ভেজা বৃষ্টি - অমিত কুমার সাহা || veja brishti - Amit Kumar Saha || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

       ভেজা বৃষ্টি

    অমিত কুমার সাহা


সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরধারায়।এখন একটু সকাল সকালই ঋতভাস বেরিয়ে যায়, অফিসের জন্য।স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে যেতে হয়।

অন্যসময় এর দুটো ট্রেন পরে গেলেও চলে। সেজন্য বেশ ভোর থেকেই বিদীপ্তার তাড়াহুড়ো।

ঋতভাসের সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে হাতের কাছে দেওয়া, টিফিন তৈরি এইসব। ও অফিস চলে গেলে সারাটাদিন বিদীপ্তা একা।


আর পাঁচটা ফ্ল্যাটের মতো ওদের ফ্ল্যাটেও একটা ব‍্যলকনি আছে। ওটাই বিদীপ্তার খোলা মাঠ, ওটাই ওর সাধের বাগানের জায়গা।বেশ কয়েকটা গাছও লাগিয়েছে ওখানে। ছোটোবেলা থেকেই বৃষ্টি খুব ভালো লাগে বিদীপ্তার। ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিজতে। তবে এই শহরে এসে সেসবের পাট চুকেছে ওর।আর তাছাড়া ঋতভাস একটু

অন্যরকম,এসব রোমান্টিসিজমের ত্রিসীমানার

বাইরে।


সারাটাদিন সাংসারিক কাজকর্মে কেটে যায় বিদীপ্তার। বিকেলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকে একমনে। হঠাৎ দমকা শ্রাবণের হাওয়া এসে লাগে ওর চোখে মুখে, সাথে উড়ো বৃষ্টি।আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না ও।ছুটে চলে যায় ব‍্যলকনিতে। ওপেন ব‍্যলকনি থেকে দুহাত বাড়িয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয় বৃষ্টির মাঝে। বৃষ্টির বেগ আরও বাড়তে থাকে।ওর ঋতভাসের সাথে বছরতিনেকের সংসার, ভালোবাসাহীন কৃত্রিম শারীরিক উষ্ণতা, সময়ের খেলায় একসাথে বেঁধে দেওয়া সম্পর্কের অযাচিত জুটি এসব যেন এক লহমায় অতীত হয়ে যায়।বিদীপ্তা ফিরে যায় মুহূর্তেই ইউনিভার্সিটি জীবনের শেষ দিনটিতে।


সেদিনও দ্বৈপায়ন আর বিদীপ্তা একসাথে ফিরছে

ইউনিভার্সিটি থেকে,আর পাঁচটা দিনের মতো। দুজনে খুব ভালো বন্ধু।একে অন্যের চাওয়া পাওয়া, ভালো লাগা মন্দ লাগা সব জানে। সেদিন প্রায় বিকেল,এমনই এক শ্রাবণের দিন। পরিষ্কার খোলা আকাশ হঠাৎই ঢাকতে শুরু করল গাঢ় অন্ধকারে। দমকা হাওয়ায় কিছু একটা উড়ে এসে পড়ল দ্বৈপায়নের চোখে। দুজনে রাস্তার পাশে একটা বড় গাছের নিচে সরে আসল। দ্বৈপায়ন চোখ থেকে ঐ অযাচিত উড়ো জিনিসটি বের করতে চেষ্টা করলেও কিছুতেই কাজ হলো না।


"দেখি,সর্!আমায় দেখতে দে।"


"আরে তুই পারবি না!"


"বকিস না তো! দাঁড়া দেখছি।"এই বলে বিদীপ্তা

দ্বৈপায়নের চোখটা ফাঁক করে আলতো ফু দিল। নিজের ওড়নাটায় মুখের গরম ভাপ নিয়ে দ্বৈপায়নের চোখে বেশ কয়েকবার ঠেকালো।


"ছাড়্, হয়েছে।গেলো মনে হয়, ব্যথাটা করছে না আর।"এই বলে দ্বৈপায়ন বিদীপ্তার হাতটা ধরতেই বিদীপ্তার চোখ আটকে গেল ওর দুই চোখে।


"কিরে?কি দেখছিস্ এমন করে?"


বিদীপ্তা বলে ওঠে,"তোর দুচোখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।"


দ্বৈপায়নের কাছে  বিদীপ্তার বলে ওঠা এই একটি লাইনেই বিদীপ্তার গোটা মনটা আরো অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হঠাৎ দ্বৈপায়ন আওড়ে ওঠে কয়েকটি লাইন, রবি ঠাকুরের:


"ভাষাহারা মম বিজন বেদনা

প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা

চিরজীবনেরই বাণীর বেদনা

মিটিল দোহার নয়নে....."


"এতদিন বলিস নি কেন?"বিদীপ্তা বলে ওঠে।


দ্বৈপায়ন বলে,"বলতে পারি নি বলে!"


এমন সময় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে। বড় গাছটার

পাতাগুলো সেই বৃষ্টির জল আর ধরে রাখতে পারে না। দুজনের গায়ে পড়তে শুরু করে। সম্বিত ফেরে ওদের। তাড়াতাড়ি করে দ্বৈপায়ন ছাতা বের

করতে যায় ব‍্য।গের থেকে। বিদীপ্তা বারণ করে, বলে:


"আজ দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।আজ তো আমাদের একসাথে বৃষ্টি ভেজারই দিন।"


দ্বৈপায়ন আর দ্বিমত না করে সায় দেয় ওর প্রস্তাবে।বিদীপ্তা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে দ্বৈপায়নের হাত। রাস্তায় নেমে দুজনে ভিজতে থাকে, অঝোরধারায়।


নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক পেরিয়ে ওরা দুজন এক নতুন সম্পর্কের দিগন্তে প্রবেশ করে।


কিন্তু এ সম্পর্কের সুখ ওদের বেশিদিন টেকেনি।

মাস দুয়েক পর হঠাৎই একদিন হার্ট অ্যাটাকে

দ্বৈপায়নের বাবা মারা যান। গোটা সংসার চালানোর বোঝা এসে পড়ে দ্বৈপায়নের কাঁধে।

তখনও মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরোয়নি। টিউশনের ওপর ভরসা করেই টেনেটুনে চলতে থাকে ও আর ওর মা এই দুজনের সংসার। তেমন আর আগের মতো সময় দিতে পারে না বিদীপ্তাকে।

অভিমান জমা বাঁধতে শুরু করে বিদীপ্তার মনে।

ইতিমধ্যে বিদীপ্তার বাড়ি থেকে একটা ভালো ছেলের খোঁজ পেয়ে যায়।বিদীপ্তা দ্বৈপায়নকে সে

কথা জানালেও একপ্রকার বেকার দ্বৈপায়নের ঐ মুহুর্তে বিদীপ্তার দায়িত্ব নেওয়া ছিল আদতেই অসম্ভব! আরো গাঢ় হয় দ্বৈপায়নের ওপর ওর অভিমান। একপ্রকার জেদের বশেই রাজি হয়ে যায় বিদীপ্তা,পারিবারিক সিদ্ধান্তে।


আজ এই ভেজা বৃষ্টি সব কিছু যেন এক ঝটকায় মনে করিয়ে দিল বিদীপ্তাকে। ইতিমধ্যে বিকেলের আকাশ বেয়ে নেমে এসেছে গাঢ় সন্ধ্যে। তবুও যেন ব‍্যলকনিটা আজ আর একটুও ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। এখন আবার কে এলো? এতো তাড়াতাড়ি তো ঋতভাস অফিস থেকে ফেরে না!


গেট খোলে বিদীপ্তা।


"একি তুমি?আজ এতো তাড়াতাড়ি?"


"হুমমম,আজ একটু তাড়াতাড়িই অফিস ছুটি হয়ে গেল।আর বিদীপ্তা, ইনি আমাদের অফিসে কয়েকদিন আগেই জয়েন করেছেন।অনেক দূরে বাড়ি।কাল সকালে আমাদের দুজনকে মুর্শিদাবাদে একটা কাজে যেতে হবে।ভোর পাঁচটার অফিসের গাড়ি আসবে।তাই উনি আজ রাতে আমাদের বাড়িতে একটু থাকবেন।" ঋতভাস এক নিঃশ্বাসে বলে যায়।


"সে তো বুঝলাম। কিন্তু সব কথা কি বাইরে দাঁড়িয়েই বলবে?"বিদীপ্তা বলে ওঠে।


"আসুন, ভেতরে আসুন।"ঋতভাস ওর কলিগকে ভেতরে ডেকে নেয়।


"জানো বিদীপ্তা, উনি বলছিলেন রাতটা কোনো হোটেলে কাটিয়ে দেবেন।আমিই একপ্রকার জোর করে ওনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে এলাম।"


"আচ্ছা, বেশ।যাও, তোমরা এবার ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি একটু চা আর টিফিনের ব‍্যবস্থা করতে যাই।"


"নিন্,এবার মাস্কটা খুলুন ভাই, আপনার সাথে আমার স্ত্রীর পরিচয়টা করিয়ে দি। তারপর না হয় ফ্রেশ হয়ে আসবেন।"


ঋতভাসের কথা মতো মাস্কটা উনি খুলতেই বিদীপ্তার চোখ আটকে যায় ঐ অতিথির মুখের দিকে।


"আলাপ করিয়ে দি," ঋতভাস বলে ওঠে,"উনি আমার স্ত্রী বিদীপ্তা আর ইনি দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।"


মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খুব চেনা দুটি মানুষ, মাঝখানে ব্যবধান তিন তিনটে বছর। বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল হঠাৎ, আবারো দুটি মন,ঠিক বছর তিনেক আগের মতো;অন‍্য দুটি চোখের আড়ালেই।








Comments

Popular posts from this blog

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024