গল্প || পটলার কবিতা চর্চা || রঞ্জিত মল্লিক

 পটলার কবিতা চর্চা




                পটলা বেশ কিছুদিন ধরে কাজে বেরোচ্ছে না। আগে সকাল সকাল অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। এখন একদম ওর অটো রাস্তাতে দেখা যায় না। পটলার হলটা কি? সৃজাও বেশ কিছুদিন ধরে দেখছে পটা কাকুকে অটো নিয়ে চৌরাস্তার মোরে কম দাঁড়াতে দেখা যায়। একদিন রাস্তাতে দেখা হতেই সৃজা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,"কি ব্যাপার বলত তোমার, অটো নিয়ে আজকাল আর রাস্তা ঘাটে দেখি না তোমাকে?"


        "না না তেমন কিছু নয়।কদিন একটু....."

        "কদিন কি? শরীর খারাপ?

        "না রে। আসলে একটু অন্য কাজে সময় কাটাচ্ছি। তাই আমাকে এই কদিন দেখতে পাসনি।" 

        "বিষয়টা ঠিক পরিষ্কার হল না।"

         "পরে ঠিক বলব।"


             সৃজা কনভেন্ট স্কুলের বারো ক্লাসের ছাত্রী। ভীষণ স্মার্ট আর বুদ্ধিমতী। পটলার অটোতে যাতায়াত করে। পটলার সাথে ভীষণ সখ্যতা। পটলার সব খবরাখবর রাখে। এমনকি পটলার নতুন বান্ধবী হলেও অজানা থাকে না।


              দুদিন পরেই সৃজা রহস্যের সমাধান করল। পটাকাকুকে দেখল পার্কে অটো চালিয়ে এক বৌদিকে নিয়ে ঢুকছে। বৌদি দুদিন হল পটলার পাড়াতে ভাড়া এসেছে। দেখতে ভীষণ সুন্দরী। কবিতা লিখতেও যেমন পারেন। তেমনি ভাল আবৃত্তির গলা। বৌদির কাছে আধুনিক কবির কবিতার বইয়ের ভাল কালেকশান আছে।  


          একদিন সৃজা পটলার অটোতে দু একটা ঐ রকম বই দেখে চমকে ওঠে। অনেক জোরাজুরির পর পটলা ওকে জানায় যে ঐ বৌদি রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ভাল আবৃত্তিও করেন। পটলা নিজে আগ বাড়িয়ে বলতে গেছে যে সে একটু আধটু কবিতার চর্চা করে। একটা সময় ভাল আবৃত্তিও নাকি করতে পারত। এখন কাজের মধ্যে ঢুকে আর তেমন সময় দিতে পারেনা। তবে চর্চাটা বজায় আছে। আর তাতেই বৌদি বেশ গদগদ।


         সব শুনে সৃজার মাথা গেছে ঘুরে। এমনিতেই পটলার লোক হাসানোতে জুরি নেই। একবার সখ করে নাটক করতে গিয়ে কেলোর কীর্তি করে বসে। আর একবার কোন এক পার্টির জনসভা হচ্ছিল। জোর করে ওকে মঞ্চে তুলে দেয়। সবাইকে বলে বেড়িয়েছে ও না কি ভাল বক্তৃতা দিতে পারে। তা সে পার্টির মিটিং হলে তো কোন কথায় নেই। সেখানে মঞ্চে ভাষণ দিতে উঠেই আর এক কাণ্ড! এমন ভাঁট বকেছে যে মার খায়নি এই যা ভাগ্য ভাল। 


          যাই হোক আন্তর্জাতিক কবিতা দিবসে পটলার আবৃত্তি শোনার জন্যে ভিড় উপচে পড়েছে। ক্লাবের মাঠে। ঐ বৌদিও ভাল তালিম দিয়েছে। যাতে পটলা সাবলীল ছন্দে স্টেজে উঠেই বাজিমাত করতে পারে। তার আগে বেশ কিছু মহড়াও হয়ে গেছে। তাতে পটলা ভালই পারফরম্যান্স করেছে। যদিও বৌদি ভীষণ টেন্সড্। উনি সব বিষয়ে একটু খুঁতখুঁতে। পটলা পাঞ্জাবী পরে মঞ্চে উঠতেই হাত তালির ঝড়। বয়ে গেল। 


          এত লোকের সামনে পটলা এই প্রথম স্টেজে উঠছে। ওর বুকের ভিতর ছোট্ট "ভিসুভিয়াস"টা মনে হচ্ছে যেন দপদপ করছে। একটু নার্ভাস মনে হল ওকে। চোখে একটা চশমাও লাগিয়েছে। চশমাটা একটু তুলল। তারপর কপালের ঘামটা মুছে, মঞ্চে উপবিষ্ট গুণীজনদের প্রণাম ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে নিজের পরিচয় পর্বটা সারল। 


          কথা শেষ হতেই আবার হাততালির সুনামী আছড়ে পড়ল। পটলা খুশীতে ডগমগ করছে। জীবনে ওকে নিয়ে এত আবেগের ঝলকানি ও আগে কখনো দেখেনি। তাই....



            পটলা অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের একটি বিখ্যাত কবিতা চয়ন করেছে পাঠ করবে বলে। প্রথমে ঠিক ছিল "ঘুষ" কবিতাটি পাঠ করবে। পরে ঐ বৌদিই ওটা বাদ দিয়ে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের কবিতাটি বলার জন্যে ওকে অনুরোধ করে। পটলা বেজাই খুশী। পটলার এত ট্যালেন্ট আছে লোকে জানত না।


           একবার দম নিয়েই পটলা বলতে শুরু করল। মাঝে দু একবার থেমেও গিয়েছিল। তারপর আবার সেই চেনা কণ্ঠস্বর মাইক্রোফোনে ঝলসে উঠল। সবাই বলছে পটলা ফাটিয়ে দিয়েছে। এতে ওর ঘ্যাম আরো বেড়ে গেছে। তবে আবৃত্তির মঞ্চে হাসির রোল উঠল। হাততালি প্রথম দিকে হলেও পরে তা থিতিয়ে পড়ে।


            পটলা কিন্তু ঠিক আবৃত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। গলার উচ্চারণটা বেশ স্পষ্ট। মাঝে মাঝে দর্শক আসন থেকে চিৎকার ভেসে আসছে।


          "সাবাস পটলা! সাবাস!"

          ........... ......... ...........

          "জিও কাকা! চালিয়ে যাও....।

         "........ ফাটিয়ে দিয়েছ গুরু....."

 

            কেউ কেউ আবার একটু অন্য ঢঙে, রঙ চড়িয়ে বলতে শুরু করল......


             "জয়! পটলা বাবাজীবনের জয়!

              "জয় বাবা পটলকুমার! জয়......"

      

          পটলা কিন্তু বিষয়টা স্পোর্টিংলি নিচ্ছে। ও নিজেই জানে না কি হতে চলেছে। ও বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছে দর্শকের উচ্ছ্বাসে। একটা কবিতা আবৃত্তি করার পর আর একটা কবিতা পাঠ করবার জন্যে প্রস্তুতি নিল। সবাই তাতে আরো উল্লাসে ফেটে পড়েছে। পটলা বার বার বিজ্ঞের মতন চশমাটা তুলছে আর কাচটা মুছছে। 


                 এদিকে ঐ বৌদির আর দেখা নেই। পটলার আবৃত্তির শুরুর দিকে কিছুটা সময় থাকলেও পরে উনাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। উনি মোবাইলে প্রথম কিছু সময় ক্যামেরা বন্দি, ভিডিও রেকর্ডিং করার পর আর উনাকে অনুষ্ঠান চত্বরে দেখা যায়নি। পটলাও অনুষ্ঠান শেষে দেখা করার জন্যে ছুটে গেলেও দেখা পায়নি। 


             স্টেজ থেকে নামার পর পটলা দেখল অনুষ্ঠান কমিটির অনেকের মুখ বেশ থমথমে। ও নিজেই জানে না কি ঘটতে চলেছে। অথচ স্টেজে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ তো ঠিকই ছিল। কেউই আর ওর সাথে তেমন কথা বলছে না।পটলা ভাবছে আবৃত্তির পর তার হয়ত পার্সোনালিটি অনেকটাই বেড়ে গেছে।তাই হয়ত কেউ চট করে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। 


           একটু রাত করে বাড়ি ফিরল পটলা। দেখে পাড়াতে অনেকেই ওকে দেখে মুখ টিপে হাসছে। পটলাও একগাল হাসি উপহার দিল। 


                .......... ......... ...........

    

                দু সপ্তাহ অতিক্রান্ত। পটলা এখন বাড়ি থেকে কম বেরোচ্ছে। অটো নিয়েও বেশী রাউণ্ড দিচ্ছে না। সৃজাও পটাকাকুকে কম দেখতে পাচ্ছে রাস্তা ঘাটে। পটলার হোলো টা কি? তাহলে কি সৃজা যা ভাবছে সেটাই ঠিক। 

        

           তবে ঐ বৌদিকে টানা দুই সপ্তাহ দেখা যায়নি। উনি ঘর থেকেই বেরোন নি। শরীর খারাপ হয়নি উনার। আসলে মন ভাল নেই। কোন কারণেই হোক......।


            আসল সত্যটা সৃজা জানল অনেক পরে। জানার পর থেকেই সৃজার হাসি আর থামছে না।এতবড় একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে পটলা যে এইভাবে কিস্তিমাত করবে কে জানত? তবে সবাই একবাক্যে বলছে, পটলার দম আছে।


            পটলার কবিতার আবৃত্তির মোবাইলে তোলা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।আর পটলা তাতেই রীতি মত ফেমাস। সেইজন্যেই ও ঘর থেকে বেরোতে চাইছে না। এটা ঠিক পটলা পার্সোনালিটি মেনটেন করতে জানে।


            ঐ দিন আবৃত্তি করতে গিয়ে জগা খিচুড়ি করেছে। প্রথমে ঠিকই ছিল শুরুতে। পরে অচিন্ত্য সেনগুপ্তের কবিতার মধ্যে জীবনানন্দের "বনলতা সেন" বেলাইন হয়ে ঢুকে পড়েছে। মাঝে আবার জয় গোস্বামীর "নুন" কবিতার দু একলাইনও নিজের অজান্তেই বলে ফেলেছে। জীবনানন্দ দাশ নোবেল পেয়েছেন সেটা কবিতা পাঠের শুরুতে বলতেও ভোলেনি। আর তখনই হাততালির দাপট আরো বেড়ে যায়। ঐ হাততালির শব্দ যে ওকে বিদ্রূপ করা হচ্ছে সেটা পটলা ধরতে পারেনি।


          যাইহোক পাড়াতে এখন ওর কদর বেড়েছে। ও এখন কবিতা লিখতেও শুরু করেছে। তারজন্যে আজকাল বেশ পড়াশোনাও করছে বলে মনে হল। সপ্তাহন্তে কলেজ স্ট্রীটের ধ্যানবিন্দুতে একবার করে যায়। আর সেখান নামী, গুণী লোকেদের সাথে আড্ডা জমায়। নিজেকে সমৃদ্ধ করে। 


          ভাল প্রকাশনীর খোঁজে আছে ও।বইমেলাতে নিজের একক বই, একটা সংকলন প্রকাশের বহুদিনের ইচ্ছে মনের মধ্যে সুপ্ত ছিল। 


          আজ তা মনে হচ্ছে ডাল পালা ছড়িয়ে বাস্তবের আলো দেখতে চলেছে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024