অরণ্যের প্রতিশ্রুতি
প্রণব কুমার কুন্ডু
সন্ধ্যার আকাশে লাল আভা যখন ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকে, তখন গ্রামের সীমানায় অবস্থিত বিশাল অরণ্য যেন নিজের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে জেগে ওঠে। সূর্যের শেষ রশ্মি গাছের পাতার উপর দিয়ে হালকা সোনালি আভায় ছড়িয়ে পড়ে, এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি করে। অরণ্যটি ছিল গ্রামের লোকদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ঠিক যেন তাদের পুরনো এক বন্ধু। অরণ্য শুধু তাদের জীবিকা নয়, তাদের রক্ষাকবচও। গাছের ছায়া, পাখির গান, আর সবুজে ভরা অজস্র প্রাণী মিলে এখানে অদ্ভুত সাম্যতা তৈরি হয়েছিল।
গ্রামের লোকেরা প্রতিদিনের কাজ শেষে যখন অরণ্যের দিকে তাকাত, তাদের মন অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যেত। দিন শেষে ক্লান্ত শরীরে যখন তারা ঘরে ফিরত, অরণ্যের স্নিগ্ধ বাতাস তাদের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিত। এই অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করা, ফল-মূল তোলা, এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ নিয়ে আসা ছিল তাদের রোজকার কাজ। অরণ্য তাদের অভয়ারণ্য, যেখানে দুঃখ-দুর্দশার ছায়া পড়ে না। কিন্তু সময়ের প্রবাহে, তাদের এই প্রিয় অরণ্য ঘিরে বিপদ দানা বাঁধতে শুরু করে।
শহরের দৃষ্টি পড়ল অরণ্যের ওপর। বড় ব্যবসায়ী আর আধুনিক স্থাপত্যের কারিগরদের চোখ পড়ল। একদিন, একজন ধনী ব্যবসায়ী গ্রামে এসে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। "আপনারা জানেন, এই অরণ্য যদি কেটে ফেলা হয়, তবে এখানে বড় বড় দালান-কোঠা গড়ে তোলা যাবে। আধুনিক রাস্তা হবে, নতুন নতুন কাজের সুযোগ হবে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে যাবে। আপনারা শুধু এই সুযোগটা নিন," তিনি তাদের বোঝাতে লাগলেন।
গ্রামবাসীরা তাঁর কথায় হতবাক হল। এতকাল ধরে তারা অরণ্য থেকে যা পেয়েছে তাতে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু আধুনিক জীবনের প্রলোভন, আর তার সঙ্গে ব্যবসায়ীর কথার মাধুর্য, তাদের বিভ্রান্ত করল। কিছুদিন গ্রামে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলল। গ্রামবাসীদের মাঝে মতভেদ দেখা দিল। কিছু লোক ব্যবসায়ীর প্রস্তাবে রাজি হল, আর কিছু লোক দ্বিধাগ্রস্ত রয়ে গেল।
গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি দীনেশ মশাই চুপচাপ সব শুনলেন। তিনি জানতেন, অরণ্য শুধু তাদের জীবনযাত্রার অংশ নয়, এটা তাদের ইতিহাস, তাদের পরিচয়। তিনি গ্রামবাসীদের সতর্ক করতে চাইলেন, কিন্তু গ্রামের তরুণ প্রজন্ম ব্যবসায়ীর প্রলোভনে পড়ে গেল। "আমাদের ভবিষ্যতের জন্য উন্নতি দরকার," তারা বলল। "আধুনিক শহরের সুবিধা পেলে আমরা উন্নত জীবন পাব।" তাদের কথা শুনে গ্রামবাসীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। অরণ্য থেকে পাওয়া সেই স্নিগ্ধ বাতাস, পাখিদের গান, মাটির সুগন্ধ—সবই যেন তারা ভুলতে বসল।
দীনেশ মশাই গ্রামবাসীদের ডেকে বললেন, "তোমরা যদি অরণ্য নষ্ট করতে চাও, তবে একবার ভেবে দেখো, আমরা কী হারাব। আমাদের জীবনযাত্রার মূলভিত্তি এই অরণ্য। একে রক্ষা করতে না পারলে, ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানেরা কী নিয়ে বাঁচবে?" কিন্তু যুবকেরা তাঁর কথায় তেমন গুরুত্ব দিল না। আধুনিক জীবনের মোহ তাদের আচ্ছন্ন করল। গ্রামের বাকিরাও মনে করল, একটু উন্নত জীবন পেলে মন্দ হবে না।
অরণ্য কেটে ফেলার কাজ শুরু হল। প্রথমে গাছগুলো কাটা শুরু হল, তারপর মাটি খুঁড়ে শিকড়গুলো তুলে ফেলা হল। ক্রমে ক্রমে অরণ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা খালি হতে লাগল। গাছগুলোর পতনে অরণ্যের প্রাণীরা উদ্বিগ্ন হল। তারা তাদের বাসস্থান হারাচ্ছিল, আশ্রয়ের অভাবে নতুন করে জীবন যাপনের চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পাখিরা তাদের ছোট্ট বাসাগুলো নিয়ে দূরে উড়ে গেল, হরিণেরা অস্থির হয়ে দৌড়াতে লাগল।
দিন গড়িয়ে মাস গেল, শহরের লোকেরা আসতে থাকল। তাদের হাত ধরে এল মেশিন, যন্ত্রপাতি, আর বড় বড় ট্রাক্টর। অরণ্য একসময় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেল, তার জায়গায় তৈরি হতে লাগল বড় বড় দালান, রাস্তা, আর মেটালিক স্থাপত্য। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের শান্তি ও স্থিতিশীলতা হারিয়ে যেতে লাগল।
প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার অভ্যাস আছে। একদিন সন্ধ্যায়, যখন গ্রামে মেঘ জমেছিল, গ্রামের লোকেরা দেখল আকাশের অদ্ভুত এক কাণ্ড। কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে, হাওয়া বইছে দ্রুত। একটু পরেই শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। অরণ্য তো আর ছিল না, তাই পাহাড়ের মাটি ধসে গ্রামের দিকে নেমে এলো। গ্রামের প্রায় অর্ধেক অংশ মাটির নিচে চাপা পড়ে গেল। যারা বাঁচল, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। তারা ভাবল, এত বড় বিপদ এল কোথা থেকে?
দিনের পর দিন বৃষ্টি হলো, জলের স্তর ক্রমশ বাড়ল। গ্রামের পুরোনো কাঁচা বাড়িগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করল। মাটি ধসিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গ্রামের কিছু অংশ টিকে থাকল শুধুমাত্র পুরোনো কিছু গাছের জন্য, যারা তাদের শিকড় দিয়ে মাটি আঁকড়ে রেখেছিল। সেই গাছগুলোই মাটি ধরে রাখার শেষ আশ্রয় হয়ে দাঁড়াল।
যে মুষ্টিমেয় গাছ বেঁচে ছিল, তাদের যেন এক অলৌকিক শক্তি কাজ করল। বুড়ো দীনেশ মশাই, যিনি গ্রামবাসীদের সতর্ক করেছিলেন, সেই বাকি গাছগুলোর কাছে গিয়ে তাদের সেবা করতে লাগলেন। তিনি গাছের পাতায় জল ছিটিয়ে বললেন, "তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমরা ভুল করেছি। তোমরা আমাদের প্রাণ বাঁচাও, তোমাদের ফেরানো আমাদের একমাত্র উপায়।"
গাছগুলো যেন সেই প্রার্থনা শুনল। কিছুদিন পর বৃষ্টি থেমে গেল, জলের স্তর নামতে শুরু করল। গ্রামবাসীরা অবাক হয়ে গেল। তারা ভাবতে শুরু করল, এই গাছগুলোর মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? তাদের জীবনের এই নতুন শুরুর জন্য তারা গাছের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করল।
গ্রামবাসীরা প্রতিজ্ঞা করল, এবার থেকে তারা কখনও প্রকৃতির সঙ্গে বৈরিতা করবে না। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখেই তাদের জীবনযাত্রা সুখের হতে পারে। বুড়ো দীনেশ মশাই গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে বললেন, "প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখেই তোমরা জীবনের উন্নতি করতে পারবে। আধুনিক জীবন গাছ কেটে অর্জন করা যায় না, প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়।"
বছর ঘুরতেই অরণ্য আবারও সবুজ হয়ে উঠল। গাছেরা ছায়া দিতে লাগল, বাতাসে আবারও সেই প্রাচীন শীতলতার পরশ ফিরে এল। গ্রামের বাতাসে মাটির গন্ধ ফিরল, পাখির গান শোনা যেতে লাগল। যে সবুজের অভাব গ্রামের মানুষ অনুভব করছিল, তা যেন আবার ফিরে এল। অরণ্যের মাটি শক্ত হয়ে দাঁড়াল, ঝড়-বৃষ্টির সঙ্গে মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করল।
তবে শুধু অরণ্যই নয়, গ্রামবাসীদের মধ্যে এক নতুন বোধের জন্ম হলো। তারা অনুভব করল, প্রকৃতি তাদের অংশ, এবং এর ক্ষতি করলে তার প্রতিক্রিয়াও ভয়াবহ হতে পারে। তারা বুঝতে পারল যে প্রকৃতির দান কেবল নেয়ার নয়, তাকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্বও মানুষের।
গ্রামের পুরোনো ঐতিহ্যগুলো আবারও ফিরে আসতে লাগল। উৎসবের সময়, অরণ্যের গাছগুলোকে সজ্জিত করে রাখার রীতি আবার ফিরিয়ে আনা হল। পাখির বাসার দিকে নজর রেখে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হল, যেন তারা নিরাপদে থাকতে পারে। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল যে শুধু নিজের লাভের জন্যই কাজ করা উচিত নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা সবার দায়িত্ব।
এক ভ্রমণকারী একদিন গ্রামে এসে পৌঁছাল। গ্রামের মাটির পথে হাঁটতে হাঁটতে সে চারপাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হল। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা সবুজের ছোঁয়া, গাছের ছায়া, আর বাতাসে মিশে থাকা মাটির গন্ধ যেন তার মনকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি গাছ যেন কোনো না কোনো গল্প বলছে। সে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে দেখা করতে চাইল, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিল।
গ্রামে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ল, কাঁচা রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। পাখিরা গাছে গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে, আর বাতাসে তাদের মিষ্টি গান শোনা যাচ্ছে। ভ্রমণকারী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য উপভোগ করল। বাতাসে একটি নিঃশব্দ নৃত্য চলছিল, পাতা ও পুষ্পের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণীরা যেন নিজেদের জীবনযাত্রা নিয়ে ব্যস্ত। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ এবং মাঝে মাঝে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়া শুকনো পাতার আওয়াজ এক ধরনের মায়াবী অনুভূতির সৃষ্টি করছিল।
এরপর সে গ্রামের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলল, যারা অরণ্যের ইতিহাস জানতেন। প্রবীণরা তাকে তাদের জীবনের গল্প শোনালেন—কীভাবে এই অরণ্য তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, আর কীভাবে তারা একসময় ভুল করে অরণ্য ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। তারা বললেন, "আমাদের অরণ্য একসময় খুব বিপদে পড়ে গেছিল, আমরা বুঝতেই পারিনি কী ভুল করছিলাম। কিন্তু প্রকৃতির দয়ায় আমরা আবার সেই ভুল শুধরে নিতে পেরেছি।"
ভ্রমণকারী সেই গল্প শুনে আবেগে আপ্লুত হল। সে গ্রামের মানুষের চোখে অরণ্যের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দেখল। গ্রামের প্রতিটি মানুষ যেন অরণ্যকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে, তার প্রতি যত্নশীল। ছোট্ট শিশুরা গাছের নিচে খেলছে, আর বয়স্করা গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছে—এমন দৃশ্য দেখে ভ্রমণকারীর মনে হল, সে যেন এক অন্য জগতে এসে পড়েছে, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যে এক অপূর্ব বন্ধন আছে।
ভ্রমণকারী গ্রামে আরও কিছু দিন কাটাল। প্রতিদিন সে নতুন কিছু শিখতে লাগল। সকালে যখন গ্রামের মানুষরা ঘুম থেকে উঠত, তখন তারা প্রথমেই অরণ্যের দিকে তাকাত। তারা জানত, তাদের দিন শুরু হয় অরণ্যের আশীর্বাদ নিয়ে। গ্রামের লোকেরা অরণ্যের প্রতিটি অংশকে গুরুত্ব দিত, এমনকি ক্ষুদ্র পোকামাকড়দেরও রক্ষা করার চেষ্টা করত। ভ্রমণকারী দেখল, গ্রামের শিশুরা পর্যন্ত অরণ্যের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা নিজেদের হাতে গাছ লাগানোর আনন্দ উপভোগ করে, আর মাটির সঙ্গে খেলে। সেই শিশুদের মধ্যে কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতির মোহ ছিল না, তারা প্রকৃতির সঙ্গেই বড় হচ্ছে।
একদিন বিকেলে, ভ্রমণকারী গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ সে দেখতে পেল, কিছু গ্রামবাসী অরণ্যের মাঝে বসে আছে। তাদের চারপাশে কিছু গাছের চারা রাখা, আর তারা সেই চারাগুলো রোপণ করছে। ভ্রমণকারী কাছে গিয়ে জানতে চাইল, তারা কী করছে। এক যুবক বলল, "আমরা নতুন গাছ লাগাচ্ছি, যাতে অরণ্য আরও সবুজ হয়ে ওঠে। আমরা বুঝেছি, অরণ্য আমাদের বাঁচিয়েছে, এখন আমাদের দায়িত্ব তাকে আরও শক্তিশালী করা।"
ভ্রমণকারী এই কাজ দেখে মুগ্ধ হল। সে ভাবতে লাগল, কীভাবে আধুনিক জীবনের প্রলোভন থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামবাসীরা নিজেদের প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। সে মনে মনে ভাবল, "এটাই তো প্রকৃত উন্নতি। আমরা আধুনিকতার নামে যে ধ্বংস করছি, সেই ধ্বংসই আমাদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছে। এই গ্রামের মানুষরা প্রকৃতির প্রকৃত রূপ বুঝতে পেরেছে।" তার মনে হল, এই গ্রাম থেকে সে যে শিক্ষা নিচ্ছে তা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তার।
গ্রামে কাটানো এই ক'দিনের অভিজ্ঞতা ভ্রমণকারীকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সে তার নোটবুকে লিখল, "এই গ্রামের মানুষরা আমাদের জন্য এক বড় শিক্ষা। আমরা আধুনিকতার নামে যা কিছু করছি, তা প্রকৃতির উপর এক নীরব আঘাত। কিন্তু এই গ্রামে এসে আমি শিখেছি, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকাই আসল শান্তি। প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে।"
ভ্রমণকারী যখন গ্রাম থেকে বিদায় নিল, তখন সে প্রতিজ্ঞা করল, সে এই শিক্ষা পৃথিবীর আরও মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। সে তার বন্ধুদের, সহকর্মীদের এবং পরিবারের সঙ্গে এই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে। সে বলল, "আমাদের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা তখনই আসে যখন আমরা প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে থাকি। অরণ্য আমাদের শুধু জীবন দেয় না, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সুন্দর করে তোলে।"
তার এই প্রতিজ্ঞা শুধু তার নিজের জীবনেই নয়, শহরের মানুষের মনেও দাগ কাটল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতিকে ছাড়া জীবন কতটা অর্থহীন। তারা ঠিক করল, নিজেদের শহরেও একইভাবে প্রকৃতির সুরক্ষা করতে হবে। তারা গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিল, নতুন গাছের যত্ন নেওয়ার পরিকল্পনা করল, আর পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য নানা কর্মসূচি হাতে নিল। শহরের মানুষেরা প্রথমে যে সকল গাছকে উপেক্ষা করেছিল, তারা তাদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করল। নতুন উদ্যমে তারা একতা বজায় রেখে সেই গাছগুলোকে রক্ষা করতে উদ্যোগ নিল।
অন্যদিকে, গ্রামে ফিরে আসা ভ্রমণকারীর অনুপ্রেরণায় গ্রামের মানুষরা আরও সতর্ক হয়ে গেল। তারা নতুন উদ্যমে অরণ্যের যত্ন নিতে লাগল। তারা জানত, এই অরণ্য তাদের জীবন রক্ষা করেছে, আর তারা তা কখনও ভুলবে না। গ্রামের মানুষরা অরণ্যকে ঘিরে নানা উৎসবের আয়োজন করল। পাখির বাসার দিকে তারা আরও যত্নবান হলো, তাদের খাবার ব্যবস্থা করতে থাকল। গ্রামের শিশুদেরও অরণ্যের সুরক্ষা সম্পর্কে শেখানো হলো, যেন তারা বড় হয়ে এই অরণ্যকে আরও ভালোভাবে রক্ষা করতে পারে। শিশুরা প্রথমবার অরণ্যের অভ্যন্তরে রোপণ করা গাছগুলোর ফুল ফুটতে দেখল, এবং তাদের মুখে খুশির ঝিলিক ধরা পড়ল।
গ্রামের মানুষের এই প্রচেষ্টা শুধু তাদের জীবনেই নয়, আশেপাশের গ্রামের মানুষদেরও উদ্বুদ্ধ করল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা বজায় রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উদ্যমে তারা নিজেদের গ্রামেও গাছ লাগাতে শুরু করল। তাদের মধ্যে প্রকৃতির প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ জন্ম নিল।
ভ্রমণকারীর ফিরে যাওয়ার পরেও গ্রামে নতুন নতুন মানুষ আসতে থাকল। তারা এসে বুঝতে পারল, এই গ্রাম শুধু একটি নির্দিষ্ট স্থান নয়, এটি একটি জীবন্ত উদাহরণ যে কিভাবে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করা যায়। শহরের কোলাহল থেকে দূরে এসে তারা এখানে প্রকৃতির অমোঘ শক্তি এবং জীবনের সত্যিকারের মানে খুঁজে পেল। গ্রামবাসীদের আন্তরিকতা, তাদের অরণ্যের প্রতি ভালোবাসা এবং প্রকৃতির প্রতি তাদের অটুট বিশ্বাস দেখে শহরের মানুষদের হৃদয়েও পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল।
গ্রামটি একসময় আড়ালে ছিল, কিন্তু এখন এক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও এই গ্রামের অনুপ্রেরণায় নিজেদের অরণ্য রক্ষার উদ্যোগ নিতে শুরু করল। তারা বুঝতে পারল, প্রকৃতির সুরক্ষাই তাদের ভবিষ্যৎকে নিরাপদ রাখার একমাত্র উপায়। গ্রামটি ধীরে ধীরে একটি প্রতীক হয়ে উঠল—একটি প্রতীক যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি একত্রে সহাবস্থান করতে পারে, যেখানে অরণ্য শুধু জীবিকা নয়, জীবনকেও পূর্ণতা দেয়।
No comments:
Post a Comment