সে ফিরে ফিরে আসে - রাখেশ দেবনাথ || Se phire phire Ase - Rakesh Debnath || বড় গল্প || Big story || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
সে ফিরে ফিরে আসে
রাখেশ দেবনাথ
দৌড়ে ট্রেনে ওঠে ওরা তিনজন।
তারপর শ্বাস নিতে নিতে সায়ান জানায় -
"আরেকটু হলেই ট্রেনটা মিস করছিলাম আরকি! ভাগ্যিস তনু দেখতে পেলো, নাহলে পুরো ট্রিপটাই কেচে যাচ্ছিলো !" বলতে বলতে আবারো শ্বাস ফুলে ওঠে সায়ানের।
"সব এই হতচ্ছাড়া মেঘের বাচ্চার জন্য। এতো ল্যাদখোর কিভাবে হতে পারে একটা মানুষ !" তনুর কথায় তিরস্কার ধরা পরে।
"ভাই জানিসই তো আমার একটু ইয়ে টা বেশি পায়..."
মেঘ কথা বলার চেষ্টা করে।
"এই ইয়ে টিয়ে কী রে!বাথরুম বলতে পারিস না?হতচ্ছাড়া " তনু গর্জে ওঠে।
মেঘ কিছুই না বলে দাঁড়িয়ে থাকে,এটা দেখে তনুর রাগ টা যেন আরো বেড়ে যায়। সে টুক করে একটা চিমটি কেটে দেয় মেঘের পেটে।
আআ... করে চিৎকার করে ওঠে মেঘ।
"এ থামবি তোরা। বেড়াতে যাচ্ছি কোথায় একটু চিল করবি,তা না,আবার মারপিট করা শুরু করেছিস দুজনে।ধুরর এরকম করলে যাবই না যা তোদের সাথে!" সায়ান এগিয়ে যায় দরজার কাছটায়।
ট্রেন ইতিমধ্যেই আরেকটা স্টেশনে ঢুকতে শুরু করেছে।
সায়ান কে এইভাবে রেগে যেতে দেখে, দুজনেই থেমে যায়।
ওরা সায়ানের রাগের কথা জানে ভালো করেই। ও একবার রাগলে পরে আর রক্ষা নেই। দুজনেই গিয়েই টেনে ধরে সায়ানের হাতটা।
পুরুলিয়ার পাঁচদিনের ছোটো একটা ট্রিপে যাচ্ছে তারা । তারা বলতে সায়ান, অনু আর মেঘ এই তিনজন।
তিনজনেরই এই বছর উচ্চমাধ্যমিক ছিল। তাই পরীক্ষা শেষে আর অপেক্ষা করতে চাইনি কেউই,সোজা ব্যাগপত্র বেঁধে পরের দিনই হাজির হয়েছিল স্টেশন চত্বরে। মাঝখান থেকে বাধা পড়লো মেঘের জন্য।
ওর আসলে একটা মানসিক ব্যামো আছে। কোথাও নতুন গেলেই ওর আসলে 'ইয়ে ' পায়, মানে ওর তখন টেনশনে ঘন ঘন বাথরুম চলে আসে।
এই নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া বেঁধে যায় তনুর সাথে।
তনু মানে তনুপ্রিয়া সরকার first girl of her school. এবার উচ্চমাধ্যমিকে সে rank holder হবেই বলে স্কুলের দিদিমনিদের দৃঢ় বিশ্বাস।
এই তিনজনের দলে ওইই সব থেকে বেশি স্মার্ট। তাই বাকি দুজন ওকে একটু তোয়াব করেই চলে। তবে তনুর একটা সফ্ট পয়েন্ট আছে, আর সেটা হলো সায়ান।
সায়ান, মেঘ আর তনু সেই ছোটবেলার বন্ধু। প্রায় একই সাথে ওদের ওঠা বসা।
তাই একসাথে চলতে চলতেই কখন যে সে সায়ানকে 'more than friend' ভাবতে শুরু করেছে সেটা সে জানেনা।
এই ব্যাপারটা অবশ্য মেঘ জানে, এই নিয়ে তাই সে প্রায়ই তনুকে খোঁচা দেয়। তনু অবশ্য সেসব না বোঝার ভান করে উড়িয়ে দেয়।
সায়ানও এই নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় না। সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে। তার পছন্দের জিনিস বলতে দুটো একটা এডভেঞ্চারিং আর দুই নম্বর হচ্ছে গোয়েন্দা গল্প।
এতদিন সে পরীক্ষার চাপে দুটোর একটাতেও মন দিতে পারেনি ; তবে আজ আর তাঁর কোনো বাধা নেই।
ভোরের হালকা শীতের একটা আমেজ চারদিকে ; কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ট্রেন টা এগোচ্ছে ধীর মেজাজে। যেন শহরের ব্যস্ততার বুনো ছাপ তাঁর ধরা ছোঁয়ার বাইরে ।
সায়ান গিয়ে বসল ট্রেনের এক কোনের জানালার ধারে। তারপর ব্যাগ থেকে বের করে আনলো কোনান ডয়েল এর শার্লক সমগ্র।
সায়ান ডুবে যায় তাঁর গল্পের জগতে। অপরদিকে তনু আর মেঘের মধ্যে চলতে থাকে খুনসুটি।
(২)
কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামের দৃশ্য। অন্ধকার রাতে কাঁচা পথ ধরে হেটে চলেছে এক রমনী।পরনের পোশাক আলুথালু। সেইদিকে তাঁর খেয়াল নেই। তাঁর হাঁটা চলার গতির মধ্যে দেখা যায় অসংগতি।
পায়ের তলা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তাঁর চলার পথে কেউ যেন ফুটিয়ে তুলেছে রক্ত রাঙা আল্পনা।
হাতে তাঁর ধরে রাখা আছে ছোট্ট একটা শিশু। শিশুটি ঘুমন্ত। মায়ের কোলের নিরাপদ আশ্রয়ে সে ডুবে রয়েছে গভীর নিদ্রায়।
নারীটি এসে দাঁড়ালো এক পুরোনো বাড়ির ভাঙা দরজার সামনে। তাঁর হাতটা সোজা হয়ে উঠলো সামনের দিকে তবে কব্জি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত অংশটা মাটির দিকে ঝুলছে ; ঠিক যেমন পুতুল নাচের সময় পুতুলের হাত গুলো ঝুলে থাকে।
হাতের ঠেলায় দরজাটা খুলে গেলো নীরব আর্তনাদে । সামনে এক প্রশস্ত লবি। অন্ধকার লবির চারপাশে মাকড়সা আর বাদুড়েরা যেনো নীরবে পাহাড়া দিয়ে চলেছে কোনো কিছুর। লবির এক পাশে এক দীর্ঘ সিড়ি। সিড়ির পাশে রয়েছে ছোট্ট একটা ঘর।
মেয়েটি আগুনের দিকে ছুটে চলা পতঙ্গের ন্যায় এগোতে থাকে ঘরের দিকে। ঘরটার মধ্যে থেকে ভেসে আসছে, মন্ত্রপাঠের চাপা শব্দ।
ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে মেয়েটি। তারপর এগিয়ে যায় ঘরের ঠিক মাঝখানে জ্বলতে থাকা অগ্নিকুন্ডের ঠিক সামনে। সেখানের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নামিয়ে রাখে তার হাতের ছোট্ট শিশুটিকে।
মেয়েটির চোখ তখনও বোজা, ঘরের উচ্চারিত মন্ত্রের তালে তালে তার মাথা দুলে উঠছে ডানদিক থেকে বামদিকে, আবার পরক্ষনেই সামনে থেকে পিছনের দিকে। যেনো সে নাঁচছে, কোনো এক অজানা গানে। ধীরে ধীরে তাঁর শরীর থেকে খসে পড়ছে একের পর এক কাপড়, এখন সে সম্পূর্ণ অনাবৃত। দুলতে দুলতেই সে আগুনের সামনে থাকা একটি পাত্র থেকে মুঠো করে তুলে নেই সিঁদুর, তারপর একটু একটু করে সেটা ডলতে থাকে নিজের অনাবৃত শরীরে।
তাঁর অচেতন মনে কোনো লাজ-লজ্জা কাজ করলো না। ঘরের মধ্যে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তির কথা সে যেন জানেই না এইভাবে সে অনাবৃত অবস্থায় নৃত্য করতে লাগলো।
ঘরে মন্ত্র উচ্চারণ আরো জোরালো হয়ে উঠতে লাগলো, নারীটির ঘোর যেন মন্ত্র উচ্চারণএর সাথে সাথে আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে। এক সময় সে তুলে নিলো পাশে পরে থাকা ছোট্ট আড়াই ইঞ্চির একটা ছুড়ি।
তারপর সেটা এগিয়ে ধরলো নিজের কপালের দিকে, আড়াই ইঞ্চির চাকুটা দিয়ে সে ধীরে ধীরে কেটে তুললো কপালের একটা অংশ।
ঘরের মধ্যে থাকা ওপর ব্যক্তির চোখ খুশিতে তখন জ্বল জ্বল করছে। সে মহিলার দিকে এগিয়ে দিলো কালো রঙের এক মুক্ত। মুক্তটা এতটাই কালো ছিল যে তাঁর মধ্যে সে যেন সব কিছুকে শুষে নিচ্ছে। মহিলাটি নির্দ্বিধায় হাতের তুলে নিলো মুক্ত টা, তারপর বসিয়ে দিলো তাঁর কপালের সেই কাটা অংশটার মধ্যে।
একটা যেন ঝটকা লাগলো মেয়েটার শরীরে, তারপর সব কিছু আবার সেই আগের মতন।
ঘরের মধ্যে থাকা অন্য লোকটি এবার মন্ত্র পড়তে পড়তে একটি তরল এগিয়ে দিলো মহিলাটির দিকে। মহিলাটি সেটিকে হাতে তুলে নিয়ে,পুরোটাই এক নিমেষে শেষ করে দিলো।
তারপর হাতে ধরে থাকা ছুরিটা নিয়ে এগিয়ে গেলো মাটিতে শুইয়ে রাখা ছোট্ট শিশুটার দিকে, এক হাতে তুলে নিল নিষ্পাপ শিশুটাকে। মহিলাটির মুখে তখন শোনা যাচ্ছে এক অশ্রাব্র মন্ত্র, মন্ত্র শেষ হতেই ডান হাতে থাকা ছোট্ট ছুরিটা নেমে এলো শিশুটার নরম গলা লক্ষ্য করে।
ছুরিটার গা বেয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত গিয়ে পড়তে লাগলো জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডের মাঝে।
প্রচন্ড যন্ত্রনায় হয়তো কেঁদে উঠতে চাইছিলো শিশুটি, কিন্তু সেই সুযোগ সে পেলো না।
যন্ত্রনায় পা দুটো একটু নড়ে উঠলো তার, তারপরেই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসলো তার পুরো শরীরটা।
মহিলাটি আবারও অবচেতন মনে মন্ত্র পরে চলেছে।
একসময় সে শিশুটির রক্ত জমাট করতে লাগলো এক পাত্রের মধ্যে। ধীরে ধীরে পাত্রটি শিশুটির তাজা রক্তে ভোরে উঠলো।
মহিলাটি শিশুটির দেহটি ছুঁড়ে ফেলো দিলো অগ্নিকুনন্ডের মাঝে। তারপর এক নিমেষে পান করে ফেললো রক্তে ভরা পাত্রখানা।
মহিলাটির মাথায় থাকা পাথর খানা যেন আরো কালো হয়ে উঠলো।
ঘরে থাকা লোকটি এবার তার লাল বর্ণের পরিধান টি খুলে নীরাবরণ হয়ে দ্বিগুন উত্তেজনায় মন্ত্র পড়তে লাগলো। মন্ত্র শেষ হতে না হতেই সে তার সামনে থাকা অন্য একটা ছুড়ি তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলো তার বাম হাতের পাতায়। ছুরির আঘাতে সেখান থেকে তখন টপটপ করে রক্ত পড়ছে । পুরুষটির মুখের অপর যন্ত্রণার কোনো ছাপ পরতে পারলো না।সে ততক্ষনে তার হাতটি তুলে ধরেছে মহিলাটির মুখের সামনে। রক্তের তাজা গন্ধে মহিলার সাড়া শরীর কাঁপছে তখন। পুরুষটি তার হাতটা ঢুকিয়ে দিলো মহিলাটির মুখে।
মহিলাটি পরম আনন্দে রক্ত পান করছে পুরুষটির হাত দিয়ে।
পুরুষটির চোখ একবার জ্বলে উঠলো শুধু আর সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাটির বাম পাশে নেমে আসলো পুরুষটির অপর হাতে ধরে থাকা ছুরিটি।
এক অপার্থিব চিৎকারে ভেসে উঠেছে সিঁড়ির তলার ঘর খানা। যেন নরকের কোনো দানব চিৎকার করে উঠলো মৃত্যুযন্ত্রনায়।
কিছু সময় পর, প্রাণহীন সেই শরীরের উপর ঝুকে, কিছু একটা খেতে দেখা গেলো লোকটিকে। লোকটির চোখে তখন পৈশাচিক আনন্দ।
জ্বলতে থাকা আগুনের নিভু নিভু আলোতে মহিলাটির কপালে লাগানো কালো পাথরটি যেন নরকের অন্ধকারের থেকেও কালো হয়ে উঠেছে।
কুয়াশার মাঝ থেকে আসতে দেখা গেলো সায়ানদের ট্রেনটাকে তারপর প্লাটফর্মএর হইহট্টগোলের মাঝে এসে একটিমাত্র ঝাকুনি দিয়ে থেমে গেলো ট্রেনটা।
ট্রেন থেকে একে একে নামলো ওরা তিনজন। হাতে ধরে রাখা ব্যাগ পত্র গুলো নিয়ে স্টেশনের ভিড় কাটিয়ে তারা সোজা চলে গেলো স্টেশনের বাইরের দিকটায়, সেখানেই তাঁদের নিতে আসার কথা আছে শম্ভুর।
শম্ভু হলো তনুদের লজের কেয়ার টেকার। ওদের কাল রাত্রেই ফোন করে জানানো হয়েছিল যে আজকে ওরা আসবে তাই ওদের নিতে যেন কাউকে পাঠানো হয়। সেই সূত্রেই ওদের নিতে আসার কথা শম্ভুর।
কিন্তু বাইরে গিয়ে কাউকেই দেখতে পায় না তারা। খিদেতে তাঁদের পেট তখন চুইছুই করছে । সেই সকাল বেলা ট্রেনে বসে শুধু চা খেয়েছিলো তারা আর এখন প্রায় ১১:৩০ টা বাজতে চলেছে।
নিজেরা গাড়ি করবে কিনা ভাবছে এমন সময় দৌড়ে আসতে দেখা গেলো একটা লোককে। পরনে একটা আধো নতুন উলের সোয়েটার, গলায় মাফলার ঝোলানো, পায়ে মোজা গলানো হাওয়াই চপ্পল।
লোকটা দৌড়ে এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। তারপর লজ্জা লজ্জা ভাবে বলতে লাগলো
" এইতে একটু নেইট হয়ে গেলো বাবুঝিরা ,মাপ করি দিবেন।আসলে গাড়িটা মাঝ রাস্তায় এমন ভাবে বিগড়ে গেলে কিনা! "
লোকটা তার গাড়ির উপর দোষারোপ করতে যাচ্ছিলো, তাকে থামিয়ে দিয়ে সায়ান কিছুটা রসিকতা করে বললো
"লেট্ যে করেছো সেতো দেখতেই পাচ্ছি,কিন্তু আরেকটু লেট্ করলে তোমাদের এই বাবুটির যে খিদে পেয়েছিলো তাতে এবার সে আমাদের খাওয়া শুরু করে দিত যে।"
সায়ানের এই কথায় সবাই মিলে তাকায় মেঘের দিকে। মেঘ যেন একটু লজ্জা পেয়ে যায় তাতে।
" এমন করে লজ্জা পাচ্ছিস যেন সত্যি সত্যিই খাওয়া শুরু করে দিতিস আমাদের।" তনু একটু খোঁচা মারে মেঘকে।
"এই ধুরর না, তোরা না সত্যিই.."
মেঘের এই কথায় তারা আর হাসি আটকে রাখতে পারে না। সবাই এবার হেসে ওঠে হাহা করে।
হাসি থামতেই শম্ভু জানালো তাঁদের জন্য নাকি লজে গরম গরম লুচি আর বেগুনের পোখরা বানানো হয়েছে। এই পোখরাটা নাকি আবার ওদের লজের ষ্টার আইটেম। তাই ওরা আর কেউ দেরী না করে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
কাঁচা পাকা রাস্তার মাঝ দিয়ে ছুঁটে চলেছে তাঁদের গাড়ি। চারপাশের প্রকৃতি যেন ওদের সাথে দৌড়ে না পেরে থেমে যাচ্ছে এক এক করে।
তনু আর মেঘ পুরো রাস্তা দু তিনটে গান ধরেছিল তার দুটো হিন্দি, একটা বাংলা। তবে সেগুলো খুব একটা জমে উঠতে পারেনি। তাই অবশেষে গানের হাল ধরতে হয়েছিল এই সায়ানকেই। সে তার পছন্দের একটা গান ধরে গুনগুন করে
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
সাগরের ঢেউয়ে চেপে,
নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো
আমি শুনেছি সেদিন তুমি
নোনবালি তীর ধরে,
বহুদুর বহুদুর হেঁটে এসেছো
আমি কখনও যাই নি জলে,
কখনও ভাসিনি নীলে
কখনও রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাং চিলে
আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও,
নেবে তো আমায় বল নেবে তো আমায়?...
সায়ানের গানের গলাটা খুবই সুন্দর। ছোটবেলায় নিয়ম করে দুইবেলা রেয়াজ করতো ছেলেটা। তবে এখন পড়াশোনার চাপে সময় করে উঠতে পারে না সে। তাছাড়া বয়সন্ধির কারণে তার গলার আওয়াজ ও গঠনেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। তাই সে বেশি সময় গাইতে পারেনা। গাইলেই তার গলাটা ব্যাথা করে উঠতে শুরু করে।
তবুও সায়ানের গান খারাপ লাগে কারোর।
মেঘ দু একবার আড়ালে তনুকে এই নিয়ে চোখ টিপি দিয়েছে, যেনো সে বলতে চাইছে দেখ তোর hubby কে, কী সুন্দর গাইছে তাইনা!
'উফফ এই ছেলেটা না!' মনে মনে রেগে ওঠে তনু।
তবে মুখে সে কিছু বলে না , মুগ্ধ হয়ে গান শুনতে থাকে সে।
বুঁকের ভিতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে তার।
(৪)
সকাল বেলায় লক্ষীর দেহটাকে খুঁজে পেলো, ভবেনের জ্যাঠামশাই কানু গোপাল ভুঁইয়া। ভোরের বেলা তিনি মাঠে যাচ্ছেলেন, এমন সময় আলের ধারে পাড়ার কুকুরটাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে, এগিয়ে গেছিলেন সেদিকে।
কুকুরটা একটা ছেঁড়া জামার কাপড় শুকছিলো, আর মাথা তুলে তুলে মাঠের উত্তর কোনে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সে একা কোনোমতেই সেখানে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না।
কানু জ্যাঠাকে তার দিকে আসতে দেখে সে কিছুটা সাহস পেলো যেন।
সে কাপড়টা মুখে নিয়ে এগিয়ে গেলো জ্যাঠুর দিকে।
জ্যাঠা মশাই, দেখলেন ভুচো মুখে একটা কাপড় নিয়ে তারই দিকে এগিয়ে আসছে, তিনিও এগিয়ে গেলেন ভুচোর দিকে তারপর আদুরে গলায় বললেন
"কী রে ভুচো, তোর মুখে ওটা কী নিয়ে আসছিস?"
ভুচো লেজ নাড়তে নাড়তে মুখের জিনিসটা নামিয়ে রাখলো জ্যাঠা মশাই এর পায়ের কাছে, তারপর উত্তর কোনে তাকিয়ে দুবার ডেকে উঠলো সে ।
জ্যাঠামশাই নিচে পরে থাকা কাপড়টার দিকে তাকালেন, ছোট্ট বাচ্চাদের জন্য তৈরী জামার একটা অংশ সেটা ।
তিনি কাপড়টা নিয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন না, গ্রামে প্রায়ই দু একটা কাপড় চোপড় মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যায় বেপাড়ার কুকুররা, তারপর সেটাকে নিয়েই কামরাকামড়ি করে।
এটাও সেরকম হবে ভেবে তিনি ভুচোকে নিয়ে চলে আসছিলেন। কিন্তু ভুচো যেন কোনো মতেই সেখান থেকে যেতে চাইছে না। সে দৌড়ে যায় উত্তর কোনের দিকে তারপর সেখানে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুই সময় কিন্তু ভয় পেয়ে আর এগোয় না সামনের দিকে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে জ্যাঠামশাই এর দিকে তাকিয়ে ডাক দেয় । যেন সে তাকে আসতে বলছে তার সাথে।
জ্যাঠামশাই জিনিসটা বুঝতে পেরে কিছু একটা ভাবেন, তারপর জোর পায়ে এগিয়ে যান গ্রামের দিকে।
ভুচো তখনও ডেকে চলেছে সেখান থেকে,জ্যাঠামশাইকে ঐভাবে চলে যেতে দেখে সে যেন কষ্ট পেয়েছে এইভাবে কুইকুই করতে থাকলো সে।
জ্যাঠা মশাই বুদ্ধিমান লোক, তিনি আন্দাজ করতে পারছেন ভুচো ওখানে কী দেখেছে বা দেখতে পারে, তাই সে দেরী করে না করে গ্রামে ফিরে যায় । তারপর পাড়ার দু একজন কে জড়ো করে সোজা চলে যান মাঠের ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে তিনি প্রথমে ভুচোকে দেখেছিলেন।
জ্যাঠামশাইকে ফিরে আসতে দেখে ভুচো আবারো লেজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে যায় জ্যাঠামশাইয়ের দিকে। জ্যাঠামশাই একবার হাত বুলিয়ে দিলেন ভুচোর মাথায়।
"কই রে ভুচো চ.. দেখি কী দেখাচ্ছিলি তখন?"
ভুচোর লেজটা নড়ে ওঠে আবার , সে যেন সবটা বুঝতে পেরেছে, এমনভাবে সে একবার ডেকে ছুঁটে গেলে উত্তর দিকে। জ্যাঠামশাইয়ের দলও ছুঁটে চলল তার পিছন পিছন।
মিনিট দুই পরেই তারা ভুচোর পিছু পিছু পৌঁছে গেলো মাঠের একধারের এক জোঙ্গুলে জমিতে।
চারপাশে আগাছার ঝোপে ভর্তি,জায়গায় জায়গায় কাঁটালো গাছএর সমারোহ , এখানে দৌড়ানো মুশকিল , তাই সবাই মিলে চারপাশটা ভালো মতো দেখতে দেখতে হেটে চললো ভুচোর পিছন পিছন ।
আরো মিনিট দুই পর ভুচোকে দেখা গেলো সে চিৎকার করে ডাক দিচ্ছে কিছু একটা দেখে।
সকলে দৌড়ে গেলো জায়গাটার সামনে। কিন্তু গিয়ে যা দেখলো তাতে সকলেই এক মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো।
এমনকি দলের সব থেকে সাহসী ব্যক্তিটিও মুখ চেপে বসে পড়লো মাটিতে।
সামনে পরে রয়েছে এক অনাবৃত নারী দেহ, তার সাড়া শরীর সিঁদুর দিয়ে লেপা। মাথার মাঝ বরাবর দেখা যাচ্ছে একটি গর্ত।
শরীরের জায়গায় জায়গায় খুবলে নেওয়া হয়েছে মাংসের টুকরো। নারী দেহের বাম পাশের স্তন যেন কেউ খুবলে নিয়েছে ধারালো কোনো অস্ত্র দিয়ে। একটা চোখে বেরিয়ে পরেছে তার অক্ষীকোটর ছেড়ে। গালের ডান পাশটা কোনো পশু খুবলে নেওয়ায় দাঁতের সারি গুলো দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে। চারদিকে এক ঝাঁক মাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ভনভন করে।
তবে সব থেকে ভয়ানক দৃশ্যটি হলো, নারীর উন্মুক্ত নিম্নাঙের ঠিক মাঝ বরাবর পরে রয়েছে এক ছোট্ট শিশুর ধরবিহীন মাথা। ঠিক যেন কোনো পুতুলের দেহ থেকে মাথা খুলে নেওয়া হয়েছে।কিছু মাছি উড়ে গিয়ে বসছে গলার নিচের খোলা সেই অংশটার উপর।
শিশুর তাজা রক্তে যেন তাদের নেশা ধরে যাচ্ছে।
গ্রামের ভিতরের একটি দৃশ্য।
একটা দেড় তলার বাড়ির নিচে জমা হয়েছে কিছু জনতা। এদের মধ্যে বেশ কিছু মুখ আমাদের চেনা। সকালেই এদের দেখতে পাওয়া গেছিলো জ্যাঠা মশাই কানু গোপাল ভূঁইয়ার সাথে।
তাছাড়া মহিলার মৃত শরীরটা নিয়ে আসা থেকে শুরু করে সৎকারের কাজ পর্যন্ত এরা সকলেই ছিল জ্যাঠামশাইয়ের সাথে।
এখানে এখন লোক জমায়েত হয়েছে মূলত দুটি কারণে। এক, হত্যাকান্ডের আসল খুনিকে শনাক্ত করা আর দুই নম্বর হচ্ছে বির্জুকে শান্তনা দিতে।
বির্জু হলো লক্ষীর জামাই, যার দেহটা খুঁজে পাওয়া গেছিলো আজ সকালেই। এক রাত্রেই স্ত্রী-পুত্র হারিয়ে মনভাঙ্গা অবস্থায় উঠোনের এককোনে বসেছিল সে।
লক্ষীর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল বছর দুই আগে। নিজের বৌটাকে খুব ভালোবাসতো বির্জু । মাঝে মধ্যে যে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হতো না এমন নয়, তবে কখনো সে তার বৌয়ের গায়ে হাত তুলেছে বলে শোনা যায় নি । বিয়ের বছর দেড়েক পরেই তাঁদের একটা বাচ্চা হলো। বাচ্চাটাকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালো বাসতো বির্জু, দিন শেষে প্রায়ই বাচ্চাটার জন্য খেলনাটা খাবারটা কিনে নিয়ে যেত সে।
কাল রাত্রেও সে বাচ্চাটার জন্য একটা জামা কিনে নিয়ে এসেছিলো। তারপর সেই জামা পরিয়ে কিছুক্ষন ঘুরে বেড়ালো গ্রামের ভিতরে।
কিন্তু সকাল হতেই তার না রইলো বউ আর না রইলো বাচ্চা।
এই নিয়ে পাড়ার লোকেদেরও হাহুতাষের শেষ নেই। জনে জনে এসে তাকে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছে ।
কিন্তু যার ঝরে ঘর ভাঙে, সেইই জানে ঘর হারানোর কষ্ট।
ভিড়ের মধ্যে থেকে দু একজনকে নতুন করে বিয়ে করার প্রস্তাব দিতেও শোনা গেলো। বির্জু তাঁদের দিকে একবার লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়েছিল, মুখে কিছুই বলে নি সে।
এতেই লোকগুলো একে একে সরে গেলো সেখান থেকে।
এই গেলো দুই নম্বর এবার এক নম্বরে আসা যাক,
কানু জ্যাঠাকে ঘিরে একটা দল কিছু তফাতে জড়ো হয়েছে, তাঁদের সবার মুখে একটাই প্রশ্ন ঐরকম নৃশংস ভাবে খুন দুটো করলো কে।
"কাল রাতে বোধহয় ছেলেটাকে ঘুম পাড়াতে বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছিলো ,আর তখনই সুযোগ পেয়ে শিয়ালে টেনেছে তাঁদের ।" নাকে নস্যি টানতে টানতে টেঁকো মাথার একজন লোক বলল কথাখানা।
"শিয়ালে টেনে নিয়ে গেলো আর কেউ কিছু জানতে পারলেনি! তুমি যে কী বলো খুড়ো!"
"এই... এই এক কারনে কিছু বলতে চাই নে, যত্তসব ডেপো ছেলের দল। গুরুজন কিছু বললেই চ্যাংড়ামো করতে চলি আসে। " এই বলে এক দীর্ঘ নিঃশাস ছাড়লেন তিনি, এতে তার সমস্ত নস্যি নাসারন্ধ্র থেকে বেড়িয়ে এসে পড়ল নীচের মাটিতে। এতে যেন তিনি আরো চটে গেলেন।
লোকটিকে শান্ত করতে এবার জ্যাঠামশাইই বলে উঠলেন
"না, শিয়ালে তাকে টানেনি,একটু ভেবে দেখো একজন বছরের উনিশের মেয়ে কে শিয়ালে টেনে নিয়ে গেলো আর কেউ একবারটি টের পেলো না! তাছাড়া বির্জু তো সেদিন ঘরেই ছিল, তার বৌ বাচ্চাকে শিয়ালে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আর সেই ধসরাধসরির আওয়াজ সে পাবে না? "
"তাহলে? " সবার মুখেই একই প্রশ্ন।
"তাহলে? তাহলে, এই ঘটনাটা যখন একবার ঘটেছে মানে আর যে ঘটবে না তার কোনো মানে নেই "
সবার মুখেই ভয় ফুটে ওঠে।
"মা.. মানে? " টাক মাথার লোকটি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে।
"মানে, আর কিছু না একটু সাবধান থাকবেন। চলি.." এই টুকু বলে কানু জ্যাঠা উঠে পরে সেখান থেকে। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যান তার বাড়ির দিকে।
দলের বাকিরা তখন হতভম্বের মতো এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
(৫)
জঙ্গলের মধ্যে থেকে ডাকটা আবার যেন ভেসে আসে লজের ভিতরে।
আজ পরপর তিনদিন হলো সে শুনতে পাচ্ছে ডাকটা।খুবই করুন সেই ডাক। যেন কেউ তার খুবই কাছের কোনো মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। সেই বেদনায় আর্তনাদ করে বিলাপ করছে ডাকটা ।
আজকে ডাকটা শুনতেই তনু আর অপেক্ষা করে না, হাতের ফোনটাতে চার্জ চেক করে তখনই বেরিয়ে পরে লজ ছেড়ে। তবে সামনের দরজা দিয়ে যায় না সে, পিছনের দিকে একটা ছোটো দরজা আছে সেটাই খুলে বেরিয়ে পরে সে । কালকেই খুঁজে পেয়েছিলো তনু দরজা খানা। দরজাটা খুললেই একটা ছোটো পায়ে চলার পথ চলে গেছে সোজা জঙ্গলের দিকটায়। সেদিকে একটা ছোটো দীঘি আছে, সেই দীঘি দিয়ে জল আনার জন্যেই মূলত রাস্তাটা ব্যবহার হয় ।
তনু মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বেলে এগোতে থাকে সেই পথ ধরে। লজের বাকিরা তখন গভীর ঘুমে।
ডাকটা আবার শুনতে পায় তনু। সেই ডাকের মধ্যে থাকা একরাশ যন্ত্রনা যেন কাঁপিয়ে দিয়ে যায় তনুর মনকে ।
জোর পায়ে হেটে চলে সে, অন্ধকারের পথে চারদিকে সাপ খোপের ভয়,তাই মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় পথ দেখে নিতে ভুল করে না তনু একদমই । মাথার উপরে গাছপালার ঘন চাঁদয়া ঢেকে রেখেছে রাতের আকাশকে।
হাঁটতে হাঁটতে জঙ্গলের অপেক্ষাকৃত খোলা একটা জায়গায় এসে পৌছালো তনু । এখানে গাছপালা, আশেপাশের জঙ্গলের তুলনায় একটু পাতলা , বনের মাঝ খানে ঠিক যেন একটা খোলা মাঠ।
মাথার উপর থেকে নেমে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। তারই মধ্যে সে দেখতে পেলো অপরূপ এক দৃশ্য।
জঙ্গলের অপরদিক থেকে দৌড়ে এলো একটা বাদামি রঙের হরিণ। চাঁদের রুপোলি আলোয় ঝকমক করছে তারা সাড়া শরীর ।
তনু আর নিজেকে আগলে রাখতে পারলো না, হাতের ফোনটা দিয়ে ঝটপট করে তুলে নিলো কিছু ছবি।
প্রাণীটা এক মুহূর্ত যেন থামলো সেখানে, তারপর মুখটা পিছনের দিকে একটু বাকিয়ে জিভ দিয়ে চেটে নিল নিজের শরীরটা। একবার যেন মাথা ঘুরিয়ে তনুকেও দেখে নিলো সে । অসম্ভব সুন্দর লাগছে চারিদিক।
"উফফ ভাগ্যিস এসেছিলাম এখানটায়, নাহলে পুরোটাই মিস হয়ে যেত আজকে, ভালো হয়েছে কাউকে কিছু জানায়নি নাহলে এরকম দৃশ্য একা দেখাটা আর ভাগ্যে জুটতো না আজকে।" মনে মনে ভাবে তনু।
কালকে যখন সে ছবি গুলো দেখাবে বাকিদের তখন ওদের মুখের ছবি যে কেমন হবে সেটা ভাবতেই তনুর খুশি যেন ডবল হয়ে ওঠে।
কিন্তু পড়মুহূর্তেই যা ঘটলো সেটা তার এতো সময়ের সব খুশি মাটি করে দিয়ে মনে জাগিয়ে তুললো নিখাদ ভয় আর বিস্ময়।
হরিনকে অনুসরণ করে জঙ্গলের সেই দিক থেকে ছুঁটে এসেছে একটা শিশুমূর্তি।
সঠিক ভাবে বললে জঙ্গলের সেই দিক থেকে উড়ে এসেছে মূর্তিটি। কারণ তার পা মাটিকে স্পর্শ করছে না। উন্মুক্ত গলার থেকে নেমে এসেছে থাক থাক রক্তের ঝুড়ি, ঠিক যেমন বট গাছে দেখা যায়। সেই রক্তের ঝুড়িতেই ভর করেই এগিয়ে চলেছে শিশুটি। আবার শোনা গেলো সেই ডাকটা, তনু যেটাকে এতো সময় হরিনের ডাক বলে ভেবেছিলো সেটা আসলে ভেসে আসছে তার সামনের সেই শিশুটির শরীর থেকে। এক রাশ আর্তনাদ মিশিয়ে ডাক দিতে চাইছে শিশুটি কিন্তু গলার উপর থেকে কিছু না থাকায় সেই ডাক যেন পূর্ণতা পাচ্ছে না।
এতো সময়ে সামনে দাঁড়ানো হরিণটার দিকে এগিয়ে গেছে প্রাণীটা। হরিণটা পালানোর একটা বৃথা চেষ্টা করলো মাত্র, কিন্তু সে সেটা পারলো না। রক্তের একটা ধারা দ্রুতগতিতে পেঁচিয়ে ধরলো হরিনের পিছনের পা দুটি আর পরোমুহূর্তেই বটের ঝুড়ির মতো দেখতে থাকা রক্তের ফোয়ারা যেন হয়ে উঠলো তোলোয়ারএর ফলার মতো ধারালো। নিমিষে সেটা ছুঁটে গেলো হরিনের মাথা লক্ষ্য করে আর রক্তের শোনিত অগ্রভাগ একটু একটু করে ঢুকে গেলো হরিনের মাথার ঠিক মাঝ বরাবর। তারপর একটু একটু করে শুষে নিল হরিণটির প্রাণ শক্তি ।
বড় বিভৎস সেই দৃশ্য ;তনুর গা গুলিয়ে ওঠে, তবে সে একদমই বোকা নয়। মুখ চেপে কোনো মতে আটকে দেয় তার বমি। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে
ধীরে ধীরে মৃত্যু প্রশান্তি নেমে এসেছে হরিণটির সাড়া শরীরে।
চুপ হয়ে পরে রয়েছে হরিনটি । আর কখনো নড়বে না সে।
বিজয় গর্বে ডেকে উঠলো সেই রক্তিম পিশাচ শিশু। একবার... দুবার... তিনবার।
তারপর ধীরে ধীরে আরো কিছু রক্তের ঝুড়ি গিয়ে ধরলো হরিণটিকে, তারপর সেটিকে আকাশের দিকে তুলে এগিয়ে নিয়ে আসতে লাগলো সেই মাথাবিহীন শিশুটার গলার কাছে, যেখান থেকে নেমে এসেছে এই অপাকৃতিক রক্তের ঝুড়ি।
হরিনের শরীরটি সে চেপে ধরেছে নিজের গলার কাছে। যেন সে গিলে নিতে চায় প্রাণীটাকে এবং সেটাই হলো
তনুর চোখের সামনেই একটু একটু করে হরিণটিকে গিলে নিতে লাগলো শিশুটি।
কোথাও পরে রইলো না একটুও অবশিষ্টাংস।
শিশুটি খুশিতে একটা দীর্ঘ চিৎকার করে উঠলো। দীর্ঘ কয়েক মিনিটের সেই চিৎকার। চিৎকার থামলে তনু দেখতে পায়ে নরকের এই বিভীষকাময় নাটকের নাট্যমঞ্চে সে একা।
সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে দীঘিতে যাচ্ছিলেন লজের মালিক পশুপতি শিকদার। হাতে তার ধরা একটা সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির নিম ডাল। নিম ডালের মাথাটা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে নেওয়া।
সেটা দিয়ে তিনি তার দাঁত ঘষছিলেন , এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন তনুর শরীরটাকে, নিশ্চল শরীরটাকে ঐভাবে পরে থাকতে দেখে তিনি ঘাবড়ে গেছিলেন।তবে কিছুক্ষণ পর বুকে একটু সাহস জুগিয়ে এগিয়ে গেলেন শরীরটার দিকে।
ভয়ে ভয়ে তিনি একবার তনুর ডান হাতটা তুলে নিয়ে কিছু একটা পরীক্ষা করলেন । তারপর একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে তনুর হালকা শরীরটা পাজাকোলা করে নিয়ে চলে গেলেন লজের ভিতরে।
"না তেমন কিছু নয়, প্রচন্ড ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে শুধু। আজকের দিনটা বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া এই ওষুধটা দিয়ে গেলাম যদি জ্বর ওঠে তাহলে হালকা কিছু একটা খাইয়ে ওষুধ টা খাওয়াবেন।" এই বলে ডাক্তারবাবু তার ব্যাগ থেকে একটা ওষুধের পাতার তিন খানা ওষুধ কেটে তুলে দিলেন সায়ানের হাতে।
"আচ্ছা তাহলে আজ আসি।" ডাক্তারবাবু খাটের পাশের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন।
"চলুন ডাক্তারবাবু আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি " মেঘ এই বলে ডাক্তার বাবুর হাত থেকে ব্যাগটা নিজের হাতে তুলে নিলো , তারপর ডাক্তারবাবুর সাথে চলে গেলো নিচের দিকে।
সায়ান জানে মেঘ নিচে গিয়ে ডাক্তারবাবুর ফিসটা মিটিয়ে দেবে। আসলে মেঘ এইসব ছোটো ছোটো দিকে খুবই mature।
ঘরে লোক বলতে এখন ওরা তিন জন। সায়ান, শম্ভু আর খাটে অচৈতন্য অবস্থায় শুয়ে থাকা তনু।
"দাদাবাবু আপনে এখানে একটু বসেন, আমি নিচে খাবার বানাতে যাই। সেই সকাল থেকে কারো মুখে কিছ্ছুটি পরেনি, আমি যাই কেমন!"
এই বলে শম্ভুও ঘর ছেড়ে চলে যায়। ঘরে এখন তারা একা। সায়ান ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় তনুর খাটের কাছে, তারপর তার মাথার কাছের খানিকটা ফাঁকা অংশে বসে পরে সে।
তনুর মুখের উপর এসে পরেছে কিছু চুলের গোছা। ডান হাত দিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে, তনুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে সে, কী অপরূপ লাগছে তনুকে এখন।
তনুর মাথায় হাত রাখে সায়ান, তারপর উস্কো খুস্ক চুলগুলোর উপর দিয়েই হাত বুলিয়ে চলে সে কয়েক মুহূর্ত ধরে।
সময় যেন গরমের নির্মম হাওয়ার মত বয়ে চলে যায় একটু একটু করে।
রাতের দিকে কাঁপিয়ে জ্বর আসে তনুর। সাড়া শরীর পুরে যাচ্ছে তাপে।
থার্মোমিটারটা নিয়ে এসে মুখে গুঁজে দেয় মেঘ। শরীরের তাপমাত্রা ১০৩ ছুঁইছুঁই। চিন্তায় সকলের মাথাতেই ভাজ পরেছে।
সকাল থেকে একবারও জ্ঞান ফেরেনি তনুর। সেই অবস্থাতেই একটু ছাতুর জল খাওয়ানো হয়েছিল তাকে ঝিনুকে করে। তখনও জ্বর আসেনি বলে ওষুধটা খাওয়াইনি তারা। কিন্তু মুশকিল হয়েছে সন্ধ্যার পরে থেকেই, একটু একটু করে গায়ের তাপ বাড়ছিলো তনুর, শেষে আবারো কিছুটা ছাতু খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল তারা তবে কোনো মতেই তারা তনুর ঠোঁট দুটো আর ফাঁক করতে পারেনি। ঠোঁটদুটো যেন কেউ আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে। ফলে ওষুধটাও খাওয়ানো সম্ভব হচ্ছে না তাঁদের।
রাত বারোটা পর্যন্ত একরকম চিন্তা ও চেষ্টার জোরেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল লজের সকলে। এই সকলের মধ্যে লজের মালিকও ছিলেন। ভদ্রলোক যথেষ্ট ভালো, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সকলের ভালো মন্দ দেখে যাচ্ছিলেন। এমনকি একটু আগে পর্যন্ত তাঁদের সকলকে নিজের হাতে চা খাইয়ে, নিজের ফোন নম্বর দিয়ে জানিয়ে গেছেন কোনো অসুবিধা হলে যেন তাকে খবর দেওয়া হয়।
মেঘ আর সায়ান তনুর ঘরেই থেকে পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ।
মেঘ চেয়ারটায় আর সায়ান মাটিতে একটা পাটি পেতে শুয়ে পরে। প্রথম চার ঘন্টা মেঘ পাহারা দেবে আর পরের চার ঘন্টা পাহারা দেবে সায়ান। তারপর সকাল হলেই তারা তনুকে নিয়ে চলে যাবে ঘন্টা খানেক দূরের হাসপাতালে। এমনটাই ঠিক করে তারা দুজনে।
সেই মতো মেঘ পাহারা দেওয়া শুরু করে।
রাত তখন আড়াইটা।
তনু এক ঘন বনের মধ্যে দিয়ে হেটে চলেছে ঠিক আগের দিনের মতো। ঘন বনের চারদিক থেকে ভেসে আসছে বুনো পশুদের আওয়াজ।
গাছগুলো যেন একটু একটু করে গ্রাস করে চলেছে তাঁর হেটে চলার পথটিকে।
তনু বুঝতে পারে না সে এখানে কী করছে। সে বোঝার চেষ্টাও করে না। সে শুধু হেটে চলেছে সামনের দিকে,না সে শুধু হাটছে না তাকে যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। একটা অমোঘ টান, সেই টান উপেক্ষা করা বড় শক্ত।
হাঁটতে হাঁটতে তার পায়ে গেথে যাচ্ছে বুনো কাঁটা, সেই কাঁটার আঘাতে কেটে গেছে তার নরম পারি জোড়া, রক্তের এক সুদীর্ঘ আল্পনা দেখা যায় তার ফেলা আসা পথের উপরে ।
দূর থেকে একটা রক্তিম আভা চোখে পরে তনুর। সে যেখানে এখন আছে তার থেকে মাত্র কিছু দূরে কিছু গাছ এমন ভাবে একে ওপরের সাথে ঘন হয়ে আছে যে, দূর থেকে দেখলে সেটা একটা সুড়ঙ্গের সরু মুখ বলেই মনে হবে। আর সেই সুরঙের ভিতর থেকেই আসছে কৃত্রিম লাল সেই আভা।
তনু না থেমে এগিয়ে চলে সে সেই দিক। কী একটা প্রচন্ড টান ভেসে আসছে সেই সুড়ঙ্গ থেকে ।
সুড়ঙ্গের মুখটার সামনে একটা ছোটো লাল সুতোর দড়ি দেখতে পায় তনু। সুড়ঙ্গের মুখটা যেন কেউ বেঁধে রেখেছে সেই সুতো দিয়ে। তনু একটা হাত বাড়িয়ে ধরে সেই সুতোটা, একটা হালকা বিদ্যুতের স্রোত বয়ে যায় তার সাড়া শরীর দিয়ে তারপর হঠাৎ করেই ছিঁড়ে পরে সেই সুতোখানা। তনু সেইদিকে নজর না দিয়ে সোজা চলে যায় সুড়ঙ্গের ভিতরে।
বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু সুড়ঙ্গের ভিতরটা যেন কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ। তনু হেঁটেই চলে সুড়ঙ্গের ভিতরে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে লাল আলোটা সে সুড়ঙ্গের বাইরে দেখেছিলো, সেটা যেন সুড়ঙ্গের ভিতরে আসা মাত্রই মিলিয়ে গেছে শূন্যের মাঝে।
এইভাবেই কেটে যায় কয়েক ঘন্টা। তনু হেটেই চলেছে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সে একটুও ক্লান্ত হচ্ছে না এমনকি তার পায়ে কোনো ব্যাথা পর্যন্ত করছে না।
আরো কিছু সময় হেটে সে দূরে একটা দরজা দেখতে পায়। বিশালকার সেই দরজা। তনু জীবনেও এতো বড় দরজা দেখেনি কখনো। বিশাল সেই দরজার উপর খোদাই করা রয়েছে এক বিরাট চিহ্ন। এই চিহ্নটাকে সে চেনে, তাঁদের বাড়িতে, ঠাকুর ঘরে এমনকি পূজা মণ্ডপেও সে দেখেছে এই চিহ্ন।
দরজায় খোদাই করা রয়েছে এক বিরাট স্বস্তিকা।
হালকা হাতে ছুঁয়ে দেয় সে দরজা খানা আর সাথেই সাথেই ঘটে যায় Domino effect।
দরজাটা ছুঁতেই সেটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে পরতে লাগলো তনুর পায়ের কাছে। কিন্তু সেই অংশগুলো মাটিতে পরার আগেই যেন মিশে যেতে লাগলো বায়ুর মধ্যে।
এইরূপ অবাক দৃশ্যে তনু হতবাক। দরজার অপরদিকে দেখা যায় এক বিরাট ঘর। হঠাৎ ফস করে যেন একটা আলো জ্বলে উঠলো সেই ঘরের মধ্যে।
আলোটা প্রথমে ছিল নীল কিন্তু প্রতিমুহূর্তেই সেটা আঁকারে বাড়তে লাগলো আর তার রঙ বদলে যেতে লাগলো তীব্র রক্তিম রঙে।
একসময় সেই আলোর মধ্যে থেকে যেন একটা চেহারা ফুটে উঠতে লাগলো তনুর চোখের সামনে।
লাল সেই চেহারায় চোখের জায়গায় জ্বল জ্বল করে জ্বলছে দুটো আগুনের শলাকা। আর তার গলার নিচ থেকে নেমে এসেছে শত শত শিরা উপশিরা। শিরা উপশিরা গুলো শত শত সাপের মতো কিলবিল করে ঘুরে বেড়াতে লাগলো সাড়া ঘরে।
মুখটি তার প্রাথমিক আয়তনের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে কয়েকশো গুন। তার দৃষ্টি স্থির, সে তাকিয়ে রয়েছে তনুর দিকে।
দানব মুখটি হা করে ওঠে, তার মুখে থেকে বেরিয়ে এসেছে কয়েক হাত লম্বা কালো এক জিভ।জিভটার অগ্রভাগটা চেরা, ঠিক যেন একটা সাপের জিভ।
তনু আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না। তার শরীর কেঁপে উঠলো ভয়ে।
খাটে সটান করে সোজা হয়ে বসলো তনু। হাফাচ্ছে সে, তার শরীর ঘেমে পোশাকটা ভিজে উঠেছে।
সে চারদিকে একবার তাকালো, লজে নিজের রুমে শুয়ে রয়েছে সে। তবে ঘরে মেঘ আর সায়ানকেও দেখতে পারলো সে।
একজন চেয়ারে আর ওপরজন শুয়ে রয়েছে রয়েছে মেঝের একটা পাটিতে।
ঘরের মধ্যে সে একমাত্র ব্যক্তি যে জেগে রয়েছে।
খাটের পাশে একটা টেবিলে জলের একটা বোতল দেখতে পায়ে তনু। সেটাকে হাতে তুলে নিয়ে গটগট করে খালি করে ফেলে পুরো বোতল টা।
লজের নিচের একটা ওয়ালক্লকে ঢং ঢং ঢং করে তিনটে ঘন্টা পড়লো। মানে এখন রাত আড়াইটে কী তিনটে বাজে।
হাতের চেটো দিয়ে ঘামটা মোছে তনু। তারপর তার চোখ চলে যায় তার পায়ের কাছের জানলাটার উপর। সেখানে সে দেখতে পেলো এক অদ্ভুত দৃশ্য।
রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করছে একটা লাল ভাঙা চাঁদ। আর চাঁদের নিচে কী একটা যেন উড়ে বেড়াচ্ছে রাতের আকাশে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে সেটা বেড়ে উঠছে একটু একটু করে। মানে প্রাণীটা এগিয়ে আসছে তাঁদের লজেরই দিকে। তনু অবাক চোখে সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে পরিষ্কার দেখতে পায় সেই প্রাণীটাকে। প্রাণীটাকে সে চেনে, গতকাল রাত্রে সে রুপোলি আলোতে প্রাণীটাকে দেখেছিলো একটা হরিনকে শিকার করতে।
প্রাণীটা আর কেউ নয়,সেই মাথা বিহীন খুনে শিশু।
তনু আর সহ্য করতে পারে না, সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে।
গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে ঘুমাচ্ছিলো ভুচো। একটু আগেই কানু জ্যাঠার মেয়ে তাকে দুটো রুটি খেতে দিয়ে গেছে। সেই দুটো খেয়ে ভুচো কিছু সময় গ্রামের চারপাশে একটা চক্কর দিয়েছিল। তারপর, সব কিছু ঠিকঠাক আছে দেখে, সে এসে শুয়েছিল এই মোড়ের মাথায়।
রাত তখন একটার কাছাকাছি, গ্রামের প্রতিটা ঘরের আলো নিভে গেছে অনেক ক্ষণ হয়েছে।
হঠাৎ করেই একটা খসখস শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো ভুচোর। সে একবার তার শায়িত মাথা খানা তুলে চাইলো চারদিকে।
না কাউকে দেখতে পাচ্ছে না সে। ভুচো তার ঘুমন্ত মাথাখানা আবার নামিয়ে আনে পায়ের কাছে।
আজ যেন তার একটু বেশিই ঘুম পাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই সে হারিয়ে যায় ঘুমের কোনো এক অজানা রাজ্যে।
ভুচো বুঝতে পারলো না এই ঘুম তার চির তরে রয়ে যাবে।
রাত দুটো বেজে ১৯ মিনিট।
বনের মধ্যে এক দৃশ্য। এক অন্ধকার ছায়া করে চলেছে এক অপ্রাকৃতিক যজ্ঞ। তার সাড়া শরীর কালো পোশাকে ঢাকা। সাড়া মুখে একরাশ জট বাধা গোফ-দাড়ি।
ব্যক্তিটি পদ্মাসনে বসে পাঠ করে চলেছেন গ্রূঢ় কোনো প্রাচীন মন্ত্র। তবে সেই মন্ত্র বড়ই অশুভ।
তার সামনে সাজানো রয়েছে সারি সারি জিনিস পত্র।সেই জিনিসপত্রগুলোর মধ্যে যেটা চোখে পড়ার মতো তা হলো চারটি বড় ধরনের রাম দাঁ। সেই দাঁ দুটির প্রতিটির গায়ে খোদাই করা রয়েছে কিছু শব্দ। সেই শব্দগুলো বহু প্রাচীন যেনো সৃষ্টির আগেরও অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া কোনো ভাষা।
আগুনে ঘৃতাহূতির মতো সে দিয়ে চলেছে তাজা তাজা রক্ত। তবে রক্ত তিনি যেটা দিয়ে আহূতি দিচ্ছেন সেটা হলো কোনো ছোটো শিশুর ডানহাতের কনুই থেকে চেটো পর্যন্ত।
ব্যক্তিটির থেকে কিছু হাত দূরে দেখা যাচ্ছে তিনটি প্রাণীর অচৈতন্য দেহ। যার মধ্যে রয়েছে একটি বেজি,একটি গোসাপ আর অপরটি আমাদের খুবই পরিচিত কুকুর ভুচো। চাঁদ এবং আগুনের হালকা আলোয় প্রানীগুলোর পিছনে যেনো সৃষ্টি করেছে এক অন্ধকারের গোপন ক্ষেত্র।সেই ক্ষেত্রে নজর পরলে প্রথমে কিছুই দেখা যায় না , কিন্তু অন্ধকারে চোখ আসতেই সেখানে দেখা যাবে হাড়িকাঠ।বলির জন্য সাজানো তিনটি কড়িকাঠ । কিন্তু সেই হাড়িকাঠ গুলো বড়ই অদ্ভুত, সাধারনত বলির হাড়িকাঠ গুলোতে উপরের দিকে দুটো ছিদ্র থাকে যার মধ্যে দিয়ে একটি লোহার রড গলিয়ে দেওয়া হয় ,যাতে করে বলি দিতে যাওয়া পশুটি পালাতে না পারে । কিন্তু এটার সেইরকম কিছুই দেখা যাচ্ছে না । বরং, হাড়িকাঠের নিচের দুই দিকে দুটো V আকৃতির পাতলা পাত লাগানো ।
কড়িকাঠ তিনটির প্রত্যেকটিত খোদাই করা রয়েছে সাড়ি সাড়ি প্রাচীন বর্নমালা ।
হাড়িকাঠের নিচ থেকে তিনটি সরু পথ এসে মিশেছে যজ্ঞবেদির ঠিক আগে , যেখানে রয়েছে আরেকটি জিনিস ,যা আমাদের অতি পরিচিত সেই কালো পাথর ।
প্রানীগুলোর সকলের কপালেই দেখা যাচ্ছে রক্ত তিলক।
লোকটি এবার মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে কিছু একটা তরল ছুঁড়ে মারছে প্রাণীগুলোর গায়ে, আর সেই তরলএর কনা গুলো যেখানে যেখানে পড়ছে সেখান থেকেই যেন উঠে আসছে ঘন কালো ধোয়া।
একটু একটু করে কেটে গেলো আরও কিছুটা রাত । লোকটির যজ্ঞানুষ্ঠান এখন শেষ পর্যায়ে। এখন তার হাতে দেখা যাচ্ছে একটি রামদা। তিনি একটু একটু করে রাম দা খানা ঘষছেন আর মন্ত্রউচ্চারণ করছেন জোরে জোরে। সব শেষে রাম দা গুলো যেনো ঝলমল করে ওঠে তীব্র রক্ত লালসায় ।
প্রানীগুলো এখনও নিরব ও নিশ্চল । লোকটি একবার ঘুরে তাকালেন পশুগুলোর দিকে ,তার ঠোঁটে দেখা যাচ্ছে পৈশাচিক হাসি ।
একটা ছোট শিষের শব্দ যেনো ভেসে এলো তার গলা থেকে আর সঙ্গেই সঙ্গেই প্রানীগুলো জেগে উঠল এক এক করে । আরেকটা শিষের আওয়াজ শোনা যেতেই প্রানীগুলোর শরীর সোজা হয়ে উঠল । কিন্তু তাদের মধ্যে আর কোনো চাঞ্চল্য দেখা গেলো না । প্রানীগুলো এতটাই শান্ত যেনো রক্তে মাংসে গড়েতোলা কোনো প্রানহীন পুতুল । তারপর
লোকটি সদ্য শানিত দা গুলোকে বসিয়ে দিলেন হাড়িকাঠের সেই V এর মধ্যে। দা এর ধারালো মুখ উপরের দিকে ।
আরেকটা শিষ শোনা যেতেই প্রানীগুলো গিয়ে দাঁড়ালো হাড়িকাঠের খুব কাছে । তাদের গলা গুলো রাম দা এর সাথে আড়াআড়ি ভাবে রাখা।
লোকটির মাথায় যেনো নেশা উঠে গেছে , সেই নেশা রক্তের তাজা গন্ধের। এরপরই শোনা গেলো পরপর তিনটি শিষের শব্দ ।আর সঙ্গেই সঙ্গেই প্রানীগুলোর গলা গিয়ে ধাক্কা মারলো সেই রক্ত পিপাসু শানিত দায়ের উপরে ।
তিনটে প্রানীর মাথা ছিটকে পড়ল হাড়িকাঠের বিভিন্ন দিকে,আর তাদের শরীর গুলো তীব্র যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগলো কড়িকাঠের অপর পাশে । যেনো মৃত্যুর ঠিক আগে তারা তাদের জ্ঞান ফিরে পেয়েছিল ।
তাদের গলা বেয়ে গড়িয়ে পরা রক্ত একটু একটু করে জমা হচ্ছিল কালো পাথরের চারপাশে । রক্তের শীতল স্পর্শে পাথরটি একটি লাল রঙের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছিল চারপাশে ।
আশ্চর্যের বিষয় পাথরের পাশাপাশি যজ্ঞবেদী ও হাড়িকাঠের সেই প্রাচীন বর্নমালাগুলোও এক রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে ।
লোকটির চোখ থেকে গড়িয়ে পরতে লাগল গাঢ় কালো রক্ত। লোকটির মুখে তবুও ফুটে উঠেছে পৈশাচিক সেই হাসি ,তবে এইবার সেই হাসি নিরব নয় ,আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে হাসছে লোকটা ।
আগেই যজ্ঞের ছাইয়ের একটি মূর্তি তৈরি করে ফেলেছিল লোকটা । সেই মূর্তি বড়ই বীভৎস। যেনো প্রাচীনকালের কোনো দানব নারী ফুটে উঠেছে সেখানে । নারীটির পেট একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর ন্যায় বৃহৎ । তার দুই হাত ধরে রয়েছে সেই পেট ।
লোকটি কালো পাথরটি এনে বসিয়ে দিলেন সেই নারীর পেটের উপর । চোখের নিমিষেই পাথরটা প্রবেশ করে গেলো সেই অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেটে ।
লোকটি এবার হালকা হাতে নারীমূর্তিটাকে নামিয়ে রাখলেন নীচে ।তারপর একটা প্রনাম করলো সেই মূর্তিটাকে।
"মা এসেছিস মা? , অবশেষে তুই আবার ফিরেছিস । দেখ মা ,দেখ তোর ছেলে তোকে আবার ফিরিয়ে এনেছে ।তোর ইচ্ছা পূরন করেছে তোর ছেলে । এবার আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা মা ,তারপর তুই আবার জেগে উঠবি ,রাজ করবি তুই রাজ ।তোর ছেলেরা আবার ফিরবে এক এক করে । তোর পায়ের তলায় থাকবে এই গোটা দুনিয়া।আর ঐ দেবতাদের টানতে টানতে ছুঁড়ে ফেলব মন্দিরগুলো থেকে।সেখানে পূজিত হবি শুধু তুই মা শুধু তুই । শুধু তোর এই ছেলেটা হয়তো থাকবে না । তবে তুই চিন্তা করিস না মা ,এই সব হয়ে যাওয়ার পর তোর ছেলে ফিরে আসবে অন্য এক শরীরে। তুই মা শুধু দেখ ,তোর ছেলেরা কী করতে পারে তোর জন্যে।"
এই বলে গান হাতে সেই শেষ দা খানা তুলে নিল লোকটা । তারপর মূর্তির দিকে তাকিয়ে রাম দা খানা উঁচিয়ে ধরলো তার গলা বরাবর , তারপর হাতটাকে সোজা করে ধরল সে ।
"মা দেখ তোর ছেলেকে । মা..."
পরক্ষনেই লোকটার মাথা ছিটকে গিয়ে পড়ল যজ্ঞের নিভু নিভু আগুনের উপরে । লুটিয়ে পরতে থাকা শরীরটার গ্রীবার কাটা অংশ থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত ছিটকে পড়ল মূর্তিটার শরীরে ।
চারপাশটায় যেনো হঠাৎ করেই নেমে এলো নরকের গভীর নিরবতা। তবে সেটা শুধু কিছু ক্ষনের জন্যই পরমুহূর্তেই চারপাশের পরিবেশ কেঁপে উঠল নারীকন্ঠের তীব্র চিৎকারে। যেনো কোনো সন্তান হারা মা আর্তনাদ করে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে।
লোকটির বানানো সেই কুৎসিত নারীমূর্তিটা নিমিষেই শূন্যে ভেসে উঠল ,তার সারা শরীর দিয়ে ছিটকে পরতে লাগল নরকের সেই রক্তিম আভা । মূর্তিটির চোখের জায়গা থেকে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা । রক্তের প্রতিটা ফোঁটার মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই সেই জায়গাগুলো যেনো প্রচন্ড তাপে গলে যেতে লাগলো । আর সেই জায়গা গুলো থেকে একে একে উঠে আসতে লাগল শতশত নরক পিশাচ ।
এক অমানবিক পৈশাচিক গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগল বনের চারপাশটায়।
কীসের একটা শব্দ শুনে ,কানু জ্যাঠা জেগে উঠেছিলেন তার ঘুম থেকে ।
তার ঘরের চারদিকটা একটা অশুভ গন্ধে মো মো করছে ।
তিনি তার নাকখানি উপরে তুলে কিছু একটা শুঁকে নিয়ে পরমুহূর্তেই বলে উঠলেন
"নাহ! গন্ধটা খুব সন্দেহজনক!"
পর্ব :৬
মাঝ রাতে তনুর ডাকে ঘুম ভেঙে গেছিলো দুজনের।প্রথমে মেঘ তো তনুকে এইভাবে চিৎকার করতে দেখে অবাকই হয়ে গেছিলো । আজ সারাদিন সারা রাত ধরে যে তনুর জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না । এখন সেই তনুকেই এইভাবে চিৎকার করতে দেখে কেই না অবাক হবে !
তনু জানালার দিকে আঙুল দিয়ে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছে তাদের । তনুর সারা মুখ যেনো রক্তশুন্য। চোখ বিস্ফারিত ভাবে বেরিয়ে আসছে কোটর ছেড়ে ।
তারা দুজনেই ঘুরে তাকাল জানালার দিকে ,না ! কিছুই নেই সেইদিকে। জানালার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কুয়াশার একটা হালকা ধারা প্রবেশ করছে ঘরের ভিতর আর দূরের অস্বচ্ছ আকাশে দেখা যাচ্ছে শুক্লপক্ষের অপূর্ণ চাঁদ।
তনুর এইরূপ ভয় পাওয়ার কারণ কিছুই বুঝতে পারে না ওরা । সায়ান উঠে গিয়ে বসে তনুর খাটের পাশটায়। ভয়ে তনুর ফর্সা মুখটা ভরে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘামে । সায়ানের বড্ড মায়া লাগতে লাগল তনুর উপর । ডান হাতটা দিয়ে আলতো করে সে তনুর ঘাম গুলো মুছিয়ে দিলো । গাল গুলো যেন ঠান্ডায় জমে উঠেছে ।
মেঘ এগিয়ে গেলো জানালাটা বন্ধ করতে। একটু আগে জানালাটা এইভাবে খোলা থাকতে দেখে সে খানিকটা অবাকই হয়েছিল,কারণ তার স্পষ্ট মনে আছে ,কয়েক ঘণ্টা আগে, সে নিজের হাতেই বন্ধ করে দিয়েছিল জানালাখানা ।
জানালার কাছে আসতেই একটা উদ্ভট পচা গন্ধ মেঘের নাকে এসে লাগল,যেন কয়েক যুগ আগেকার কোনো মৃতদেহ কেউ একটু আগে ফেলে দিয়ে গেছে তাদের জানালার তলায় ।
বাকি রাতটা জেগেই কাটালো তারা । খাটে বসে ভয়ার্ত ভাবে কাপছিল তনুর শরীরটা। মাঝে মাঝে সে তার ভয়ার্ত চোখ খানা তুলে দেখে নিচ্ছিল ঘরের চারপাশ। আর মুখ থেকে বলে চলেছিল কোনো এক অজানা ভাষা। এই ভাষার কিছুই তারা বুঝে উঠতে পারে না ।
রাতের তুলনায় তনুর আচরণ এখন যেন আরো এলোমেলো, উদ্ভ্রান্ত।
সায়ান বা মেঘ কাউকেই সে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না । কাছে গেলেই সে গালি দিয়ে থুতু ছুঁড়ে মারছে তাদের লক্ষ্য করে ।
কোথায় সেই স্কুলের ফার্ষ্ট গার্ল আর কোথায় সেই শহুরে শিক্ষিত স্মার্ট তনুপ্রিয়া সরকার ! এ যেন অন্য কোনো এক মেয়ে , এই তনুকে তারা কেউই চিনতে পারে না ।
অবশেষে লজের মালিক কে ফোন লাগায় সায়ান ।
"হ্যালো ...!" ঐপাশ থেকে ভারী পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে।
"হ্যাঁ... হ্যালো শিকদার মশাই বলছেন?"
"হুমম, বলছি বলুন ...।" বোঝাই যাচ্ছে এই ভোর বেলায় ফোন পেয়ে তিনি বিরক্ত ।
"শিকদার মশাই ,একটু সমস্যায় পরেই আপনাকে এইভাবে ফোন করতে হলো । আসলে আপনার মনে আছে আপনি রাতে আমাদের ,আপনার নাম্বার দিয়ে বলেছিলেন যাতে কোনো সমস্যা হলেই আপনাকে ফোন করি ?"
ওই পাশে খানিকখন কোনো কথা শোনা গেলো না । তারপর হঠাৎ করেই শোনা গেলো
"ওহ হ্যা হ্যাঁ,বলো ।আসলে বুঝতেই পারছ অনেক রাত করে ঘুমিয়েছি , এখনও ঘুমটা পুরো হয়নি ।তাই প্রথমটায় চিনতে পারিনি , don't mind ...."
শিকদার মশাইয়ের কথা শেষ করার আগেই ,সায়ান বলে উঠলো
"জি বুঝতেই পারছি ,আসলে খানিকটা সমস্যায় পরেই এইভাবে আপনাকে কল করা "
"আরে হ্যা হ্যা নির্দ্বিধায় বলে ফেলো। কোনো কী সমস্যা হয়েছে? তোমাদের সাথের মেয়েটা ভালো আছে তো এখন?"
"আসলে ওই ব্যাপারেই আপনাকে কল করা। আজ সকাল থেকেই ওর শরীরটা আবারো খারাপের দিকে যাচ্ছে।আমরা ভাবছিলাম ওকে এইভাবে লজে না রেখে একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যদি treatment করানো যেত তাহলে ভালো হতো।"
সায়ান একটু থামলো, তারপর একটু নিজেকে সহজ করে নিয়ে বললো
"স্যার, বলছি by any chance আপনি কী একটা গাড়ি ম্যানেজ করে দিতে পারেন?"
"আরে হ্যাঁ হ্যা, তুমি এক কাজ করো না, লজের গাড়িটাই নিয়ে যাও, আর আমি শম্ভু কে না হয় বলে দিচ্ছি, ও তোমাদের সাথে যাবে।"
"অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার।"
"এই মা নানা ধন্যবাদ টন্যবাদ দিতে হবে না। এক কাজ করো ঘন্টা খানেক পরেই শম্ভু কে নিয়ে বেরিয়ে যাও কেমন?"
"আচ্ছা স্যার, রাখছি তাহলে "
"আচ্ছা রাখো।"
গাছেদের সারির ফাঁক দিয়ে ওদের গাড়িটা ছুটে চলেছে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। গাড়ির চাকার প্রচন্ড ঘর্ষণে ওদের ফেলে আসা রাস্তার উপর দেখা যাচ্ছে এক রাশ ধুলোর মেঘ। গাড়িতে লোক বলতে ওরা চারজন। গাড়ির সামনের ড্রাইভার এর সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে শম্ভু। আর পিছনের দিকে বসে রয়েছে বাকি তিনজন। পিছনের একদম ডানদিকে মেঘ আর বামদিকে বসে থাকা সায়ান জাপটে ধরে রয়েছে উগ্র তনুকে।গাড়িতে তনুকে যে ওরা সহজে তুলতে পারেনি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তনুকে গাড়িতে বসানোর সময় তো সে রীতিমতো সায়ানের চোখটা খামচে দিয়েছিলো। মাত্র কয়েক cm এর পার্থক্যে তার চোখটা রেহাই পেয়েছিলো অন্ধ হয়ে যাওয়া থেকে।
তনুকে গাড়িতে আগলে ধরে রাখতে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে দুজনকে। তনু রীতিমতো তাদের দুইজনকে আঁচড়ে কামড়ে এক করে ফেলেছে। আর ক্ষনে ক্ষনে তাদের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিচ্ছে কিছু অশ্রাব্য কথা।
হাসপাতাল পৌছাতে এখনও ঘন্টা দেড়েক বাকি।
ওদের চারপাশের গাছপালার সারি যেন আরো ঘন হয়ে উঠেছে। নির্জন রাস্তায় চারপাশটা বেশ অন্ধকার, আসলে গাছেদের চাঁদয়া ভেদ করে সূর্যের আলো ভুপৃষ্ঠে নেমে আসতে পারে না।
শম্ভু গাড়িটা গিয়ে দাড় করালো রাস্তাড় একটা সাইড এ।
"কী হলো? গাড়ি থামালে কেন? " মেঘ প্রশ্ন করে।
শম্ভু খানিকটা লজ্জা পেয়েই উত্তর দিলো
"আসলে দাদাবাবু, একটু এক নম্বর এসেছে। আপনারা একটু গাড়িতে বসুন আমি ওই গাছের পিছনে হালকা হয়ে চলে আসছি। বেশি সময় লাগবে না, এই যাবো আর আসবো..."
"আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে যাও, বেশি দেরী করো না যেন..."
"না না... এই তো এখনই এসে পরবো।"
এই বলে শম্ভু গাড়িটা রেখে চলে গেলো বনের একটা গাছের পিছনে। গাড়িতে ওরা একা। তনু ওদের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করছে বাইরে ছুটে যাওয়ার জন্য।
মেঘ অনেক ক্ষন ধরে উসখুস করছিলো কিছু একটা বলার জন্য, সায়ান তনুকে ধরে রাখতে রাখতে তাই আবার বলেই ফেললো
"কী রে, কী হয়েছে তোর বল তো? "
"কই কিছু না তো "
"না কিছু তো একটা হয়েছে,বল।"
মেঘকে ইতস্তত করতে দেখে সায়ান ই বলে উঠলো
"বাথরুম পেয়েছে, তাইতো?"
মেঘ মাথায় নারে।
"আচ্ছা, যা তুইও করে আয় ওই রাস্তার দিকটা থেকে।"
মেঘ না গিয়ে চুপ করে বসে থাকে।
"কী হলো যা। গাড়ি কিন্তু আর থামবে না, আর থামবে সেই ঘন্টা দেড়েক পরে হাসপাতালে। ওতো সময় চেপে রাখতে পারবি তো? "
"কিন্তু তুই... একা এইভাবে, তনুকে আটকে রাখতে পারবি তো এইভাবে? দেখেছিস কী রকম করছে মেয়েটা?" মেঘ তনূর দিকে তাকিয়ে বললো কথাটা, ওর চোখে খানিকটা কষ্ট উঁকি মারলো।
"আরে, ধুরর কোনো ব্যাপার না। আসলে মেয়েটা কোনো কিছু দেখে প্রচন্ড ভাবে শক পেয়েছে, তাই এরকম করছে, হাসপাতালে নিয়ে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে, তুই চিন্তা করিস না তো। আর যা হালকা হয়ে আয় যা।"
মেঘএর ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও যেতে হলো এবার, মূলত প্রকৃতির ডাকের জন্যই।
গাড়িতে এখন সায়ান আর তনু দুজন একা।
মেঘ গাড়ি থেকে নেমে চলে যায় গাড়ির বাম দিকটায়, সেখানে একটা গাছ বেছে নিয়ে চলে যায় তার পিছনে।
গাছে জল দিতে দিতে সে হঠাৎ করেই শুনতে পায়, গাড়ির দিক থেকে সায়ান চিৎকার করে তাঁদের ডাকছে। মেঘের আসঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে।
সে তাড়াতাড়ি হালকা হয়ে ছুটে যায় গাড়ির কাছে।
কিন্তু সায়ান বা তনু কাউকেই সে দেখতে পায়ে না গাড়িতে।
শম্ভুও ততক্ষনে পৌঁছে গেছে গাড়ির কাছে। দুজন দুজনের দিকে হতবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
তখনই রাস্তার ডান দিকের জঙ্গল থেকে ভেসে আসে সায়ানের গলা।
"ভাইইই এইদিকে, জলদি। আমি তনুকে ফলো করছি, তোরা ও আওয়াজ লক্ষ করে ছুটে আয় এইদিকটাতে।"
শম্ভু আর মেঘ বুঝতে পেরেছে কী হয়েছে। তারা আর দেরী না করে ছুট লাগায় জঙ্গলের দিকে। গাছপালার মধ্যে দিয়ে তাঁদের ছুটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবুও লতা পাতার মধ্যে দিয়ে তারা ছুটে চলে আওয়াজ লক্ষ্য করে।
পাঁচ-দশ মিনিট এইভাবে দৌড়ে তারা জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে পৌঁছে গেলো। সেখানেই তারা দেখতে পেলো সায়ানকে, মাথা নিচু করে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। ওরা গিয়ে দাঁড়ালো সায়ানের পাশে।
" ভাই... তোরা যেতেই... আমি ধরে রেখেছিলাম তনুকে, জানিনা কখন...হাতটা একটু.. ঢিল হয়েছে...অমনি দরজা খুলে... এই জঙ্গলের দিকে দৌড়ে... এসেছে। "
সায়ানের শ্বাস একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
"কিন্তু... তনু এখন কোথায়? " মেঘের স্বরে দুশ্চিন্তা।
"ওই.. ওই দিকটায় গেছে... তোরা যা... আমি আসছি।"
মেঘ আর শম্ভু সেইদিকটার দিকে হাঁটতে থাকে।
মেঘ এর মাথায় হঠাৎ করেই কথাটা আসলো, তনুর পিছনে তারা দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে চলে এসেছে কিন্তু রাস্তায় তো লজের মালিকের গাড়িটা তারা ফেলে রেখেছে , সেটার কী হবে!
মেঘ শম্ভুকে সেটা বলতেই,তার কপালেও দুশ্চিন্তা ফুটে ওঠে। তখন মেঘই তাকে বুদ্ধিটা দেয়-
শম্ভু এখান থেকে সোজা ফিরে যাবে গাড়ির কাছে,সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করবে তাঁদের জন্য। আর মেঘ ও সায়ান তনুকে খুঁজতে চলে যাবে জঙ্গলের মধ্যে । তনুকে খুঁজে পেলেই তারা গাড়ির কাছে ফিরবে, তারপর সেখান থেকে সোজা হাসপাতালে।
সেই মতোই সমস্তটা ঠিক হয়।
সায়ানও কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে তাঁদের খুব কাছে চলে এসেছে। মেঘ আর দাঁড়ায় না। সে সায়ানকে সাথে নিয়ে চলে যায় জঙ্গলের ভিতরে।
তবে এরপর তাঁদের সাথে যে কী ঘটতে চলেছে সেটা তারা তাঁদের কোনো দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি।
পর্ব :৭
মেঘ এবং সায়ান বনের গভীরে প্রবেশ করে। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ভবিষ্যতের দীর্ঘশ্বাসকে ঘন করে তুলেছিল একটু একটু করে।গাছেদের দীর্ঘ
ছায়াগুলি সূর্যের অল্প আলোতে সৃষ্টি করেছিল এক
রহস্যময় অনিশ্চিয়তা।
গাছেদের দীর্ঘ বাঁকানো শিকড়গুলি বনের মেঝেতে শুয়ে থাকা অসংখ্য সাপেদের ভ্রম সৃষ্টি করেছে খুবই নিপুনভাবে।বিরাট বিরাট গাছেদের শাখাগুলো যেন আকাশকে বন্দি করে রেখেছে তাঁদের ঘন পাতার আবডালে।
জঙ্গলের মধ্যের অপার্থিব নীরবতাকে ভেঙে চলেছে তাঁদের জোড়া পায়ের আওয়াজ।দূর থেকে ভেসে আসা কোনো নাম না জানা পাখির শব্দ, তাঁদের চারপাশের পরিবেশে এক অস্বস্তির অনুভূতি যোগ করে।
ঘন পাতার মধ্য দিয়ে আলোর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র এসে পরেছে তাঁদের সামনের বিস্তীর্ণ জঙ্গলের স্থানে স্থানে।প্রাণবন্ত সবুজ শ্যাওলার এক পাতলা আস্তরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে গাছেদের গুঁড়ির উপরে, যার উপর ফুটে উঠেছে ছোটো ছোটো বুনো ফুল ।
এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অমানবীয় নেশা লেগে যাচ্ছে তাঁদের মানবীয় হৃদয়ে।
তারা জানতে পারে না, এই সুন্দর্যের মরুভূমির কোনো এক সুদীর্ঘ কোনে তাদেরই জন্য অপেক্ষা করছে কোনো এক অন্ধকার। তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ তার জানা। তবুও সে লুকিয়ে থাকে অন্ধকারকে ঘিরে। কারণ সে বড্ড খেলতে ভালোবাসে।
সায়ান আর মেঘ তনুকে খুঁজতে থাকে এই বনভূমির গোলক ধাঁধাতে। দুপুর হতে না হতেই এখানে যেন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। তারা বুঝতে পারে তনুকে খুঁজে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হবে এই ভয়ঙ্করের জঙ্গল থেকে। এই জঙ্গল ভালো নয়।
"তনুউউউ..." সায়ান ডেকে ওঠে।তার এই ডাক কিছুসময় ঘুরে বেড়ায় তাঁদের মাথার উপরে।
পাখিদের এক ঝাঁক বসেছিল তাঁদের পাশেরই কোনো এক গাছে, সায়ানের শব্দে তারা বিরক্ত হয়ে উড়ে যায় দূরের কোনো গাছের উদ্দেশ্যে।
"তনুউউ, কোথায় তুই....?"
"তনুউউউ...."
তাঁদের গলার শব্দই ফিরে ফিরে আসে তাঁদের কাছে।
সায়ানরা কী করবে বুঝতে পারে না, তবে এইভাবে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যে তারা তনুকে খুঁজে পাবে না, এই কথাটা তারা বেশ বুঝতে পারছে।
দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকায়। মেঘই কথা বলে প্রথম
"ভাই কী করি বলতো? এইভাবে খুঁজতে থাকলে, আমরা lifetime ধরে খুঁজলেও তনুকে পাবো না। তাছাড়া ওর যা এখন মাথার অবস্থা তাতে আমার আরো চিন্তা হচ্ছে "
"আচ্ছা, একটা কাজ করি চল।"
"কী কাজ, খুলে বলতো "
"তুই তো গাছে উঠতে পারিস? কেমন হয় যদি কোনো এক উঁচু গাছে উঠে, আমরা উপর থেকে খোঁজার চেষ্টা করি তনুকে। "
" সে তো বুঝলাম, কিন্তু গাছ গুলোর গোড়ার দিকটা দেখছিস কী রকম শ্যাওলা ভর্তি, ওখান থেকে উঠতে গেলেই তো পিছলে নামবো রে। "
দুজনে আবার একটু চিন্তায় পরে, তারপর আবার মেঘ বলে ওঠে
"এক কাজ করনা, তুই আমাকে গাছটার ওই ডালটা পর্যন্ত তুলে দে, ঐখান থেকে আরামসে উপরে ওঠা যাবে, কোনো চাপ থাকবে না।"
সায়ান মেঘের দেখানো গাছটার দিকে তাকায়, গাছটা বাকি গাছগুলোর মতো বড় হলেও ওর একটা ডাল নেমে এসেছে অনেকটা নিচের দিকে।
সায়ান আর মেঘ এগিয়ে যায় গাছটার কাছে, তারপর সায়ান একটু ঝুকে কাঁধে তুলে নেই মেঘকে।
মেঘ হাতের কাছে গাছের ডালটা পেয়ে ঝুলে পরে সেটা ধরে। তারপর পা দুটো দিয়ে ডালখানা জাপ্টে ধরে এক ঝটকায় নিজেকে তুলে নেয় ডালটার উপরে।
ওখান থেকে সে গাছটার উপরে উঠতে থাকে একটু একটু করে। মুহূর্তেই সে গাছটার সব চেয়ে উপরের ডালটায় দাঁড়িয়ে, জঙ্গলের চারপাশটায় একবার নজর ঘুরিয়ে নেয়।
একটা লাল মতো কিছুকে সে দৌড়ে যেতে দেখে খানিকটা দূরে।
"এই সায়া... ন, দৌড়ে তোর ডানদিকে যা তো, ওখানে কাউকে একটা দেখতে পেলাম মনে হলো "
উপর থেকে মেঘের গলা ভেসে আসে।
"আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি, তুই নামতে পারবি তো উপরে থেকে একা?..."
"আরে হ্যাঁ... তোর চিন্তা করতে হবে না, তুই দৌড়ে যা ঐদিকে। নাহলে তনু হয়তো জঙ্গলের আরো ভিতরে চলে যাবে। জলদি যা... কুইক!"
মেঘের কথা শেষ না হতেই, সে নিচ থেকে সায়ানের দৌড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলো।
সায়ান দৌড়ে যেখানটায় এসে দাঁড়ায়, সেখানটা আরো বেশী অন্ধকার। নিজের থেকে কিছু ফুট দূরের জিনিসও ভালো করে দেখা যায় না এখানে, এইরকম জায়গায় তনুকে খোজার চেয়ে খড়ের গাঁদায় সূচ খোজা অনেক বেশী সহজ বলে মনে হলো সায়ানের। সে পকেট থেকে ফোনটা বার করে ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বেলে ধরে সামনের দিকে। ফ্লাশের গোল আলোক বৃত্ত এসে নেমেছে তার পায়ের কাছে।
খসখস করে একটা আওয়াজ শুনতে পেলো সায়ান, যেন কেউ জঙ্গলের পাতার উপর দৌড়ে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। জঙ্গলের এই আধোঅন্ধকারে বলতে নেই, সায়ানের একটু ভয় ভয়ই করতে লাগলো।
হঠাৎ কিছু একটা এসে,ধাক্কা মারলো সায়ানের হাতটায় ,প্রচন্ড ধাক্কার জোরে ফোনটা গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়লো তার থেকে হাত খানেক দূরে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা নিবে গেছে ততক্ষনে। চারপাশের প্রায় অন্ধকার পরিবেশে সে নিচু হয়ে খুঁজতে লাগলো তার ফোন খানা।
আশ্চর্য চারপাশ হাতরে হাতরে খুঁজেও সে তার ফোনটাকে খুঁজে পেলো না, অথচ তার স্পষ্ট মনে আছে তার হাতে থেকে ফোনটা ঠিক এখানেই এসে পড়েছিল। এরকম করেই কেটে যায় খানিকটা সময় , পাতার উপর থেকে কারো হেটে চলার হালকা শব্দ ভেসে সায়ানের কানে, যেন কেউ একজন দাঁড়িয়েছে তার ঠিক পিছনে।
সায়ান এর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে ওঠে, সে ধীরে ধীরে মাথাটা ঘোরায় পিছনের দিকে।
তার মুখের খুবই কাছে দেখা যাচ্ছে আরেকটা মুখ, পাতাবিহীন চোখ দুটি দিয়ে সে তাকিয়ে রয়েছে সায়ানের দিকে। তার সারা মুখে এক অপার্থিব নীলচে ভাব। তবে যেটা দেখে সায়ানের সবথেকে বেশি ভয় লাগলো তা হল তার গলার নিচ থেকে বেরিয়ে আসা শত শত শিরা-উপশিরা, সেই গুলো যেন মহাকাশে সাপের মতো কিলবিল করে উড়ে বেড়াচ্ছে আর ভাসিয়ে রাখছে সেই ভয়ানক নরমন্ডু টাকে।
সায়ান আর সহ্য করতে পারলো না সেই দৃশ্য, সে চোখ বুজে ফেললো। ভয়ে তার সাড়া শরীর কাঁপছে।
কিছু মুহূর্ত পরেও যখন কিছু হলো না, তখন সে ধীরে ধীরে তার চোখ খুললো।
না কেউ নেই তার সামনে।
সায়ান ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ায়, তারপর চোখ বুলিয়ে নেয় জঙ্গলের আশপাশটায়।
কাউকে না দেখতে পেয়ে সে তার ফেরার পথের দিকে যেতে থাকে।
কিন্তু মুশকিল টা হলো ঠিক সেখানটায়, সে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে।
এই আধো অন্ধকার পথে রাস্তা খুঁজে বের করা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলেও তো রাস্তা নিজে থেকে আসবে না তার কাছে। তাই সায়ন আন্দাজে একটা দিক ধরে হাঁটতে থাকে সামনের দিকে।
এরকমভাবে সে হেঁটে চলে ঘন্টাখানেক ধরে, কিন্ত এই জঙ্গলের গোলক ধাঁধা তাকে ঘিরে ধরেছে একটু একটু করে।
সায়ান তবুও হাঁটা থামায় না, সে জানে একবার থেমে গেলে এই রাক্ষসে জঙ্গল তাকে আর ফিরতে দেবে না।
হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ তার কানে এসে লাগে, সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার খুব কাছ থেকেই সে শুনতে পায় শব্দটা। সায়ানের ভয় করলেও সে এগিয়ে যায় শব্দটাকে লক্ষ্য করে। কয়েক পা যেতেই সে বুঝতে পারে শব্দটা আসছে সামনের একটি ঝোপ থেকে। সে কোনমতে নিজের শরীরটাকে ঝোপের মধ্যে থেকে গলিয়ে পৌঁছে যায় ওপাশটায়।
ঝোপের অপর পাশে পৌঁছে সে যা দেখে, তাতে তার বিস্ময়ে তাক লেগে যায়। সামনে কিছু গাছ এমনভাবে মিশেছে যে সেটাকে কোন সুরঙ্গের পথ ভেবে ভুল হয়। আর সেই সুরঙ্গের মুখে হাঁটুর উপর মাথা বুঝে ফুপিয়ে কান্না করছে তনু। কান্নার বেগে তার পিট কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সায়ান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে যায় তনুর দিকে। তারপর তনুর পিঠে একটা হাত রেখে সে বলে
"বাহ্,এইভাবে আমাদের হন্যে করে ঘুরিয়ে,পথ হারিয়ে এখানে এসে কান্না করা হচ্ছে ম্যাডামএর।"
সায়ানের এই কথায় কান্না থেমে যায় তনুর,তবে সে তখনও মাথা গুজে বসে থাকে।
সায়ান আবার বলে ওঠে
" কী রে,ওঠ। চল,এবার।অনেক হয়েছে আর এমন ভাবে কাঁদতে হবে না । "
তনু তবুও ওঠে না, সে তখনও তার মাথাটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করে
"তুমি কী আমাকে নিয়ে যাবে তোমার সাথে?"
'তুমি'! তুমি করে তো তনু কখনো বলেনি তাঁদের। সায়ান একটু অবাক হলো সায়ান।
"আরে হ্যাঁ, চল তাড়াতাড়ি এখান থেকে, ঐদিকে মেঘ একা খুঁজছে হয়তো আমাদের।"
এই বলে সায়ান তনুর হাতটা ধরে টান দিতেই সে যা দেখলো তাতে কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব নয়।
সায়ানের ডান হাতে উঠে এসেছে তনুর হাত, কেউ যেন তনুর হাত কনুই এর একটু নিচ থেকে কেটে ধরিয়ে দিয়েছে সায়ানের হাতে।
তনুর সেই হাতের কাঁটা অংশ থেকে বেরিয়ে রয়েছে অসংখ্য শিরা উপশিরা আর তাঁদের প্রত্যেকটি সাপের মতো কিলবিল করে বেড়াচ্ছে বাতাসে।
তনু এবার মাথা তুলে তাকালো সায়ানের হতভম্ব মুখের দিকে। সেই মুখ সায়ান চেনে, কিন্তু এই মুখ তনুর নয়। এই মুখ হলো কিছু সময় আগে বনে দেখা সেই ভয়ঙ্করের মুখ।
সেই মুখটা হাসছে, তবে তার হাসি খুবই নীরব, নরকের অন্ধকারের মতো তার হাসি ছড়িয়ে পরেছে এক কান থেকে অপর কানের দিকে। একবার সেই নরকের ভয়ঙ্কর তার আকর্ণবিস্তৃত ঠোঁট গুলোকে চেটে নিলো তার দীর্ঘায়িত জিভ দিয়ে, কিন্তু সেই জিভ সাধারণ নয়, তার ঠিক মাঝখানটা চিরে সরে গেছে দুইদিকে ।
সায়ান আর দেখতে পেলো না সেই দৃশ্য, সে একটা চিৎকার করে তার হাতে ধরে রাখার হাতখানা ছুঁড়ে মারলো মাটিতে। সেই হাতের আঙ্গুল গুলো তখন যেন এক একটা সাপের ফনার মতো সোজা হয়ে ছুটে আসতে লাগলো সায়ানের দিকে। সায়ান দাঁড়ালো সেখানে, সে দিক বেদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছুটতে লাগলো জঙ্গলের মধ্যে, সে পিছনে ফিরলো মা একবারও, কারণ সে জানে তার ঠিক পিছনে ছুটে আসছে একটা হাত, আর সেই হাতের পিছনে পিছনে ছুটে হাসছে হাতের সেই মালিক।
হঠাৎ একটা শিকড়ে পা বেঁধে গেলো সায়ানের, সেখানের জায়গাটা একটু ঢালু থাকায় তার শরীরটা গড়িয়ে পরতে লাগলো ঢালের নিচের দিকে। গড়িয়ে পরার সময় তার মাথাটা কিছু একটায় ঠুকে যাওয়ায় সায়ান জ্ঞান হারায়। তার সংজ্ঞাহীন দেহ খানা গড়িয়ে চলতে থাকে কোনো এক অজানার দিকে।
পর্ব :৮
"সায়ান... এই... সায়ান এই এই... কী রে ওঠ "
মুখের উপরে কিছু জলের ছিটা পরতেই, সায়ান চোখ মেলে তাকায়। চেনা অচেনা বেশ কিছু মুখের ভিড় জমেছে ওকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে যে দুটো মুখ ওর চেনা, সেই মুখ গুলো হলো মেঘ আর শম্ভুর। বাকিদের কাউকেই সে চেনেনা।
সায়ান বুঝতে পারে না ও এইখানে কিভাবে আসলো। জ্ঞান হারানোর আগের স্মৃতিগুলো সব ঝাপসা তার কাছে। তবে সেই ঝাপসা স্মৃতির অনেকটা জুড়েই তনুকে খুঁজে পায় সে।
সায়ান উঠে বসেই জিজ্ঞাসা করে
"এই তনু কোথায় মেঘ? "
মেঘ সায়ান কে শান্ত করতে করতে পাশের একটা ঘরের দিকে দেখিয়ে বলে " তনু এখন ঘুমাচ্ছে ওই ঘরটাতে। তার আগে বল, তুই ঠিক আছিস তো ?"
"না আমি ঠিক আছি, শুধু একটু গায়ে হাতপায় ব্যাথা,আমাকে নিয়ে এতো ভাবিস না, তার আগে বলতো কোথায় আছি আমরা? এটা তো আমাদের লজের মতো লাগছে না।"
"ঠিক, আমরা এখন জঙ্গলের পাশের একটা গ্রামে আছি, আয় তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দি "
এই বলে মেঘ ঘরের মধ্যে একজন অপেক্ষাকৃত বয়স্ক লোককে দেখিয়ে বলল...
"সায়ান, ইনি হচ্ছেন এই গ্রামের প্রধান, আর আমরা এখন যেই বাড়িতে আছি সেই বাড়ির মালিক শ্রী কানুগোপাল ভূঁইয়া গ্রামে সকলে এনাকে জ্যাঠামশাই বলেই ডাকে ।"
লোকটি হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন, সায়ানও প্রত্যুত্তরে একটা নমস্কার করে নিজের পরিচয় জানালো,
"নমস্কার, আমার নাম সায়ান সেন, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই ভাবে আমাদের হেল্প করার জন্য।"
"না.. না... আপনারা আমাদের অতিথি, আর অতিথি সেবা আমাদের ধর্ম। তাছাড়া আপনারা সেই দূর শহর থেকে এইছেন, এই বিদেশবিভূয়ে বিপদে পড়েছেন আর আমরা আপনাদের সাহায্য করবো না এটা কোনো কথা হলো!"
সায়ান লোকটার আন্তরিকতায় এতটাই মুগ্ধ যে সে কোনো উত্তর দিতে পারলো না।
মেঘ সায়ানকে চুপ থাকতে দেখে এবার বলে উঠলো, " আচ্ছা তুই জঙ্গলের অত গভীরে গিয়েছিলি কেন? আর খাদের মধ্যেই বা গিয়ে পড়লি কি করে? ".
"সেটা বলছি, তার আগে তুই আমাকে বলতো তুই তনুকে কোথায় খুঁজে পেলি? আর আমরাই বা এখানে এলাম কী করে? "
এই প্রশ্নের উত্তরে মেঘ এক এক করে সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে লাগলো,
"আর বলিস না, গাছের উপর থেকে তো কিছু একটা নড়তে দেখে ভাবলাম তনু বোধহয় ঐদিকে লুকিয়ে রয়েছে, আর তোকেও বলা মাত্র তুই দৌড়ে গেলি, এবার হয়েছে কী আমি যখন গাছটা থেকে নামছিলাম তখন শ্যাওলাতে পিছল খেয়ে পরে গেলাম মাটিতে, আর আমার পকেটে থাকা ফোনটাও পকেট থেকে বেরিয়ে এসে গিয়ে পড়লো গাছটার কিছুটা দূরে একটা ঝোপের মধ্যে, আমি ফোনটাকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে ঢুকি ঐ ঝোপের ভিতর আর ঢুকেই দেখি আমার ফোনটা মুখ থুবড়ে পরে রয়েছে ঝোপের মধ্যে আর ঠিক পাশেই তনু সংজ্ঞাহীন ভাবে পরে রয়েছে , প্রথমটায় তো ভয় পেয়ে গেছিলাম। যদি সাপে টাপে কামড় দিয়ে থাকে, তখন আঙ্গুলটা নাকের কাছে নিয়ে যেতেই দেখি না, শ্বাস পরছে। তার পরপরই আমি তোকে কতবার করে ডাকলাম, কিন্তু তোর তো কোনো সাড়াই পাওয়া যাচ্ছিলো না, আর এইদিকে তনু এইভাবে অজ্ঞান হয়ে রয়েছে, তখনই ঠিক করলাম আর রিস্ক নিয়ে লাভ নেই। এইভেবে, তনুকে কোনো মতে কাঁধে ফেলে জঙ্গলের বাইরে নিয়ে যেতে থাকি, কিন্তু একেই পরে গিয়ে পায়ে খানিকটা ব্যথা পেয়েছিলাম তারউপর গাছ পালার জ্বালায় জঙ্গল পার করতে যেন সারাজীবন লেগে গেলো, জঙ্গল যখন একটু পাতলা হয়ে এসেছে এমন সময় ফোনটা চেক করতেই দেখি নেটওয়ার্কএর একটা টাওয়ার মিটমিট করছে, তাই আর দেরী না করে সোজা শম্ভুকে ফোন করে দি, শম্ভু গাড়িটা লক করে এসে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আমাদের। তারপর সেখান থেকে শম্ভু আর আমি দুজন মিলে তনু কে নিয়ে এসে গাড়িতে বসাই অনেক কষ্টে। তনুর গা তখন প্রচন্ড গরম। তাই আর অপেক্ষা না করে সোজা চলে আসি এই গ্রামের সরকারি হাসপাতালে, এখানে তনুকে ভর্তি করিয়ে প্রথমে যাই গ্রাম প্রধানের কাছে তিনি সবটা শুনে তৎক্ষণাৎ কিছু লোক জোগাড় করে পাঠিয়ে দেন আমাদের সাথে, তারপর ঘন্টা খানেক খোঁজাখুঁজির পরে তোকে খুঁজে পাই একটা খাদের খুব কাছে, আর মাত্র ইঞ্চি খানেক দূরেই খাদটা যেন হা করে মুখ খুলেছিলো তোকে গেলার জন্য। "
মেঘ একটু থেমে শ্বাস নেয়, তারপর আবার বলে ওঠে
"তোকে খুঁজে পেয়ে যখন গ্রামে নিয়ে আসলাম, তখন কানু জ্যাঠাই তোকে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে বললেন, এখানে নিয়ে আসার সঙ্গেই সঙ্গেই তিনি লোক পাঠিয়ে ডাক্তার ডেকে আনলেন, আর তার পরপরই তো তুই উঠলি, এর পরের সবটা তো তুই জানিস"
এই বলে মেঘ থামলো। সায়ানএর মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো জ্যাঠা মশাই এর জন্য।
"আচ্ছা, তুই একটা কথা বলতো, তুই অত ভিতরে গেলি কী করে ? আর ঐভাবে খাদের পাশেই বা অজ্ঞান হয়ে পরে ছিলি কেন?" মেঘের হঠাৎ প্রশ্নে সায়ান কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে, তারপর ঘরের মধ্যে অতজনকে থাকতে দেখে একটু ইতস্তত করে, জ্যাঠা মশাই সেটা বুঝতে পেরে ঘরের বাকিদের উদ্দেশ্যে বললেন
"এই, চলো তোমরা সকলে, ওরা এখন একটু বিশ্রাম নেবে... চলো... চলো।"
এই বলে জ্যাঠামশাই ঘরের বাকিদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন,
"জ্যেঠু, কিছু মনে না করলে আপনি কী একটু দাঁড়াতে পারবেন... কিছু বলার ছিল আপনাকে।"
সায়ান বলে ওঠে।
সায়ানের এই কথায় ভূঁইয়া মশাই দাঁড়িয়ে গেলেন।
ঘরে এখন তাঁদের তিনজনকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে ফাঁকা। একটা ছোটো হলদে বৈদুত্যিক বাতির আলো এসে পড়েছে কানু জ্যাঠার মুখে, তাতে ওনার কপালের ভাজ আরো গাঢ় হয়ে উঠেছে।
সায়ান একটু আগে সমস্ত টা খুলে বলেছে তাঁদের কাছে, প্রথমটায় মেঘ কিছুই বিশ্বাস করতে পারছিলো না, কিন্তু ভূঁইয়া মশাইয়ের ঐ রূপ চিন্তালগ্ন মুখ দেখে সে কিছু বলে উঠতে পারেনি।
কানু জ্যাঠা কী একটা ভেবে নিয়ে উঠে গেলেন ঘর ছেড়ে,কিছু সময় পর তিনি লাল কাপড়ে ঢাকা কোনো কিছু একটা নিয়ে আবার ঘরে ঢুকলেন।
হাতের জিনিসটাকে একবার মাথায় পরম শ্রদ্ধা করে ঠেকিয়ে নিলেন তিনি, তারপর সেটা থেকে একটা অতি পুরোনো বই বের করে আনলেন তিনি। বইটার বেশ খানিকটা পোকায় খাওয়া।
কানু জ্যাঠা বইটার পাতার পর পাতা পাল্টে কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন, তারপর বইটার ঠিক শেষের দিকটার একটা পাতার উপরে এসে থামলেন তিনি।
বইটার সাড়া পাতা জুড়ে কোনো এক দূর্বধ্য ভাষায় লেখা রয়েছে কিছু আর তার ঠিক মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটা ছবি।
ছবিখানা তিনি মেলে ধরলেন সায়ানদের দিকে,
"আচ্ছা, তুমি কী এরকমই কিছু একটা দেখেছো?"
মেঘ দেখলো ছবিটা বড় অদ্ভুত, একটা বীভৎস মাথা ভেসে রয়েছে শূন্যের উপরে আর তার গলার নিচ থেকে সরু সরু অনেক রেখা জেলিফিশের পায়ের মতো বেরিয়ে এসেছে নিচের দিকে,
আর মাথার ঠিক নিচে দেখা যাচ্ছে একজন মহিলা কোলে ধরে রয়েছে এক শিশুর মস্তকশূন্য দেহকে, আর সেই দেহ থেকেও যেন বেরিয়ে এসেছে অনেক গুলো শুড়, আর সেই শুর এর অগ্রভাগ যেন চেপে ধরেছে মহিলার গলায়।
সায়ান যেন ভুত দেখছে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলো সেই ছবিটার দিকে, তারপর সেই মাথার ছবিটাকে দেখিয়ে বললো
"হ্যাঁ, ঐ ঐ মাথাটাকেই আজ দেখেছি আমি, কী ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য।"
কানু জ্যাঠার চোখে মুখে ফুটে ওঠে চরম আতঙ্ক।
তার পরে তিনি যা বললেন তাতে মেঘ আর সায়ানের চোখে মুখেও সে একই আতঙ্ক জমাট বাঁধলো।
পর্ব ৯:
"সুর আর অসুরের বিরোধ চিরন্তন ; সুরের রাজত্বে যেমন অসুরের প্রবেশ নিষেধ তেমনি অসুরের রাজত্বেও সুরেরা নিষিদ্ধ। তবে , এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অসুরেরা মাঝে মধ্যেই উঠে আসে নরক থেকে , আর তখনই দেখা দেয় সুর-অসুর দ্বন্দ্ব। জ্বলে ওঠে ধরাধাম,মানব জাতি ধুঁকতে থাকে যুদ্ধের পচাপাঁকে।
এই যুদ্ধ ঘটে চলেছে সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই। এর উৎপত্তি ঘটেছিলো
মহর্ষি কাশ্যপের দুই স্ত্রী দিতি আর অদিতির সন্তানদের মধ্য দিয়ে।
অদিতি ছিলেন দেবতাদের মা। তার সন্তানেরা ছিল স্বর্গের অধিপতি।
অপরদিকে দিতি ছিলেন অসুর জননী, তার সন্তানেরা হলো পাতাল বাসী ।
শুরু থেকেই তারা কেউই একে অন্যকে পছন্দ করতো না, সুর বা দেবতারা স্বর্গে বসবাস করায় তারা প্রায়ই দিতি ও তাঁর সন্তানদের নিচু চোখে দেখতো, সময়ে অসময়ে তাঁদের লাঞ্ছনার শিকার হতে হতো দেবতাদের দ্বারা।
ফলে অসুরকুলের কেউই দেবতাদের পছন্দ করতো না, তাই তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেবতাদের উপরে প্রতিশোধ নিতে হানা দিত দেবতাদের স্বর্গ রাজ্যে।
কিন্তু প্রাথমিক পর্বে তারা সফলতা পেলেও শেষে এসে তারা মারা যেত দেবতাদের হাতে ।এইভাবেই একে একে মারা যেতে থাকে অসুরকুলের শত শত সুর বীর।
আর প্রতি নিয়ত অসুরকুলের সংহারে দেবতাদের ঐদ্ধত্য বেড়ে যেতে থাকে কয়েকগুন। এমনকি তারা নিজেদের সীমা লঙ্ঘন করে নিজ পিতা এবং বাকি বিমাতাদেরও হীন ও লাঞ্চিত করতে ভোলে না।
অবশেষে দিতি তার পুত্রদের এক এক করে মৃত্যু আর সহ্য না করতে পেরে সোজা চলে যায় তার স্বামী মহর্ষি কাশ্যপর কাছে। মহর্ষি কাশ্যপ তার স্ত্রীর বেদনার্ত মিনতি শুনে তাকে এক বীর সন্তানের আশীর্বাদ দেন, সেই সন্তান হবে সমস্ত অলৌকিক শক্তির অধিকারী এমনকি সেই সন্তান দ্বারাই যে দেবতাদের পতন ঘটবে এমন কথাও তিনি জানান।
তো সেইরূপ দিতি আবার অন্তসত্ত্বা হলেন , এবং তার উদরে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে শিশু সন্তানটি।
তো, একবার কী হলো সেই খবর গিয়ে পৌছালো দেবতাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইন্দ্র এর কানে। এই ইন্দ্র ছিলেন স্বর্গের রাজা। তো ইন্দ্র কেন স্বর্গের রাজাসন ছাড়বে! কিন্তু যতই হোক সে তার পিতাকে ভয় করে চলে, তার উপস্থিতিতে সে কিছুই করতে পারবে না দিতি কে।
এইভাবে কেটে গেলো নয় মাস, এই নয় মাস দিতির আর অদিতির সন্তানদের মধ্যে কোনো রূপ বিরোধীই দেখা গেলো না। দেবতারা দিতির সন্তানদের উত্তোক্ত করার কোনোরূপ চেষ্টাই ছাড়েনি। কিন্তু তবুও তারা চুপচাপ সমস্ত কিছুটা সয়ে গেছে।
আর মাত্র একমাস বাকি, তারপরেই জন্ম নেবে সেই অলৌকিক শিশু। এইদিকে ইন্দ্র তার সিংহাসন হারানোর ভয়ে পার করে চলেছে একের পরে এক দিন কিন্তু পিতার ভয়ে কিছু না করতে পেরে আরো হতাশ হয়ে পরতে থাকে।
তো একবার হলো কী, মহর্ষি কাশ্যপ কোনো একটি কাজে বাড়িতে ছিলেন না । আর সেইদিনই দিতির বাকি সন্তানেরাও কোনো এক কাজে ব্যস্ত ছিল।
এরকমই একটা দিনের অপেক্ষায় ছিলেন মহারাজ ইন্দ্র, তিনি তার দুই চ্যালা নিয়ে সোজা হাজির হন বিমাতা দিতির কাছে।
দিতি তাঁদের দেখে মাতৃসুলভ আচরণেই বসার জন্য আসন পেতে দিতে থাকেন। ঠিক এমন সময়ই ইন্দ্র লাথি ছুঁড়ে দেন দিতির পেট লক্ষ্য করে। প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে দিতি ছিটকে পড়েন এক কোনে।
ইন্দ্রর দুই চ্যালা গিয়ে তুলে ধরেন দিতিকে।
ইন্দ্র আরেকটা লাথি ছুঁড়ে দেয় দিতির পেট লক্ষ্য করে, প্রচন্ড যন্ত্রনায় দিতি কুঁকড়ে ওঠে, তার পা বেয়ে আসতে থাকে এক উষ্ণ তরল ধারা।
ইন্দ্র এবার এক প্রচন্ড ঘুষি মেরে উঠলো বিমাতার পেট লক্ষ্য করে, ঘুষির প্রচন্ড আঘাতে যেন অলৌকিক উপায়ে বেরিয়ে আসলো সেই শিশুটি। তার সমস্ত শরীর রক্ত স্নাত। এক দীর্ঘ নাড়ি শিশুটিকে তার মায়ের সাথে ধরে রেখেছে।
প্রচন্ড যন্ত্রনায় দিতি তার জ্ঞান হারায়।
ইন্দ্র তবুও থেমে থাকে না।
দিতির যখন জ্ঞান ফেরে সে দেখে তার পায়ের কাছে পরে রয়েছে তার শিশুর মস্তকবিহীন দেহ খানা। তার শরীরের একটা অংশ তখনও মিশে রয়েছে শিশুটির প্রানবিহীন দেহের সাথে।
দিতি ধীর হাতে তুলে নেয় সেই দেহ, তারপর একজন মা তার মৃত শিশুর দেহ ধরে আর্তনাদ করে ওঠে, তার চোখ থেকে জল বাড়ি হয় না, বেরিয়ে আসে অন্তরের আক্রোশ, রাগ, ঘৃণা, আর সেইসব মিলে মিশে একাকার করে উৎপন্ন করে লাল রঙের ধারা।
দিতি তার মৃত শিশুকে মাথার উপরে তুলে ধরে পাঠ করে চলে কোনো অজানা অভিশাপ, সেই অভিশাপ এতোই ভয়ঙ্কর যে দিতির শরীর একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে থাকে শূন্যের মাঝে।
কিছু সময় পরে দিতির স্থানে দেখা যায় একরাশ ধুলো, আর তার ঠিক মাঝে পরে থাকে একটি ছোটো কালো পাথর।
বলা হয় সেই পাথরের মধ্যেই স্থিমিত হয়ে রয়েছে দিতির সমস্ত অভিশাপ, সেই পাথর জেগে উঠলেই ঘনিয়ে আসবে চরম বিনাশ।
যুগ যুগ ধরে দিতির সন্তানেরা বারবার চেষ্টা করে গেছে সেই পাথরকে জীবিত করে তোলার, কিন্তু বার বার তারা ব্যর্থ হয়েছে।
লোক মুখে শোনা যায়, ঐ জঙ্গলের মধ্যেই কোনো এক স্থানে ছিল দিতির সেই বাড়ি। আবার কেউ কেউ বলে দিতির সেই সন্তানের মাথা মহারাজ ইন্দ্র এনে লুকিয়ে রেখেছিলেন সেই জঙ্গলের কোনো এক গোপন কঠোরে। তবে এর সত্য-মিথ্যা জানা নেই।"
কথাগুলো বলে একটু থামলেন কানু জ্যাঠা।
সায়ান আর মেঘ দুজনেই চুপ করে শুনছিলো তার কথা। তাঁদের কথাগুলো অবাস্তব লাগলেও তারা কিছু বলতে পারছে না। কারণ সায়ান নিজে দেখেছে সেই মুখকে, আর মেঘ জানে সায়ান মজা করার পাত্র নয়।
ঘরে ওরা সবাই চুপ, বাইরে থেকে ঝিঁঝি পোকার আর্তনাদ যেন তাঁদের কানে এসে লাগছে।
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে এক প্রচন্ড চিৎকার ছুটে আসলো তাঁদের কানে, তারা সকলেই দৌড়ে গেলো ঘরটার দিকে।
তারা খেয়াল করলো না জানলার সোজাসুজি গাছটার পিছনে আবডালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে। লোকটি তার হাতে ধরে রয়েছে একটি পাথর.... একটি ছোটো কালো পাথর।
এক ঘন অন্ধকার মেঘ যেন জমতে থাকলো বাড়িটাকে ঘিরে।
পর্ব :১০
পাশের ঘরে ওরা যেতেই যেটা দেখে তাতে তারা সকলেই অবাক। বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে তনু। তার সারা শরীর দমকে দমকে ছুটে আসছে উপরের টিনের চালের দিকে, তনুর চোখের মনি দেখা যাচ্ছে না,যেন তনুর চোখ দুটো উল্টে গেছে পুরোপুরি ভাবে।
তার মুখের কস বেয়ে বেরিয়ে আসছে এক কালো তরল ধারা।
তনু তার হাত দুটো দিয়ে সে প্রচন্ড শক্ত করে ধরে রয়েছে বিছানার দুই দিক।
সায়ান আর মেঘ দেরি না করে দৌড়ে যায় তনুর কাছে, তারপর জাপ্টে ধরে তনুর শরীরটাকে।
কিন্তু তনুর শরীরের প্রচন্ড ধাক্কায় তারা ছিটকে যায় কিছুটা দূরে।
তনুর সারা শরীর তখন বিছানার উপর প্রচন্ড জোরে জোরে আছাড় খাচ্ছে।
তার গলা থেকে ভেসে আসছে কোনো এক অজানা ভাষার মন্ত্র। এই মন্ত্র আমাদের জানা, কিন্তু সায়ানরা এসবের কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা দুজনেই হতবাক, এ কী হচ্ছে তাঁদের সাথে!
পরীক্ষার পরে কোথায় তারা এসেছিলো একটু মজা করতে, আর এখন তাঁদের সাথে যেটা হচ্ছে সেটাই মোটেও কোনো মজাদার ঘটনা নয়।
সায়ান আর মেঘ একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো, দুজনের মুখেই ভয়-হতাশা-নিরুপায়তা।
হঠাৎ করেই একটা প্রচন্ড শব্দে ঘরের লাইট গুলো সব বন্ধ হয়ে গেলো। মেঘ পকেট থেকে ফোন টা বার করে ফ্ল্যাশ জ্বালে।
অন্ধকার ঘরে ওরা তিনজন এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে অপ্রাকৃতিকের ভয়ঙ্কর।
কানু জ্যাঠা এতো সময় চুপ থেকে ঘটনা গুলো দেখছিলেন, এরপর তিনি ঘটনার গভীরতা উপলব্ধি করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন তনুর মুখটা তার মুখের ঠিক সামনে, তনু তার ধবধবে সাদা চোখ দুটো দিয়ে কানু জ্যাঠাকে দেখে চলেছে খুব কাছ থেকে। কানু জ্যাঠা এই শীতের মধ্যেও খানিকটা ঘেমে উঠলেন। সায়ান আর মেঘও তনুকে এইভাবে দেখে ভয় পেয়েছে রীতিমতো।
তনু যেইভাবে হঠাৎ করে তাঁদের মুখের সামনে এসেছে দাঁড়িয়েছিল তার থেকেও দ্বিগুন গতিতে সে গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো বিছানার উপরে। তার শরীরটা এখন নিশ্চুপ হয়ে পরে রয়েছে বিছানাতে।
এইভাবে তনুকে চুপ হয়ে পরে থাকতে দেখে সায়ান আর মেঘ এগিয়ে যায় তনুর কাছটাতে। না তনুর শরীরে তখনও কোনো সারা দেখা গেলো না।
মেঘ এবার একটু সাহস করেই তনুকে ডেকে উঠলো
"তনু.... এই তনু.... শুনতে পারছিস?.... এই কী রে "
কিন্তু সেই ডাকের কোনো উত্তর এলো না। তারা খুবই একটা আশাও করেনি।
মেঘ সায়ানের দিকে তাকালো, চোখে মুখে ভয়-ভীতি আর প্রশ্ন, যেন সে কিছু একটা জানতে চাইছে সায়ানের কাছ থেকে। সায়ান সেটাই বুঝতে পেরে, মেঘের পাশে টেবিল এর উপরে থাকা জলের বোতলটা তুলে নিলো। তারপর তার থেকে হাতে কিছুটা জল নিয়ে তনুর চোখে মুখে একটু ছিটিয়ে দিলো।
না, তনু তখনও নিশ্চুপ।
মেঘের হাতে ধরে থাকা ফোনটাতে এবার low battery এর একটা নোটিফিকেশন ঢুকলো। সায়ান সেটাকে হাতের বুড়ো আঙ্গুলটা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কিন্তু অদ্ভুত ফোনের স্ক্রিনটা যেন একটু আঠা আঠা ঠেকলো তার হাতে। সে হাতের বুড়ো আঙ্গুলটাকে হাতের তর্জনীর সাথে দু তিনবার মিশিয়ে আঠালো ভাবটা পরীক্ষা করলো।
হঠাৎ করে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা নিভে গেলো মেঘের। আর সাথেই সাথেই ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো একটা নম্বর, তাকে কেউ কল করেছে, কল নাম্বার এর উপরে ভেসে আসছে কল দাতার নাম, সেই নাম দেখে মেঘের মুখের রক্ত নেমে গেলো তার শিরদাড়ার দিকে।
তাকে কল করছে তনু। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব!
তনু তো শুয়ে রয়েছে তার সামনেই, আর তার ফোন কেউ ব্যবহার করে মেঘকে ফোন করছে এটাও সম্ভব নয় কারণ তার আরেকটা পকেটে রয়েছে তনুর ফোনটা।
মেঘ কলটা ধরবে কী ধরবে না ভাবছে, এমন সময় ফোনের স্ক্রিনটা অফ হয়ে গেলো তার, তারপর বারবার power button চিপে ধরেও সে ফোনটা চালু করতে পারলো না।
মেঘের ফোন বন্ধ হওয়ার সাথেই সাথেই ঘরে আবার নেমে এসেছে একরাশ অন্ধকার।
ঘরের মধ্যে যেন একটা গরম হাওয়া ঘুর পাক খেতে লাগলো।
ঘরের এককোনা থেকে ভূঁইয়া মশাই বলে উঠলেন
" তোমাদের পাশের টেবিলের ড্রয়ারে একটা মোমবাতি আর দেশলাই আছে, ওটাকে জ্বালাও তাড়াতাড়ি।"
মেঘ অন্ধকারে হাতরে ড্রয়ার টা খুলে মোমবাতি খুঁজে পায়, তারপর আরেকটু হাতরে দেশলাইটাও তার হাতে চলে আসে।
দেশলাইটা দিয়ে মোমবাতিটা ধরায় মেঘ, একটা হালকা হলদে আলোয় ঘরটা ভরে ওঠে।
মোমবাতিটা জ্বালিয়ে তুলে ধরতেই মেঘ সায়ানের ভীত গলা শুনতে পায়
"এই.... তনু কোথায়... মেঘ?"
"তনু কোথায় মানে! তনু তো ঐ বিছানা..."
কথাটা শেষ করতে পারে না মেঘ, তার চোখ তখন দেহশূন্য বিছানাতে।
বিছানায় তনু নেই।
"কী রে কোথায় গেলো তনু? "
"সেটাই তো দেখছি কোথায় গেলো মেয়েটা!"
মোমবাতির কাঁপতে থাকা আলোতে ওরা তনুকে খোঁজার চেষ্টা করে।
মেঘ আলোটা নিয়ে খাটের তলায় ঝুকে দেখার চেষ্টা করে,
না কিছু নেই সেখানে।
"এই ওখানে ওইটা কী "
কানু জ্যাঠার কথায় ওরা ঘুরে তাকায় ঘরের এক বিশেষ কোনে, সেখানে তারা যা দেখে তা কোনো ভৌতিক সিনেমাকেও হার মানায়।
ঘরের সেই দিকের দেয়ালের দিকে পিছন করে তনু একটু একটু করে উঠে যাচ্ছে চালের দিকে, তার মাথার সামনের দিকে চুল এসে ঢেকে দিয়েছে তার সারা মুখ।
ওদেরকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তনু দেওয়াল চড়া থামিয়ে দিয়ে চোখের পলক ফেলার আগেই দৌড়ে আসে সায়ানের কাছে, সায়ান ভয়ে পিছোতে গিয়ে পরে যায় মাটিতে। তনু সায়ানের মুখের উপর ঝুকে পরে তাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে, সায়ানের মুখ ভয়ে রক্ত শূন্য হয়ে উঠেছে, পিঠএর জামা ঘামে ভিজে উঠেছে।
তনু যেন সায়ানের ভয়ের গন্ধটা শুষে নিলো তার নাক দিয়ে, তারপর ভয়ঙ্কর নৈশব্দের একটা হাসি ছুঁড়ে দিলো সায়ানের দিকে।
সেই হাসি বড়ই ভয়ের, তনুর দাঁতগুলো কোনো এক জাদুবলে বেড়ে গেছে কয়েক ইঞ্চি, আর তার মধ্যে থেকে গড়িয়ে পরছে কালো থকথকে এক তরল।
Comments