সপ্ন যখন সত্য হয় - সামিমা ইয়াসমিন || Swapna Jokhon Sotti hoi - Samima yeasmin || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প
সপ্ন যখন সত্য হয়
সামিমা ইয়াসমিন
গল্পটি শুরু হয় তানিয়া নামে একটি মেয়ের নেতৃত্ব দিয়ে যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি ভালো কলেজে পড়ে। আর এই কলেজে অনেক ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। কিন্তু খুবই কম ছাত্র-ছাত্রী আছে যারা গরীব ঘরের তবে তারা স্কলারশিপ এর মাধ্যমে এই কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। আর তাদেরই মধ্যে তানিয়া হলো একজন।
তার বাবা একটি কোম্পানিতে শ্রমিকের কাজ করে এবং মা গৃহকর্ত্রী। পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে খুব কষ্টে তাদের পারিবারিক জীবন যাপন চলে। এমনকি তানিয়া নিজে একটি কেকের দোকানে কাজ করে যাতে করে তার পড়াশোনার খরচা তুলতে পারে এবং তাদের পারিবারিক আর্থিক সমস্যা দূর করতে পারে। তবুও তাদের এই দারিদ্রতা দূর হয় না। তার একটি ছোট ভাইও আছে, হামিদ। সে এখন ক্লাস টেনে পড়ে। তার ছোট থেকে একটা ইচ্ছা আছে যে সে বড় হয়ে একজন রিপোর্টার হবে । কিন্তু সে তার দিদির মত অতটা পড়াশোনাতে ভালো নয় তাই সে ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ পাইনি। কিন্তু তানিয়া ছোট থেকে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে সে বড় হয়ে একজন লেখিকা হবে। আর ছোট থেকেই তার এই লেখার অভ্যাস টি তাকে আরও উদ্যোগী করে তুলেছে। যখন সে একা কোথাও বসে থাকে তখন সে শুধু ভাবে আর তার মনের কথা কলমের দ্বারা খাতায় প্রকাশিত হয়।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু তখন চারিদিকে করোনা ভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণে কয়েক মাস লকডাউন ছিল। সরকারের তরফ থেকে বাড়ির বাইরে বেরোনো নিষেধ ছিল তাই সে বছর পড়াশোনাটাও খুব ভালো হয়নি। কিন্তু অনলাইনে পরীক্ষা হওয়ার কারণে বেশিরভাগ সবাই পাস করে গেছে। তবে এখনো পর্যন্ত ফার্স্ট সেমিস্টারের রেজাল্ট বের হয়নি। আর সরকার থেকে রীতিমতো সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়ার কারণে করোনা ভাইরাসের মহামারী আপতত দূর হয় এবং স্কুল-কলেজ সব খুলে দেয়। তারপর রীতিমতো পড়াশোনা শুরু হয় তানিয়াদের ও কলেজ খুলে দেয় এবং কলেজ থেকে একটা নোটিশ দেয় তাতে লেখা থাকে —
“ এতদ্বারা কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের জানানো হচ্ছে যে, বিগত দুবছর ধরে অতিমহামারীর সংকট কাটিয়ে মহাবিদ্যালয়ের নিয়মিত পঠন-পাঠন বর্তমানে অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার পূর্বের ন্যায় বর্তমান ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে কলেজের বার্ষিক পত্রিকা ‘নবাঙকুর’ প্রকাশ করা সম্ভব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পত্রিকার জন্য সকলকে নিম্নলিখিত বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লেখা জমা দেবার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
বাংলা ভাষায় লেখা যেকোনো ধরনের রচনায় আকাদেমি বানান বিধি অনুসরণ করতে হবে এবং লেখার শেষে নিজ স্বাক্ষর দিতে হবে। লেখার মধ্যে কোনরকম নকল থাকলে বা কারো লেখা হুবহু তুলে এনে জমা দেওয়া হবে যাবে না। কেবলমাত্র উপযুক্ত লেখাগুলি পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা গুলির মধ্যে তিনটি বাছাই করা লেখার রচয়িতাদের পুরস্কার প্রদান করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। লেখা জমা দেবার শেষ তারিখ ১৫ ই এপ্রিল ২০২২। ”
তানিয়া এ ব্যাপারে খবর পাই যে কলেজে নোটিশ দিয়েছে কিন্তু কী নোটিশ দিয়েছে তা জানেনা। সে রোজকার মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং ব্রেকফাস্ট করে কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর সবার প্রথমে কেকের দোকানে গিয়ে তিন ঘন্টা দোকান সামলায়। তারপর কলেজ যায়। দোকানের মালিক তানিয়াকে তার নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসে। তাই তাদের মধ্যে সম্পর্কটি বেশ ভালোই আছে।
আজকে নোটিশ দেওয়ার খবর শুনে সে একটু তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরিয়ে পরে । তারপর কলেজে গিয়ে সে দেখে যেখানে নোটিশ টাঙানো রয়েছে সেখানে অনেক ভিড় লেগে আছে এবং সে কলেজের ছাত্র- ছাত্রীদের মধ্যে ঘেঁষাঘেঁষি তে নোটিশটি পরে। নোটিশটি পড়ে তার মনে একটা আসা জাগ্রত হয় এবং মনে মনে ভাবে সে তিনজনের মধ্যে একজন হবে যাদের পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ যেন তাকে ব্যঙ্গ করে বলে “তুই এটার স্বপ্ন দেখিস না, তোর জন্য এই পুরস্কারটা নয়” কথাটা শুনে তার মনে একটু দুঃখ হলো তবুও সে কারো কথায় কোন কান না দিয়ে নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখল ।
৩ নং রুমে ইংরেজি অনার্স এর অপর্না ম্যামের ক্লাস হচ্ছে। ক্লাসে ম্যামও নোটিশটির ব্যাপারে আলোচনা করল। ক্লাসে বসে তানিয়া ভাবছে সে কী বিষয়ে গল্প লিখবে এবং সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পরে। কিছুক্ষণ পরে ম্যামের আওয়াজে তার অন্যমনস্কতা ভাঙলো। “ কী হয়েছে, এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছো কেন? ”তানিয়া তখন ঘাবড়ে গিয়ে বলল গল্প লেখার ব্যাপারে ভাবছিলাম । এ কথাটি শুনে পাশে ছাত্রছাত্রীরা তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে শুরু করলো । তারপর ম্যামের বকুনিতে সবাই চুপ করল এবং বলল— "গল্প লিখবে ঠিক আছে কিন্তু এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে হবে না। তুমি একটু বেশিই ভাবো, ঠিক আছে বসে পর।"
ক্লাস শেষ হবার ঘন্টা পড়ল এবং ম্যাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে পড়ল আর সে তখনও ভাবছে সে কী লিখবে । আজ পর্যন্ত সে বিভিন্ন রকম গল্প লিখে এসেছে এবং সেগুলির মধ্যে বেশিরভাগই প্রেমের কাহিনী তবে এখন সে আলাদা ধরনের লিখতে চায়।
কলেজ ছুটি হল এবং তাকে তার বান্ধবী পিছন থেকে ডাকছে । তার নাম জিনিয়া কিন্তু সে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়ে । ছুটতে ছুটতে এসে বলল “ কলেজের পাশে একটি বই মেলা বসেছে চল গিয়ে দেখে আসি ”। তারা দুজনে বই মেলায় গেল । মেলা ঢোকার প্রবেশ দরজায় লেখা আছে ‘ সাগরদিঘী বইমেলা ’ । আর সেই মেলায় বিভিন্ন রকমের বইয়ের দোকান আছে এবং একটা দোকানে এক এক রকমের বই আছে। কোনোটা ভূতের গল্পের বই আবার কোনোটা হাসির গল্প , প্রেমের গল্প ইত্যাদি। তানিয়া একটি বই কিনল। সেটিতে প্রেমের কাহিনী লেখা আছে কারণ সে প্রেমের গল্প পড়তে খুব পছন্দ করে। আর জিনিয়া একটি ভূতের গল্পের বই কিনল কারণ সে বাড়ীতে বেশীরভাগ সময় ভূতের সিনেমা দেখে । তারপর তারা দুজনে ফুচকার দোকানে গিয়ে ফুচকা খেল। তখন জিনিয়ার মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো এবং সেই ফোনটি কেটে দিয়ে মোবাইলটি সুইচ অফ করে দিল। তার মোবাইলে প্রায় অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে এবং তাকে বিরক্ত করে। কিন্তু তাদের কাউকে পাত্তা দেয় না কারণ সে আগে থেকেই রিলেশনশিপে আছে । অন্যদিকে তানিয়াকে অনেকজনই প্রপোজ করেছে কিন্তু তাদের কাউকেই সে পাত্তা দেয়নি কারণ এসবের জন্য তার সময় নেই । আর তার এই ভাঙ্গা মোবাইলে কেই বা ফোন করবে । কারণ সে এতটাই গরীব যে মোবাইল ঠিক করার জন্য তা কাছে টাকা নেই । তাই তার মোবাইল শুধু বারে বারে সুইচঅফ হয়ে যায়।
মেলা দেখার পর তারা দুজনে বাড়ি চলে যায়। জিনিয়া আর তানিয়ার বাড়ি একই দিকে নয় তাই তারা বিপরীত দিকে চলে যায়। বাড়ি আসার পথে তানিয়া মনে মনে ভাবে সে কত গরিব ,তাকে শুধু টাকার জন্য কাজ খুঁজে বেড়াতে হয় আবার তাকে পড়াশোনাও করতে হয় । তার জীবন শুধু দুঃখে পরিপূর্ণ।
তারপর সে বাড়ি আসার পরে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু কথা না বলে সোজা ঘরে ঢুকে যায়। মা দেখে আশ্চর্য হয় এবং তাকে খাওয়ার জন্য ডাকে। সে হাত মুখ ধোয়ার পর খেতে বসে । তার মা বলেন “ কী হয়েছে ,কি ব্যাপার চুপচাপ আছিস কেন ? অন্যদিন তো খুব বকিস ”। সে মাকে নোটিশটির ব্যাপারে সব কথা বলল। শোনার পর মা তাকে বললো “ তোকে কারো কথায় কোন কান দিতে হবে না তুই শুধু নিজের উপরে বিশ্বাস রাখ ,আমি জানি তুই পারবি ”। তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেলল সে কি গল্প লিখবে এবং সে তারই জীবন কাহিনী নিয়ে একটা গল্প লিখল।
আজ রবিবার ,কলেজ ছুটি। তাই সে দুপুরবেলায় ঘরে বসে তার লেখা গল্পটি বারে বারে পড়ছে এবং মাঝে মাঝে একটু লজ্জা বোধ করছে। সে ভাবছে তার গল্পটা শুনে কেউ আবার হাসবে না তো! যদি এ ব্যাপারটা অতটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও গল্পের শিরোনাম দেওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে এখনও ঠিক করতে পারেনি যে গল্পটির কী শিরোনাম দেবে। এবং সে এটা নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়ে গেছে।
যাইহোক ,গল্পের শিরোনাম নিয়ে যে সমস্যাটি ছিল সেটি দূর হয়ে গিয়েছে কারণ সে ঠিক করে ফেলেছে কী শিরোনাম দেবে। তারপর সে সেটি কলেজে জমা দিয়েছে।
আর কয়েকদিন পর সেই তিনজনের নাম ঘোষণা করবে যাদের লেখা সবথেকে সুন্দর হয়েছে। দিন গোনা শেষ হলো এবং তিনজনের নাম ঘোষণা করা হলো। সেই তিনজনের মধ্যে তার নামও ছিল।
এইসব শুনে তার তো খুশির সীমা নেই। তার সারা বাড়িতে শোরগোল পড়ে যায়। যে পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল সেটি বাড়ির সবার হাতে হাতে ঘোরে এবং একবার করে বলে ,বাঃ চমৎকার লিখেছে তো !
পত্রিকার সুচিপত্রে নামও ছিল। ছোটবেলা ( গল্প )তানিয়া সুলতানা।
আর তানিয়া এবং বাকি দু'জনকে কলেজ কর্তৃক পুরস্কার দেওয়া হল তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল রহিম মণ্ডল এবং আরেকজন সৌমিত্র চক্রবর্তী।
Comments