আদরী - দিলদার সেখ || Adari - Dildar sekh || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
আদরী
দিলদার সেখ
কোনও শিশু অন্ধকারে আচমকা আমার বড়ো ফুপুকে দেখলে যে সে ভালো মতোই ভয় পেয়ে যেতে পারে, – সেকথা আমার বড়ো ফুপু নিজেও জানত। ছোটবেলায় আমরাও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সারাক্ষণ গায়ে যেমন ধপধপে সাদা শাড়ি তার, – গায়ের রং তেমনই তার বিপরীতে। যেমন লম্বা তেমনই চওড়া তার গায়ের গঠন। ছোটবেলায় ফুপু যখনই আমাদের বাড়ি আসত, তার গায়ের সেই একই সাদা শাড়ি দেখে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা, ফুপু সবসময় অমন সাদা শাড়ি পরে থাকে কেন?
মা বলত, তুর ফুপা যে মারা গেছে। কোনও বিবাহিত মেয়ের স্বামী মারা গেলে তাকে যে অমন সাদা শাড়ি পরেই থাকতে হয় বাকিজীবন!
মায়ের এই উত্তর শুনে মাকে আবার পাল্টা প্রশ্ন করতাম, তাহলে আদরী কেনে সাদা শাড়ি পরে না?
মা কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলত, অর কথা বাদ দে। খেপী ও অ্যাকটা!
আদরী আমাদের গ্রামের এক আদ বয়স্কা বিধবা। লোকে তাকে এক ডাকে আদরী খেপী বলে চেনে। বিধবা হলেও আদরী কিন্তু আজ অব্দি একটাবারের জন্যও গায়ে সাদা শাড়ি তোলেনি। বরং উল্টে তাকে দেখা যায়, চার আঙ্গুল চ্যাপ্টা পাড়ওয়ালা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে ঘুরতে। আবার এই রং শুধুই লালেই শেষ নয়, – কখনো লাল, কখনো নীল, কখনো গোলাপী, কমলা, হলুদ! বিয়ের কয়েক বছর পর বিধবা হয়ে আদরী আজ প্রায় পনেরো কুড়ি বছর ধরে এই গ্রামেই আছে।
আদরীর বাপের পুরনো কয়েক কাঠা খালি জায়গা পড়ে ছিল আমাদের পাড়াতে। তার ভাইরা সেখানেই আদরীকে একটা ছোট্ট খুপরি বানিয়ে দিয়েছিল থাকার জন্য। তিনটে ভাইয়ের তিন তিনটে পাকা দালানবাড়ি থাকতেও তাদের একমাত্র বিধবা বোনের জায়গা হয়নি সেখানে। মনে জায়গা ছিল কি না, সেই সন্দেহ! গ্রামের কোনও লোকে কিছু বললে তারা জবাব দেয়, ও পাগলকে কে বাড়িতে রাখবে!
আদরীকে যে খুপরিটা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল থাকার জন্য, – তার ছাউনী নেই বললেই চলে। আদরীর ভাইপোরা শুধু নতুন করে তালপাতা কেটে চাপিয়ে দিয়ে যায় পুরনো তালপাতাগুলো ঝড়ে উড়ে গেলে। আর তাছাড়া, ছাউনী থাকলেই বা কী, আর না থাকলেই বা কী? আদরী নিজেই তো থাকে না সে খুপরিতে। তাকে দেখা যায় কখনো মল্লিকপাড়াতে, কখনো উত্তরপাড়াতে, – কখনো তালতলাতে, কখনো বা বেলতলাতে। কখনো তার সকাল হয় আমতলায় আমগাছের গোঁড়ায় ধুলোতে শুয়ে থেকে। পুরো গ্রামের যেকোনও পাড়ার যেকোনও গলিতে যেকোনও সময়ে তার দেখা মিলে যেতে পারে। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার পেছন ধরে। ডাকতে থাকে, আদরী খেপী আদরী খেপী করে। আদরী ঘুরে দাঁড়ায় তাদের দিকে। বলে, তু খেপী। তুর মা খেপী। তুর চোদ্দগুষ্ঠী খেপী।
বলেই আদরী ছোট ঢিল তোলে হাতে। ছেলেমেয়েগুলো অমনি ছুটে পালিয়ে যায়। লুকিয়ে পড়ে যে যেখানে। আদরী হাঁটতে শুরু করলে আবার বেরিয়ে আসে তারা। পেছন ধরে আদরীর। কোনও বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে বাড়ির মেয়েরা যদি ডাকে আদরীকে, – আদরী যায় সে বাড়ি। গিয়ে বসে। আবার হুট করে উঠে চলে আসে যেকোনও মুহূর্তেই। ডাকলেও আর রা দেয় না সে তখন। আবার কখনো কখনো সে নিজে থেকে চেনা কোনও বাড়িতে ঢুকে। বসে থাকে কিছুক্ষণ। এটা সেটা কথা তুলে নিজে হয়ে।
আদরীর গায়ে থাকে একটা টকটকে রঙিন শাড়ি। কখনো যদি সে গ্রামের কোনও বাড়িতে ঢুকে, – সে বাড়ির কোনও বউয়ের গায়ে থাকা কোনো শাড়ি যদি তার পছন্দ হয়, – কিংবা বাড়ির আঙিনায় টানানো কোনও রঙিন শাড়ি যদি তার চোখে ধরে, – সে চেয়ে বসে শাড়িটা তখনি। বলে, ও বউ, ও বউ, তুর শাড়িটা আমাকে দিবি? অ্যাঁ? আমাকে দিবি? আমার খুব পছন্দ। আমার খুব পছন্দ। দে না, দে। আমাকে দে।
অনেকে বাহানা করে এটা সেটা। আবার অনেকে দিয়েও দেয় তাকে। আদরীর কথায়, গ্রামের প্রায় সকলেই তাকে খাতির করে, – শুধু তার নিজের ভাই ভাবীরা ছাড়া। আদরী ঘেঁষেও না সেদিকে। আদরীর মাথায় এক খাবল চুল। তাও তেলে চুবচুবে হয়ে থাকে সারাক্ষণ।। বিকেলে মল্লিকপাড়ার কোনও বাড়িতে ঢুকে সে আবদার করে, আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে তো বউ। দে না, দে। আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে। খারাপ হয়ে আছে চুলগুলো। দে না, দে।
দিয়ে দেয় তারা তার চুলে তেল। চিরুনি চালিয়ে দেয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আদরীর খুশি হয় খুব। ছুটে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে। আর এক মুহূর্ত থাকে না সেখানে।
কোনও বাড়িতে আবার পুরুষ মানুষ থাকলে আদরী সে বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়। পুরুষ মানুষটিকে দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, মারবে না তো? আমাকে ও মারবে না তো? অ্যাঁ?
সে বাড়ির মেয়েরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে, বসিয়ে, গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে, মারবে কেন, আদরী? কেউ মারবে না তুকে। কে মারবে? কেউ কি মেরেছে কখনও তুকে?
আদরী তখন ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় বলে, রতন। রতন। রতন মেরেছিল আমাকে। অনেক মেরেছিল। অনেক মেরেছিল। এই দেখ, এই দেখ, আমার পিঠে দাগ দেখ। আমার হাতে দাগ দেখ। ভালো না। ভালো না। ওরা ভালো না।
এই রতনই আদরীর মৃত স্বামী। আদরী বলে, বিয়ের পর প্রথম যেদিন সে তার শ্বশুর বাড়ি গেছিল, – প্রথম যে রাতে সে তার স্বামীর ঘরে, – যে রাতে তার সারা শরীরে ভালোবাসার ছোঁয়া নেওয়ার কথা ছিল স্বামীর থেকে, – তার স্বামী তাকে উপহার দিয়েছিল অসহ্যকর আঘাত। তার সারাশরীরে এঁকে দিয়েছিল আজকের এই মারের চিহ্ন।
কারও হাতে হাতভর্তি চুড়ি দেখলে আদরী তার হাতকে খপ করে ধরে। ধরে বলে, আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে দিতে পারিস না, হা লো? দিস কেনে আমাকে অ্যামন সুন্দর চুড়ি কিনে! দিবি? অ্যাঁ? দিবি আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে?
– তুর চুড়ি পড়তে ভাল্লাগে আদরী?
– হ্যাঁ, লাগে তো। আমার অনেক ভাল্লাগে। আমা চুড়ি পরব। আমি দুইহাতে অ্যাত্ত করে চুড়ি পরব।
– রতন বুঝি তুকে অনেক চুড়ি কিনে এনে দিত? অনেক সাজিয়ে রাখত তোকে?
– কে? কে? রতন? না না না না..... দ্যায়নি। দ্যায়নি। সে আমাকে চুড়ি কিনে দেয়নি। একটাও চুড়ি কিনে দ্যায়নি। আমি অনেক কেন্দেছিলাম। সে আমাকে চুড়ি কিনে দ্যায়নি। মেরেছে। সে আমাকে অনেক মেরেছে।
সেবার উরসের মেলা হচ্ছিল খুব বড়ো। আদরী তখন নতুন বউ। অনেক বায়না করে সে রতনকে রাজি করিয়েছিল তাকে নিয়ে মেলাতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রতনকে বাধ্য হয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল শেষে। মেলায় লাল হলুদ চুড়ি দেখে আদরী মেতে উঠেছিল চুড়িগুলোর জন্য। রতনকে বলেছিল কিনে দিতে। রতন কিনে দেয়নি। পরে আদরীর মান করায় তাকে মেলাভর্তি লোকের সামনে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে এসেছিল রতন। আদরীর মান তখন জল।
পর পর তিনটি পুত্র সন্তানের পর আদরীর বাপ মা বড়ো করে আশা করছিলেন একটা কন্যা সন্তানের জন্য, – আদরীর জন্ম ঠিক সেই সময়ে। জন্মের পর পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলে তাকে দেখতে এসে বলে গেছিল, সোনা কপালী মেয়ে। বাড়িতে এই প্রথম মেয়ে সন্তান। তিন তিনটে বড়ো ভাইয়ের আদরে সোনার থালায় ভাত খাবে তাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন। ছিলও সে সবার বড়ো আদরের। সেই জন্যই কিছুটা বড়ো হলে সকলের আদরে তার নাম পড়ে গেল আদরী। আসল নাম যা রাখা হয়েছিল, তা গেল চিরকালের মতো ঘুঁচে। কিছুটা বড়ো হলে আদরীর কাজে কামে গুন দেখে অনেকে বলেছিল, বড়ো গুনবতী মেয়ে। এই মেয়ে পারবে সুখে সংসার করতে বটে। মায়ের চেয়েও কাজে কামে তার পরিপাটি বেশি। যুবতী অবস্থায় তার রূপ দেখে বলাবলি করেছিল অনেকেমিলে, মেয়ের যেমন গুন, রূপও তেমনি চোখ ধাঁধানো। বিয়ের পর এই মেয়ে স্বামীর ভালোবাসায় ডুবে থাকবে সারাক্ষণ। স্বামী ঘুরবে বউয়ের আঁচল ধরে ধরে।
যথা সময়ে আদরীর বিয়ে হল। খিজিরপুরের জমিদার বাপের একমাত্র ছেলে রতনচাঁদ একশোর উপরে বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে এসছিল আদরীকে। যদিও বরযাত্রী আসার কথা হয়েছিল ষাটটে। পঞ্চাশে না মানতে চায়লে আদরীর বাপ আরও দু চারজনকে বাড়িয়ে শেষে ষাটে কথা পাকা করেছিলেন। রতনচাঁদ এনেছিল একশোর বেশিজনকে। এবং সেটাই ছিল তার শেষবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে আসা। দুপুরে জোহরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছিল ঠিকঠাকভাবে। আদরীর বাপ তাঁর একমাত্র আদরের মেয়েকে সঁপে দিয়েছিলেন রতনের হাতে। গোল বেঁধেছিল খাওয়া দাওয়ার সময়। একশোটা লোক একটা জায়গায় একসাথে থাকলে সেখানে নানারকম ভালো মন্দ কথা হবে। হবেই। পাত্রপক্ষ থেকে আসা কারও কারও মুখ থেকে আদরীর বাপের ভোজ আয়োজন নিয়ে কিছু খারাপ মন্তব্য শুনে পাত্রীপক্ষের কয়েকজন উত্তর করেছিল। পাত্রপক্ষের ‘পাত্রপক্ষ’ হয়েও কেন যাচ্ছেতাই বলার অধিকার থাকবে না, – এবং পাত্রীপক্ষরা ‘পাত্রীপক্ষ’ হয়েও কেন পাত্রপক্ষের সাথে তর্ক করবে, এই ছিল পাত্রপক্ষের রাগ। রতনের রাগ। আর এই রাগ এক সময়ে হাত চালাচালিতে পরিণত হয়। অবশ্য খেতে খেতে উঠে এসে হাত উঠিয়েছিল সবার আগে রতন নিজেই। শেষে বিয়ে করা বউকে শ্বশুর বাড়িতেই ফেলে রেখেই রতন তার বরযাত্রীদের নিয়ে ফিরে গেছিল বাড়ি। তিনদিন পর রতনের বাপ লোক পাঠিয়েছিলেন পুত্রবধূকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সোহাগীর বাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোককে বড়ো খাতির যত্ন করে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে।
আদরী বলে, তার শ্বশুরের ছয়চালা মস্ত বড় মাটির বাড়িতে থাকার লোক বলতে ছিল শুধু রতন এবং রতনের বাবা। মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগে। মা মরা ছেলে রতনের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে কখনই আদরীকে বিয়ের করার জন্য রাজি ছিল না। তবে আদরী বলে নয়, সে নাকি সেই সময়ে বিয়েই করতে রাজি ছিল না কাউকে। বিয়ের আগে রতনের নিত্য অবাধ যাতায়াত ছিল পাশের গ্রামের রঙ্গপাড়ায়। সেখানে গিয়ে রতন মদ গিলত বোতলের পর বোতল। পড়ে থাকত বেহুঁশ হয়ে কোনও কোনওদিন। রাত হয়ে গেলেও তার হুঁশ আসত না। শেষে ও পাড়ার লোকেরা তুলে ধরে দিয়ে যেত তাকে বাড়িতে। আদরী বিয়ের পর গিয়ে কত শুনেছে, কত মেয়ের সাথে ধরা পড়ে রতন কত্তবার মার খেয়েছে! রতনের বাবা কোনওদিন বাড়িতে না থাকলে, রতন সুযোগ বুঝে মেয়েদের টাকা, গয়না কিংবা ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসত। অগুণতি টাকা পয়সা খরচ করত তাদের পেছনে। রতনের বাবা ঠিকই শুনতে পেতেন সব। তবুও বহু চেষ্টা করে তিনি রতনকে এসব পথ থেকে ফেরাতে পারেননি। শেষে ভেবেছিলেন, ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে হয়ত বা ছেলে শুধরে যাবে। তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে সে রাস্তা থেকে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টে রতনের মনে হত, আদরী যেন তার পথের বাধা, – তার সমস্ত সুখ ও শান্তির বিঘ্ন শুধুমাত্র ওই আদরী। আদরীকে হয়ত সে একটা দিনের জন্যও নিজের সুখ তো দূরের কথা, – দুঃখের সঙ্গী বলেও মেনে নিতে পারেনি। আদরীর কথা তার কেবলই ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি মনে হত। সে সারাক্ষণ সমস্তরূপে বিমুখ থাকত আদরীর উপর। পরিবর্তে আদরী পেত শুধুই লাথি আর কিল, কিল আর মার। অসহ্যকর যন্ত্রনা!
এখন গ্রামের কোনও বিধবা বুড়ি যদি আদরীকে ডাকে, – ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, এই আদরী, বিধবা মানুষকে যে অমন রঙচঙে শাড়ি পরতে হয় না লো! আমাদেরকে দ্যাখ, – আমাকে দ্যাখ, আজ ষোলো সতেরো বছর হয়েছে রাঁড় হয়েছি। একটিবারও রঙিন তেনা গায়ে ওঠাইনি। সেই যে সতেরো বছর আগে আমার সেই সোনার হরিণ শাড়িখানা খুলে ছুড়ে দিয়েছি আগুনে, – ওই শ্যাষ। রতন যে আর নাই লো। তু বিধবা মানুষ অ্যাখন। ফেলে দে ওই শাড়ি খুলে। অমন রঙচঙে শাড়ি পরিস না আর। ভেঙে দে তুর ওই হাতের চুড়ি। পরতে নেই। পরতে নেই। খুলে দে।
আদরী সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে সেই কথায়। বলে, না না না.....! কে রতন? কে সেই ছোঁড়া? কবে কোন কালে মরে ভূত হয়ে গেছে সে। শাউনতলার মাটিতে পুঁতে দিয়েছে তাকে। আমি দেখেছি। আমি দেখেছি। মরে ভূত হয়ে গেছে সে। তার জন্য আমি কেনে সাদা শাড়ি পরব? কিসের জন্য আমি আমার অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা ফেলে দিব আগুনে? সে কি আমাকে এই শাড়ি কিনে দিয়েছে নাকি? সে কি আমাকে অ্যামন সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিল কখনও? দ্যায়নি। দ্যায়নি। আমি বলিনি? আমি কান্দিনি নতুন শাড়ির জন্য? দ্যায়নি। সে আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। এই দ্যাখ, এই শাড়িটা আমাকে ওই মল্লিকদের বউ দিয়েছে। ও মাগী খুব ভালো। আমাকে শাড়ি দিয়েছে। কত্ত সুন্দর শাড়িটা দ্যাখ। আমি কেনে পরব না অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা? আমি পরব। বেশ করব। আমি আরও করে রঙিন শাড়ি পরব। আরও করে চুড়ি পরব হাতে।
বলতে বলতে আবার কোথায় উধাও হয়ে যায় সে, – কেউ দেখতে পায় না।
অনেকে আদরীকে একা একা বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখেছে অনেক সময়। সে কোনও এক মোটা গাছে নিচে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকে একা একা। চোখ মুছে নিজের শাড়ির আঁচলে। পেছনদিক থেকে গিয়ে কেউ ঘাড়ে হাত রাখলে আদরী অমনি নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আদরীর মনে যে কষ্ট লুকিয়ে আছে, যে কষ্ট তাকে কাঁদায় আজও, – তা সে বলে না কাউকে। বলতে চায় না। শুধু মনে করে বসে বসে। আর কাঁদতে থাকে একা একা।
আদরীর মনে পড়ে, রতনের লাথি ঝাঁটা, ঘরে কুলুপ লাগিয়ে মার কিংবা পায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়াতেও কোনওদিন ততটা কষ্ট পায়নি, যতটা কষ্ট সে সেদিন রতনের না মারাতে পেয়েছিল। রতন সেদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। আদরীর শ্বশুর সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সন্ধ্যার পর রাত করে মদ গিলে রতন টলতে টলতে বাড়ি ফিরেছিল। আদরী ভেতর থেকে ঘরের দরজা খুলতেই রতন ঢলে পড়েছিল আদরীর উপরে। কাঁধে হাত দিয়ে টলমলে গলায় বলেছিল, আমি রোজ রোজ অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, ফুর্তি করি বলে তুর খুব হিংসে হয়, তাই না? খুব যে ঘ্যানঘ্যান করিস! হ্যাঁ হ্যাঁ, হিংসে হবেই তো! হিংসে হওয়ারই তো কথা! তা আজ থেকে আর হিংসে হবে না যা। আমি য্যামন অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, – তুও অন্য পুরুষের সাথে শুয়ে থাকবি সারারাত। আনন্দ করবি। ফুর্তি করবি। তাহলেই তো হল! তাহলে আর হিংসে হবে না তুর। কী রে, থাকবি না? দ্যাখ আমি কাকে নিয়ে এসেছি তুর জন্যে। ওই দেখ, ওই দেখ, – কী রে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনে? ভেতরে আই। এই এই এই দ্যাখ, – এই দ্যাখ আদরীকে – আমার বউ। যা যা। ভেতরে যা।
বলে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারই মতো এক মদ গেলা মাতালকে আদরীর সাথে। কুলুপ এঁটে দিয়েছিল রতন বাইরে থেকে হয়ত বা সামান্য কিছু টাকার পরিবর্তে।
হয়ত এমন আরও অনেক কথা আছে, যা আদরী বলে না কাউকে। এড়িয়ে যায়। বলতে চায় না। নিজে একা একা বসে মনে করে আর কষ্ট পেতে থাকে। কাঁদতে থাকে লুকিয়ে লুকিয়ে। কথায় কথায় যদিও বা বলে ফেলে কিছু কথা কারও কাছে, – বলতে বলতে জিব কেটে ছুটে পালায় সেখান থেকে।
রতন কবে কিভাবে মারা গেছিল, সেকথা সকলেই জানে। তবুও যদি জিজ্ঞেসা করা হয় আদরীকে, আদরী, রতনের কী হয়েছিল রে? কী করে মারা গেছিল সে?
আদরী এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলে, অসুখ হয়েছিল। অসুখ হয়েছিল। কঠিন অসুখ হয়েছিল তার।
– মিছা কথা কেনে বলছিস, আদরী?
– না না, মিছা লয়। মিছা লয়। জ্বর হয়েছিল তার। হ্যাঁ, জ্বর হয়েছিল।
– ও মা! জ্বর হয়েছিল? কিন্তু রতন তো বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল রে! বল না, কী হয়েছিল? কেন আত্মহত্যা করেছিল সে?
– না না না.....!
বলতে বলতে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে সে। উঠে দৌড় মারে খোলা রাস্তাপানে। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে থাকে, আমি তাকে বিষ দিইনি। আমি তাকে বিষ দিইনি। রাত্রিবেলা আমি তার ভাতে বিষ মিশাইনি। না না, আমি তাকে বিষ খাওয়াইনি। আমি তাকে মারিনি।
রাস্তার ধারের দুয়েকজন যারা তার এসব কথা শুনতে পায়, – কোনও গুরুত্ব না দিয়ে হেসে বলে, খেপী কোথাকার! কি সব যে মনে মনে বলতে থাকে, ওই জানে আর উপরওয়ালাই জানে!
Comments