উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -24
আট
যখন আমরা বাড়ীতে ফিরলাম, অনেক রাত হয়েছে। শ্যামলীদি পোষাক-টোষাক না বদলে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। মনে হয় আজ শান্তিতে ঘুমুবে। প্রায়ই দেখেছি গভীর রাত পর্যন্ত জেগে কি এক চিন্তায় মগ্ন থাকতো। ঘুম তো তার কাছ থেকে এক রকম বিদায়ই নিয়েছিল। গায়ে চাদরটা ঢাকা দিয়ে ওর মুখপানে তাকিয়ে থাকতে চলচ্চিত্রের মতো কয়েকটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কেউ কি জানতো শ্যামলীদি খুনী হবে? কি প্রয়োজন ছিল খুন করার? ইচ্ছে করলে কি সে ক্ষমা করতে পারত না? না। শ্যামলীদি একরোখা মেয়ে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বদলা নিতে পিছুপা হয় না । কখনো বজ্রের মতো কঠিন আবার কখনো কুসুমের মতো কোমল ৷ জানি না, খুন করে সে কতখানি অন্যায় করেছে। তবুও সে খুনী! তাই করজোড়ে ঈশ্বরের কাছে প্ৰাৰ্থনা করলাম, সে খুনী হলেও তার যেন শাস্তি না হয়। সে যেনপুলিশের কাছে ধরা না পড়ে। শ্যামলীদি ছাড়া কোন প্রকারেই এখানে থাকতে পারবো না বাবুগুণ্ডা আর আদরী মাসীর অত্যাচারে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠব। কিন্তু ঐ শয়তানী আদরী মাসী যদি জানতে পারে শ্যামলীদি খুনী, তাহলে কি হবে তার আগে উভয়ে এই নরককুণ্ড থেকে যেমন করে হোক পালিয়ে যাবো। কেউ আমাদের নাগাল পাবে না। হঠাৎ এক সময় এসব ভাবনার মধ্যেই তন্দ্রালু অবস্থায় শ্যামলীদির পাশে শুয়ে পড়লাম। পরদিন যখন ঘুম ভাঙলো, তখন অনেক বেলা গড়িয়ে গেছে।
নিত্যকার পদ্ধতিতে আমার সখীরা তখন তাদের সংসারের কাজে মন দিয়েছে। কেউ নোংরা জামা-কাপড়ে সাবান দিচ্ছে। আবার কেউ বা উনুনে আঁচ দিচ্ছে। দশটার মধ্যে রান্না-বান্নার কাজ ও আহারাদির পর টানা চার পাঁচ ঘন্টা ঘুম দেবে। কারণ সখীদের নব নব আগন্তুকের জন্য নিশিযাপন করতে হয়। সমস্ত রজনী কেটে যায় প্রেমলীলায়। সকাল পর্যন্ত সেই ঘরে রজনীগন্ধার সৌরভ, আতরের উগ্র গন্ধ ও ফুলের ছিন্ন মালা পড়ে থাকতে দেখা যাবে।
এক সময় দেবীবাবুর গাড়ীর আওয়াজ পেলাম। কোন প্রকারে মুখে জল নিয়ে শ্যামলীদিকে উঠতে বললাম। কারণ সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। নিদ্রিত শ্যামলীদির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছল সে যেন চরম প্রশান্তি লাভ করছে, দীর্ঘদিনের ব্যথিত মন যেন তার শান্তি পেয়েছে।
অন্যদিন সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। আজকে কোন তাড়া নেই, আমি শ্যামলীদিকে উঠাবার আগে দেবীবাবু দরজার কাছে হাজির হয়েছেন। শ্যামলীদি আমার ডাক শুনে ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, বিরক্ত করিস কেন? শান্তিতে কি ঘুমুতে দিবিনি ?
দেবীবাবুর আগমন বার্তা বললাম, তবুও সে অনড়। দেবীবাবু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকাতে ভেতরে প্রবেশ করতে বললাম। কোন দ্বিধা না করে ভেতরে প্রবেশ করে একটা কাঠের চৌকির উপর বসলেন। আমি কয়েক মিনিটের মধ্যে সাজগোজ করে শ্যামলীদিকে বলে দেবীর সাথে বেরিয়ে পড়লাম ।
ময়নার কাছ হতে ফিরতে বেশ দেরী হলো। ট্যাক্সির মধ্যে বসে আমার অতীতের ব্যর্থতা ও নৈরাশ্য পীড়িত জীবনের হাহাকার আমাকে উতলা করে তুলল। খুনী শ্যামলীদির কথা, দেবীবাবুর কথা সর্বোপরি ময়নার কথা আমার জীবনের চিন্তাধারাকে এলোমেলো করে দিলো। আর কটা দিনই বা ময়নার কাছে থাকবো। নদীর স্রোতের মত দিন বয়ে যেতে থাকে। আর বেশীদিনের মেয়াদ নেই। কয়েকদিন পরেই দেবীবাবু আমাকে ছুটি দেবেন। ময়নাকে ভুলে যেতে কি পারবো ?
হঠাৎ গলাটা আর্দ্র হয়ে গেলো। মনে হলো ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠি। কিন্তপারিনি। ততক্ষণাৎ কে যেন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলো আমি একজন বারবণিতা, আমার এতো মায়া কেন? নেহাত তার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য দেবীবাবুর মত একজন গণ্য মান্য লোক বারাঙ্গনালয়ে পা ফেলেছে। নচেৎ তার সঙ্গে আমার যোগাযোগই ঘটতো না।
ট্যাক্সির জানালায় মুখ বাড়াতেই চোখ দিয়ে টপ্ টপ্ জল পড়ছিলো। গভীর ভাবে আমি অতীতের চিন্তায় মগ্ন ছিলাম। এমন সময় আচম্বিতে কয়েকটা কথা কানে প্রবেশ করতেই আমার চোখ পড়লো একটা ভিখিরির প্রতি। পরিধানে শতছিন্নবস্ত্র, মুখখানি খোঁচা-খোঁচা দাঁড়িতে পরিপূর্ণ, কংকালসার দেহ, হাড়ের সাথে যেন দেহের চামড়া লেগে আছে। ঘাড়ের গলায় চাপ চাপ ময়লা জমে আছে। চোখ দুটো কোটরাগত। চোখের পাতা দুটো শুধু মিট মিট করছে।
একটা মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলছে অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে - দুটো পয়সা দাও। অন্ধকে দান করো বাবু, দুদিন পেটে কিছু পড়েনি। ভিখিরির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না, সে আর কেউ নয়, আমার পিতা। বাবা বলে ডাক দেবার আগে মেয়েটা বলে উঠল কড়া মেজাজ নিয়ে, এই নোংরা পাড়ায় কেন আস বল দিকি? এখানে কি পাবে বলতে পারো ?
আর থাকতে পারলাম না। কণ্ঠ আমার রুদ্ধ হয়ে গেলো। কে যেন প্রবল শক্তি দিয়ে আমার গলাটা চেপে ধরলো। তবুও জোর করে কয়েকটা কথা দেবীবাবুকে বললাম, আপনি বাড়ী যান, আমি এখানে নামবো। দেবীবাবু আমার মানসিক দুর্বলতা বুঝতে পারলেন, কিছু কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললাম, বিকেলে আসুন আলোচনা করবো।
দেবীবাবু বাক্যব্যয় না করে ট্যাক্সি নিয়ে প্রস্থান করলেন। আমি ঐ স্থানে না দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় গুঁজে শ্যামলীদির কাছে উর্দ্ধশ্বাসে হাজির হয়ে বাবার কথা বললাম। এরপর বল দিদি কি করে বাবাকে আমার পরিচয় দেব? বাবা বলে একটি বার ডাকতে পারলাম না। নোংরা বস্তীতে হাজির হয়েছে বলে বস্তী ত্যাগ করে শহরের দিকে পা বাড়িয়েছে। বাবা যদি জানতে পারে আমি পতিতা বৃত্তি গ্রহণ করেছি, তাহলে বাবা আর বাঁচবে না। তাই আমি বাবা বলে ডাকতে পারিনি। বাবার কাছে আমার এই ঘৃণ্য পরিচয় দিতে পারিনি। মনের দুঃখ চাপা রাখতে না পেরে দেওয়ালে মাথাকে আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করার চেষ্টা করলাম। আমার বাবাকে আমার পরিচয় দিতে না পারায় আমি আমার অদৃষ্টকে ধিক্কার দিলাম।
Comments