প্রচ্ছন্ন আততায়ী - গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য || Prachanno Atotai - Gayatri Bhattacharya || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
প্রচ্ছন্ন আততায়ী
গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য
জানালা খুলতেই নন্দিনী দেখলো চাপচাপ কুয়াশা গোটা আকাশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। খুব কাছাকাছি মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চললো, কিন্ত কুয়াশা আর কাটতেই চাইছে না। জানুয়ারি মাসের শেষের দিক, যেমন ঠান্ডা, তেমনই কুয়াশা। মুসৌরিতে অনেক বছর হলো নন্দিনীর বাস, তাই শীতকালে মুসৌরিতে ঠান্ডার হাল- হাকিকত তার জানা। কলকাতার ঠান্ডা এর ধারেকাছে আসতেই পারে না। এই কুয়াশার সময় জানালা খুলে রাখলে ঘরের ঠান্ডা আরও বেড়ে যাবে। এখানে তার নিজের ছোট্ট একটা বাড়ী।বছর পঞ্চাশের নন্দিনী এখানকার একটি বেসরকারী অফিসে চাকরি করে। আজ নেহাতই ছুটির দিন, তাই জানালা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো।
একটু বেলার দিকে নন্দিনীর মনে হলো কুয়াশার চাদর একটু হালকা হয়েছে, সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকি মারছেন। কি মনে হতে জানালা খুললো নন্দিনী। বাইরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে। ঠিক তার ব্যালকনির নীচে এক ছায়া মূর্তি। ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। নন্দিনী উচ্চৈস্বরে বলে উঠলো,
“—কে! কে ওখানে?”
নাঃ,কোনো সাড়া নেই! তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখলো কেউ কোত্থাও নেই! কদিন ধরেই নন্দিনীর যেন মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে।কিন্ত কাউকে যে দেখতে পেয়েছে এমনটা নয়। তবুও সন্দেহটা মনে খচখচ করে জানান দিচ্ছে। যদিও সে যে কোনও ঠোস প্রমাণ বা সাবুদ পেয়েছে,তা নয়।
দূর, কি যে ভেবে চলেছে নন্দিনী।কেন কেউ তার পিছু নেবে! মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে নিশ্চিন্ত হলো।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল নন্দিনীর নিস্তরঙ্গ জীবন। একদিন তার মনে হলো মুসৌরি লেক আর কেমপ্টি জলপ্রপাত ঘুরে আসবে। কেমপ্টি ফলসের ওখানে প্রচুর লোক আর দর্শকদের ভীড়। তার চেয়ে মুসৌরি লেক অনেকটা বেটার, নিরিবিলি। মুসৌরি লেকের ধারে একটা জায়গায় চুপচাপ বসেছিল। আনমনে তার জীবনের পুরোনো কথাগুলো রোমন্থন করে যাচ্ছিল। যত ভাবে সেই ঘটনা মন থেকে মুছে দেবে, কিন্ত বারেবারে সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে,ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তার শরীর -মনকে। গা গুলিয়ে ওঠে নন্দিনীর।
আনমনা মন সচেতন হয়ে পড়লো যখন নন্দিনীর দুই চোখ কিছুটা দূরে একজনকে দন্ডায়মান দেখলো। কালো ওভারকোট আর টুপি পরা একটা লোক,সে একদৃষ্টে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে! ব্যাপারটা নন্দিনীর খেয়াল হতেই তার বুকটা কেমন চ্যাঁৎ করে উঠলো। স্বগতোক্তি করে উঠলো ,
“—কে! কে ওখানে?”
কোনোরকম কাল বিলম্ব না করে সেই স্থান ত্যাগ করলো। নিজের বাড়ীতে ফিরে এসে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। সারা শরীরটা কেমন যেন করছে। একটা চাপা উত্তেজনা গোটা শরীরকে বিকল করে দিচ্ছে, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে তার মস্তিষ্কে।
সেদিনের তার ঘরের ব্যালকনির নীচে দেখা ছায়ামূর্তিটা আর আজ লেকে দেখা লোকটা হুবহ এক! সেদিনের লোকটাকে ভালোভাবে দেখতে পায় নি,চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল বলে। আজ দিনের আলোতে পরিস্কার তাকে দেখেছে। কিন্ত সে কেন হবে! তার পক্ষে এখানে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় । না না! ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না! নন্দিনীর চেয়ে আর কেউ বেশী জানে না, ‘সে’কিছুতেই নয়। ভুল,সব মনের ভুল। রাত হতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো, নাহলে তার ঘুম আসবে না।
দু- তিন দিন পর অফিসে জয়েন করল নন্দিনী। তার বস নন্দিনীকে ছুটি দেন তাই,নাহলে কি যে হতো। অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলো, পাহাড়ে মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে। ছাতা সঙ্গে রাখতেই হয়। ছাতা থাকলেও সামান্য ভিজে গেল। বাড়ী এসে সদর দরজা খুলে নিজের রুমে ঢুকতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,
“—নন্দিনী “
“—কে ! আমার ঘরে কে?” নন্দিনী জোরে বলে উঠলো।
“—আমি নন্দিনী।“
নন্দিনী এবার লক্ষ্য করলো তার ড্রয়িংরুমে কালো ওভারকোট, আর টুপি পরা লোকটা একটা সোফায় গা এলিয়ে বসে রয়েছে। ভয়ে আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকলো।
নন্দিনী পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই সোফায় বসা লোকটি তাকে ধরে ফেললো ,
“—সেকি নন্দিনী ! তুমি যে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলে!”
নন্দিনী একটু ধাতস্থ হতে বললো ,
“—কে আপনি ! কি প্রয়োজন আপনার! কেনই বা এসেছেন এখানে আমার বাড়ীতে! আর কি আশ্চর্য আমি তো দরজা লক করে বেরিয়েছিলাম, কি করে আমার ঘরে ঢুকলেন! আপনার সাহস তো কম নয়! আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি,তারপর কি শাস্তি হয় দেখছি।“ ত্রাস মিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বললো নন্দিনী।
“—হাঃ হাঃ হাঃ, তাই নাকি! তুমি পুলিশ ডাকবে! আমাক ধরিয়ে দেবে! পারবে পুলিশ ডাকতে! “
“—খুব পারবো, একজন অচেনা অজানা লোক আমার ঘরের চাবি চুরি করে কি মতলবে আমার ঘরে ঢুকেছে, সেটা পুলিশ জানতে পারলেই সোজা শ্রীঘরে।” খানিকটা জোরেই কথাগুলো বললো নন্দিনী।
লোকটি আবার হেসে উঠে বললো,
“—সে কি! তুমি জোরে কথা বলছো! ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি! এতো গলার জোর দেখিয়ে বোঝাতে চাইছো যে তুমি আমাকে চেনো না! হাঃ হাঃ ,তাই নাকি! আমি অবাঞ্ছিত আর তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছি তাই পুলিশকে খবর দেবে!বেশ,ডাকো পুলিশ।”
নন্দিনী পুলিশ ডাকার কথা মুখে বললেও সত্যিই সে ডাকতে পারবে না, এই কথা তার চেয়ে বেশী কেউ জানে না। কিন্ত এতদিন পর কিভাবে তার উদয় হলো! নাঃ ভুল ভাবছে নন্দিনী, এই লোক ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না। তাকে যে নিজের হাতে .....। কিন্ত তাই বা কি করে হয়! লোকটি অবিকল তারই মতো দেখতে! সেই লম্বা, চোখে মুখে হিংস্র কুটিলতা,যেমনটি সে ছিল। শুধুমাত্র গলার স্বরটা একটু অন্যরকম। গলার স্বরের সেই হিমশীতল বর্বরতার ভয়ে সবসময়ই কাঁটা হয়ে থাকতো নন্দিনী, সেইটা যেন নেই ! এতোদিন পর বলে গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে হয়তো ! কিন্ত কি ভাবছে নন্দিনী! ‘সে’ হতেই পারে না! তাকে নন্দিনী নিজের হাতে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
“—এতক্ষণ ধরে কি এতো ভেবে চলেছো মেরে জান, আমার নন্দিনী! ভাবছো যে, এতোদিন পর আমি কিভাবে তোমার বাসায় এলাম! একজন মৃত মানুষ কি করে আসতে পারে, যে মানুষকে তুমি নিজের হাতে খুন করেছিলে! তাহলে আমি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে এলাম কি করে!”
এই কথাগুলো কঠিন কন্ঠে বলে লোকটি ধীর পায়ে নন্দিনীর কাছে এগিয়ে এলো।
নন্দিনী আঁতকে উঠে দূরে ছিটকে সরে গিয়ে বললো ,
“—আসবে না,আসবে না তুমি আমার কাছে। তুমি একটা পিশাচ, বন্য পশুর থেকেও ভয়ঙ্কর, তোমার মতো নোংরা পাপী লোক একদম আমার কাছে আসবে না। সাবধান বলে দিচ্ছি।“
“—এই তো ম্যাডাম!যাক্ আমাকে চিনতে পারলে তাহলে! হাঃ হাঃ।”
এইরকম সাংঘাতিক নরাধমকে না চেনার উপায় কি আছে নন্দিনীর! এই মানুষকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিল সে, সারা জীবনের মতো বাবা মাকে পর করে দিয়েছিল।নন্দিনীর বাবা- মা, দাদা কখনও চাননি, নন্দিনী পলাশের মতো বাজে ছেলেকে বিয়ে করুক। কিন্ত প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। বয়স তখন কম ছিল নন্দিনীর। তাই প্রেমিক পলাশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল,ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সুরক্ষিত নিরাপদ আদরে ঘেরা বাবা মায়ের ভালোবাসার বন্ধনকে। সেই সময়ে পলাশকে ভেবেছিল পরম আপন, আর বাবা মা শত্রু। ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি নন্দিনীর। কিছুদিন পরেই টের পেয়েছিল পলাশের বিকৃত মানসিকতার আচরণ, কি ভয়ানক,কি ভয়ংকর রূপ।মনে পড়তেই গোটা শরীরের তীব্র কষ্ট হতে শুরু করে নন্দিনীর। একদিন সব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নিজের হাতে পলাশকে .....
“—পলাশ! তুমি কিভাভে আবার ফিরে এলে ! না ,না, তুমি পলাশ নও,তুমি অন্য কেউ!” ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো নন্দিনী।
“—কেন বিশ্বাস হচ্ছে না ম্যাডাম, আমিই পলাশ, আমাকে তুমি খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলে ! সেই আমি কি করে এতোদিন পর বেঁচে উঠলাম! বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার! কি বলো ?”
“—পলাশ তুমি !! কিভাবে ....! তোমাকে আমি যে যে নিজের হাতে মেরে ফেলেছিলাম! “
কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে বলে সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ল। হঠাৎই ঘরের চারদিকের আলোগুলো জ্বলে উঠলো। নন্দিনী খেয়াল করলো প্রায় আলো- অন্ধকার মেশানো ঘরে পলাশের সঙ্গে কথা বলছিল। কিন্ত এখন সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল! তার আশ্চর্য হওয়ার রেশ কেটে গেল এক গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে! পাশ থেকে কে বলে উঠলো,
“—তাহলে নন্দিনী ম্যাডাম,স্বীকার করছেন যে আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরীকে নিজে হাতে খুন করেছেন? বাই দ্য ওয়ে, আমি নির্মল বসু গোয়েন্দা বিভাগ লালবাজার, কলকাতা থেকে এই কেসের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্বে আছি। আর যাঁকে আপনি আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরী মনে করেছেন,তিনি আসলে আমার সহকারী প্রচেৎ অধিকারী।”
নন্দিনী এবার দেখলো, প্রচেৎ মাথা থেকে উইগ খুলে ফেললো, তার সঙ্গে নকল গোঁফ দাড়ি। এতক্ষণ যাকে পলাশ বলে ভুল করছিল,সে এখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।
“—ম্যাডাম আপনি বাড়ী বিক্রি করে দেওয়ার পর মুসৌরী চলে আসেন। পরে ঐ বাড়ী হাতবদল হয়ে যায় প্রায় একবছর আগে। বাড়িটি কেনেন এক পুলিশ অফিসার। নতুন নির্মাণের জন্য খনন করতেই বাগানের একপাশে মাটির তলা থেকে একটি কঙ্কাল বেরোয়। ঐ অফিসার ডি.এন. এ. টেষ্ট করাতে জানা যায় উনি পলাশ চৌধুরী। তারপর 'পলাশ চৌধুরী মিসিং' ফাইল রি – ওপেন হয়। এবার আপনি বলুন।”
কথাগুলো শোনার পর নন্দিনী কঠিন স্বরে বলে,
“—আমি পলাশ বিয়ে করার পর বুঝতে পারি সে একটা অমানুষ, সাইকো, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় নি। আমাকে অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা দিয়ে যৌনসুখ পেতো। সে কষ্ট, যন্ত্রণা আর লজ্জার কথা আপনাদের বলতে পারবো না। আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, আমি আস্তে আস্তে পঙ্গু এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। একদিন এক দুর্যোগের রাত এলো, পুরো কলকাতাকে সুপার সাইক্লোন তছনছ করে দিচ্ছিল। প্রচন্ড ঝড়, প্রশাসন থেকে সতর্ক করে দিয়েছিল। সেই রাতে মদ্যপ পলাশকে ক্ষুর দিয়ে আক্রমণ করি ,সে মদ্যপ ছিল তাই প্রতিহত করতে পারে নি। ক্ষুর দিয়ে আমি ওর শ্বাসনালী কেটে দি। ও বুঝতে পেরেছিল আমি ওর কাছ থেকে শেষ হিসেব চেয়ে নিচ্ছি। নরপশুটা ছটফট করতে করতে মারা যায়। তারপর বাগানে নিয়ে গিয়ে একটা গর্তের মধ্যে ওকে এবং সমস্ত প্রমাণ মাটি দিয়ে বুজিয়ে দি।ঐ গভীর গর্ত পলাশ তৈরী করেছিল বাগানে সুইমিং পুল বানানোর উদ্দেশ্যে। ঝড়ের রাতে কেউ দেখার মতো ছিল না,তাছাড়া আমাদের বাড়ীটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
দুদিন পর দুর্যোগ কমলে, থানায় গিয়ে’পলাশ চৌধুরী নিখোঁজ’ ডায়েরি করি। সাইক্লোনে গাড়ী চাপা,গাছ চাপা এইসব কারণে বহু মানুষ মারা যায়। আরও দু দিন পর থানা থেকে আমাকে ফোন করা হয়,একটি লাশকে সনাক্ত করার জন্য। একটি ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে চেনার উপায় ছিল না,আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। সেই লাশকে আমি পলাশ বলে সনাক্ত করি,তারপর নিয়ম মাফিক সৎকার করি। আরও বছরখানেক থাকার পর সমস্ত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, আর বাড়ী বিক্রির টাকা নিয়ে চলে আসি মুসৌরিতে। সে প্রায় কুড়ি বছর আগে। এতদিন পর আপনারা .....ভাবতেই পারি নি আমাকে ধরে ফেলবেন!! যাইহোক আমার কোনো আক্ষেপ নেই। যেখানে নিয়ে যাবেন চলুন...।“
নন্দিনী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
Comments