অচেনা অতিথি - শচীদুলাল দাস || Ochena Atithi - Sajhidulal Das || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story
অচেনা অতিথি
শচীদুলাল দাস
বাইরের দরজাটা হাট করে খোলা। বুকটা ধড়পড় করে উঠল। কি হলো? তাহলে কি সব চুরি হয়ে গেছে? টাকা পয়সা!গয়নাগাঁটি সবকিছু! খারাপ কিছু ভেবে আস্তে আস্তে দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
মানব জীবনে সম্পদের প্রতি টানটা খুব সহজাত। সবাই তা আগলে রাখার লড়াই করে চলেছে প্রতিনিয়ত। রোজগারের সাথে সম্পদ বাড়ানোর ইঁদুর দৌড়ে দৌড়াচ্ছে সবাই। কেউ কেউ দারুন ভাবে সফল। আবার কেউ কম সফল হয়ে হতাশায় দিন কাটায়। কিন্তু একটা সময় এসবের কোন প্রয়োজন হবে না,সবকিছু তেমনি থাকবে পড়ে - খালি হাতে বিদায় নিতে হবে এই ধরাধাম থেকে। তবুও আকাশের চাঁদকে ধরতে, অনিশ্চিয়তার বন্ধুর পথে অন্ধকারে হাতড়ে চলছে সবাই।
অরিন্দম দাস অবসর নেওয়ার পর, গ্রামের জায়গা জমি ভাইদের দেখাশোনার ভার দিয়ে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন কয়েক বছর ধরে।একমাত্র মেয়ে মধুপর্ণাও পড়াশোনা বেড়ে ওঠা এইখানে।সে ছাত্র- জীবনের এক সফল সৈনিক।সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত। বেতন কাঠামো ও মনের মত। এখন মা বাবাকে ছেড়ে একাই থাকে সেখানে।
প্রায় দেড় দু মাস হলো অরিন্দমবাবু স্ত্রী অপর্ণাকে নিয়ে মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে গেছেন। সেখান থেকে কন্যাকুমারী, পণ্ডিচেরী বেড়াতে যাবেন। মেয়ে ভালো টুরিস্ট কোম্পানির সাথে সব ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করে রেখেছে। পণ্ডিচেরীর শান্ত- স্নিগ্ধ সাগরবেলা, ভারতীয় সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম আর অরোভিল নগরের মানব ঐক্যের জীবন্ত দৃষ্টান্ত তাদেরকে বড়ো মুগ্ধ করে।সেখান থেকে ফিরে কয়েকদিন মেয়ের কাছে জিরিয়ে নেবেন, তারপর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ফিরবেন। এবারে মেয়ে এলে সবাইকে নিয়ে গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে যাবেন।
অনেকদিন পর মেয়ে বাড়ি ফিরছে। ফ্লাইটটা কলকাতার মাটি স্পর্শ করতেই যে আনন্দটা ছিল,তা যেন হটাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। এ আবার এক উটকো ঝামেলা!
কিন্তু একি কান্ড! ড্রয়িং রুম পেরোতেই মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিক আছে।
মধুপর্ণা মাকে নিয়ে, এক নিঃশ্বাসে সবগুলো ঘরের তালা খুললো। আসবাব, জিনিসপত্র কোন কিছুর কোনো নড়চড় নেই। যেমনটি রেখে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনই আছে। অরিন্দমবাবু চটকরে আলমারী খুলে লকারটা দেখলেন। সবই ঠিক আছে। সবাই অবাক হলেন! তাহলে?
কতকগুলো রহস্যময় ‘তাহলে’ তাদের মনে খোঁচা দিতে লাগলো বারবার।
সবাই যখন তাহলের রহস্যে ঘরের ভিতরে গভীর চিন্তায় ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক যুবক বড় একটি পিঠের ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বড় সাইজের একটি খাম।
স্যার বলে ডাক দিতেই অরিন্দমবাবু বেরিয়ে এলেন। হাতে খামটা দিয়ে, সবিনয়ে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে গট গট করে বেরিয়ে চলে গেল।
আপনি কে? কিসের খাম?
দাঁড়ান! কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
চটজলদি ফোনটা নিয়ে সিকিউরিটিকে ফোন করে, ছেলেটিকে আটকাতে বলেন।
নামতে নামতে থানায়ও ফোন করেন।
মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে অরিন্দমবাবু সিকিউরিটির কাছে পৌঁছালেন। ছেলেটি নির্বিকার!অবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের দেখে আবারও হাতজোড় করে নমস্কার জানাল। সিকিউরিটি জিগ্যেস করলো, “উনি কি আপনাদের আত্মীয়”?
না! “এ আমাদের কেউ নয়”!
এর মধ্যেই থানা থেকে গাড়ী এসে গেছে।
অফিসার বলেন, “এখান থেকে কে যেন ফোন করছিলেন”?
অরিন্দমবাবু বলেন, “আমি ফোন করছিলাম স্যার। দিয়ে ঘটনাটা আদ্যপান্ত বলেন”।
সবশুনে অফিসার বলেন, “আপনারা বাড়ীতে ভালো করে সবকিছু দেখুন, তারপর সন্ধ্যায় থানায় আসুন।আমাদের আরও একটা কল আছে। ছেলেটাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা না বলা পর্যন্ত ছাড়া হবে না”।
অস্বস্তি যেন কাটলো! পুলিশের রুলের ঘায়ে ঠিক সব বেরিয়ে যাবে। একরাশ স্বস্তি নিয়ে, তারা ঘরে ফিরলেন।তবুও ব্যাপারটা মনের ভিতরে যেন কিছু প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে।
এসে ড্রয়িং রুমে ঢুকলেন। বিছানাটা কেমন এলোমেলো। আলনায় বেশ কিছু জামা প্যান্ট ছিল, সেগুলো নেই।পাশে প্লাস্টিকের ডাস্টবিনে কিছু পার্সেল খাবারের প্যাকেট, দেশলাই কাঠি, পোড়া সিগারেটের টুকরা ছাড়া আর কিছু নেই। এরপর বাথরুমে গেলেন। তাদের জিনিসপত্র গুলো একদিকে সুন্দর করে গোছানো। গামছা একটা শুকছে। আর কোনোকিছুর কোন পরিবর্তন নেই।রহস্য যেন আরও ভাবিয়ে তুললো।
তারপর হাতে হাত রেখে চললো ঘর গোছানোর পালা। বিছানাপত্র ঝাড়াঝাড়ি হল। দেরী দেখে, কুকারে ভাতে ভাত বসিয়ে খাওয়া দাওয়া হল। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে মনের খুঁত-খুঁতানি কিছুতেই যাচ্ছে না। আবার সারা ঘরের আসবাব, গয়না, টাকা পয়সা সব মিলানো হল। তেমন কিছু হেরফের নেই। প্রায় সবই ঠিক আছে। তাহলে পুলিশের কাছে কিসের নালিশ করবেন?
শুধুমাত্র সামনের গেটে তালাটি ভাঙা। তার পরিবর্তে গোদরেজর একটি নতুন তালা রাখা। তাহলে ব্যাপারটা কি?
বিকালে চায়ের টেবিলে মধুপর্ণা মনে করলো, “বাপি! ছেলেটা একটা খাম দিয়েছিলো না”?
“হ্যাঁ রে! একদম ভুলে গেছি। সেটা ড্রয়িং রুমে বেডের নীচে রাখলাম মনে হয়। দাঁড়া নিয়ে আসছি। খামটা বেশ ভারী তো!কি আছে ওর মধ্যে? কে জানে”!
খাম খোলা হল। তাতে এল, আই, সি থেকে পাঠানো অরিন্দমবাবুর দুটো চিঠি। দশ হাজার টাকা ও হিন্দিতে লেখা একটি চিঠি।
তাহলে কি ওই চিঠিতেই এই রহস্যের চাবিকাঠি? দেখাযাক!
মধুপর্ণা বাবার হাত থেকে চিঠিটা চিলের মত ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। দিয়ে পড়তে শুরু করল। তার বাংলা করলে এমন হয় –
শ্রদ্ধেয় স্যার নমস্কার নেবেন। আমি যশপাল যাদব। বিহারের পাটনার কাছে একটি ছোট্টো শহরে আমার বাড়ী। আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের লাস্ট ইয়ারের ছাত্র। ইন্টার্নশিপে একমাস পাঁচ দিনের জন্য কলকাতায় পাঠানো হয়। আমি কলকাতার বিশেষ কিছু জানিনা। নাম শুনেছি মাত্র, আগে কোনদিন আসিনি।থাকার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে হন্যে হয়ে গেলাম, কিছু পেলাম না। যে সব ঘরের খবর পেলাম তা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি অতি সাধারণ বাড়ীর ছেলে। দু রাত্রি শিয়ালদা স্টেশনে কাটিয়েছি। ভবঘুরের মত রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে এই ফ্ল্যাটটায় এলাম। দরজায় টোকা দিলাম, কোন উত্তর নেই। তারপর দেখি সামনে তালা। সিকিউরিটির কাছে আপনাদের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আপনাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম। শুনলাম দুমাসের জন্য বাইরে গেছেন। বেরিয়ে গেলাম। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসল। আগেই লিখেছি আমি খুব দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি। বাড়ীতে ছোট্টো একটা তালা সারাই ও নতুন তালার দোকান। বাবা দেখাশোনা করেন। আমি অবসর সময়ে সঙ্গ দি। তালা ভাঙা বা খোলার কাজে সিদ্ধহস্ত। বাইরে থেকে একটি নতুন তালা কিনে ফিরে এলাম। সিকিউরিটিকে বলি উনারা ডুপ্লিকেট চাবি রেখে গিয়েছিলেন। উনারা না আসা পর্যন্ত, আমাকে বাইরের ঘরটায় থাকতে বলেছেন। আমার নাম, ঠিকানা, ফোন নং নিয়ে ছেড়ে দেয়। আমি সামান্য বকসিসও দি।আর কোনদিন আটকায় নি। আমি প্রায় একমাস যাবৎ আপনাদের বাইরের ঘরটিতে আছি। অন্য কোনদিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করিনি। বন্ধুরা আসতে চাইলেও বারণ করি। বলি এক পরিচিতর ঘরে আছি, তাঁরা পছন্দ করেন না। গতকাল স্টাইফেন্ড বাবদ কুড়ি হাজার টাকা পেয়েছি। আপনার ঘর ভাড়া, ইলেকট্রিক ও অন্যান্য খরচ বাবদ দশ হাজার টাকা রেখে গেলাম।এই অধমের স্পর্ধা ক্ষমা করবেন।
নমস্কারান্তে
যশপাল যাদব
সবাই হতবাক! প্রায় দশ মিনিট কেউ কথা বলেনি। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্ট। মধুপর্ণা ডান হাতে চিঠি, বাম হাত গালে দিয়ে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে। অপর্ণাদেবীর কথায় নীরবতা ভাঙলো। স্বামীর উদ্দেশে বললেন, “তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে ছেলেটাকে ছেড়ে দাও। আমাদের মধুও ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে বাসার জন্য কি হয়রানি টা পেয়েছিলো, মনে আছেতো”!
একটু থেমে দম নিয়ে অরিন্দমবাবু বললেন,
“আত্মীয় নয়! অথচ নিকট আত্মীয়ের চেয়েও ভালো কাজ করে একমাস যাবৎ ঘরটাকে পাহারা দিয়ে গেল। এর চেয়ে বড় আত্মীয় আর হয় না। ছেলেটা অনায়াসে পালিয়ে যেতে পারতো কিন্তু সে তা করেনি। সে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। এটাই মনুষ্যত্ত্ব বিকাশের মানদণ্ড। বর্তমান সমাজে যা বিরল”।
চটজলদি করে অরিন্দমবাবু প্যান্টটা গলিয়ে, মেয়েকে তৈরী হতে বললেন। ট্যাক্সিতে করে থানায় পৌঁছলেন। ছেলেটটার হাতে হাতকড়া। তাদের দেখে ক্ষমার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্ষুধা,তৃষ্ণায় চোখ মুখ বসে গেছে। হয়তো থানায় সকাল থেকে কিছু খেতে দেয়নি। অরিন্দমবাবুর পিতৃত্বের প্রদীপটা কেউ যেন উসকে দিল। চোখের কোনে টলটলে জল।
বললেন, “ওর বিরুদ্ধে আমাদের আর কোন অভিযোগ নেই। কোন ডাইরি লিখবেন না। ওকে ছেড়ে দিন”।
ছাড়া পেয়ে ছেলেটা অরিন্দমবাবু কে প্রণাম করলো।ক্ষুধা, তৃষ্ণা উপেক্ষা করে মুক্তির উল্লাসে সে বিহ্বল,যেন পিঞ্জর থেকে মুক্তি পাওয়া মুক্ত বিহঙ্গ।
বাইরে নিয়ে গিয়ে অরিন্দমবাবু তাকে ধোসা, চাউমিন খাওয়ালেন।ছেলেটি ক্ষুধায় গো গ্রাসে গিলে যাচ্ছে। তার দশ হাজার টাকা ফেরত দিলেন। সাথে আরও দুহাজার টাকা দিলেন। বাড়ীর জন্য কিছু নিয়ে যেও। কলকাতায় যদি কখনো আসো তবে আমার বাড়ীতে উঠবে। মনে থাকে যেন। তোমার জন্য দরজা খোলা থাকলো। সে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল।
মনে হল, পরিচিত না হয়েও বুদ্ধি ও সু ব্যবহারে মনের সব গ্লানি জয় করে, এক অভিনব পরিচয় রেখে গেল।যা হয়তো স্মৃতির পাতায় হেসে খেলে বিচরণ করবে আজীবন।
Comments