ঝুলন্ত তার - কাহার মল্লিক || Jhulanta Tar - Kahar Mallik || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প

 ঝুলন্ত তার

            কাহার মল্লিক



মেঘু, সিটু দুজনের কেউই পেশাদার চোর নয়; বলা যেতে পারে মজাদার চোর। চুরি করে মজা পায় বলেই তারা চুরি করে। আর যত মজা পায়, ততই তারা চুরি করার আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারে না বরং চুরির প্রতি আগ্রহ তাদের বেড়েই চলে। এটা একধরনের মানসিক ডিজঅর্ডার, যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ক্লেপ্টোম্যানিয়া বলা হয়। তারা খেয়ালিপনায় চুরি করতে গিয়ে মালিককে নাজেহাল করে ছাড়ে আবার কখনো চুরি করা বস্তু মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দেয়।এই আজগুবি চোর দ্বয় ছিচকে চোরের মতোই অপরের জিনিস চুরি করেছে কম আর ইন্টাটেনমেন্ট বা আমোদপ্রমোদ মেতে উঠেছে বেশি।


মেঘু, মাঝারি গড়নের, বাবরি চুল, বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের মতো। সিটু, শীর্ণকায়, বদমাইয়েশি বিদ্যায় তুখোড়। ইয়ার্কি, মশকারি, বাঁদরামি, ইতরামি, ফাজলামি, লোকঠকানো ইত্যাদি কাজে তাদের জুড়ি মেলা ভার।এদের গুরু হলেন হাদু, ষাটোর্ধ্ব, পাতলাগোছের মানুষটির বিদঘুটে চেহারা। ভাত খায় কম, মদ খায় বেশি।গ্রীষ্মের দাবদাহে ফাটা মাঠের মতোই তার চামড়া ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। তার গোটা দেহের হাড়গুলো ক্ষুধার্ত মানুষের মতো দাঁতমুখ বের করে আছে।একটি বাক্যে হাদুর বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হবে, একটি নরকঙ্কাল, যার মাথাভর্তি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, মুখমণ্ডল ভরা দাড়িগোফ, গায়ে ধুলোমাখা তেল চিটচিটে আজানুলম্বিত এক আলখাল্লা। তার একটি বিশেষত্ব হল, পৃথিবীর হেন কোনো ঘটনা নেই বা হেন কোনো খবর নেই যে; সে টের পায় না। লোকে বলে হাদু মাতাল, কিন্তু কেউ তাকে একবারও মাতলামি করতে দেখেনি, এমনকি মদের দোকানের ধারেকাছেও দেখেনি।অথচ বাড়িতে বসে বসে চেলা মেঘু, সিটুদের নিয়ে বোতলের পর বোতল মদ পান করেছে।অনেকে গোপনসূত্রে জেনেছে, হাদুর বাড়িতে নাকি মদ তৈরি হয় বা চোরাপথে মদ আসে।তাই তাকে নিয়ে দুই লাইনের একটা ছড়াও তৈরি হয়।

                                     হাদুর বাড়ি, মদের হাড়ি।

                                     হাদু মদ খায় কাড়িকাড়ি।

কিন্তু কেউ কোনোভাবেই হাদুর বাড়িতে মদতো দূরের কথা, মদের হাড়িটিরই কোনোরকম হদিশ পায়নি।


মেঘু গ্রামে ‘কপাল কাটা’ আর সিটু ‘দাঁত ভাঙা’ নামে পরিচিত। এই মানুষদুটির মনে যা আসে তা-ই করে। তরুণদের সাথে কবাডি খেলায় দুই জনে দুই দলের হয়ে নেমে পড়ে।সিটু মেঘুকে ধরতে গিয়ে মেঘুর উপরে পড়ে, তখন সিটুর ওপর চোয়ালের একটি দাঁত ভেঙে মেঘুর কপালে ঢুকে যায়।তবুও মেঘু টের পায় না, ব্যাপকহারে রক্তক্ষরণ হলে, তার দলের একজন দাঁতটিকে টেনে বার করে।তখন মেঘু কপালের কাটা জায়গাটিতে টাইট করে গামছা বেঁধে, এর থেকে মারাত্মক একটি ঘটনার কথা শোনায়।কোনো এক জায়গায় কবাডি খেলায় একজন ধরতে গিয়ে তার মাথার ঢুসে বাইশ ইঞ্চির কাঁসার একটি বালতি দুমড়ে যায়, অথচ তার মাথার কিছুই হয়নি।আর সিটু শোনায়, সে একজায়গায় চুরি করতে গিয়ে একটা মোটা লোহার তালাকে দাঁতে টেনে খুলে দিয়েছিল, সেই কথা।


মানুষ যখন নিজের খোশখেয়ালে কাজ করে, তখন যেকোনো কাজেই তার ভয়ডর থাকে না। এরা চুরির সাথে মালিককেও নাকানিচুবানি খাওয়ায়।রাতটি ছিল কনকনে শীতের। চাঁদ ডুবুডুবু। মালিক তার জমির এককোণে অস্থায়ী একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরের ভিতরে লেপ-কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থেকে, তার গচ্ছিত ধান পাহারা দিচ্ছিল।একসময় তার গভীর ঘুম আসে। আর এদিকে মেঘু, সিটুও আসে। মেঘু মালিকের ঘুমন্ত অবস্থার ফায়দা তুলতে গচ্ছিত ধানের শিষ কেটে কেটে বস্তা বন্দি করতে থাকে।আর এক ফন্দি এটে সিটু বলে, “ দেখবি শালার সারাজীবনের মতোন আগলদারি বার করে দিবো।“ লেপ-কম্বল সহ ঘুমন্ত মালিককে তারা দুজনে পাঁজাকোলা করে ধরে নিয়ে গিয়ে পুকুরের জলে ফেলে দেয়।তারপর ধানের শিষ ভর্তি বস্তা নিয়ে ফুড়ুৎ করে দৌড় দেয়।


ঘুটঘুটে অন্ধকার এক রাত্রিতে মেঘু, সিটু কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গকে নিয়ে পেঁয়াজ চুরি করতে যায় ডহরের মাঠে। ডহরের মাঠে শুধু সারি সারি পেঁয়াজের ডাঙা।এই মাঠে হাদুরও একটি ডাঙা আছে বলেই কাউকে পেঁয়াজের ডাঙা পাহারা দিতে হয় না। ঘোরান্ধকারে তারা বস্তার বস্তা পেঁয়াজ তুলে নিয়ে চলে আসে।সকাল হলে হাদুর কানে খবর আসে, তার ডাঙারও পেঁয়াজ চুরি হয়েছে।হাদু নিশ্চিন্তে থাকে।মেঘু, সিটু ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের চুরি করা সমস্ত পেঁয়াজ পরের রাতে বস্তাবন্দি হয়ে হাদুর বাড়িতে পৌঁছে যায়।হাদু পেঁয়াজ তুলতে বেঁচে যায় এবং তার ডাঙা থেকে উৎপাদিত পেঁয়াজের থেকে প্রায় দুই গুণ বেশি পায়।


প্রত্যেক রাতের মতো, সে রাতেও সড়োদাদু বাঁশের খাঁচা দিয়ে একটি পুকুরে কাঁকড়া ধর ছিল। সড়ো মাল, পাতলাগোছের থুত্থুড়ে বুড়ো। ঐ পুকুরেই মাছ চুরি করতে আসে, মেঘু ও সিটু। রাতের গাঢ় অন্ধকারে তারা পুকুরপাড়ে কারো উপস্থিতির টের পায়। তখন মেঘু নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে গো তুমি?” সঙ্গে সঙ্গে সড়োদাদু উত্তর দেয়, “ওগো সড়ো।“ তখন তারা পিছনের দিকে সরতে থাকে আর সড়োদাদু তাদের দিকে এগিয়ে যায়, বিড়ির আগুনের জন্য। আবার মেঘু জিজ্ঞেস করে, “কে গো তুমি?” সড়োদাদু একই উত্তর দেয়, “ওগো সড়ো।“ তারা দুজনে পিছনের দিকে সরতে সরতে একদম পুকুরের ধারে চলে আসে, আর এক পা পিছনে দিলেই জলে পড়বে, সেই মুহূর্তে মেঘু আবারও জিজ্ঞেস করে, “ওগো আর সরা হবে না, ঠিক করে বলো , কে তুমি?” তখন সড়োদাদু স্পষ্টভাবে ও একটু জোর দিয়ে বলে, “ ওগো আমি সড়ো মাল, কাঁকড়া ধরছি।“ তখন তারা বুঝতে পারে, পাশের গ্রামের সড়োদাদু, পুকুরে কাঁকড়া ধরতে এসেছে। তখন সিটু সড়োদাদুর দুই হাত ধরে আর মেঘু দুই পা ধরে, তাকে দুলিয়ে দুলিয়ে পুকুরের জলে নিক্ষেপ করে।তারপর তারা কাঁকড়াসহ বাঁশের খাঁচাটি নিয়ে দৌড় দেয়।


মানুষ আপন মর্জিমাফিক চললে তার বিভিন্নরকরের প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটে।মেঘু, সিটুর, মরার বাড়ি থেকে চাল নিয়ে বিড়ি কিনতে বিবেকে বাঁধেনি।তারা রোজা (উপোস) থাকার নামে ভন্ডামি করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি‌। হাটে-বাজারে গিয়ে ডজন ডজন কলা গিলেছে। সেইসময় গ্রামের কেউ দেখে তাদেরকে রোজা থাকার কথা স্মরণ করালে হাতের কলা ফেলে দিয়ে পাক্কা ইমানদার ব্যক্তিদের মতো বলেছে; “আস্তাগফিরুল্লাহ (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা), ভাই আমরা ভুলে গেছিলাম, আর ভুল হবে না।“ তবে তাদের আজগুবি উদ্ভট কান্ড এখানেই শেষ নয়। কত লোকের যে তারা তাড়ি চুরি করেছে, হাঁড়ি ভেঙেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।কত লোকের কত হাঁস, মুরগি, ছাগলকে মরার অজুহাত দেখিয়ে জবাই করেছে তার কোনো হিসেব নেই।কত ছেলেকে ছলে, কৌশলে তাড়ি ও ছড়ির বাড়ি খাইয়েছে তারও কোনো হিসেব নেই। ছোটো ছোটো ছেলেদের তাল বা খেজুর খাওয়ানোর কথা বলে, মাঠে নিয়ে গিয়ে তাদের তাড়ি খাইয়েছে। কিছু ছেলে স্বেচ্ছায় খেয়েছে আর কিছু ছেলে তাড়ির প্রতি অনীহা প্রকাশ করেছে। তাড়ি খেতে অনিচ্ছুক ছেলেদের সিটু বলেছে, “ দ্যাখ, তোরা যদি তাড়ি না খাস, তাহলে তোদের বাবাদের বলবো, তোরা তাড়ি খেয়েছি। আর তখন তোরা তোদের বাবার কাছে রামধোলাই খাবি।“ তখন তাড়ি-পায়ী ছেলেগুলো সিটুর পক্ষাবলম্বন করেছে‌। অগত্যায় পড়ে ও রামধোলাইয়ের ভয়ে নিরীহ ছেলেগুলো তাড়ি পান করেছে। অবশেষে এই ধূর্ত দ্বয়ের পাল্লায় পড়ে ছেলেগুলো, সবাই বাবা-মার হাতে বেধড়ক মার খেয়েছে।


মেঘু, সিটু চুরির কাজে মজা পেতে পেতে, চুরি করার পরিণতি যে ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তারা ভুলে গেছে‌।হাদু তার দুই চেলাকে নিয়ে এক অন্ধকার রাতে বিদ্যুতের তার কাটতে যায়।তাদের কাটতে আসা বিদ্যুতের তারটি দীর্ঘদিন ধরেই অনেকটা ঝুলে থাকায় সেদিকে মানুষজন যায় না বললেই চলে‌। একদিন একজন ঝুলন্ত তারটির নীচ দিয়ে একটি ভেজা ধানের বোঝা নিয়ে যেতে বিরাট শক খায়। কিন্তু মূর্খদের নাকি সাহস বেশি। পরিণামের কথা না ভেবে, সিটু গুরুর কথায় খট খট করে একটি ধারালো অস্ত্র হাতে নিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির ডগায় উঠে যায় আর তার পিছু পিছু মেঘুও অনেকটা উঠে কিন্তু ধড়াম পড়ে যায়। শুকনো-শক্ত জমিতে হাঁটু গেড়ে পড়ায়, তার দুই পায়েরই হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সিটু ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে তার কাটতে গেলেই শক লাগে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ছিঁড়ে নিয়ে পড়লেই তার মৃত্যু হয়। তখন হাদু মেঘুকে তার গোপন ডেরায় চালান করে দেয়। সকালে হাদুর চেলারা রটিয়ে দেয়, “ দাঁত ভাঙা সিটু রাতে মাঠে পায়খানা ফিরতে গিয়ে ঝুলে থাকা তারটির শক 

খেয়ে মারা গেছে।"

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024