রম্যরচনা || অন্ধকারের উৎস হতে || সামসুজ জামান
অন্ধকারের উৎস হতে
“ অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো...” এই আলোর গুরুত্ব আমাদের জীবনের জন্য নেহাত কিছু কম নয়। বরং বলা ভালো সময়ে সময়ে সেই আলো স্বর্গীয় দীপ্তিতে আমাদের জীবন যৌবনের প্রতিটা প্রতিটা মুহূর্ত কে আরো অনেক বেশি উদ্ভাসিত করে দেয়।
আমার আন্দামানের শিক্ষকতা জীবনের সামান্য একটা ঘটনা। এমনিতে সম্পূর্ণ শিক্ষকতা জীবনে হাতেগোনা দু-একদিন মারধর করেছি। কিন্তু সেদিন দয়াল নামের অত্যন্ত দুরন্ত একটি ছাত্রকে মারার ফল খুব বিপদজনক হবে সেই চ্যালেঞ্জের মুখে এক সহকর্মী খানিকটা বাজেভাবে আমায় ঠেলে দিয়েছিল। ক্লাসে পড়াচ্ছিলাম জীবনানন্দের কবিতা। ঠিক সেসময় খুব ঔদ্ধ্যত্যের সঙ্গে ক্লাসের বাইরে থেকে দুলালের আগমন। দুম করে বিঘ্ন ঘটানোয় অসহ্য হয়ে বেধড়ক মার দিয়েছিলাম দয়ালকে। দুলাল নাকি খুব বাজে ছেলে? কিন্তু মাথা নত করে আমার মার আশ্চর্যভাবে নীরবে সহ্য ক’রে আমার মনের অন্ধকারে দুলাল আলো উৎসারিত করেছিল সেদিন। কোন ঔদ্ধত্যের প্রকাশ' নয় বিনয়ের সঙ্গে দুলাল মাথানত করে বলেছিল "স্যার, আর কোনদিন এরকম ভুল করবোনা স্যার!"
সঙ্গে সঙ্গে আমার উপলব্ধিতে নিজেকে ঠিক সেই মুহূর্তে একটা পশুর মত মনে হয়েছিল। ছি: ছি: ছি:! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিলাম আর ভেবেছিলাম এত বড় ভুল করলাম ছেলেটাকে ওভাব মেরে? কত কিছু শিখতে আমাদের বাকি আছে এখনো আমাদের। মন থেকে কেউ যেন দেখিয়ে দিয়েছিল 'অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো' সত্যিই কখন কিভাবে যে আমাদের মনে সাড়া জাগায় তা অকল্পনীয়।
জীবনে উপলব্ধি করেছি আসলে খুঁজে নিতে জানলে তবেই কালো মায়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন দেখা যায়। মন বিক্ষিপ্ত থাকলে শান্ত সংযত না হলে সেই আলো দেখা যায় না, দেখা যায় শুধু অন্ধকার। সেইজন্যেই কবি বলেছেন "কেউ নয়ন মুদে দেখে আলো, কেউ দেখে আঁধার"। আসলে অন্ধকারের উৎসেই লুকিয়ে থাকে বিদ্যুতের ঝলক। কালো অন্ধকারময় রূপের আড়াল থেকে ভুবনমোহিনী হাসি নিয়ে আলোয় আলোকিত হয়ে আবির্ভূত হন ভালবাসাময় পরম সিদ্ধপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। তাই সন্তান বিয়োগব্যথার পাথার বুকে করেও নজরুল চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া পৃথিবীর রূপে নিজেকে হারিয়ে ফেলে সেই মুহূর্তে পৃথিবীর রূপ সুধা আকন্ঠ পান করতে পারেন। অগনিত স্বজনবিয়োগ অগ্রাহ্য করেও কবিগুরু তাই অন্ধকার নয়, আলোর হাতছানি উপলব্ধি করেন। আর শান্ত মনে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ করেন– "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে....।”
Comments