উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -25
আমার মর্মবেদনা অনুভব করে শ্যামলীদি বলল, কোন চিন্তা করিস না, আমি যখন আছি তোর বাবাকে আর পথে পথে ভিক্ষে করতে দেব না। আমার বাসাতে রেখে আমি তাকে সুস্থ করে তুলবো। আমাকে দেখিয়ে দিবি কে তোর বাবা। বিলম্ব না করে শ্যামলীদিকে সাথে নিয়ে হাজির হলাম। বাবা তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শহরের অভিমুখে।
একজন ধনী পুত্র হয়ে এক মুঠো অন্ন সন্ধানে পথে পথে ভিক্ষে করছে। অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস। তবে কি এ তার কর্মফল ? কেউ উত্তর দেয়নি। বার বার মনকে জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পাইনি। শুধু দারুণ মর্মবেদনায় আমার অন্তর জ্বলে জ্বলে উঠছিলো। বাণবিদ্ধা হরিণীর মতো আমাকে কাতর করে তুলেছিল। এই স্থানে বাবাকে একটি বারও বাবা বলে ডাকতে পারবো না। মেয়ে বলে পরিচয় দিতে পারবো না। আমার কণ্ঠস্বর তার কানে পৌঁছলে বাবা জানতে পারবেই আমি তার কন্যা রমা।
নোংরা পল্লীতে নোংরা মেয়ে ছাড়া কি ভালো মেয়ে থাকবে? বাবা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে, শ্যামলীদি বাবার কাছে গিয়ে বলল, আপনি ফিরে যাচ্ছেন বাবা?
কে বাবা বলে ডাকলে মা? তবে কি রমা? না-না এ রমার কণ্ঠস্বর নয়। আর এই নোংরা পাড়ায় রমা আসবে কেন? রমা ভালো চাকরি পেয়েছে। কিন্তু হতভাগী মা আমার কোথায় যে আছে জানি না। তুমি কে?
আমাকে আপনার মেয়ের মতো মনে করবেন। অনেক দিন হলো বাবাকে হারিয়েছি। তারপর ভাবলাম আপনিই আমার বাবা, কারণ আপনাকে দেখতে আমার বাবার মতো। সেই মুখ, চোখ, সেই নাক একই রকম দেখতে যেন। তাই -
তোমার বাবাকে কি হারিয়ে ফেলেছো মা?
হ্যাঁ, বাবা পাগল হয় আমাদের সকলকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গেছেন আজও পর্যন্ত খুঁজে পাইনি। আপনার সাথে যখন আমার বাবার অনেকখানি সাদৃশ্য আছে সেজন্য আপনাকেই বাবা বলে মেনে নেব। আপনি কি আমাকে মেয়ে বলে মেনে নিতে পারবেন না।
কিন্তু এই নোংরা পল্লীতে
ভাগ্য এখানে টেনে এনেছে বাবা। আপনি আমার বাসায় চলুন, আপনি ক্লান্ত অবসন্ন, আপনার বিশ্রামের দরকার। সময় হলে আমার দুঃখের কথা শোনাবো। অশুচি, অপবিত্র বলে ঘৃণা করবেন না ।
ও কথা কেন বলছো মা। বাবা কি মেয়েকে কখনো ঘৃণা করতে পারে ? হ্যাঁ, মা আমি তোমার সাথে যাবো। আমার ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খেতে দেবে মা? জানো মা গত দু'দিন থেকে আমি অভুক্ত আছি।
আমার সাথে আসুন সব ব্যবস্থা হবে। বাবার অভুক্ত থাকার কথা শুনে আমি একরকম মুখ চাপা দিয়ে কেঁদে উঠলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেলাম না। আমার কান্না শুনে বাবা বলে উঠলেন, কে কাঁদছে মা?
ও আমারই বোন। বাবা ওকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আসুন আমার সাথে, বাড়ীতে গিয়ে পরিচয় হবে। শ্যামলীদি বাবার হাত ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাসার দিকে। আমি মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে পিছনে চললাম। কি দুর্ভাগ্য আমার। বাবাকে কাছে পেয়েও বাবার নিকট আমার পরিচয় দেবার মতো মুখ নেই। যদি তিনি দৃষ্টিশক্তি না হারাতেন তাহলে আমি কি করতাম? তবে কি বাবাকে উপেক্ষা করে চলে যেতাম? মানসিক যন্ত্রণাকে কোন প্রকারে চাপা দিতে না পেরে ঘরের ভেতরে গিয়ে তক্তাপোষের উপর উপুড় হয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলাম। শ্যামলীদি আমার পিঠে ঘা মারলো। তবুও আমার মন মানলো না। কাটা ছাগলের মতো ছটপট করতে থাকলাম। শ্যামলীদি দ্বিতীয়বার ধমক দিতে নিজেকে একটু শান্ত করলাম। ধীরে ধীরে দরজার কাছে এগিয়ে এসে এক দৃষ্টে বাবার মুখপানে তাকিয়ে বার বার ঠাকুরদার কথা মনে পড়তে থাকল। কত আদর যত্ন করে বাবাকে মানুষ করেছিলেন। আজ তার এই দুর্দশা। আর মেয়ে বারবণিতা। যে পাপের বোঝা মাথায় বয়ে চলেছি তার ঘৃণ্য ইতিহাস প্রকাশ করে বাবার এই দুর্বলচিত্তে শোকানল প্রজ্বলিত করতে চাই না। হয়তো আমার পরিচয় জানতে পারলে মানসিক স্থৈর্য্য রাখতে পারবেন না ।
শ্যামলীদি খাবারের ব্যবস্থা করল। খাবার মুখে তুলে বললেন, বহুদিন পর আজ মেয়ের ডাক শুনলাম মা। তোমার মতো আমারও একটি মেয়ে ছিল। বড় আদর যত্ন করতো। কিন্তু এই কলকাতাতে চাকুরি করতে এসে আর ফিরে গেলো না। জানো মা, এই মহানগরীর জনস্রোতে কোথায় যে হারিয়ে গেছে জানতে পারিনি। চোখের দৃষ্টিকে হারিয়ে আমি আবার নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছি। এই কলকাতা শহরে ছেলে ও মেয়ে দুজনকে হারিয়ে ফেললাম। আমার নিকট এই কলকাতা মহানগরী এক বিভীষিকা। ওদের চিন্তায় এই আমার অবস্থা। আমার মনে হয় নিশ্চয়ই এ আমার পূর্ব জন্মের পাপ।
শ্যামলীদি বলল, আগে খেয়ে নিন তারপর আপনার কথা শুনবো। বাবা কথা না বলে মুখে খাবার তুললেন। একটু পর হঠাৎ কাশি আরম্ভ হলো। পরপর দুদিন অনাহারে থেকে ওর ভেতরটা শুকিয়ে গেছে। কাশি থামছে না। এক সময় কাশির সাথে এক ঝলক রক্ত বেরুতেই চমকে উঠলাম। তবে কি বাবার টি.বি. হয়েছে।
শ্যামলীদি দৌড়ে এসে বাবাকে ধরলো। চাপ চাপ তাজা রক্ত মুখ দিয়ে অনর্গল বেরুতে লাগলো। শ্যামলীদিকে অতি ধীর কণ্ঠে বললাম, বাবার একি অবস্থা দিদি? আমি যে সহ্য করতে পারছি না।
কোন ভয় নেই, আমি যখন আছি সব ব্যবস্থা হবে। তুই এক কাজ কর, বাবার
দিকে নজর রাখ আমি ডাক্তার ডাকছি। বাবা বললেন, ডাক্তার ডাকতে হবে না মা। আমার টি.বি. হয়েছে। আগে কয়েক বারই মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। আমার মেয়ের অনুসন্ধানে দীর্ঘকাল অনাহারে, অনিদ্রায় যত্রতত্র খুঁজেছি। যার ফলেই আমাকে দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়তে হয়েছে। আমার যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে মা।
তুমি অস্থির হয়ো না। এই মানুষটাকে শেষ হতে দাও। আমার বেঁচে থেকে কি
লাভ ?
শ্যামলীদি আমার কাঁধে হাত রেখে জানিয়ে দিলো ঘাবড়াবার কিছু নেই। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। বিলম্ব না করে শ্যামলীদি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই দুজন পুলিশ ইন্সপেকটর ও চারজন কনস্টেবল এসে শ্যামলীদির পথ অবরোধ করে বললেন, এখানে শ্যামলী চৌধুরী কার নাম?
কি দরকার তার সাথে ?
আমরা জানতে চাইছি, দুজনের মধ্যে কার নাম শ্যামলী চৌধুরী? শ্যামলীদি একটু চিন্তা করে বলল, আমি শ্যামলী চৌধুরী। এবার বলুন কি প্রয়োজন ? আপনাকে গ্রেপ্তার করতে এসেছি।
কারণ?
আপনি খুনী।
খুনি ?
হ্যাঁ। এই চাবুকাটা চিনতে পারছেন? এই চাবুকের বাঁটে আপনার নাম লেখা আছে। তাছাড়া শিবাজী সিং এর একটা লোক ধরা পড়েছে। সে আপনার নাম বলেছে। চলুন বিলম্ব করবেন না।
Comments