ছোট গল্প - অশ্বত্থের ডায়েরী || লেখক - রঞ্জিত মল্লিক || Written by ranjit mallik


 

 অশ্বত্থের ডায়েরী

          রঞ্জিত মল্লিক




      "........আশ্বিনের শারদ প্রাতে.......

......... .......... বেজে........"


            ভাদ্রমাসের চড়া রোদ পড়েছে। আশাবরী ছাদে কাপড়গুলো শুকোতে দিয়েই নীচের ঘরে আড্ডাতে যোগ দিল। পুজো আসতে এখনও কিছুদিন বাকি। 


           আকাশে নীল মেঘের টোপর, খোলা খামে বলাকার চিঠি, পদ্ম দীঘির জলে শালুক, শাপলার সরল খুনসুটি, সবুজের মখমলে কাশের জনসভা, শিউলি ভোরে শিশিরের স্যাঁতস্যাঁতে অভিমান, মাঝে মাঝে ঢাকের মাতাল করা মিষ্টি মল্লারে ভেসে আসছে আগমনী সুর।


              আড্ডা বেশ জমেছে। ঘর থেকেই ঘন ঘন চায়ের অর্ডার আসছে। নিকোটিনের গন্ধে ভরপুর আড্ডার আসর। পুজোর বেড়ানো, শপিং, ঠাকুর দেখা নিয়ে কথা হচ্ছে। 


                 একটু পরেই দুর্নিবার ধূমকেতুর মতন উদয় হয়ে নৈঋতার বিয়ে ভাঙ্গার খবরটা দিল।


              "আমি আগেই জানতাম। নৈঋতার এই বিয়েটা টিকবে না।" আশাবরী বলল।

             "আমারও সব শুনে সেটাই মনে হয়েছিল। আমি জানতাম ও পারবে না গুছিয়ে সংসার করতে।"সোমলতা বলে ওঠে।

            "আসলে ওর একটা পুরানো অতীত আছে। সেই অতীতকে ছেড়ে..............."সাম্য কথাটা শেষ না করেই সিগারেটে টান দেয়।

            "আমিও কিছুটা শুনেছিলাম।তবে অতটা গুরুত্ব দিয়নি।" রাজন্যা বলে ওঠে।

               "সামান্য আভাসও আমিও পেয়েছিলাম। আমার সাথে প্রায়ই ফোনে কথা হত।"দুর্নিবার কথাগুলো বলেই একবার সকলের দিকে গভীর দৃষ্টি ছোড়ে। 

               "একটা অসমবয়সী প্রেম সব শেষ করে দিল। দোষটা দুজনের কারোর নয়।" সাম্য বলল। "হতে পারে এটা ইনফ্যাচুয়েশান। আর সেটাই মনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে গ্রো করছে।" দুর্নিবার আবার বলে ওঠে।

                                     ***************


               নৈঋতা নিজেও ভাবতে পারেনি তার জীবনে এই রকম পরিণতি হতে পারে। শেষ বিয়েটা না টেকাতে পেরে আজকাল খুব ভেঙ্গে পড়েছে।


               সারাদিন ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাকে। কোন কথা বলছে না। কিছুদিন ধরেই ভাবছে দুদিনের জন্যে কোথাও ঘুরে আসবে।


            "কি রে, সকাল থেকেই মুখ গোমরা করে বসে আছিস?" মা ঠাকুর ঘর থেকেই হাঁক পাড়ল।

           "মা, কিছুই ভাল লাগছে না। আমার আর এই জীবনে সংসার করা হবে না।" নৈঋতা বলল।

           "সবই আমার কপাল। আমাদের কপাল।একদিন দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।" মা স্বান্ত্বনা দেয়।

           "ভাবছি, একটু বাইরে যাব। স্কুল থেকে কদিন ছুটি নিয়েছি।"

          "কোথায় যাবি?"

          "মালদার চাঁচলে। আমার পুরানো স্কুলে একবার যাব।কিছু কাজ বাকি আছে। আজকেই বেরোতে হবে।"

           "আজ রাতেই যাবি?" 

          "এরপর গেলে আসল কাজটাই হবে না। অনেক দেরী হয়ে যাবে।"

           

               নাইটিতে চোখের জলটা মুছেই নৈঋতা ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। ব্যাগে পুরানো শাড়িটা ঢোকাতে গিয়েই কিছু চিঠি বেরিয়ে আসল। চিঠিগুলো দুর্জয়ের লেখা।মনটা নিমেষে ডানা মেলল দূর অতীতে।

                           

                                  *************


            ওর সাথে প্রথম বিয়ে। বিয়ের আগেই পাঁচ বছরের পরিচয় ছিল। দুর্জয়ের বাড়িতে যেদিন প্রথম পা রাখে, সেদিন ওর ঠাকুমার নৈঋতাকে দেখেই পচ্ছন্দ হয়েছিল।


               নৈঋতাও চাইছিল এই রকম এক শ্বশুড়বাড়ি। ঘরোয়া পরিবেশ। ছোট্ট সংসার।


               ধুমধাম করে বিয়ে হলেও বিয়েটা শেষাবধি টিকল না। দুর্জয় অনেক চেষ্টা করেছিল। নৈঋতাকে বোঝানোর। ও শোনেনি।


                প্রতি রাতে দুজনের ঘনিষ্ঠ হবার মুহূর্ত্যে অশ্বত্থের ছবি ভেসে আসত নৈঋতার মনে। নৈঋতা বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল সেই সম্পর্ক থেকে। পারেনি, ভিতরে গুমরে উঠত। 


                একদিন দুর্জয় বলেই ফেলল...,


             "অশ্বত্থ কে? তোমার প্রাক্তন.....?"

            "আমার শুভাকাঙ্ক্ষী।।ভাল সম্পর্ক আছে। আমাদের মধ্যে। সেটা....."

            "আজও ওকে ভালবাস ?"

             "জানিনা। হয়ত কিছুটা হলেও ভালবাসি।তা না হলে সে আমার মনের মধ্যে আসবে কেন? আসলে আমাদের রিলেশানটা এমন যে তোমাকে ঠিক বোঝানো যাবে না।"

            "আর অশ্বত্থ? সেও কি....?"

            "হতে পারে।"


            টানা চার-পাঁচ বছর সংসার করার পর দুর্জয়ের সাথে সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসে। জানেনা ও এখন কোথায় আছে। 


               ট্রেনে চেপেই ঘামে ভেজা শরীরটা চোখ বন্ধ করে জানালার গায়ে ছেড়ে দিল। 


                 এখন প্রায়ই অশ্বত্থের কথা মনে ভাসে। চাঁচলে চাকরি করতি গিয়ে ওর সাথে পরিচয়। পরে বিএড করার সময় ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা।


                                           **********


                বাবা, মা মরা অশ্বত্থ হোস্টেলে থাকত। বাড়ি জলপাইগুড়ি। গার্জেন বলতে একমাত্র কাকা,কাকিমা। মামার বাড়ির নিকটস্থ চাঁচলের স্কুলেই পড়ত।


           অংকে ভাল নম্বর পেতে অশ্বত্থের মামা নৈঋতাকে টিউটর হিসেবে ঠিক করে। বারো ক্লাসের ছাত্র অশ্বত্থ এমনিতেই অংকে ভাল। নৈঋতা এসে উজার করে সব কিছু শেখাতে শুরু করল।


                 আসতে আসতে নৈঋতা বুজতে পারল, অশ্বত্থ কেমন যেন ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।ওর জীবনের অনেক কিছুই শেয়ার করত দিদিমণির কাছে। সুন্দর বণ্ডিং ছিল দুজনের।


               এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বণ্ডিংটা আরো স্ট্রং হল। নৈঋতার ছোট ছোট কাজে অশ্বত্থ এগিয়ে আসে। বাজার হাট , ওষুধ কিনতে অশ্বত্থের ডাক পড়ত।


             নৈঋতা অসুস্থ হয়ে পড়লে, অশ্বত্থ নিজে এসে দিদিমণির রান্না করে দিয়েছে। মাথায় জলপটি দিয়েছে।

                           .......................


             "আজ শরীর কেমন আছে? জ্বরটা কমেছে দেখছি।"

             "জ্বর কমলেও শরীরে একটু ব্যথা আছে। মাথাটা পুরো ভারী হয়ে আছে।"         

         "কপালটা একটু টিপে দেব? বেশ হালকা লাগব।"

           "না, থাক।"

                                  ...........

             "অঙ্কগুলো সব হয়ে গেছে?""

             "সব হয়নি দিদিমণি। দু একটা বাকি আছে।"

              "স্কুলে কি করাল?"

               "ক্যালকুলাস।"  


                  বারো ক্লাসে হিংসে করার মতন নম্বর পেয়ে অশ্বত্থ জলপাইগুড়ির কলেজে ভর্তি হয়। ফিজিক্স অনার্স। নৈঋতার ইচ্ছে ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক। কিন্ত আর্থিক অবস্থা ভীষণ খারাপ।নৈঋতা সব দিক ভেবে এগিয়ে আসে। অশ্বত্থকে জয়েন্টে বসতে বলে।


                  এক চান্সে জয়েন্ট উতড়ে যায়। জলপাইগুড়ির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই ভর্তি হয়। নৈঋতাই সব খরচ দেয়। 


               পরে ও জলপাইগুড়িতে বিএড করতে এলে সম্পর্কের নিবিড়তায় পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে ওঠে।


              নৈঋতাও বুঝতে পারে অশ্বত্থের প্রতি কেমন একটা টান চলে আসছে। সেই টান কি ভালবাসার ? না অন্য কিছু? নিজেই জানে না।


               অশ্বত্থের পড়া শেষ হতে তখনও দুই বছর বাকি। নৈঋতা মিউচুয়াল ট্রান্সফার নিয়ে জলপাইগুড়ির একটা স্কুলে জয়েন করে। মাঝে মাঝে অশ্বত্থকে ডেকে তার স্টাডি কেমন চলছে খোঁজ নেই। নিজের হাতে ওর খাবার, টিফিন বক্স সাজিয়ে দেয়।


                পুরানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখটা বুজে এসেছিল খেয়াল করেনি। বর্ধমান এসে গেছে।


                জানালার দিকে আপন মনে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই পিছন থেকে একজন টোকা মারল। ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে বিদর্ভ দাঁড়িয়ে।


            "তোমাকে শিয়ালদাতে উঠতে দেখেছি।"

          "কোথায় যাচ্ছ?"

         "অফিসের কাজে বালুরঘাটে যাচ্ছি।"  

                   "তুমি?"

         "মালদা। কাজ আছে। জলপাইগুড়িও যেতে পারি।"

       "বুঝেছি।"

      "কি?"

       "সেই পুরানো সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পার নি?"

      "ঠিক ধরেছ। বেরোতে না পারলে তোমাকে এত সহজে........?"

    "মন থেকে বলছ?"


                 ট্রেন ছেড়ে দিল। বিদর্ভ ওর দুটো বগির পিছনেই উঠেছে। বেশী দিন হয়নি ওদের ডিভোর্স হয়েছে।


             দুর্জয় চলে যাবার পর ঠিক করেছিল জীবনটা একাই কাটাবে। কাউকে আনবে না এই ছন্নছাড়া জীবনে। অসুস্থ মার কথা রাখতেই কেন্দ্রীয় সরকারের আধিকারিক বিদর্ভকে বিয়ে করে।


            ওকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল। পারেনি। তার কারণও ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর অশ্বত্থ ভাল চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালুরু চলে যায়। চার বছর পরে ওকে ফ্রান্সে পাঠায়।


             তখন থেকেই অশ্বত্থের সাথে যোগাযোগটা ফিকে হয়ে আসে। বিদর্ভকে অশ্বত্থের কথা বলতে হয়নি। খাঁচার পাখি অশ্বত্থকে বিদর্ভ নিজেই একদিন খাঁচাটা খুলে মুক্ত করে দিল।


           বিদর্ভ হঠাৎ একদিন জানায় যে সে এই সম্পর্ক থেকে বেরোতে চাই। কারণ এক নার্সের সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে যাকে সে ভালবাসে। যদিও নার্স তার থেকে বয়সে আট বছরের বড়।


     "আমি মনামীকে ঠকাতে পারব না। তোমার আগে ও আমার জীবনে এসেছে। ও আমাকে পাগলের মত ভালবাসে।"

   "সব বুঝলাম। তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন ? মার কাছে মহৎ হতে?"

     "কিছুটা তাই। তখন সিচুয়েশান অন্যরকম ছিল।"

  "এখন হঠাৎ নতুন করে পুরানো প্রেম উথলে উঠল?"

"এক্সিডেন্টের পর মনামীর স্মৃতি চলে যায়। এখন ওর স্মৃতি ফিরে এসেছে। ও আমাকে খুঁজে চলেছে।"

"বেশ তো যেদিন বলবে আমি ডিভোর্স পেপারে সই করে দেব।"


               নৈঋতা আর কথা বাড়ায়নি। বিদর্ভের দাবী মেনে নিয়েছিল। পরে চিঠি লিখে বিদর্ভকে অশ্বত্থের বিষয়ে সব জানিয়েছিল।


            ট্রেন বোলপুর ছাড়তেই ঘুমটা আবার ভেঙ্গে গেল। বোলপুরের শান্তিনিকেতনে একবার অশ্বত্থ কাকাদের সাথে এসেছিল পৌষমেলাতে। সেবারে নৈঋতা দিদিমণিকেও আসতে রাজী করিয়েছিল। ওর মনে আছে পৌষমেলাতে মাদলের সাথে পা মিলিয়েছিল। অশ্বত্থ ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখিয়েছিল।


              আজও নৈঋতার শূন্য বুকের মাঝে একটা মাদল বাজে। সেটা আনন্দের না কষ্টের ও নিজেই জানে না। তবে সেই মাদলের তালে তালে, মাঝে মাঝে অশ্বত্থের স্পন্দনটা টের পায়।


          চোখের জলটা মুছেই আবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করল। ঘুম কিছুতেই আসছে না।


                     

                                   ***************


                   ট্রেন মালদা ছুঁয়েছে। চাঁচলের স্কুলের কাজ মিটতে একটু বেলা হল।


              শরৎকাল যে এসেছে প্রকৃতির সাজ দেখলেই তা বোঝা যাচ্ছে। আম বাগানের ফাঁক ফোকর দিয়ে হলদে রোদ্দুরটা আলপনা এঁকে বেড়াচ্ছে। কাশের বনে সাদা বকের জ্যোৎস্না।


               অশ্বত্থের মামার সাথে দেখা হয়েছিল। ওর খবর একটা পেয়েছে। আর তাতেই......। পুরানো স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে। চোখ ছলছল করছে অনবরত। নিজেকে আজ ভীষণ একা মনে হচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। চারিদিক জমাট অন্ধকারে ঘিরে ধরবে। নৈঋতার মনে হচ্ছে সেই অন্ধকার ওর সব কিছু কেড়ে নেবে। 


                                  ********


             চাঁচল থেকে জলপাইগুড়ি অনেকটা পথ। ওখানে নেমেই চোখে মুখে একটু জল দিল। ওখানের পুরানো স্কুলেও একবার যেতে হবে।


                স্কুল থেকে ফিরেই সোজা চলে আসল অশ্বত্থের বাড়ি।বাড়িটা আগের মতই আছে। সেই রকম সাজানো গোছানো। গুছিয়ে রাখার সেই মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না। মামার কাছে গতকালই শুনেছে ও দেশের বাইরে আছে। তবে বাড়ির মধ্যে পা ফেলেই বুঝতে পেরেছে একটা চাপা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে সাড়া বাড়িতে। 


  "অশ্বকে দেখছি না?"

   "অশ্ব এখানে এখন আর থাকে না।"

   "শুনলাম আমেরিকাতে আছে?"

   "কে বলল?"

   "মামী।"

   "হ্যাঁ, ঠিক শুনেছ। ও আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে।"


           অশ্বের কথা বলতে বলতে কাকিমার চোখ ছল ছল করে উঠল। একটু থেমেই, "আর একটা দিন থেকে গেলে হত না?"

"এবারে ছুটি কম। পরে একবার আসব।"


                নৈঋতা বেরোনোর জন্যে রেডী হতেই কাকিমা ওর হাতে একটা ডায়েরী এগিয়ে দিয়ে করুণ সুরে বলল," ডায়েরীটা অশ্বত্থের। এখানে অনেক কিছু লেখা আছে। ও তোমাকে দিতে বলেছে।"


                 ডায়েরীটা হাতে নিয়ে নৈঋতা বেশ অবাক হল। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে কাকিমণির দিকে।একটু থেমে বলল,"কিন্তু কেন?"

"জানিনা, আমরা কোনদিন এর পাতা উল্টেও দেখিনি। ও চলে যাবার আগে এটা তোমাকে........"


            ডায়েরী নিয়েই নৈঋতা স্টেশনের দিকে পা বাড়াল। ছিপ ছিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ওর চোখেও নামল শ্রাবণের ভরা কোটাল। বৃষ্টির বিন্দুগুলো পদ্মপাতার উপর পড়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করছে।


              ট্রেনে উঠেই জানালার ধারে হেলান দিয়ে বসল। আজ মনে হচ্ছে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে। অশ্বত্থের মুখটা ভাসছে সদ্য ফোটা শিউলির মতন।ওর সরল হাসি, শিশুসুলভ কথাগুলো কানে বাজছে। মনে মনে ভাবছে,ভালই হয়েছে ও দূরে চলে গেছে। কেউ আর ওকে বিরক্ত করবে না।


             নৈঋতা বুঝতে পেরেছিল অশ্বত্থের কাছে ও বাঁধা পড়েছে। অশ্বত্থও একটা অজানা টান অনুভব করত ওর প্রতি। হতে পারে সেই টানটাই ভালবাসা। কিংবা ভালবাসার মতই এক শক্ত, নিখাদ বন্ধুত্ব।                     

                                   *****************


                   সময়ের খরস্রোতে ন টা বছর দেখতে দেখতে কেটে গেছে। বোধনের রোদ্দুর আবার চৌকাঠে এসে ঝলমল করছে। কদিন পরেই মা অপর্ণা সবার ঘর আলো করে আসবে।


                    "বাজলো তোমার

                      ........... আলোর বেণু......."


                    আশাবরীর বাড়িতে পুজোর আড্ডাটা আর নেই। সেখানে ঘোলাটে ভেজা অন্ধকার। তার প্রতিফলন অশ্বত্থের জলপাইগুড়ির বাড়িতে। নৈঋতার ঘরেও। কাকিমণি মারা গেছে। নৈঋতার মায়েরও বেশ বয়স হয়েছে। 


                   দুর্জয় মাঝে মাঝে নৈঋতার মা, বৃদ্ধা সবিতাদেবীর খোঁজ রাখে। ও আর বিয়ে করেনি। সিঙ্গল ফাদার হিসেবে থাকতে চায়। একটা মেয়েকে দত্তক নিয়েছে। বাবা, মেয়েতে আছে ভালই। বিদর্ভের সাথে মনামীর অসমবয়সী প্রেমটা ছাদনাতলার গন্ধ মাখলেও শেষরক্ষা হয়নি। মনামীর আবার স্মৃতি লোপ পেলে বিদর্ভ শোকে দুঃখে তিন বছরের মধ্যেই মারা যায়। 


                  আজ অষ্টমী। সন্ধিপুজো শুরু হতেই সবিতাদেবী প্রদীপ হাতে নৈঋতার ঘরে ঢুকল। প্রদীপের স্বর্ণাভ আভায় ধুলোর চাদরে মোড়া মেয়ের ছবিটা জ্বল জ্বল করছে।ঠিক যেন মা উমা!  


              ছবির ভিতর থেকে নৈঋতা মিষ্টি হেসে যেন বলছে,"মা, তোমাদের আদরের ঋতা ভাল আছে। যেখানে আছে সুখেই আছে।"


               ঐ আলোর ছটা, নৈঋতার মধুর হাসি জলপাইগুড়ির অরবিন্দ পল্লীর এক দোতলা বাড়ির ছোট্ট ঘরকেও আলিঙ্গন করল। যেখানে ভালবাসা আজও বেঁচে আছে। নৈঋতা, অশ্বত্থ যেখানেই থাকুক ওরা ভাল থাকবে।


                সন্ধিপুজো শেষ হতেই ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। সবিতাদেবীর চোখেও নামল শ্রাবণের ভরা কোটাল।      


               "দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী......

                ..........মহিষাসুরমর্দিনী........"


               কিছু অসমবয়সী প্রেম কুসুমিত হবার পর কালের নিয়মে কেন জানিনা ঝরে যায়। কিন্তু তার রেশ আজীবন থেকে যায়। নৈঋতা, অশ্বত্থ, আর বাকিরা সেই অসম, বন্ধুর পথের কুশীলব।


                                    **************


              সেদিন চাঁচলের মামা অশ্বের সঠিক খবরটা দেয়নি। কাকার বাড়িতেও বিষয়টা চেপে রাখে। কাকিমণি জানত, শুনলে নৈঋতাও ভীষণ কষ্ট পাবে। তাই ওকে কিছু বলা হয়নি।। ও যে আসবে সেটাও ভাবতে পারেনি। তাছাড়া কাকিমণিও অশ্ব আর নৈঋতার মধ্যে নিবিড় সম্পর্কের কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল।

           

             ট্রেনে যেতে যেতে ডায়েরীর অনেকটা পড়ে নৈঋতা অশ্বত্থর মনের অনেক অজানা, না বলা কথায় জানতে পারল। যার কিছুটা অনুভব করেছিল মাত্র। হৃদয় দিয়ে। ভালবাসা দিয়ে।      


                                   *****************

          

               জলপাইগুড়ির স্কুলে কিছু বছর চাকরি করার পর প্রোমোশন পেয়ে প্রধান শিক্ষিকা হয়ে হুগলীর একটা স্কুলে যোগ দেয়। ও চেয়েছিল অশ্বত্থ জীবনে বড় হোক। রোজ ভগবানের কাছে প্রে করত। ভগবান প্রার্থনা শুনেছে। 


            অশ্বত্থ চাকরি পাবার পর ব্যাঙ্গালুরু চলে যায়। তারপর ইউরোপ। ওর সাথে যোগাযোগ একটু ঘোলাটে হতেই নৈঋতাকে একাকীত্ব গ্রাস করে। সেই সময়ই বিদর্ভ আসে জীবনে। অশ্বত্থ বিয়ের খবরটা জানল অনেক পরে।ও দিদিমণির প্রথম বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি। হয়ত চায়নি উনি এত তাড়াতাড়ি ঘর বাঁধুক।


               দু দুটো বিয়ে ভেঙ্গে যেতে অশ্বত্থ একটু অবাকই হয়েছিল। বিদেশ থেকে ফেরার পরে অশ্বত্থও একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অফিসের বসের মেয়ে শ্রীকে বিয়ে করে ফেলে। ততদিনে নৈঋতাও বিদর্ভের সাথে সংসার করছে। যদিও শ্রী বয়সে আট বছরের বড়, তবুও তো একটা সম্পর্ক।


               ভালবাসতে পারেনি শ্রীতমাকে। সব সময় নৈঋতার ছবি মনে ভাসত। জানত দিদিমণির একটা নতুন সংসার হয়েছে। উনি হয়ত আর ফিরে আসবেন না। ওখানেই বাঁধা পড়েছেন। 


               অশ্বত্থের কষ্টও হয়েছিল। বসের মেয়ে বলে শ্রীতমা মাঝে মাঝে অশ্বত্থকে মানসিক নির্যাতনও করত। মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব, নিত্য অশান্তি চলত।মাঝে মাঝে ও ডিপ্রেসনে চলে যেত। সেই কারণেই..

.

                                       *****************


                সেদিন ট্রেনে যেতে যেতে নৈঋতা ডায়েরীর সবটা পড়তে পারেনি। ওর ঘুম চলে এসেছিল। সারাদিনের ক্লান্তিতে। বাড়িতে ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে গভীর রাতে ডায়েরীর বাকি পাতা ওল্টাতেই চমকে উঠেছিল। সারা শরীর বেয়ে নেমে এসেছিল শিহরণ।


                   ডায়েরীর বেশ কিছু পাতাতে অশ্বত্থ দিদিমণির প্রতি তার ভালবাসা উগড়ে দিয়েছে। সেখানে পরিষ্কার আদরের দিদিমণির প্রতি তার চূড়ান্ত দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সাদা কালো অক্ষরে, পেনের কালিতে তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু লাইনে অশ্বত্থ নিজেই স্বীকার করেছে যে, সে নৈঋতাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাকে গভীরভাবে কাছে পেতে.......


                ডায়েরীর শেষ দিকের কিছু লাইনে নৈঋতার চোখ আটকে গেল। বেশ কিছু কথা এলোমেলো আর অসংলগ্ন। সেখানে ক্রমশঃ ভয়ের ভাব প্রকট। কিছু কিছু লাইন সুউচ্চ পর্বতের গভীর গিরিখাতের মতন সংকীর্ণ ঢালু হয়ে নেমে গেছে। যা অতীব ভয়ঙ্কর। 


                 নৈঋতার মনে হচ্ছে সে ঐ গভীর গিরিখাতের মধ্যে দিয়ে যেন তলিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সে তলিয়েও গেল। ডায়েরীর একেবারে শেষ লাইনগুলো তার আর পড়া হয়ে ওঠে নি। আর কোনদিন হবেও না।


                      "........জাগো দুর্গা.......

                       .......... ..........তুমি জাগো......"


                 মহালয়ার ভোর শুরু হবার আগেই নৈঋতার শোক জর্জরিত বেদনা ক্লিষ্ট শরীরখানি সিলিং থেকে ঝুলে পড়ল ভীষণ ব্যথায় আর অভিমানে। 

                                               ********** 


              সেদিন দুই বাড়ির কথা শুনে নৈঋতা বুঝেছিল অশ্ব আমেরিকাতে আছে। আসলে ও ততদিনে মারা গিয়েছিল। যেটা ওকে কষ্টে কেউ বলেনি। 


              অশ্বত্থ আমেরিকা গিয়েছিল ঠিকই। তবে ও মারা যাবার দেড় বছর আগে। আমেরিকা থেকে ফিরে এসেও শান্তি পায়নি।শ্রীতমা ওর জীবনটা দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যার নিদারুণ পরিণতি সুইসাইড।


             মারা যাবার একমাস আগেই সব কিছু লিখে রেখেছিল ডায়েরীর পাতায়। প্রথমদিনের ক্লাস থেকে শুরু করে একটু একটু করে দিদিমণির সান্নিধ্যে আসা, বিপদে আপদে উনার পাশে এসে দাঁড়ানো, নৈঋতার অকৃপণ সাহায্যের হাত বাড়ানো, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা কোন কিছুই বাদ রাখেনি।


                 ডায়েরীর শেষ দিকের লাইনগুলোতে অশ্ব অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছে। দিদিমণিকে হারানোর ব্যথায় দ্বগ্ধ হয়েছে তার সবুজ মন। বারে বারে তার লেখার আকুতিতে এটা স্পষ্ট যে সে নৈঋতার কাছে ফিরে আসতে চায়। ওর এই চরম দুর্দিনে নৈঋতার আগের মতন পাশে দাঁড়ানোটা খুব প্রয়োজন।


               সময়ের জোয়ার যত সামনের দিকে এগিয়েছে অশ্বত্থ নিজেকে তত গভীর হতাশার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। ডায়েরীতে নিজেকে শেষ করে দেবার কথাও বলা আছে। আর সেটাই শেষ পরিণতি পেয়েছে।


              নৈঋতাও ডায়েরীটা পড়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। অশ্বত্থের মৃত্যুটা মেনে নিতে পারেনি। 


               শেষে চরম দ্বন্দ, হতাশা, একাকীত্বের দাঁড়িপাল্লায় দুলতে দুলতে অশ্বত্থের মত ও ফিরে গেছে না ফেরার দেশে। 


                                     ************


                 নবমীর পুজো এখনও বসেনি। গতকাল সারাদিন উপোসের পর ঘুমিয়ে ছিলেন। কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। 


                দরজা খুলেই দেখে দুর্জয় মেয়ে শাল্মলীকে নিয়ে হাজির। নীল শাড়িতে ওকে অসাধারণ লাগছে। নৈঋতা নাকি ছোটতে এই রকমই ছিল। দুর্জয় প্রতিবার বিজয়াতে আসে। এই প্রথম মেয়েকে আনল। তাও আবার নবমীর সকালে। 


           "দিদুন,আমি কদিন তোমার কাছেই থাকব।"

           "মা, আসলে আমি অফিসের কাজে একটু বাইরে যাচ্ছি। শালুর হোস্টেলেও ছুটি পড়েছে। তাই ভাবলাম......."


            সবিতাদেবী দুর্জয়ের কথা ঠিকমত শুনতে পায়নি। শাল্মলীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকরুদ্ধ। উনার বারান্দাতে সোনামুগ হলদে রোদের জলসা। তার অণু,পারমাণু নাতনির চোখেও।


           নৈঋতা ফিরে এসেছে। সেই সাথে মনে হল মা দশভূজাও আজ উনার ঘর আলো করে বসে আছেন। সবিতাদেবীর চোখে নিষ্পাপ আশ্বিনী শিশিরের স্পন্দন। সব দুঃখ ভুলে মনটা নতুন করে খুশীতে ভরে উঠল। 


            "শঙ্খ শঙ্খ মঙ্গল গানে......

            "জননী এসে দ্বারে........"

             

               

              

            

        

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024