উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -23


 


শ্যামলীদি মুখ গম্ভীর করে বলল, আজ আর কারো বাপের হিম্মৎ নেই যে আমার পথে কাঁটা ফেলবে। আর কেউ যদি সে চেষ্টা করে, তাহলে সে যোগ্য জবাব পাবে। সন্ধ্যায় আমাকে বেরুতেই হবে। তাই সাত ঘন্টা আগে বলে রাখছি, যদি কেউ কোন রকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে তাহলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবো। আদরী মাসী ভয়ে পিছিয়ে গেলো।


আমি শ্যামলীদির কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলাম। ভেবেছিলাম যদি শ্যামলীদির সাথে তেমন দক্ষযজ্ঞ হয়ে ওঠে তাহলে মহাদেবের সাঙ্গ-পাঙ্গর মতো আমিও ঝাঁপিয়ে পড়বো। কিন্তু এতদূর যখন গড়ালো না, তখন অনর্থক কথা খরচ করে কি লাভ। আদরী মাসী পালিয়ে যেতেই হেসে উঠলাম।


সেদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত শ্যামলীদির চঞ্চলতার সীমা রইলো না । কেন যে চঞ্চলতা তা বুঝতে পারলাম। শুধু কারণ একটাই, প্রতিশোধ নেবার সুযোগ এসেছে। শ্যামলীদি আমাকে তৈরী হতে বলে পাশের রুমে চলে গেলো। আমি উৎফুল্ল মনে গুঞ্জরণ করতে করতে শাড়ী বদলে শ্যামলীদির রুমে প্রবেশ করতেই আমার চোখ দুটো বিস্ময় বিস্ফারিত হয়ে গেলো। এ যে অকল্পনীয় ! আমার চোখকে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এ কি স্বপ্ন না বাস্তব! শ্যামলীদি তখন সুরাপান করে চলেছে। পুরুষের পোষাকে সজ্জিত হয়েছে। পরণে চোস্ত প্যান্ট ও সার্ট। চল্লিশ মিলিমিটার চওড়া চামড়ার বেলটে কোমরটা শক্ত করে বাঁধা। কোনদিন ঐ অবস্থায় বা ঐ পোষাকে দেখিনি শ্যামলীদিকে।


আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, কি রে পুরুষ বলে মানিয়েছে তো? আজ পুরুষের কাজ করতে হবে বুঝলি ?


পুনরায় বোতলটা মুখের কাছে নিয়ে যেতে ওকে বাধা দিয়ে বললাম - এ কি করছো শ্যামলীদি, এভাবে তোমাকে মদ খেতে তো দেখিনি?


মদ আমি খাই, তোকে জানতে দিইনি কখনো। ভেবেছিলাম আমার ঠোঁট কোনদিন মদ স্পর্শ করবে না, কিন্তু কেন খাই জানিস? মদে ভীরু সাহস পায়, দুর্বল শক্তি পায়, দুঃখীর দুঃখ-যন্ত্রণার লাঘব হয়। বোতলটা দে, আজ আর বাধা দিস না।


আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো বোতলটা। এক নিঃশ্বাসে বোতলটা শেষ করে গম্ভীর মুখে বলল, ঠিক মতো তাকে আয়ত্তে আনতে না পারলে প্রতিশোধ নিতে পারব না পদ্মা। ঐসব নিম্নগামী, হীন পথাবলম্বী মানুষদের শিক্ষা দিতে গেলে স্বাভাবিক অবস্থায় পারা যায় না। চল আর দেরী করব না, সন্ধ্যা প্রায় হলে এলো


তখন ধরণীর বুকে সন্ধ্যার ঘন তমিস্রা ঘনিয়ে এসেছে। বস্তী হতে বেরিয়ে ফুটপাতে


এসে ট্যাক্সী ধরলাম। আমাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে বেশী সময় লাগলো না। শিবাজীদার


নির্দেশমত উপস্থিত হলাম বচন সিংয়ের ভাড়া বাড়ীতে। আমরা উপস্থিত হতেই সেলাম করে একজন নেপালী চাপরাসি বলল, আপনার নাম শ্যামলী হ্যায় ?


শ্যামলীদি ঘাড় নেড়ে তার নিজের পরিচয় দিলো।


সে আমাদের উপরে যেতে বলল। উপরে গিয়ে দেখলাম শিবাজীদা বারান্দায় পায়চারি করছে। আমাদের দেখে শশব্যস্তে হয়ে বলল, পাশের রুমে আমাদের হিতৈষী বন্ধু বন্দী অবস্থায় আছে।


শ্যামলীদি ও আমি পাশের রুমে প্রবেশ করতেই রন্টুর সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। শ্যামলীদির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মুখটা তার সিঁদুরের মত হয়ে গেছে। চোখ


দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে।


শ্যামলীদি ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছো ?


রন্টুর মুখে কোন বাক্য নেই। হাত দুটো তার শক্ত দড়িতে বাঁধা। শ্যামলীদি আবার বলল, কথাটা শুনতে পাওনি বুঝি ? আমাদের দেখে বোবা হয়ে গেলে নাকি?


রন্টু তবুও নিরুত্তর। মনে হলো আমাদের দেখে ওর শরীরের রক্ত প্রায় শীতল হয়ে গেছে।


শ্যামলীদির ঢল ঢল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠিক ভিলেনের অভিনয়ের মতো ওর কাছে গিয়ে বলল, আ-হা, পরোপকারী যুবক, একেবারে বোবা হয়ে গেলে যে! তখনি শ্যামলীদি গর্জন করে বলে উঠল, আমার প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে মিঃ পল্টু বিশ্বাস। আমাকে চিনতে পেরেছো? বলতো আমি কে? কি আমার পরিচয় ?


কোন উত্তর নেই। যেন একটা জড় পদার্থ স্তম্ভের সঙ্গে রজ্জুবদ্ধ হয়ে আছে। রন্টুর মুখে কোন কথা বেরুচ্ছে না দেখে শ্যামলীদি বজ্রকণ্ঠে বলল, এখন আর বোবা সেজো না বন্ধু, বোবা সাজলেও আর রেহাই নেই। তোমার মুখে কিভাবে কথা ফোটাতে হয় তার ওষুধ আমার কাছে আছে। বলো, কত টাকার বিনিময়ে পদ্মাকে আদরী মাসীর কাছে বিক্রি করেছো?


তবুও সে নিরুত্তর। কোন কথা মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না দেখে সজোরে তার তলপেটে এক লাথি মারলো শ্যামলীদি। এই তো শুভারম্ভ এখনো অনেক পাওনা বাকী আছে। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে মেরে তোমার হাড়-পাঁজরা সব গুঁড়িয়ে দেবো। উত্তর দাও, কার প্ররোচনায় কিসের লোভে সমস্ত ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে তুমি আমাকে বারাঙ্গনায় পরিণত করেছো? এতো সাহসই বা কোথায় পেয়েছিলে?


শ্যামলীদির রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনে রন্টুর হাত-পা যেন শিথিল হয়ে আসছিলো। মনে হতে লাগলো মৃত্যুর অশুভ ইঙ্গিতে সে যেন তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার বিয়োগান্তক পরিণতি কি করুণ!


মেয়েদের নারীত্ব নিয়ে সে ছিনিমিনি খেলেছে। মনে হয় শ্যামলীদির কাছ হতে সে এবার চরম শাস্তি পাবে। ওকথা চিন্তা করা মাত্রই শ্যামলীদি বেতের চাবুকটা চালালো রন্টুর শরীরে। রন্টু চাবুকের আঘাতে মুখটা একটু উঁচু করে চোখ দুটো বন্ধ করল।


শ্যামলীদি ওর ঠোট নেড়ে বলল, বড্ড আরাম লাগলো না ? আর একটা দি তাহলে ? বলা মাত্রই চার পাঁচ বার চাবুক চালিয়ে বলল, কতগুলো মেয়েকে এই কদর্য পথে ঠেলে দিয়েছো? উত্তর দাও পল্টুবাবু। কি ভাবছো, দেবে না? উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, নয়তো...


শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির ধারার মতো চাবুকের আঘাত পড়তেই রন্টুর মুখ দিয়ে কথা বেরিয়ে এলো - আর মেরো না শ্যামলী, তোমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। শ্যামলীদি একটু থেমে বলল, এবার তাহলে কথা বেরুলো? পদ্মা, ওষুধে আমার


কাজ করেছে রে। বলো, আমাকে বিক্রি করে কত টাকা পেয়েছো? ৫০ হাজার।


মোটেই পঞ্চাশ হাজার! তাহলে আরো অধিক টাকার বিনিময়ে আমার নারীত্বকে পূর্ব মর্যাদায় ফিরিয়ে দিতে পারবে?


রন্টু নীরব। তীক্ষ্ম কণ্ঠে শ্যামলীদি বলল, যারা দশের কাছে কুমারীর কুমারীত্বকে জোর করে বিলিয়ে দিতে পারে, যারা নারীর নারীত্বকে ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারে, তারা কেন পারবে না কুমারীত্বকে ফিরিয়ে দিতে? একে চিনতে পারছো? যে মেয়েটা সরল মনে বিশ্বাস করে দুমুঠো অন্নের সন্ধানে তোমার সাথে এই মহানগরীতে এসেছিল, সেই পূজনীয় দাদার কৃপায় শেষ পর্যন্ত এই নিষ্পাপ মেয়েটা লালসা ও প্রবঞ্চনার শিকার হলো? তোমার মতো জানোয়ারকে আমি সহজে ছাড়বো না। তোমার একমাত্র শাস্তি।


চাবুকের আঘাতে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলল। কাটা ছাগলের মতো ছটপট করতে থাকল আমাদের পূজনীয় দাদা। শ্যামলীদি তবুও ক্ষান্ত হয় না। প্রতিশোধের আগুন তখন তার শিরায় উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছে, রন্টুর গগনভেদী আর্তনাদে দেওয়াল যেন ফাটতে শুরু করল। একটু পরে শ্যামলীদি আমার দিকে ছুরিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, পদ্মা, এই ছুরিটা ধর, তারপর -


ছুরিটা দেখে রন্টু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমাকে মেরো না শ্যামলী। আমায় ক্ষমা করো, আমি আর কখনো অন্যায় করবো না।


শ্যামলীদি অট্টহাসি হেসে বলল, পাগল নাকি! তোমার মতো মহাপুরুষকে বলি দিয়ে আমার পাপের বোঝা বাড়াতে যাবো কেন? তাছাড়া তোমাদের মতো ব্যক্তি শত শত মেয়ের উপার্জনের পথ করে দিচ্ছে, তাহলে কেন তোমাদের মতো উপকারী বন্ধুকে পৃথিবী হতে সরিয়ে দেবো?


শ্যামলীদি চকচকে ছুরিটা নিয়ে ধীরে ধীরে ওর কাছে গিয়ে জামাটা কেটে শরীর থেকে সরিয়ে দিতে সাদা ধবধবে পিঠটা মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলো। চাবুকের অস্পষ্ট দাগ দেখে শ্যামলীদি সান্ত্বনা দেওয়ার মত করে বলল, সত্যি, সাদা ধবধবে পিঠটা সিঁদুরে মেঘের মতো হয়ে গেছে। বড্ড লেগেছে প্রিয়তমের! না না, আর মারবো না। তবে তোমাকে যাতে ঐ পথে না এগোতে হয়, তোমার জন্য আরো মেয়ে নষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা করে মুক্তি দেবো। কি, মুক্তি নেবে ?


রন্টু নীরব। মুক্তি কি দেবে শ্যামলীদি ওকে? সত্যি বলছি, বড় মায়া হয়েছিল ওর অবস্থা দেখে। জানি, সে আমাদের কতখানি সর্বনাশ করেছে। তবুও আমার কোমল হৃদয় ওকে মুক্তি দিতে চাইছিলো। শ্যামলীদির রক্তচক্ষু দেখে ভরসা পাচ্ছিলাম না। ওকে ক্ষমা করবে। কিন্তু ওর মুখে মুক্তি উচ্চারণ শুনে মনকে ধাক্কা দিলো। তাহলে তোমাকে মুক্তি দিই, কেমন?


রন্টু মুখটা একটুখানি উঁচু করতেই প্রবল বেগে ছুরিটার পুরো অংশটাই ওর পেটে ঢুকিয়ে দিয়ে এক পাক ঘুরিয়ে দিলো। তৎক্ষণাৎ পিচকারী ফোয়ারার মতো রক্ত বেরিয়ে এলো ক্ষতস্থান থেকে। রন্টু প্রচণ্ড বেগে চিৎকার করে উঠল। আমি ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে চিৎকার করে উঠলাম।


এ কি করলে শ্যামলীদি! আমি যে বিশ্বাস করতে পারিনি তুমি ওকে খুন করবে!


শ্যামলীদি একটু শ্বাস নিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বলল, এতো দিন পর একটু শান্তি পেলাম রে পদ্মা। যে যন্ত্রণায় আমার ভেতরটা মর্মে মর্মে দগ্ধ হচ্ছিল তা হতে আজ আমি নিষ্কৃতি পেলাম। একটু পরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ভাবছিস অন্যায় করলাম ? না রে পদ্মা, কোন অন্যায় আমি করিনি। ওর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। ও বেঁচে থাকলে আমাদের মতো বহু নিষ্পাপ মেয়ের সর্বনাশ করতো।


একটু পরেই শিবাজীদা হাঁস-ফাঁস করে আমাদের কাছে হাজির হয়ে বলল, উসকো খুন কর দিয়া।


শ্যামলীদি ঘাড় নাড়লো।


তব জলদী চলো। য়্যাহা রহনা ঠিক নেহী হ্যায়। পুলিশকো মালুম হো চুকা কি


হম য়্যাহা হ্যায়।


এক রকম জোর করেই আমাকে আর শ্যামলীদিকে বাইরে নিয়ে এলেন শিবাজীদা।


পুলিশ খবর পেয়েছে শিবাজী সিং তার পুরানো আড্ডায় ফিরে এসেছে। তাই ওকে


ধরবার জন্য নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরী করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024