলতো করে সরিয়ে বলল "না তো "ডাইনিং টেবিলের খাওয়ার সাজিয়ে দেয় অম্বিকা। রনজিত যেন শান্তি পেল না ফের এক দফা জিজ্ঞেস করল "না সব ঠিক মোটেই নেই বলোই না আমাকে ।"এই হচ্ছে রণর এক স্বভাব খুঁচিয়ে ঘা না করা অব্দি শান্তি নেই, খেতে খেতে হেসে ফেলল অম্বিকা। মনে মনে ঠিক করল আজ একবার বলতেই হবে মনের কথাটা। খানিকটাই ইতস্তত করে বলল "রন কাকিমা ফোন করেছিলেন ।"রন খেতে খেতে বলল "কোন কাকিমা ?"অম্বিকা মনে করানোর চেষ্টা করল "ওই যে যাদের সোনার দোকান আছে।" রণ মুখ তুলে বলল "ও রুনু কাকিমা তো কি বলছে? সব খবরা খবর ঠিকঠাক তো?" অম্বিকা মুখ নিচু করে বলে চলে" হ্যাঁ, এইসবই ভালো মন্দ কথা হচ্ছিল আর... ।"থমকে গেল অম্বিকা। রনজিত মাথা নেড়ে বলল "আর কি?" অম্বিকা মুখ নিচু করে উত্তর দিল আমাদের প্যারেন্ট হুডের ব্যাপারে বলছিলেন" রনজিত তোয়াক্কা না করে বলল" এ আর নতুন কি ছয বছর ধরেই চলছে। এসব লোকের কথা গুলি মারো। কাজ কম্ম নেই" বিড়বিড় করে রন চোখ তুলে অম্বিকা বলে "আমি বুঝি রন বাট উই শুড কনসারন আবাউট আওয়ার ফার্স্ট ইস্যু। সিরিয়াসলি ...." অম্বিকার সিরিয়াস কথাটা শুনে মুখ গম্ভীর হয়ে যায় রনজিতের ।ডিনারের বাকি পর্ব টা চলেছিল নিঃশব্দে ডিনার শেষে বাসনপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে যায় অম্বিকা। ও এক প্রকার জানত এরকমই করবে রণ নতুন কিছু নয় তাও কেন জানিনা অম্বিকার হাল ছাড়তে ইচ্ছে করলো না । বিযার ভরা একটা গ্লাস বাড়িয়ে দেয় রন ওর দিকে ওর থেকে গ্লাসটা নেয় অম্বিকা কথা না বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে "কিছু ভাবলে?" দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে রন "তুমি সিরিয়াসলি এসব ভাবছো ?তোমার সময় নষ্ট করা ঠিক হবে? কাজের ক্ষতি করা ঠিক হবে? আর ব্যাপারটা তো একদিনের নয় সারা জীবনের শুধু বাচ্চা জন্ম দিলেই তো হবে না তাকে বড়ও করতে হবে এত সময় কার আছে! অনেক কষ্টের পর আজ তুমি এত সুন্দর একটা ফিগার পেয়েছো নষ্ট করে দিতে চাও নাকি? অম্বিকা মাথা নেড়ে বলে" তুমি ওভাবে কেন দেখছো ব্যাপারটা আবার ওয়ার্কআউট করে ফিগার পেয়ে যাওয়া যাবে বাট..." বাধা দিয়ে বলে রনজিত "তুমি যদি আমায় জিজ্ঞেস করো দেন মাই আনসার ইজ নো। আমি এই মুহূর্তে এত বড় ক্ষতি করতে পারবো না আমার ক্যারিয়ারের ।"অম্বিকা বিরক্ত হয়ে বলে "ক্ষতি কেন বলছ তুমি এটাকে? পৃথিবীতে সবাই কি ভুল করে যাচ্ছে ?"রনজিত ধমকে ওঠে" রিয়েলি আমি ভাবতে পারছি না তুমি এটা বলছো। without any family support এই লাইনে সাকসেস পেতে অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয় আর জীবন তো পালিয়ে যাচ্ছে না প্লিজ এসব সিলি কথাবার্তা আমায় বলতে এসো না।" অম্বিকা তাও বলে "কিন্তু..." বাধা দিয়ে গর্জে ওঠে রণজিৎ"কোন কিন্তু না আমার স্ক্রিপ্ট রেডি হয়ে গেছে পুজোর শেষে তোমার শুটিং শুরু that's it ।Figureএর প্রতি খেয়াল রাখো আর এসব নিয়ে কোনো কথা বলোনা, গুড নাইট ।"বলেই বেডরুমে চলে গেল রনজিত অম্বিকার বড় হতাশ লাগে বুকেরভিতরটা শূন্য হয়ে ওঠে, ঘোরের বসে কিছুক্ষণ পর অম্বিকা ও বেডরুমে এসে পৌঁছল ।এতক্ষণে রনজিত ঘুমিয়ে পড়েছে উল্টো দিকে ফিরে চোখ বোজেও চোখের পর্দা জুড়ে বুবাইয়ের হাসিটা ফুটে ওঠে। বুবাই ?বুবাই ওর ছোট বোন আরতির একমাত্র ছেলে কি প্রাণবন্ত ও! চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিন বছরের ছেলেটা কেমন মার দিকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আরতিকে কোলটা ভরে ওঠে ওর আর অম্বিকার কোলজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয় শূন্যতা... চোখের কোনটা ভরে ওঠে অম্বিকার কষ্ট হয় ওর ফুপিয়ে কেঁদে উঠতে চায় কিন্তু পারেনা দম বন্ধ হয়ে আসে ;লাইট ক্যামেরা একশন অটোগ্রাফের মাঝে এই মাতৃ সত্তা কোথায় চাপা পড়েছিল কে জানে!
অষ্টমীর সকালবেলাটা ভারী সুন্দর কাটলো অম্বিকার। একটা মিঠে বাতাস এত দিনের সমস্ত গ্লানি কে মুছে দেয় বেলা গড়াতেই স্নান করে দারুন সাজ দিয়ে রনর হাত ধরে আবাসনের পূজোয় হাসি হাসি মুখ করে অঞ্জলিও দিতে গেল ফিরে একই সাথে লুচি তরকারি খায় ও আর রন। অম্বিকা ভালই বুঝতে পেরেছে আজ পতি দেবতা খুব রোমান্টিক মুডে আছে কাছাকাছি এসে ঘাড দুলিয়ে প্রশ্ন করল "এই যে অঞ্জলি দিলে মন্ত্র গুলোর মানে জানো?" লুচি মুখে পুরতে পুরতে বলল রনজিত "ওই সামথিং সামথিং ।"অম্বিকা পুনরায় বলে উঠছে" এই যে বললে ধনং দেহি পুত্রাং দেহি তুমি ইন্টারেস্টটেড নও ?"রনজিত বেপরোয়া ভাবে বলল "নো ওয়ে ।"অম্বিকা বলল "বাট আই এম সো ইন্টারেস্টেড। "রনজিত বলে "অম্বিকা আবার "বাধা দিয়ে অম্বিকা বলে "আই হ্যাভ এ সারপ্রাইজ ফর ইউ "কৌতুহলী হয় রনজিত অম্বিকা রনজিতের ঘাড় জড়িয়ে বলে ওঠে "উই আর গোয়িং টু বি প্যারেন্টস ।"কাল সকাল থেকে ধরতে পেরেছিল অম্বিকা ব্রেকফাস্টের পর থেকেই মাথাটা ঘোরাচ্ছিল বারবার ,তারপর ঘনঘন বমি শরীরটাকে বেশ দুর্বল করে দেয় যে কারণে বিকেলে ঠাকুর দেখতে পারেনি বন্ধুদের সাথে। সিউরিটিটা পেল আজ সকালে নেপথ্যের কারণটা সে ,নিজেই ইচ্ছে করে ওসিপিটা ইনটেক করেনিও। ব্যাপারটা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় নেয় রনজিত স্পাইনাল কর্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা কিছু বয়ে যায় তার। দ্রুত নিজেকে সামলে উঠে রনজিৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে অম্বিকার দুটো গাল ধরে বলে "নো প্রবলেম পুজোটা গেলে ডক্টরের কাছে গিয়ে এবরশন করিয়ে নিও। এ আর নতুন কি !আগেও তো হয়েছে "বাধা দিয়ে ওঠে অম্বিকা "রন" হঠাৎই কঠিন হয়ে রনজিত বলে "এইবারের আমাদের প্রজেক্টটা কোটির কিন্তু। ঠিক আছে mind it আগের বারের ঘটনা মনে আছে তো?" কথা শুনিযে বেডরুমের দিকে হেঁটে যায় রনজিত। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, প্রায় পাথরের মূর্তি হয়ে যায় অম্বিকার শরীরটা চোখ দিয়ে নেমে আসে অবিশ্রান্ত জল ধারা হ্যাঁ মনে তার সবই আছে চার বছর আগের একটা ভয়ংকর ঘটনা শুধু সে এখন আর মনে করতে চায় না....
(3)
ডক্টর অয়ন্তিকা বোসের ওয়েটিং রুমে ক্রমে ঘামতে শুরু করে অম্বিকা বিগত কিছুদিনের স্মৃতি হাতরে ।পূজোর বাকি দিনগুলো কেটেছিল চোখের জল আর মানসিক ঘাত প্রত্যাখাতে আরেকবার মানসিক ঝড় সহ্য করার পর অভিনেত্রী অম্বিকা সেন ভালোভাবেই বুঝে গেছে নিজের glamour আর ট্যালেন্ট দিয়ে পৃথিবী এদিক ওদিক করে ফেললেও 'মা' সে হতে পারবে না। বলা ভালো মা হওয়া তাকে মানায় না। সময় নেই তার হাতে নষ্ট করার মত ,এজন্য সে প্রস্তুত। লোকসান হতে পারে এমন কোন বস্তুকে তাদের পৃথিবীতে আসতে দেওয়ার সব সব পথ বন্ধ করতে তাদের মত লাভ লোভী বড়লোকেরা সিদ্ধ হস্ত। কিছুক্ষণ পরে তার ডাক এলো, ডক্টর অয়ন্তিকার সামনে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সমস্ত কথা গুছিয়ে নিল ও।ডক্টর বললেন "বলুন ম্যাডাম" অম্বিকা বলল "উই নিড টার্মিনেশন ডক্টর। "ডক্টর অবাক হয়ে বললেন "ওয়ান্স মোর ?"মাথা নেডে শায় দেয় ও।ডক্টর মাথা নিচু করে বলেন I dont know why are you want this once more? It is equally injurious to urself। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড টেল মি ফ্র্যাঙ্কলি হোয়াট ইজ দা প্রবলেম?"একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাথা নাডে অম্বিকা বলে, "নো উই হ্যাভ নট সাফিসিয়েন্ট টাইম।" হতাশ সুরে ডক্টর বলেন,"প্লিজইট ইজ নট এনাফ রিজন ফর দিস গ্রেট লস ।"বেঁধে রাখা কান্না গুলো বেরিয়ে আসতে চায় উত্তেজিত হয়ে অম্বিকা বলে "নো নেভার আমি মা হতে চাই না পারব না কোনদিনও। পারবোনা" কিছু সেকেন্ডের মধ্যে ডক্টর অয়ন্তিকা আর অভিনেত্রী অম্বিকা সেন কে চমকে দিয়ে তৃতীয় একটি কণ্ঠস্বর বলে ওঠে" কেন পারবে না !"চমকে উঠল অম্বিকা। সামনে তাকিয়ে আরো অবাক হল ডক্টর এর মুখে একটা স্নান হাসি। অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলে অম্বিকা,"আই এম সরি হু ইজ দিস?" তৃতীয় মানুষটি কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল ডক্টর বাধা দিয়ে বললেন "ও দেবদত্তা টিচার আর আমাদের এনজিওর ফরমার মেম্বার ।"অম্বিকা জিজ্ঞাসা করে জানতে চায় "ওকে বাট উনি আমাদের কথার মাঝে ইন্টারফেয়ার করছেন কেন?" ডক্টর অয়ন্তিকা বললেন "বিকজ আই কলড অনলি ফর ইউ ইউনিড হার নট মি ।আপনি লাস্ট যখন অ্যাপোয়েন্টমেন্ট কলটা করলেন তখনই বুঝেছিলাম সামথিং ইজ রং দেয়ার আপনারা কথা বলুন ও বলা হলো না উনি একজন খুব ভালো কাউন্সিলার আসলে এত গুণ কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি!" হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ডঃ অয়ন্তিকা খানিকটা হতভম্ব হয়ে যায় অম্বিকা। ঘরের গুমোট নিস্তব্ধতা ভেঙে প্রথমে কথা বলেন অপর মানুষ টা "হাই আমি দেবদত্তা আপনি আমায় না চিনলেও আমি বা আমরা আপনাকে ভালোভাবেই চিনি ।" এটা অস্বাভাবিক কিছু না তাই চুপ করে রইলো অম্বিকা পুনরায় দেবদত্তা বলে উঠল "আই নো দিস ইজ নট ইওর first issue i know everything ,কথা বলুন কোনো ক্ষতি হবে না ।আপনার জীবনের আল্টিমাম টা আপনি ঠিক করবেন আমরা কেউ করব না কিন্তু।" অবাক হয় অম্বিকা। সবার আড়ালে থাকা সত্যিটা এই মানুষটা জেনে ফেলেছে তাও ভাবনাটাকে উড়িয়ে দেয় ও ;বরং একা ঘরে একজন ট্রান্সজেন্ডার এর সাথে বসে থাকতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে ওর ।উনি পুনরায় বলেন "জীবনটা না খানিকটা দৌড় প্রতিযোগিতার মত যাত্রাপথ বাড়তে বাড়তেই এক একটা হার্ডেলস এসে যায় আর আমরা বাইরে থেকে খালি চিযার আপ করি যাতে লড়াইটা লড়তে সহজ লাগে। এবার আপনি বলতে পারেন তাহলে আমরা যারা জ্ঞান দিচ্ছি তারা কি দৌড়াচ্ছে না?অবশ্যই দৌড়াছি। যখন কমিউনিকেশন হচ্ছে আমাদের মধ্যে আমরা তখন একটু রেস্ট করে নিচ্ছি ,সো প্লিজ কথা বলুন।" অম্বিকা বেপরোয়া ভাবে উত্তর দেয় "ইট ইজ মাই চয়েস।" প্রশ্ন করে দেবদত্তা" only yours?" অম্বিকা আমতা আমতা করে বলে,"আই মিন আওয়ার চয়েস ।"দেব দত্তা প্রশ্ন করে," যদি জিজ্ঞেস করি কেন খুব ভুল করব না হয়তো ।"অম্বিকা উত্তর দেয়,"আমাদের অত সময় নেই একটা ভুল হয়ে গেছে তো তার সংশোধনটাই তো চেয়েছি শুধু" দেবদত্তা ঘাড় নেড়ে বলে" বেশ, তা বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি কেন ?আদৌ ভুল নাকি..."ওকে থামিয়ে দেয় অম্বিকা," না আর কিছু নয় মানুষ তো, ভুল তো হতেই পারে ।"একটা অজানা ব্যথা হাতছানি দেয় অম্বিকার ,তবুও সত্যিটা এড়িয়ে যায়। দেবদত্তা বাঁকা হাসি হেসে বলে "মা দূর্গা কে দশভূজা কেন বলা হয় জানো? হ্যাঁ।তুমি করেই বলছি। বয়সে তুমি আমার থেকে ছোটই হবে। মা দুর্গা ঘর আর বাইর সমানভাবে সামলাতে পারেন। তিনি একাধারে যেমন অন্নপূর্ণা তেমনি দানব দলনি তিনি যেমন যোগীনি তেমনি জগপ্রসবিণী। আর তুমি তো সেই মায়ের জাত তুমি পারবে না কেন ?দেখো আমায় তো তুমি দিদি ভাবতে পারবে না জানি ।যদি জীবনের একটা অদ্ভুত মানুষ মনে কর তবে বাচ্চাটাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দাও যদি লালন পালন করতে পারবে না তবে আমাদের এনজিওর সাথে যোগাযোগ করো। আমরা আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করব তাকে বড় করার ফ্রি অফ কষ্ট ,তোমাদের পরিচয় ই সে বড় হবে ।বড় হলে তোমাদের কাছে ফিরে যাবে আমাদের এনজিওয়ে এরকম অনেক বাচ্চারা রয়েছে ।"কান লাল হয়ে যায় অম্বিকার ও বিরক্ত হয়ে বলে "আই থিংক আই নিড নো মোর কাউন্সিলিং আওয়ার ডিসিশন হ্যাজ মেড অলরেডি।"
বিগত চার পাঁচ দিন ধরে খালি দেবদত্তার কথাগুলোই কানে বেজেছে কাজের ফাঁকে, ভদ্রমহিলার কথাগুলোএ সম্মোহনী শক্তি রয়েছে। দ্রুত ভাবনা টা ভেবে থমকালো ও হ্যাঁ,'ভদ্রমহিলাই' তো উনি। অন্ততপক্ষে অম্বিকার চোখে। ওনার কথায় চার্জড হয়ে রণকে একবার বলার চেষ্টা করেছে যে বাচ্চাটাকে পালন করার ব্যবস্থা যদি ও করতে পারে কাজের ক্ষতি না করে তাহলেও কি সমস্যা হবে ?নিঃসন্দেহে উত্তর দিয়েছে" হ্যাঁ হবে" এবং ধমকে গেছে এই 11 দিনের ট্যুর থেকে ফিরে এসে যেন শুনতে পায় কাজটা হয়ে গেছে। তবে গত চার পাঁচ দিনে অম্বিকা কিছুই করতে পারেনি বাড়িতে মেডিসিন গুলো কেনাই আছে ;কিন্তু কিছু যেন ওকে বারবার টেনে আনছে কিন্তু এটা যে কিসের টান ও জানে না। নাহ, অত সাত পাঁচ ভেবে কাজ নেই হাতে আর মাত্র ৭ দিন। এর মধ্যে তাকে পারতেই হবে নইলে অনেক বড় লস হয়ে যাবে।খোলা চুল কাঁধের উপর গুটিয়ে নিয়ে মেডিসিন টা খুলে হাতে নেয়ও। জলের গ্লাসে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় ডোর বেল বাজলো যেটা বাজার কথা ছিল না । আই হোলে চোখ না রেখেই দরজা খুলে বলল "কে?" আগন্তুক উত্তর দিল "আমি ।সমাজের থার্ড জেন্ডার রিপ্রেজেন্টেটিভ চিনতে পারছ না?" চিনতে পেরেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর। আরে ওই মহিলা ওর ঠিকানা পেল কিভাবে? দেবদত্তা বলে উঠলো" ভিতরে ডাকবে না?" অম্বিকা বুঝতে পারলো না ওর কি করা উচিত। দেবদত্তা অযাচিতভাবেই ওর ঘরে ঢুকে আসে। কিংকর্ত্য বিমুরের মতো দরজা বন্ধ করে দেয় অম্বিকা। মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে কঠিন হয় ও বলে "আপনি আবার চলে এসেছেন আপনাদের এনজিও-র অ্যাডভার্টাইজমেন্ট করতে?" হাসে দেবদত্তা বলে "সে তুমি যাই বলো না কেন আমি কিন্তু সবটা বুঝে ফেলেছি ।"থতমতো খেয়ে অম্বিকা বলে "ক কি কি বুঝেছেন আপনি?" দেবদত্তা ব্যাখ্যা করে বলে "এই যে তুমি এবরশন করার অভিনয় করছো ।" "অভিনয় করছি মানে?" অম্বিকার চোখে মুখে অবিশ্বাস তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে "হুম, আসলে তুমি ভীষণভাবে মা হতে চাইছো কিন্তু পরিস্থিতির কাছে হেরে যাচ্ছ। না, এখনো তো হারনি ।"চিৎকার করে ওঠে অম্বিকা," কি আজেবাজে কথা বলছেন আপনি ?আমি মোটেই মা হতে চাই না ।আমার জীবনে আমার কাজের থেকে দামি আর কিছুই নেই। আমি তো আগেও বলেছি এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।" কথাটা থামা মাত্রই দেবদত্তা বলে "তাই বুঝি যে এত মা হতে না চায় সে চার দিন সময় নষ্ট করবে কেন ?(খানিক থেমে) ভগবান তো সবাইকে সব দেয় না তোমায় বারবার সুযোগ দিচ্ছেন ।কিন্তু তুমি অলরেডি অনেক পাপ করে ফেলেছ আর পাপের বোঝা বাড়িও না। অন্তরের ডাকে সাড়া দাও ,দেখবে সব প্রতিকূলতা দূরে চলে গেছে।" অম্বিকা স্তব্ধ হয়ে যায়। সে ভালোই বুঝতে পারছে সে সম্পূর্ণরূপে হেরে যাচ্ছে, শাসন করে রাখা চোখের জল গুলো বাঁধ ভেঙে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ছে, নিঃশ্বাস এর গতিবেগ বাড়ছে ক্রমশ, কণ্ঠস্বরকে গ্রাস করেছে দলা পাকানো কষ্টেরা। দুহাতে মুখ ঢেকে ফ্লোরেই বসে পড়ে ও। কতক্ষণ এই অবস্থায় ছিল জানিনা কিছুক্ষণ পরেই একটা অচেনা অজানা স্পর্শ ওর চোখের জল মোছার চেষ্টা করে। চোখ খুলে দেখতে পায় দেবদত্তা। হাসছেও বলছে "এখন ভাবতে পারো জ্যোতিষ বিদ্যাটাও শুরু করলাম নাকি? না আসলে সার্বিকভাবে সুস্থ মানুষদের নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বুঝতে পারি অসুস্থতা টা কোথায়! চোখ মোছো।" দেবদত্তার দুটো হাত সরিয়ে কান্না ভেজা গলায় অম্বিকা বলে" প্লিজ চলে যান একা থাকতে দিন আমায় ,আমার কষ্টটা আপনারা কেউ বুঝতে পারবেন না আমি মা হওয়ার যোগ্য নই। যে মা নিজে হাতে তার সন্তানের গলা টিপে মেরে ফেলে শুধু নিজের স্বার্থে সে কি আর মা হতে পারে!" শেষের কথাগুলো যেন নিভে আসে ওর।ফোপাতে শুরু করেছে মেয়েটা, ও কিছু বোঝার আগে ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে দেবদত্তা বলে "মানছি তোমার বুকে অনেক কষ্ট আছে কিন্তু চোখ মেলে দেখো ভগবান তোমার থেকেও অভাগী হিসেবে আমাকে পাঠিয়েছেন তোমার জীবনে। তোমার হারানোর যন্ত্রণা আছে আর আমার আছে না পাওয়ার বেদনা... সাথে আরো অনেক কিছু তোমার তো মানুষ হিসেবে একটা আইডেন্টিটি আছে তুমি সুস্থ তোমার জেন্ডার স্পেসিফাইড আমার কি আছে বলো তো ?"তারও গলায় কান্নার আভাস প্রথমে খানিকটা অস্বস্তি হলেও খানিক পরে অম্বিকা বুঝতে পারে এ স্পর্শের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মাতৃত্ব আছে অন্য কোন অনুভূতি এখানে ভাবনারও অতীত। মনে হলো এই প্রথম একটা খুব নিরাপদ আশ্রয় খুজে পেয়েছে সে। অভিনেত্রীর হাসির আড়ালে থাকা মানুষ অম্বিকার খুব উগরে দিতে ইচ্ছে করে এতদিনের চাপা রাখা সমস্ত কষ্টগুলো ।নাহ ,আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না অম্বিকা বহতা নদীর মতো কল কল করে বলে ফেলে জীবনের যতটুকু সত্যি সবটা এক মনে শোনার পর দেবদত্তা অবাক হয়ে বলল "শুধু মেটেরিয়ালিস্টিক সুখের জন্য তোমরা এরকম ইন্টারনাল সুখের বলিদান দিয়ে দিতে পারো এত অনায়াসে?" দেবদত্তার হাত দুটো ধরে বলে অম্বিকা," বিশ্বাস করুন এবারটা আমি চাইনা কিন্তু রনজিত কিছুতেই শুনতে রাজি হচ্ছে না ।ওর খালি এ প্রজেক্ট আর ওই প্রজেক্ট।" দেবদত্তা পাল্টা বলে," প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড এটা আমার কথা বলার স্পেস নয় বাট আই মাস্ট সে, একজন পুরুষের ইচ্ছার জন্য নিজের নারীত্বকে শেষ করে দিতে কষ্ট হয় না ?আর যে শরীরের ডিফর্মিটির কথা বলছ সেই নারী শরীরের কৃতিত্বটা কোথায় বলতো !সব শরীরের একমাত্র ঠিকানা তো আমাদের সবার জানা। পুড়ে গেলে সবই এক মুঠো ছাই ছাড়া আর কি !এ পৃথিবীতে সব কিছু রিভারসিবল সমস্যার সমাধান সম্ভব কিন্তু ইররিভারসিবল সমস্যাগুলো সমাধান শত টাকা খরচ করলেও পাবে না ।(খানিকটা সময় নিয়ে) অনেক তো হলো অন্যের জন্য বাঁচা। এবার একটু নিজের জন্য বাঁচো না, শুধু নিজেকে খুশি করতে বাচো। ভগবানের ইচ্ছায় যে আসছে তাকে জীবনের সবথেকে বড় গর্ব করে বাঁচো জানবে কোটি টাকা খরচ করলেও এই রত্ন পাবে না।" অম্বিকার মুখ থেকে গোঙ্গানি বেরিয়ে আসে" না যোগ্য নই আমি। কিছুতেই যোগ্য নই আমি আমার সন্তানকে ..... "কান্নারা ঢেকে দেয় বাকি সমস্ত না বলা কথা ।অম্বিকার হাত দুটো শক্ত করে ধরে দেবদত্তা বলে "মানুষ তো ভুল তো হতেই পারে। কিন্তু একবার পাপ করেছো বলে বারবার কেন পাপ করবে ?যখন ভগবান তোমায় নিজে থেকে প্রায়শ্চিত্তির সুযোগ করে দিচ্ছেন তুমি ঠিক পারবে তোমার এই অন্যায় বোধটাই তোমাকে শক্তি দেবে। হ্যাঁ তুমি হয়তো অনেকটা সময়ের জন্য শরীরটাকে হারিয়ে ফেলবে কিন্তু ভগবান প্রদত্ত ক্ষমতাকে অনুভব করতে পারবে, হ্যাঁ হয়তো সৌন্দর্য কিছুটা ফিকে হবে কিন্তু তোমার চোখ মুখ জুড়ে ফুটে উঠবে মাতৃত্বের আভা ।এখন বল কেজিখানেক চর্বি একগাদা স্টিচ বা আর সমাজের ট্রোলিঙএরকম আরো হাজারটা প্রতিকূলতাকে মেনে নিতে তুমি প্রস্তুত তো?" কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটা নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায় .....
(4)
"নাহ," প্রায় চিৎকার করে আঁতকে ওঠে অম্বিকা ধরফিয়ে উঠে বুঝতে পারে স্বপ্নই দেখছিল সে।হৃদ স্পন্দনের গতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। চার বছর আগের এক বীভৎস স্মৃতি হানাদায় ওর ভোরের স্বপ্নে আপাতত সে কলকাতার একটা বেসরকারি হাসপাতালে এডমিটেড। হ্যাঁ দেখতে দেখতে নয় মাস কেটে গিয়েছে যেহেতু প্ল্যানড ডেলিভারি তাই আগে থেকেই অ্যাডমিটেড হয়েছে ও। এর মধ্যে এত পরিবর্তন ঘটে গেছে অম্বিকার জীবনে যে শরীরের পরিবর্তন তার কাছে নস্যি । চোখ বুজলো ও দেখতে পেল চার বছর আগেও ভগবান ওকে এমনই সৌভাগ্য দিয়েছিল কিন্তু সেই সময় অম্বিকার কেরিয়ার তুঙ্গে জীবনে প্রথমবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেতার সাথে স্ক্রিন শেয়ার করার সুযোগটা এসেছিল তখনই ।সারা জীবন লাভের অংক গুনে সেবার রণজিৎ দেরি করেনি এত বড় লাভ লুফে নিতে ।হ্যাঁ ওদের জীবনের প্রথম একটা বিগ বাজেটের সুপারহিট সিনেমা তারা বানিয়েছিল ঠিকই; রনজিতের কথা অনুযায়ী ছোট্ট একটা সেক্রিফাইসের বদলে। এমনকি অম্বিকা আপত্তি জানায়নি একবারও পরিষ্কার মনে পড়ে দিনটা অম্বিকা। ওদের জীবনের প্রথম দেবদত্ত উপহারকে,ওদের দু মাসের ভ্রুণটাকে ..... কান্নায় চোখটা ভরে আসে অম্বিকার, রক্তে ভরে গিয়েছিল সেদিন সবকিছু এত রক্ত সে এ জীবনে কখনো দেখেনি। কষ্ট হয়েছিল তখন ও ,কিন্তু পরবর্তীকালের লাইট ক্যামেরা একশন আর হাততালির শব্দে কোথাও যেন চাপা পড়ে গিয়েছিল তারা ,আর সহ্য করতে পারে না অম্বিকা। ভয় লাগে ওর কিন্তু একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত মা হওয়ার যোগ্য সে নয় কিন্তু তা সত্ত্বেও এই লড়াইটা লড়তে চেয়েছিল ও। দেখতে চেয়েছিল মুখোশের আড়ালে থাকা আসল চেহারা গুলো। হ্যাঁ চার গুণ বেড়ে যাওয়া ওজনের সাথে সাথে অনেকগুণ মানসিক আঘাত পেয়েছে অম্বিকা তার অর্ধেকটা যদি সমাজের কাছ থেকে হয় ,তবে বাকি ৫০ শতাংশ শুধু রনজিতের কাছ থেকে। ১১ দিনের ট্যুর সেরে এসেও যখন ও জানতে পেরেছিল কাজ হয়নি, প্রচুর ধমক দিয়েছিল চোখ রাঙিয়েছিল কোন কিছুতে কাজ না হলে শেষে তো মারতেও এসেছিল। কিন্তু পারেনি অম্বিকা strong থেকেছে ও স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে মা হিসেবে সে সবকিছু করতে পারে যদি ওদের সো কলড সুখী বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বের হতে হয় ,তাতেও ও রাজি।শেষমেশ অনেক যুদ্ধ ঝগড়ার পর ওই পথটাই খোলা ছিল তার কাছে আর সত্যি বলতে এত শক্তি ও পেয়েছে শুধু দেবদত্তার কাছ থেকে। হ্যাঁ এই লড়াইটাতে একমাত্র দেবদত্তাই ছিল তার একমাত্র সঙ্গিনী ও পুরো যাত্রাপথে ওকে বারবার চিযার আপ করে গেছে ।তবে বাকিরাও ছিল বটে, অম্বিকার জন্য পৃথিবীর সব থেকে খারাপ বিশেষণ বেছে দেওয়ার দায়িত্বই নিয়েছিল বাকি চেনা পৃথিবীটা ।তবে ওসব অম্বিকা আর ধরে না, দেবদত্তার কাছ থেকে শিখেছে সে অনেক কিছু। সব নেগেটিভিটি কে মুহূর্তে পজিটিভিটিতে পরিণত করে দেওয়ার অদ্ভুত একটা ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা আছে ওর। সত্যি নেহাত কম ঝড় একা সামলে যাচ্ছে না ওই মানুষটা! জীবনের নানান জানা-অজানা গল্প শুনেছে ও দেবদত্তার মুখে। একবার জিজ্ঞেস করেছিল "তুমি তো এখন প্রতিষ্ঠিত সমাজ তবুও সম্মান দেয় না তোমায়?" দেব দত্তা বলেছিল" দেয তো শুধু আমার পদটাকে ,কিন্তু হাজার মানুষের ভিড়ে যখন হাটি আমরা বড় একা জানো কেউ আমাদের পাশে ঘেষতে চায় না..." সেইদিন একমাত্র সেই দিন দেবদত্তার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠেছিল ।অম্বিকা হয়তো একটু হলেও বুঝতে পেরেছিল দেবদত্তার অসহায়তাটা, সংগ্রাম থেকে সাফল্যটা মনে করে মনটা হালকা হয়ে যায় অম্বিকার, নিজের জন্য আর কষ্ট হয় না। অম্বিকা যে দেবদত্তার জন্য কিছু টি ভাবেনি তা নয় যে মানুষটা সমাজে এতটা অগৃহীত কোনদিনও তার মত স্টার এর জীবনে এতটা গৃহীত হয়ে যাবে কোনদিনও কল্পনাও করেনি সে। ঋণ তো নেহাত কম হলো না এ জীবনে দেবদত্তার কাছে শোধ করার কথাও ভাবছিলই হঠাৎ পেটে যন্ত্রণা হতে শুরু করে সহ্য করতে পারে না চোখ বুজে ফেলে ও।
(5)
রাস্তাটা ক্রস করতে করতে মনে মনে দু'চারটে গালি দেয় নিজেকে দেবদত্তা ।আজকের দিনটাতেই অন্য সব কাজ করতে গিয়ে বড্ড দেরি করে ফেলেছে ও। ডক্টর অয়ন্তিকার হসপিটাল থেকে ঘন্টাখানেক আগে ফোন এসেছিল অম্বিকার লেবার পেইন শুরু হয়েছে জানতে পেরেই বেরিয়ে পড়েছিল সে কিন্তু আর কাজটা এতটা দূরে পড়ে গিয়েছিল যে আসতে দেরি হয়ে গেল ।ও হাসপাতালের গেট খুলে ঢুকতেই কিছু মানুষ নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করা শুরু করে দিল এসবে অভ্যস্ত ও। কোন এক নার্স বিড়বিড় করে বলে উঠলো "আর পারা যায় না বাবা। বাচ্চা হওয়ার আগে এসে পৌঁছে যায় কাজ নেই যত্তসব" এই হসপিটালটা নতুন, ডক্টর অয়ন্তিকা বোস এর পুরনো হসপিটালে প্রায় সবাই চেনে দেবদত্তা কে এরা চেনেনা কি আর করা যাবে !কাউন্টারে গিয়ে ডাক্তার অয়ন্তিকার খোঁজ নেয় দেবদত্তা। ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট দেবদত্তার নাম শুনে তাকে নির্দিষ্ট রুমে পাঠানোর নির্দেশ দেন। লিফটে উঠেই দেবদত্তা বুঝতে পারে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতি ওঠানামা করছে গায়ের রোম গুলো খাড়া হয়ে গেল কিনা বুঝা গেল না! পুরো atmosphere ta এমন যেন বহুদিন ধরে প্রিপেয়ার করা এক্সাম এর রেজাল্ট আজকে। লিফট থেকে নেমেই ন নম্বর ঘরটায় প্রায় দৌড়ে ঢুকে ডাক্তার অয়ন্তিকার দেখা পেলো দেবদত্তা। ডাক্তারের গাল ভর্তি হাসি তিনি দেবদত্তাকে দেখে বললেন "এবরশন টু ডেলিভারি ইট ইস এ ম্যাজিকাল মেকানিজম যার ক্যাটালিস্টটা হলেন ইউ মিস দেবদত্তা ব্যানার্জি ।"জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় দেবদত্তা, ডাক্তার অয়ন্তিকা তার কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বলে "মেয়ে হয়েছে দেবদত্তা কংগ্রাচুলেশন।"আনন্দ টাকে আর ধরে রাখতে পারে না দেবদত্তা আবেগের বসে কথা জড়িয়ে যায় "কই আর অম্বিকা কেমন আছে ?"সম্মতি জানিয়ে ডাক্তার বলে "মাদার এন্ড চাইল্ড বোথ আর সেফ এন্ড নরমাল। তোমরা কথা বলো কেমন আমি আসি "বাইরে থেকে দরজাটা ভিজিয়ে চলে যান ডাক্তার অয়ন্তিকা। ঘরের ভিতরে ও খানিকটা এগোতেই দেখতে পেল সদ্য মা হওয়া অম্বিকা তার সদ্যোজাতকে আগলে রেখেছে সস্নেহে। দুচোখ ভরে গেল দেবদত্তার ।না পূজো চলে গেছে ন দশ মাস হলেও কোথা থেকে যেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ করা মহিষাসুর মর্দিনী ভেসে আসছে। এই হসপিটালের লাগোয়া একটা এসাইলাম আছে জানে দেবদত্তা। নিশ্চয়ই সেখানকার ই কোন এক বাসিন্দা অসময় মহিষাসুর মর্দিনী শুনছে এই সময় ভেসে আসা মন্ত্র মেশানো গানের সুর ছাড়া ঘর জুড়ে আছে শুধুই নিস্তব্ধতা ।কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে দেবদত্তা ,অম্বিকা আর ও নারী সন্তানের দিকে। অম্বিকা আর তার কন্যা সন্তান যে কোন অকালবোধনের শুভ সূচনা করছে তা জানেনা দেবদত্তা। অম্বিকা হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে ,বেডের পাশে থাকা টুল টায বসে জিজ্ঞেস করে দেবদত্তা "কেমন আছো?" অম্বিকা মৃদু হেসে বলে "বেশ ভালো আছি।" খানিকটা উঠে বসার চেষ্টা করে অম্বিকা তাকে বাধা দেয় দেবদত্তা কিন্তু অম্বিকা শোনে না বলে "আমি ঠিক আছি পারব ।"একটা গভীর শ্বাস নেয় ও ।দেবদত্তা মাথানেডে বলে ,"আর বোলো না আমি এমন একটা কাজে আটকে গেছিলাম .... " অম্বিকা বাধা দিয়ে বলে" চুপ একদম চুপ, এতদিন অনেক জ্ঞান দিয়েছো। এবার আমি বলব তুমি শুনবে।" হতভম্ব হযে বসে থাকে দেবদত্তা ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অম্বিকা বলে "তো এট লাস্ট আমরাই জিতলাম তাহলে ,এই এত বড় সোসাইটির বস্তা বস্তা প্রতিকূলতাকে পেরনো গেল তাহলে !এবার কিন্তু আমার একটা আবদার আছে।" অবাক হয়ে দেবদত্তা বলে "আমার কাছে? আমি তোমায় কি বা দিতে পারি আচ্ছা বলো সাধ্যমত চেষ্টা করব "মাথা নেড়ে অম্বিকা বলে "দেবে না অনেক দিয়েছো এবার নেবে।" জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে তাকায় দেবদত্তা,ওকে আশ্বস্ত করে অম্বিকা বলে "হ্যাঁ নেবে এই যে আমার কোলের এই সদ্যজাত সদস্যটিকে মানুষ করার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। আজ থেকে তুমি হবে ওর মা ।নাও ওকে কোলে নাও "যেন আকাশ ভেঙে পড়ে দেবদত্তার মাথার উপর আকস্মিক কথার চোটে সদ্যোজাতকে কোলে নিতে ও ভুলে গেল সে। মস্তিষ্ক হাতরে কয়েকটা এলোপাথাড়ি কথা বলে ফেলে "আমি আমি মা কি করে হতে পারি ?হ্যাঁ আমি নিজেকে মেয়ে বলে মনে করি ঠিকই কিন্তু আমি মা কি করে হব ?সম্পূর্ণ মেয়ে তো আমি নই। "অম্বিকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে "কে বলল তোমায় uterus আর ওভারি ছাড়া মা হওয়া যায় না !মাদারহুড ইজ এন ইমোশন। দিস ইজ নট কানেক্টেড উইথ দিস আরথি বডি। এনি ওয়ান ক্যান মাদার বি দে আর মেল অর ফিমেল.... আর জন্ম দিলেই কি খালি মা হওয়া যায় নাকি! অনুভূতি টাই আসল সত্যি ।"বেশি কিছু বলা হলো না দেবদত্তার, আজ এই মাতৃমূর্তির সামনে ওর সমস্ত জ্ঞান মূহমান। খানিক থেমে অম্বিকা আবার বলে " আমি চাই এই নতুন প্রাণটি মানুষের মত মানুষ হোক আর সেই দায়িত্ব তোমার থেকে ভালো কে পালন করবে বলো? আমি কিন্তু না শুনবো না।" কান্না পায়ে দেবদত্তার। কিন্তু কাঁদতে পারেনা বলে তাহলে "তোমার এত সেক্রিফাইস এর কি হবে ?তুমি যে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছ এত কষ্টের ফল তুমি আমায় দিও না।" মাথা নেড়ে হেসে বলে অম্বিকা,"ওই যে তুমি বলেছিলে না শুধু নিজের জন্য বাঁচতে শেখা প্রয়োজন তাই এত বড় লড়াইটা লড়লাম ।আর যা হারিয়েছি তা কোনদিনও আমার ছিলই না অনেক কিছুই আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে, গেছে আমি ভীষণ স্বার্থপর জানো শুধু নিজের জন্যই করলাম একমাত্র নিজের জন্য। আর সত্যি বলতে আমাদের এত ব্যস্ত সিডিউলে নিজের জন্যই সময় হয় না অন্যের জন্য কি করে হবে !এর থেকে বরং ও তোমার কাছে মানুষ হলে আমি চোখ বুজে নিশ্চিন্ত হব।" খানিক থেমে আবার বলে অম্বিকা "যেদিন না ওর বোঝার ক্ষমতা হবে আমরা সেদিন ওকে সবটা বলব আমি চাইনা কেউ অন্ধকারে থাকুক। মনের এই অন্ধকার গুলো ব্ল্যাক হোল হয়ে সমস্ত আলোকে গ্রাস করে নেয় ।ওকে মানুষের মতো মানুষ কোর কেমন! ও যেন এই দুই মায়ের সেক্রিফাইসটা বুঝতে পারে ।"কাপড়ে মোড়া সদ্যোজাতকে দেবদত্তার দিকে এগিয়ে দেয় অম্বিকা। মন্ত্র চালিতের মত সদ্যোজাতকে দুহাতে তুলে নেয় দেবদত্তা দুই মায়ের চোখের কোল জলে ভরে যায় ,গাল প্লাবিত হয় আর হাসি ফুটে ওঠে সদ্যজাত উমার ঠোঁটে। এখনো মহিষাসুরমর্দিনী টা ভেসে আসছে শোনা যাচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্ত্র পাঠ" যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থতা নমস্তাস্যই নমস্তাস্যই নমস্তাস্যই নমো: নমো:....."
Comments