আকাশে মায়ের মুখ - সামসুজ জামান || Akashe maaer sukh - Samsuz Zaman || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
আকাশে মায়ের মুখ
সামসুজ জামান
সাইকেলটা চালাতে চালাতে পা ধরে যাচ্ছিল নির্মলের। এমনিতে খুব একটা অভিজ্ঞ বা পরিপক্ক নয় সে সাইকেল চালানোয়। কিন্তু চাপে পড়ে তাকে সাইকেল জোগাড় করতে হয়েছিল।
মালিকের কাছে কাজ করতে করতে হঠাৎই অন্য সকলের সাথে সেও শুনল কাল থেকে সারাদেশে লকডাউন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী টিভিতে ভাষণ দিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই আদেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন যেটা অমান্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু অন্যদেরকে তার অবস্থাটা বোঝানোর মতো পরিবেশ বা ক্ষমতাও তার নেই। কাকে সে বোঝাবে আর কেমন করে বোঝাবে তার মনের অবস্থা!
এমনিতেই নির্মল বড় মা অন্ত প্রাণ। পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন দলবেঁধে হৈ-হুল্লোর, মৌজ-মস্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, তখনও কিন্তু নির্মল মায়ের কথা ভেবে বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকত না। বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতো তাকে অনেক। কিন্তু মায়ের ভালবাসার কাছে বন্ধুদের খ্যাপানোর কোন তুলনায় হয় না।
তিন দিন আগে পাশের বাড়ির ফোন পেয়ে সে জেনেছিল মায়ের সংকটজনক অবস্থার কথা। তারপরে আর কাজে মন বসে না তার। মালিকের সাথে অনেক বাদানুবাদ করেও যখন সমস্যার সমাধান হয়নি তখন অগত্যা কাজ ছেড়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। মালিক তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল – দেখ, কী ছাই লকডাউন-মাউন, এসব ব্যপার তো বাপের জন্মেও শুনি নি। এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমার হাতে দেওয়ার মত কোন টাকা-কড়িই আমার কাছে নেই। শেষে অনেক চেঁচামেচির পর অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল মালিক।
বাড়ির ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি এজেন্টের কাছে ছুটেছিল নির্মল এবং পরের দিন রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটও পেয়ে গিয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে। তাতেই তার বাড়ি ফেরার কথা। বাড়ি ফিরতে তার লাগবে সতেরো ঘন্টা। নির্মল পাগলের মত শুধু ভেবে যাচ্ছে এই সতেরো ঘণ্টা কি করে তার কাটবে? আর এমন অবস্থায় আজ হঠাৎ এই লকডাউনের ঘোষণা!
কিন্তু বাস, ট্রেন সমস্ত কিছু যখন বন্ধ, তখন ফেরার রাস্তা তো আর নেই। অন্য অনেকের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনার পরেও ফেরার রাস্তা কিছু না পেয়ে নির্মল অগত্যা সাইকেলে চড়ে ফেরার মত সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। একমনে এই দুশ্চিন্তার কথা ভাবতে ভাবতে তার নজর পড়ে হাতের দুর্বল আংটির দিকে। কারণ সামান্য কিছু অর্থের মধ্যেও আবার যদি সে বাজে খরচ করে ফেলে এইসময়, তবে তো মায়ের অপারেশন করার খরচ ই পাবে না। তখনই মাথায় মতলব আসে অন্ততপক্ষে এই সোনার আংটিটুকু বিক্রি করলে একটা পুরনো সাইকেল কেনার মত পয়সা তার হতে পারে। আর তারপরই যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সেই টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে অনেক দরদাম করার পর সাইকেলের দোকান থেকে পুরনো সাইকেলটা কিনে তার ভরসা হয়। যখন রাস্তাঘাটের গাড়িঘোড়া সব বন্ধ তখন সাইকেলে চড়ে এই দীর্ঘ পথ ফিরতে তার অন্তত কোন অসুবিধা হবে না বলেই তার মনের জোর।
রাস্তায় লোকজন তেমন নেই কিন্তু নির্মল সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন। নির্মলের পাখির চোখ তার মায়ের মুখ। পাশের প্রতিবেশী মারফত মাকে সে খবর পাঠিয়েছিল সে গিয়েই মায়ের অপারেশন এর যাবতীয় বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। রাস্তায় পুলিশ বারবার তাকে আটকে কত যে হয়রানি করেছে কতবার। কতভাবে পুলিশকে বলে, বুঝিয়ে, টাকা-পয়সা খরচ করে তবে সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।
অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ওড়িশা সীমান্ত দিয়ে ঢোকার মুখেই বিপত্তি গেল বেড়ে। পুলিশ কিছুতেই তার কথা শুনবে না। অবশেষে নিজের একমাত্র সম্বল পকেটের কম দামী মোবাইলটা পুলিশকে দিতে, তবে সে মুক্তি পেল। পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্ষিদে আর তেষ্টায়। সেসবের তোয়াক্কা না করেও অন্তহীন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে নির্মল।
অবশেষে একসময় নির্মল মাতালের মত টলতে টলতে কোনরকমে সাইকেলটা নিয়ে তাদের নিজেদের গ্রামের বড় নদীর ব্রিজ পার হচ্ছিল। সকালের নতুন সূর্যটা কি সুন্দরভাবে উঠছিল আম বাগানের পাশ দিয়ে। ওপারে বড় আম বাগানের পাশেই এলাকার শ্মশান। কিন্তু শ্মশানে হঠাৎ ভিড় কেন? খুব অসহায় লাগছে তার। সাইকেলটা কোনরকমে থামিয়ে মাটিতে পা রেখেছে নির্মল আর ছুটতে ছুটতে এলো রঘু। বলল- নির্মল কাকু তুমি এলে? কিভাবে এলে? এখনতো চারিদিকে লকডাউন। তোমার মোবাইল তো সুইচড অফ বলছে। কেউ যোগাযোগ করতেই পারেনি। জানো কাকু, ঠাকুমা........ কাল সন্ধ্যেয়...... মারা গেছে পেটের যন্ত্রনায়! ভোরে ভোরে এসে সবাই এইমাত্র ঠাকুমার দাহকার্য শেষ করল।
কি বলছিস রে রঘু? তুই ঠিক বলছিস? বলতে বলতেই মাথাটা ঘুরে গেল নির্মলের।
হ্যাঁ গো কাকু, এই কথা কি আর মিথ্যে করে কেউ বলে? জবাব দিল রঘু।
সহসা চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাটিতে পড়ে গেল নির্মল আর চিৎকার করে উঠল তীব্রভাবে -- মা! মাগো! আমি যে এসে গেছি মা, তোমার অপারেশন করাব বলে কিছু টাকাও জোগাড় করেছি।
আমবাগানের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা এসে পড়ছিল তার মুখের উপর। নির্মলের হঠাৎ মনে হল - ওই তো? ভোরের আকাশের সূর্যের মধ্যে থেকে মা চেয়ে আছে তার পানে। দুটো হাত সূর্যের দিকে প্রসারিত করে নির্মল চিৎকার করে উঠল – মা, মাগো! দাঁড়াও মা তুমি ওইখানে। আমি আসছি তোমার দিকে, তুমি চলে যেও না মা, আমি আসছি। আমি যে এত কষ্ট করে ছুটে এলাম, সে তো তোমার অপারেশনের জন্যেই। তুমি চলে যেও না মা।
মাটিতে দু’ হাতে ভর দিয়ে নির্মল প্রাণপণ শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে চেষ্টা করল সামনের দিকে, কিন্তু পা দুটো আর তার এগোল না। দু’ পায়ে জড়িয়ে আছড়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। সামনে পড়ে থাকা ভাঙ্গা একটা ইটের উপর মুখটা লাগতেই গর গর করে রক্তস্রোত বয়ে যেতে লাগল তার জামা-কাপড় বেয়ে।
ছোট্ট রঘু এই কাণ্ড দেখে হাও মাও করে চিৎকার করতে করতে লাফালাফি করতে লাগল – ও সুদীপ জ্যেঠু, ও অমর দাদু, তোমরা শিগগির ছুটে এই দিকে এসো গো। দেখে যাও নির্মল কাকুর কি অবস্থা...
কিন্তু নির্মলের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার ছোট ব্যাগটা খুলে তার অনেক কষ্টের সঞ্চয়ের টাকাগুলো ছেলেখেলার ভঙ্গীতে বাতাসে উড়িয়ে দিতে দিতে অভিমানে বলতে লাগল – কিচ্ছু দরকার নেই এগুলো আর আমার। এ টাকা-পয়সা আমার আর কোন কাজেই লাগবে না – বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল নির্মল।
Comments