মধ্যবিত্ত প্রেম - সুতপা সোঽহং || Moddhobitto Prem - Sutapa Sohong || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 মধ্যবিত্ত প্রেম

        সুতপা সোঽহং



তানি জোর করে আমার কবিতার খাতা টেনে পড়তে শুরু করেছে। মাথা নিচু করে এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে যে ওর ওড়না যে মাটিতে গড়াচ্ছে সেদিকে নজর নেই। কচি কলাপাতা রঙের ওড়না। ওঠাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ও লজ্জা পেতে পারে। থাক। ওকে ওড়না ছাড়া দেখিনি কখনো। তাকাব না তাকাব না করেও চোখ গলা পেরিয়ে বুকের খাঁজের দিকে গেছে। তৎক্ষণাৎ শরীর যেন জানান দিল আমি বছর কুড়ির ছেলে। সামনে বৈশাখে একুশে পড়ব। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। চোখ মনের সাথে পাল্লা দিয়ে অবাধ্য হচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। মার লাগানো স্হল পদ্মের কুড়ি দু একটা করে ফুটতে শুরু করেছে। গাছটা আছে। মানুষটা নেই। থাকলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হত। এতটা উদাসীন, এতটা ছন্নছাড়া হয়তো হতাম না। কিংবা হয়তো আরো খারাপ হতাম। কে বলতে পারে! যা নেই তা নিয়ে আমাদের আফশোষ করার স্বভাব। যা আছে তার মূল্য আমরা কখনো দিই না। এই যেমন এই তানি মেয়েটা সবসময় খেয়াল রাখে কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি। কিন্তু আমি তো খবর নিই না কখনো ওর। কখনো চোখে চোখ পড়লে মনে হয় ওর কী যেন এক দাবি আছে আমার উপর। অলিখিত, অনুচ্চারিত। দরজা দিয়ে তানিকে দেখা যাচ্ছে। খাতাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এসময় ঘরে ঢোকা যাবে না। কবিতা পড়লে কী এক ঘোর, মায়া কাজ করে। এসময় মানুষ আবেগে যা খুশি করতে পারে। উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পকেট হাতড়ে একটা বিশ টাকার নোট পেলাম। আজকের মতো চলে যাবে। সিগারেটও আছে একটা। আর কি চাই! নিজেকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে। বল্টুদার চায়ের দোকানে ভিড় নেই আজকে। বসলাম। বল্টুদার বৌ চা করছে। পাশে মেয়ে বস্তা পেতে বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু মন তার পরোটার দিকে। হয়তো সকাল থেকে তার পেটে কিছু পড়ে নি। হয়তো খরচ বাঁচাতে একেবারে দুপুরে খাওয়া হয়। একদিন দুপুরের দিকে এসেছিলাম এদিকে। সে সময় বল্টুদা মেয়ে বউ নিয়ে খেতে বসেছে। বসা মানে ওই একহাতে থালা নিয়ে বেঞ্চে খাওয়া আর কি। পরোটার জন্য বানানো তরকারি আর ভাত। কিন্তু তাতে কী! খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল অমৃত বোধহয়। থালায় এক কণা ভাত তরকারিও পড়ে ছিল না। আসলে খাওয়ার জিনিসের স্বাদ কী তা না খেতে পাওয়া মানুষের কাছেই জানা যায়। মেয়েটার একমাথা তেল না দেওয়া রুক্ষ চুল। একটা নোংরা চিমড়ানো কলমের মুখটি চিবুচ্ছে থেকে থেকে।বল্টুদা দক্ষ হাতে পরোটায় মাখন লাগাচ্ছে। সে গন্ধে ম ম করছে চত্বর। চাটায় দিয়ে ঘেরা দেওয়া দোকান। ভিতরে আরেকটা চাটায় দিয়ে ঘেরা। চৌকির একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ইতস্তত নোংরা কাপড় ঝুলছে। এখানেই একটা সংসার গড়ে তুলেছে। খেতে খেতেই বিষম খায় পল্টু দা। ব‌উটি তড়িঘড়ি জল দেয়, পিঠে হাত বুলায়, কী জানি এক মন্ত্র পড়ে মাথায় ফুঁ দেয়। আমি বসে বসে দেখি। বড় ভালো লাগে।অভাবী কিন্তু ছোট্ট সুখী সংসার। এই ব‌উটির কাছেই শোনা বল্টুদা অনাথ। ভিটে টুকুও নেই। বড় কষ্ট করে এই ছোট্ট দোকান টুকু দাঁড় করিয়েছে।

আমি শুধু ভাবি এই যে এতো কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা, জীবন সংগ্রামের গল্প আলাদা। এ যেন অসীম সংখ্যা নিয়ে প্রবাবিলিটির খেলা। কোন সজ্জার সাথে কোন সজ্জার মিল নেই। অথচ উপাদান সংখ্যা গুলো একই। বল্টুদা চায়ের কাপ নিয়ে এল। পরোটার কথা জিজ্ঞেস করে না এখন আর। জানে আমি খালি চা‌ খাই। আসলে খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু টাকা থাকে না অত। পরের মাসে টিউশনের টাকাটা পেলে একদিন খাব। এই মাসের আরো তিনদিন চালাতে হবে একশো টাকায়। ঘরে চিড়া, লবন আছে। চিন্তা নেই। ঘরে ফেরা যাক। তানি এতোক্ষণে কী করছে কে জানে। ঘর পাহারা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বলেও আসি নি। পা চালালাম। এক মিষ্টির দোকানের সামনে কিছু জটলা। এক পাগলীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মিষ্টি চুরি করার নাকি তালে ছিল। এ এলাকার সে না। সমানে 'খিদা খিদা। পেট জ্বলে গেল। খেতে দে না ও বাবারা' বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠে মুখ খিস্তিও। ডানহাতে এক বড় ঘা। তাতে মাছি ভ্যানভ্যান করছে। দোকানের এক ছোকরা কী এক অশ্লীল ইঙ্গিত করল। পাশে বসা দুই কাস্টোমার হো হো করে হেসে চোখ দিয়েই পাগলীর শরীর যেন চেটে খেল। বেঁধে রাখার পিছনে কোন খারাপ মতলব নেই তো? কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু সাধারণ জনতার মতো কিছু করলে তার উল্টো ফল হতে পারে। বর্তমান সময়ে কার্যকরী শুধু টাকা আর ক্ষমতা। যেদুটোর একটাও আমার নেই। জামাটাকে যথা সম্ভব ঠিক করে একেবারে দোকানের মালিকের সামনে। হুংকার দেওয়ার গলায় বললাম 'এঁকে কে বেঁধে রেখেছে? মানবাধিকার কমিশন থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। মলয় দত্ত বলে কেউ এখান থেকে ফোন করে জানিয়েছে।' ওরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমাকে পা থেকে মাথা জরিপ করে বলল ' কী কমিশন বললেন দেখে তো মনে হচ্ছে না। আর মলয় দত্ত কে তাও জানি না। প্রমান ছাড়া তো ও মাগীকে ছাড়া যাবে না।' আমার কোঁচকানো শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। জানি বিশ্বাসযোগ্য না। তারপরেও মুখে, গলায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম 'আমি এই এলাকায় থাকি। এতো সকালে কমিশন থেকে ফোন পেয়েই এলাম। দোষ করলেও এমন‌ ধরনের মানুষের উপর শারীরিক কিংবা মানসিক অত্যাচার আইনবিরোধী। '

"Don't judge a book by it's cover"

প্রবাদটা নিজে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু ওরা তো করে না। ফোনটা বের করে মিছামিছি কারোর সাথে কথা বলার অভিনয় করছি। পুলিশ, জেল ইত্যাদি শব্দ গুলো দুতিন বার জোরে জোরে উচ্চারণ করলাম। মালিকের মুখের অভিব্যক্তি খুব একটা বদলালো না। এবার অন্য কারোর সাথে ফোন করে কথা বলছি ভাণ করে ইংলিশে কথা বলা শুরু করলাম। এবারও জেল, পুলিশ বললাম। হুম এবার ওষুধে কাজ দিয়েছে। মালিক চোখের ইশারায় দড়ি খুলতে বলল।

হায়রে ইংরেজ গেছে কবে দেশ ছেড়ে। কিন্তু দাসত্ব আর ফুরোলো না। মাতৃভাষা যা পারে নি ইংরেজি ভাষায় তা সম্ভব। তুমি ইংরেজি পারো মানে এলেমদার লোক। অফিসার কেন সবই হতে পারো যদি নাক সিটকিয়ে বলতে পারো ' shit, fuck.....' তারমানে তোমার লেবেল আছে ভাই।


যাহোক এখানে তো একটা ভালো কাজ উদ্ধার হল। পাগলী ছাড়া পেতেই দৌড়ে একটা ভাতের হোটেলে গিয়ে ঢুকলো। ও বোধহয় খেয়াল করছিল এদিকে। আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম। একশো টাকাটা বের করে পাগলীটাকে খেতে দিতে বললাম। অতো সকালে রান্না হয় নি। শুধু ভাত উপুড় দিয়েছে। বললাম 'বাসি তরকারি আছে নাকি কিছু? থাকলে তা দিয়েই দিয়ে দাও'। পাগলীর সামনে বাসি ডাল দিয়ে থালায় ভাত বেড়ে দিল। আগুনের মতো গরম ভাত। হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাগলীর যেন তর সইছে না। ওমনই গরম ভাত মুখে নিয়ে আঃ উঃ করে খেতে শুরু করল। ভীষণ কান্না পেল। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় হোটেলের মালিক টাকা ফেরত নিতে বলল। অবাক হলাম। মালিক লোকটা একটু হেসে বলল 'দাদা আমরাও গরীব মানুষ। মন চাইলেও ফ্রি তে খাওয়াতে পারি না। তবুও এটার দাম নিতে পারব না।' ভাতের দোকানটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম মিষ্টির দোকানদার এর থেকে অনেক বেশি বড়োলোক কিন্তু তাতে কী! মনের দিক দিয়ে বড় গরীব।


তানি বোধহয় রেগে গেছে এতোক্ষণে। ঘটনা শুনলে রাগ কমতে পারে কিন্তু বলার সুযোগ দিলে তো। না বলে বেরোলে রাগ করে খুব। কিন্তু আমি সে অধিকার দিতে চাই না। চাই না আমার এই রকম একটা টানাটানির সংসারে ও নিজেকে জড়াক। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসলাম। এসে দেখি তানি রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ছে। রান্নার সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। মেয়েটা করে কী! আমার পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে বলল "কিছুই খুঁজে পেলাম না। চিড়া পেলাম শুধু। তাই দিয়েই পোলাও বানাচ্ছি। বাদাম, কিশমিশ ছাড়া। জানি না খেতে পারবে কিনা। হয়ে গেছে। ঘরে যাও। দিচ্ছি।"


বিনা বাক্যব্যয়ে ঘরে আসলাম। পেটে ছুঁচোর ডন চলছে। প্লেটে করে দিয়ে গেল। কী অসাধারণ হয়েছে খেতে। ইস্ মেয়েটাকে সত্যিই যদি ঘরের বউ করে আনতে পারতাম! কিন্তু আমারই চলে না। ওর দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে পারব না।


"কী ব্যাপার চোখ মুখ বুজে তো খাচ্ছো। খুব কী অখাদ্য হয়েছে?

" না না চমৎকার হয়েছে। তুমি খাবে না? "

"না আমার পেট ভরা। খেয়েই এসেছি। তুমি খাও।"


আমি জানি ডাহা মিথ্যা কথা। ওদেরও টানাটানির সংসার। বাবা দর্জি। তিন ছেলেমেয়ে। তানিই বড়ো। টিউশন করে সারাদিন। কখন যে নিজের পড়া পড়ে কে জানে! কিন্তু খাওয়া নিয়ে জোর করে লাভ নেই। খাবে না কিছুতেই। বড্ড জেদী। বহুদিন এমন হয়েছে নিজের খাবার আমাকে এসে দিয়ে গেছে। নিজে খালি পেটে থেকেছে। কিন্তু ওকে আর এসব করতে দেওয়া যাবে না। এখন থেকে কঠোর হতে হবে। নাহলে দুজনের কষ্ট বাড়বে বই কমবে না। জিজ্ঞেস করলাম " শোনো, বাড়ি যাও। আর এভাবে হুটহাট করে এসো না। রান্না করো না। মিলির বাড়ির লোক জানলে আর আমার সাথে বিয়ে দিবে না।"


"মিলি কে?"


"বান্ধবী। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা আছে।"


"হতেই পারে না। তুমি হবে বিয়েতে রাজী!!!! তাহলেই হয়েছে! তোমাকে আমি চিনি না?"


"না রাজী হওয়ার তো কোন কারণ নেই। বিয়ে করলে ওর বাবার অর্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবে। সেই টাকায় একটা ব্যবস্যা শুরু করতে পারব।"


"টাকার জন্য বিয়ে করবে? যদি গরীব বাবার মেয়ে হয় তবে করবে না?"


"নাহ গরীব মেয়েকে বিয়ে করে কী করব? "


"যদি মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে তাহলে?"


"তাহলেও না। ভালোবাসা দিয়ে কি ব্যবসা করতে পারব? টাকা চাই টাকা। মিলিকে বিয়ে করলে যেটা পাব। যাহোক তুমি আর ঘনঘন এসো না। আমার বিরক্ত লাগে।"


"বিরক্ত লাগে?!!! এটা তো কখনো বলো নি। বেশ আর আসবো না।" অন্য দিকে তাকিয়ে কথাগুলো কোনরকমে বলে তানি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি জানি ওকে আজ জন্মের কষ্ট দিয়েছি আর সেইটার পিছনে গরীব হওয়াকেই দোষ ঠাউরেছি। অথচ এই দোষের শাস্তি বা কষ্ট চিরকাল আমিও পেয়ে আসছি। মেয়েটা বোধহয় আজ সারাদিন কাঁদবে। রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি এমন সময়ে দরজায় গুম গুম করে আওয়াজ হলো। আমার দরজায় কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই অন্তত এ সময়ে। উঠে দরজা খুলে দেখলাম তানির বোন রুপু। রীতিমত হাঁফাচ্ছে।


 'কীরে তুই এতো রাতে?'


'দা শিগগির চলো। দিদি ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই।'


আমার পায়ের নীচের মাটি দুলে উঠলো। ওকে মিথ্যা বলার পরিণাম যে এমন হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন আর ভাবার সময় নেই। দৌড়ালাম। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যখন ইমারজেন্সি থেকে বেরিয়ে এলাম মনে হলো অনেক ম্যাচিওর হয়ে গেছি এই কয়েক ঘন্টায়। এখনো বোধহয় প্রেম বলে কিছু আছে। এখনো বোধহয় সবাই শুধু টাকার পেছনে ছোটে না। এই কাঠখোট্টার শহরে এখনো কিছু মানুষ ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দিতেও পিছপা হয় না। 

সারা রাত যমে মানুষে টানাটানি। ভোরের দিকে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন রোগী বিপদমুক্ত। পূর্ব দিকে লাল সূর্য উঠছে নতুন একটা দিনের আশা নিয়ে। ঘরে গিয়েই চাকরির ব‌ই গুলো খুঁজে বের করতে হবে। হার মেনে নিলে চলবে না। জিততে আমাকে হবে আমার জন্য, তানির জন্য, আমাদের জন্য!

Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024