ছোট গল্প - রাজার ঠিকানা || লেখক - চৈতালী রায় || Written by Chaitali roy || Short story - Rajar thikhana


 

রাজার ঠিকানা

চৈতালী রায় 




সামনের টেবিলটাতে একগোছা রজনীগন্ধা। সদ্য গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা। রজনীগন্ধা আমি ভালোবাসি। ওর গন্ধ আমায় পাগল করে তোলে। হঠাৎ -ই মনে হলো সমস্ত রজনীগন্ধাকে মুঠো মুঠো করে ছড়িয়ে দিই -- ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে, ছাতে - সর্বত্রই। 
সেদিন পড়তে বসেছি - রাজা এলো। একগোছা রজনীগন্ধা নিয়ে। আমি তাকালাম। দেখলাম। ও ভীষণ খেয়ালী। কেমনভাবে যেন তাকালো। আমি জানতাম - ও ভুলে যাবে। ঠিক ভুলে যাবে।অথচ ওগুলো আমাকেই দিতে এসেছে।
কি যেন ভাবছিলাম। পরিস্কার নয়। জটপাকানো। - আমি রাজাকে ভালোবাসতাম। রাজাকে দেখেছিলাম। একদিন নয়। আঙুলে গোনা দিন নয়। অসংখ্য অসংখ্য দিনের অনেক মুহূর্তে। কি বললাম - ভালোবাসতাম ? না - না এখনও বাসি।
রাজা আমাকে ভালোবাসে কিংবা বাসে না। ও আমায় এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবে বললো। আমি রাজি হলাম। যেদিন গেলাম - ও কি ভীষণ গম্ভীর থাকলো। একসময় বলে দিলো - আর কখনো আসবে না। আমি নিয়ে যেতে পারবোনা। অহেতুক জার্নিতে কষ্ট হয়। কথাগুলো বলার সময় ওর ঠোঁটদুটো একটুও কাঁপলো না ।
কলেজ থেকে ফেরার সময় রাজাকে দেখলাম। আকাশের দিকে মুখ তুলে কি যেন দেখছে। বললাম - রাজা, ভালো আছো তো ? চমকে উঠলো। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো - আমি রাজা নই। অথচ মনে হলো - এই তো রাজা। ওর চেহারার দিকে একপলক তাকালেই সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে। তবু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলাম - না , এ রাজা নয়।
" সংসার - সীমান্তে " দেখার সময় - আমার পাশে বসে ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম - রাজা আমার পাশে বসে আছে। ইচ্ছে হলো - ওর হাতদুটো চেপে ধরি। বই শেষ হলে জিঞ্জেস করলাম - রাজা, কেমন দেখলে ? গম্ভীর হয়ে বললো - আমি রাজা নই। বুঝতে পারলাম - আবারও ভুল করলাম।
আমি রাজাকে ভালোবাসি। মন - প্রাণ দিয়ে। মন খারাপ করলে ওর সঙ্গে দেখা করি। কথা বলি। সুস্থ - অসুস্থতার খবর জিঞ্জেস করি। ইচ্ছে হলেই চিঠি লিখি।
রাজা হাঁটে , কথা বলে,খায়, ঘুমোয়, স্নান করে, বই পড়ে, ছবি আঁকে, সিনেমা দেখে ----
রাজা বলেছিল - রাজা বেড়াতে ভালোবাসে । ফুল ভালোবাসে। সিনেমা দেখতে ভালোবাসে। বই পড়তে ভালোবাসে । মনুমেন্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কলকাতাকে দেখতে ভালোবাসে। গরীব - দুঃখীদের মুঠো মুঠো পয়সা দিতে ভালোবাসে।গান শুনতে ভালোবাসে। শিল্পীদের ভালোবাসে । সাহিত্যিকদের শ্রদ্ধা করে। আরো কতো কি ---

রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে অরার সাথে দেখা হলো। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম - রাজাকে দেখেছিস ? বললো - আমি তো তার সাথেই দেখা করতে যাচ্ছি। বললাম - রাজাকে তুই ভালোবাসিস ! ও দ্বিধাহীনভাবে বললো - বাসি বইকি । আমি অবাক হলাম।
দিন সাতেক পরে - রাজাকে দেখলাম ছবি আঁকছে। আপনমনে। ছবির মুখটা ঠিক অরার মতো। জিজ্ঞেস করলাম - অরা এসেছিল ? বললো - অরা বলে কাওকে ও চেনেই না। উদগ্রীব হয়ে বললাম - যার মুখটা তোমার ঐ ছবির মতো। হেসে বললো - ও তো আমার শিল্পী মনের কল্পনা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
দক্ষিণেশ্বরে বাস থেকে নেমে দেখলাম - স্মৃতি দৌড়চ্ছে। বললাম - অত ব্যস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিস ? স্মৃতি বললো - রাজার সাথে দেখা করার কথা। ভীত হলাম । জিজ্ঞেস করলাম - তুই রাজাকে ভালোবাসিস ? অনেকদিন থেকে - বলে চলে গেলো ।
বেশ কিছুদিন বাদে রাজার সাথে দক্ষিণেশ্বরে গেলাম। ওর পাশে পাশে হাঁটলাম। কথা বললাম। বাদাম ভাজা খেলাম । গঙ্গার ধারে বসে জলের ঢেউ গুনলাম। নৌকার যাতায়াত দেখলাম। বাচ্চাদের সাঁতার থেকে জল ছিটানো দেখে হাততালি দিলাম। ফেরার সময় বললাম - স্মৃতি এসেছিল ! রাজা বললো - স্মৃতিকে ও কখনো দেখেইনি।
২৯শে মে আমি হাওড়া গেলাম। কলকাতার বাইরে যাবো । কয়েক দিনের জন্য। রাজা এলো - ট্রেনে তুলে দিতে। ট্রেনে উঠে আমার বসার জায়গাটা ঠিক করে দিলো। আমার পাশে বসলো। হাসলো। কথা বললো। ট্রেন ছেড়ে দিতে রাজা নেমে গেলো। আমি হাত নাড়লাম। রাজাও --
ফিরে এসে মিষ্টুর সাথে দেখা হলো। আমি ভয় পেলাম। ও নিজেই এসে বললো - আজ রাজার সাথে দেখা করতে যাবো । সেই যেদিন হাওড়া স্টেশনে গেছিলো - সেদিনই ওর সাথে দেখা হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম - তুইও রাজাকে ভালোবাসিস ? ও হেসে ফেললো।
এরপর একদিন রাজাকে দেখলাম - বালি ব্রীজের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনমনে জলের চেহারা দেখছে অথবা গভীরতা মাপছে। ওর কাছে গেলাম। বললাম - মিষ্টুকে সেদিন আসতে বলেছিলে ? রাজা উদাস হয়ে বললো - ও নামের কাওকেই সে কখনো দেখা করতে বলেনি। আমি চুপ করে গেলাম।
সেদিন মধুমিতা বললো - রাজাকে ও চেনে । রাজা ওকে ভালবাসে। ওর নামে ডাকে চিঠি আসবে। আমি কোন উত্তর দিলাম না।
এরকমভাবে আরো কতজন কত কথা বললো। শুনলাম। কোন উত্তর দিলাম না।

একদিন অরাকে জিজ্ঞেস করলাম - রাজার চোখদুটো কেমন বল তো ? ও যা বললো - চমকে উঠলাম।
স্মৃতিকে জিজ্ঞেস করলাম - ওর কথা বলার ভঙ্গিটা তোর মনে আছে ? স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো - একদম স্পষ্ট ভাবে। নির্জনে বসে থেকেও আমি শুনতে পাই।
মধুমিতা বললো - রাজার চুলের গন্ধটা ওর নাকে এখনও লেগে আছে।
এইভাবে একে একে সকলকে জিজ্ঞেস করলাম- রাজার হাত, পা , নোখ, মাথার চুল, হাঁটার কায়দা - সব নিয়ে। সকলেই এক একটি বিষয়ের বর্ণনা দিলো অথবা আমিই শুনলাম।
দেখলাম, সবাই রাজাকে চেনে। ওর হাত চেনে, পা চেনে, কথা বলার ভঙ্গি চেনে , ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি চেনে, হাঁটার কায়দা চেনে, চোখ চেনে, নাক চেনে , মাথার চুল চেনে ---
আগে জানতাম, রাজা শুধু আমার পরিচিত। এবার বিরক্ত হলাম। ঠিক করলাম - ওর সাথে আর যোগাযোগ রাখবো না। ওর দেওয়া ফুলগুলো মাটিতে ছিটিয়ে দিলাম। ভাবলাম - ফুলগুলো শুকিয়ে যাবে। রোজ একটু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলাম। বেশ কতগুলো দিন বাদেও লক্ষ্য করলাম - ফুলগুলো থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে। ঠিক আগের মতই। অর্থাৎ ওর গন্ধটা কিছুতেই হারিয়ে যাচ্ছে না। আবার চঞ্চল বোধ করলাম - ওকে দেখার জন্য।

একদিন অরার সাথে দেখা হলো। বললাম - রাজার ঠিকানা জানিস ? অনেকদিন দেখা হয়নি। একবার দেখা করতাম। অরা হাতের চেটো উল্টে বললো - ভুল হয়ে গেছে। বললাম - তুইও কি ঠিকানা খুঁজছিস ! অরা ব্যাকুল হয়ে বললো - পেলে জানাস। আমিও একবার দেখা করবো।
আবার একদিন শ্যামবাজার ট্রামডিপোর কাছে স্মৃতির সাথে দেখা হলো। ওকে রাজার ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করলাম। কিরকম উদভ্রান্তের মতো বলে উঠলো - আমিও তো ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।
এভাবে একে একে আবার সকলের সাথে দেখা হলো। সবাইকেই রাজার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। সকলেই বললো - ওর ঠিকানা নিতে ভুলে গেছে।

আমরা এখন সবাই রাজাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওর ঠিকানা খুঁজছি। পা খুঁজছি। চোখ খুঁজছি। মাথার চুল খুঁজছি। নোখ খুঁজছি। আঙুল খুঁজছি। ভ্রূ খুঁজছি। আর মনে মনে ভাবছি - ঠিকানা পেলে সে হবে সম্পূর্ণ আমার।।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024