উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -22
এবার ভয় আর নেই। সাহস নিয়ে কথা বলতে শিখেছি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা অর্জন করেছি। ভয় আর কাউকেই করি না, করবো না। প্রয়োজন হলে ওর হাতেই মরবো তবু অন্যায়কে আর প্রশ্রয় দেবো না। শ্যামলীদির কাছে গিয়ে দেবীবাবুর কথা বললাম। তার আসার সময় হয়ে গেছে। যদি আমরা উভয়েই যেতাম তাহলে ভালো হতো না কি? কারণ যদি বাবুগুন্ডা মাথানাড়া দিয়ে উঠে ও শ্যামলীদিকে একা পেয়ে কিছু করে বসে।
শ্যামলীদি আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, কোন ভয় নেই পদ্মা, আমি মরিয়া হয়ে গেছি। কিছু ঘটবার পূর্বে কোন কান্ড না করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ব না। তুই তৈরী হয়ে নে, দেবীবাবু হয়তো এসে পড়ল। সত্যিই দেবীবাবুর ট্যাক্সির আওয়াজ পেলাম।
ট্যাক্সি হতে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কাছে দাঁড়ালো। মুখখানি দেখে তাকে চিন্তাকূল মনে হল। আমি বসার জায়গায় গিয়ে নম্র কণ্ঠে বললাম, আপনাকে ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে ?
দেবীবাবু ধীর কণ্ঠে বললেন, ভাবছি আপনাদের কথা। গত রাত্রের ঘটনা শুনলাম।
দেবীবাবুর কথা শুনে হাসিমুখে বললাম, ও এই কথা? তাছাড়া আমাদের নিয়ে চিন্তা করেই বা কি করবেন? মনকে ভারাক্রান্ত করা ছাড়া করার কিছু নেই। আমার ডিউটি ফুরিয়ে গেলে আমাকে তো বিদায় নিতে হবে। আমাদের কি মনে রাখবেন?
দেবীবাবু নীরব থাকলেন। জানি না তিনি আমাদের দুঃখে কতখানি কাতর হয়েছেন। বিলম্ব না করে তার সাথে নার্সিংহোমে উপস্থিত হলাম।
ময়না আমাকে দেখে কেঁদে উঠল। বলল, মা তুমি এতো দেরী করলে কেন? তোমার জন্য মন আমার একেবারে ভালো লাগে না। ওকে বুকে চেপে বললাম, আমার উপর রাগ করিস না মা। বাড়ীর কাজ সারতে অনেক দেরী হয়ে গেল।
ময়না আবদারের গলায় বলল, তোমার সাথে আমি বাড়ি যাবো মামনি। অবোধ শিশুকে কি বলে যে প্রবোধ দেবো তার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও বেদনা ভরাক্রান্ত হৃদয়ে চোখের জলকে কোন রকমে আটক করে বললাম, এখানে আর আর রাখবো না মা। দিন কয়েক পরেই তোকে বাড়ীতে নিয়ে যাবো।
কোলে নিয়ে তাকে আদর করছি, এমন সময় ডাঃ দাস এসে বললেন, মিসেস রায় আপনার মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। আশা করছি দিন কয়েক পরে ছুটি দিতে পারবো।
বুকটা আমার কেঁপে উঠল ডাক্তারবাবুর ডাক শুনে। তবে কি দেবীবাবু - না, না এ হতে পারে না, এ কোনদিনই সম্ভব নয়। ময়নার সাথে শুধু অভিনয় করছি, ছলনা। করছি। কেন আমি ময়নার মা হতে যাবো? বামন হয়ে চাঁদে হাত! তবুও বুকটা কেমন যেন টনটন করে উঠল। বুকের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকলাম। আপনা আপনি চোখ দুটো জলে ভরে গেলো।
কোন প্রকারে সামলে নিয়ে ময়নার কণ্ঠস্বরে, মা তুমি কাঁদছো ? তৎক্ষণাৎ চোখের জল মুছে বললাম, নারে কাঁদবো কেন? আরো গভীর আবেগে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। একটু পরে দেবীবাবু এসে হাজির হলেন।
ময়নার ঠোটে ঠোট লাগিয়ে চুমু খেলাম। দেবীবাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার ওকে কোল হতে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিন, হয়তো ডাক্তারবাবু এসে পড়বেন। যাও মামণি, তোমার বিছানায় শুয়ে পড়গে। মায়ের কোলে আর কতক্ষণ থাকবে?
দেবীবাবুর গম্ভীর মুখ দেখে আমর কেমন যেন সন্দেহ হল। হয়তো ময়নার চুমু খাওয়া পছন্দ করেননি। তবে কি দেবীবাবু আমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন? আমাকে কি অবজ্ঞা করেন? তৎক্ষণাৎ মনের মধ্যে নিজের সত্ত্বাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করলাম।
ময়নাকে চুমু খাওয়া আমার উচিত হয়নি। সে অধিকার আমার নেই। ওটা অনধিকার হস্তক্ষেপ। দেবীবাবু কেন মেনে নেবেন সেটা? তার কাছে আমি তার মানসিক রোগগ্রস্থ মেয়ের রোগ উপশমের জন্য মায়ের অভিনয় করার জন্য এসেছি। তিনি যা বলবেন সে মত করতে হবে। ময়নার সাথে তার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করায় চুক্তিবদ্ধ আমি। তাহলে কেন ওর প্রতি আমার মায়ার টান! ময়নার যে মা নই, তা ভালোভাবেই জানি। দেবীবা একজন সম্ভ্রান্ত বংশের ব্যাক্তি, তার আভিজাত্যপূর্ণ জীবনের সঙ্গে আমারপতিতাবৃত্তির জীবনের কোন সাদৃশ্য নেই। অন্তরের সুপ্ত কামনা বাসনাকে প্রকাশ না করে ময়নাকে বিছানায় শুইয়ে বাইরে এলাম। ময়নার ছল ছল চোখ আমার অন্তরের মাতৃত্বকে এক মুহুর্তের জন্য জাগিয়ে দিল।
নিরালায় এসে চোখের জলে ভাসতে থাকলাম। বার বার অতীতের স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম। কখন যে দেবীবাবু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমার খেয়াল ছিল না। তিনি আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ময়নার কাছ হতে যে চলে এলেন?
দেবীবাবু কোনদিন আমার দেহ স্পর্শ করেননি। কেন তিনি আমার পিঠে হাত রাখলেন! তবে কি আমার উষর মরুময় রুক্ষ জীবনে শ্যামল মরূদ্যান হয়ে দেবীবাবু আমার জীবনকে শ্যাম-সমারোহে ভরিয়ে তুলবেন? এ কি আমার স্বপ্ন! এ কি আমর অলীক কল্পনা! কখনও কি আমার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হবে না। মরা গাঙে জোয়ারের প্লাবন কি আসবে না। শীতের ঝরাপাতা গুলোর স্থানে আমার মনতরু কি বাসন্তী পরিবেশে সুশোভিত হবে না। না-না, এ আমার ভুল ধারণা। কেন যে আমার মনে এরকম এলোমেলো কথা আসে বুঝি না।
কোন প্রকারে চোখের জল মুছে বললাম – আমাকে বাড়ীতে পৌঁছে দেবেন? দেবীবাবু ব্যথিত স্বরে বললেন, আমার উপর রাগ করলেন বুঝি? ম্লান হেসে বললাম, রাগ করব কেন? তাছাড়া অভিমান করে কি লাভ ? আমি বক্তী যাবো।
নিশ্চয় যাবেন। আপনাকে কোনদিনই তো জোর করে আটকে রাখিনি। আপনার সাথে আমার যেরূপ কথা, আপনি সেইরূপ কাজ করবেন। তবে আমার অনুরোধ, বিকেলে আসতে ভুলবেন না। কারণ আনতে যাবার সময় হবে না, বিশেষ কাজে বাইরে যাবো।
দেবীবাবুকে কথা দিয়ে ওর সাথেই বস্তীতে উপস্থিত হয় শ্যামলীদির মুখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি যে অবাক হলাম না তা নয়। সে তার চোখ দুটোকে জবাফুলের মতো লাল টকটকে করেছে। মনে হলো কারো সঙ্গে যেন ঝগড়া করেছে।
ধীরে ধীরে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম, আজ আবার কার সাথে ঝগড়া করলে দিদি ?
আমার আদরি মাসীর সাথে। তাছাড়া আর কার সাথে ঝগড়া করবো? এখানে আমার শাশুড়ীও নেই, ননদও নেই, সতীনও নেই যে ওদের সাথে ঝগড়া করবো। আদরী মাসী আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছিলো। তা থাক, হ্যাঁরে পদ্মা, বাঁ চোখটা নাচছে কেন বল তো? শুনেছি, বাঁ চোখ নাচলে কিছু পাবার আশা থাকে।
আমাদের পাওনা তো পেয়ে গেছি শ্যামলীদি, নতুন করে আবার কি পাবো ? সহসা বিদ্যুৎ বেগে একটা দশ বারো বছরের ছেলে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।
ওর হাতে একটা কাগজের টুকরো। শ্যামলীদির দিকে বাড়িয়ে দিতে শ্যামলীদি হোঁ মেরে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখলো ওটা পত্র। শিবাজীদা পত্রটা লিখেছে হিন্দীতে লেখা। পত্রের সারাংশ হলো আজ সকালে আমাদের হিতৈষী বন্ধুকে পূর্ব নির্দিষ্ট ঠিকানায় আটক রেখেছে। আমরা আজ সন্ধ্যায় অর্থাৎ সাড়ে সাতটার মধ্যে যেন হাজির হয়ে যাই।
সেই ঠিকানায় যাবার নক্সা করে দিয়েছে। শ্যামলীদির মুখটা ক্রমশঃ খুশীতে ভরে উঠল। এক সময় আমাকে জাপটে ধরে বলল, এবার আমার আশা পূর্ণ হবে পদ্মা। আজকে আমার আসল রূপ দেখবি। দীর্ঘদিন প্রতীক্ষার পর আমার দীর্ঘদিনের পাথরচাপা বেদনাকে হৃদয় থেকে মুক্তি দিতে পারব।
সে ভেতরে প্রবেশ করে তার লুকিয়ে রাখা বেতের চাবুকটা বের করে তৈল নিষিক্ত করে আমাকে বলল-আজ রাতে একে ব্যবহার করতে হবে, অনেকদিন পর একে কাজে লাগাবো। বুঝতে পারলাম ওটা কার পিঠে বসবে। মনটা একটু আনন্দে দুলে উঠল, একারণে অনেক দিন পর আমার উপকারী বন্ধু রন্টুদাকে দেখবো বলে। সে কি উপকারই না করেছে আমার!
অতীতের স্মৃতির পাতা যখন উল্টে চলেছি, তখনই আদরি মাসীর কণ্ঠস্বরে কল্পনার রাজ্য থেকে রূঢ় বাস্তবে ফিরে এলাম। আবার এসেছে বুড়ি! লজ্জাও নেই তার!
শ্যামলীদিকে বলল, আজকের মতো কথা রাখিস মা। ভম্বলবাবু আমার পুরানো মক্কেল, তোকে ভীষণ পছন্দ করে। আমাকে বার বার বলে গেছে যদি তোকে না পেয়ে থাকে তাহলে আমার অনেক ক্ষতি হবে। তোর হাতে ধরে বলছি আমার মুখ রাখিস মা।
শ্যামলীদি মুখ গম্ভীর করে বলল, আজ আর কারো বাপের হিম্মৎ নেই যে আমার পথে কাঁটা ফেলবে। আর কেউ যদি সে চেষ্টা করে, তাহলে সে যোগ্য জবাব পাবে। সন্ধ্যায় আমাকে বেরুতেই হবে। তাই সাত ঘন্টা আগে বলে রাখছি, যদি কেউ কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাহলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবো। আদরী মাসী ভয়ে পিছিয়ে গেলো।
Comments