গল্প || তৃতীয় নয়ন || ডঃ রমলা মুখার্জী
তৃতীয় নয়ন
জন্মান্ধ অর্কর জন্যে ওর গরীব বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ নেই। তাঁদের অবর্তমানে পরাধীন হয়ে অর্ককে জীবন কাটাতে হবে। হয় তো ভিক্ষা করেই খাবার জোটাতে হবে তাকে!
অর্ক কিন্তু হারে না। বহু লড়াই করে, অন্ধবিদ্যালয়ে পড়াশোনা শিখে অবশেষে সে প্রতিবন্ধী কোটায় একটি স্কুলে চাকরি পায়।
নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তার মত অন্ধ গরীব বাচ্চাদেরও চোখে ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন আঁকার চেষ্টা করে চলে অর্ক অবিরত। বাড়িতে টেপ রেকর্ডার ও অন্যান্য শিক্ষণ-সহায়ক যন্ত্রপাতির সাহায্যে অন্ধ ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা বেতনে পড়ায় সে, আবৃত্তিও শেখায়।
গ্রামের সবাই গর্ব করে অর্ককে নিয়ে। মায়েরা তাদের সন্তানদের অর্ককে উপমা দিয়ে বলে, "দেখ তোরা চোখ থাকতেও অন্ধ, আর অর্ককে দেখ মনের আলোয় ও সবকিছু কত বেশি দেখে।"
অর্ক আবৃত্তিও করে ভারি চমৎকার! বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সে কিন্তু ছোট থেকেই আবৃত্তিতে প্রথম হয়ে আসছে। অর্কর বাবা বীরেণবাবু নাটকপাগল মানুষ, তিনি ছোট থেকেই ছেলেকে বহু কবির কবিতার ক্যাসেট নাটকের দল থেকে এনে তাঁর ছোট্ট টেপ রেকর্ডারে ছেলেকে শোনাতেন। অসম্ভব শ্রুতিধর অর্ক সেগুলি শুনে শুনেই মুখস্হ করে ফেলত। বীরেণবাবু ছেলেকে আবৃত্তিগুলি সুন্দর করে শিখিয়ে দিতেন। নাটক নাটক করে বীরেণবাবু কোনদিন কোন চাকরিতে যোগদান করেন নি। ফলে বৃদ্ধ বয়সে এখন তিনি প্রায় কপর্দকশূন্য।
বৃদ্ধ বাবা-মাকেও অর্ক মাথায় করে রেখেছে। অর্কের ছোট্ট সুন্দর বাড়িতে অর্কের ছেলে বুম্বাকে নিয়ে অর্কের বাবা-মায়ের শেষ জীবনটা পরম প্রশান্তিতে ভরে উঠেছে। বুম্বা ও পাড়ার আরও কয়েকটি কচি-কাঁচাকে নিয়ে বীরেণবাবু ইদানীং একটি শিশু-নাট্য দল "ক্ষুদে পালোয়ান" গড়ে তুলেছেন। টিভি, রেডিও, বিভিন্ন জনবহুল জায়গায় তারা ছোটদের উপযোগী নানা শিক্ষামূলক নাটিকা প্রদর্শন করে।
অন্ধ বলে অর্কের স্ত্রী সুতপার মনেও প্রথমে একটা কিন্তু ছিল। গরীবের মেয়ে সুতপা, চার বোন তারা, সুতপাই সবার বড়। তার বাবা যখন দাবীহীন অন্ধ সুউপায়ী পাত্রের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করলেন উপায়ান্তর না দেখেই বিয়েতে মত দিয়েছিল সুতপা। এখন কিন্তু সুতপার অর্ককে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়। দৃষ্টি না থাকলে কি হবে তৃতীয় নয়নের আলোয় অর্ক যে একজন মহামানব!
Comments