রম্যরচনা || তাড়ির কড়চা || অরবিন্দ সরকার
তাড়ির কড়চা
কান্দি থানার একেবারে শেষের গ্রাম পলশী। গ্রামের পরেই বিল তেলকর।বন্যায় বর্ষায় ফসল হয়না তবে গ্রামে বন্যার জল প্রবেশ করে না।
বছরে তখনকার দিনে একবারই ফসল হতো।আমন ধান বৃষ্টির জলে উঁচু জমিতে। বন্যায় ডুবে যাওয়া জমিতে খেসারি, মসুর, মটরশুঁটি, ইত্যাদি চাষ হতো।
জানকি মন্ডলের ছেলে তারাপদ তালগাছে তাড়ির চাষ করে।হালে বিয়ে হয়েছে জামনা নামক গ্রামে। মানুষের চৈত্র বৈশাখ মাসে কাজ থাকে না।তাই অভাব লেগেই থাকতো সেসময়। গাছের তাড়ি খেয়েই তাদের উদর পূর্ণ হতো।কচুর শাক, লতাপাতার তরকারি ইত্যাদি সহযোগে তাড়ি সেবা হতো।কেউ কেউ বিল কাঁকড়া, কাদামাছ ধরে রান্না করতো,অথবা মরাবিলে গুগলি শামুক ঝিনুক খাদ্য।
তালের গাছের মালিক কিন্তু মোড়লেরা। তাদের জমির আইলে, পুকুর পাড়ে প্রচুর তালের গাছ। মোড়লের ছেলেরা তেল মেখে চান করার সময় ওদের বাড়িতে বাড়িতে তাড়ি খেয়ে চুপিসারে নিজবাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে ঘুম।কেউ কেউ বাড়ি ফিরতো না। মুড়ি গামছায় বেঁধে নিয়ে তাদের দিত ও তাড়ি খেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে ওদের বৌয়ের সঙ্গে একটু মেশা মিশি করতো।
সেদিন তারাপদ মাঠ থেকে শামুক গুগলি এনে তার বৌকে বললো এগুলো বেছে রান্না করো। আমি গায়ের কাদা ধুয়ে চান করে পরিষ্কার হ'য়ে আসি।
চান করে গোয়াল ঘরে ঢুকে চক্ষু চড়কগাছ। হ্যাঁ গো ভাগু ! (ভাগ্যবতী নাম) বাড়িতে কে এসেছিল? তাড়ির ভাঁড় যে শুন্য।
ভাগু বললো - তুমি তো না শুনেই চান করতে দৌড়ালে? বলি কি যাদের তাড়ি তারায় খেয়েছে?
তারাপদ তাকে তারু বলেই সবাই ডাকে ? তারু পেটের খিদে তার উপর ওর নাম বলছে তাড়ি!
একটা গরু চড়ানো পাঁচন দিয়ে পিঠে দুই সাট্ । পাঁচন দিয়ে আঘাতকে সাট্ বলে।
ভাগা শালীর বিটি শালী! কে খেয়েছে আর একবার বল্ ?
ভাগু- বললাম তো যাদের তাড়ি তারায় খেয়েছে তুমি জানকি?
এবার তারু পাঁচন নিয়ে ঘা মেরেই যায়।বলে শালি আমার নাম করছিস্ আবার আমার বাবার নাম করছিস্ জানকি? তোর একদিন কি আমার একদিন। এভাবে ভাগুকে মেরেই চলেছে।ভাগু হাত পা ছড়িয়ে উঠোনে পড়ে গেলো! পাড়াময় লোক ছুটে এসে ভাদুকে চেপে ধরে।যেন আর আঘাত না লাগে।
এবার তারাপদ চেঁচিয়ে বললো - নষ্টা মেয়ে।সবাই মিলে তোকে চেপে ধরছে আর তুই মজা লুঠছিস্ ? পাড়ার লোকেরা তারাপদর পাঁচন কেড়ে নিয়ে সপাটে গালে চড় থাপ্পর মারতে লাগলো।
তারাপদ- তোমাদের কে ডেকেছে আমার বাড়ীতে? বেরোও বাড়ী থেকে?
এক পড়শি বললো কেন মারছিস্ তোর বৌকে? খাওয়াবার ক্ষমতা নাই তার উপর মার।
তারাপদ- তোমরা জান ও আমার নাম বলছে আবার আমার মড়া বাবা জানকীর নাম তুলছে? স্বামীর নাম কেউ করে? না শ্বশুরের নাম করতে আছে? ওকে জিজ্ঞাসা করো।
ভাগু আধমরা হয়ে পড়ে আছে।ওকে সবাই তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো - মা বলতো কি হয়েছে?
তখনই তারাপদ চেঁচিয়ে বললো বল শালী কে খেয়েছে?
ভাগু - তারস্বরে বললো , কতবার বলবো তোমাকে যে যাদের তাড়ি তারায় খেয়েছে? তুমি জান কি?
তারাপদ - এবার মারতে উদ্যত হ'লে সকলে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
সকলেই বললো - তাড়ির নামের সঙ্গে তারাপদ নামের মিল নাই।আর তোমার মরাবাবা এখানে নাই।সে সগ্গে গেছে। জানো - কি? এর সঙ্গে জানকির অনেক তফাৎ।
ভাগু এবার সবার কাছে বললো আমি আর এর ভাত খাবো না! আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো! সকলের নিষেধ অমান্য করে ভাগু বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এলো।
তারু তাড়াতাড়ি ওর পায়ের কাছে পড়ে বললো - আমার ভাত খাবিনা বলছিস্ ? ভাত তো দিতেই পারি না! তুই আমার কাছে সালুন খেয়েই থাক্। ভাগুর পা আর ওঠে না! চেপে ধরা আছে।
ভাগু- ছিঃ ছিঃ! তুমি স্বামী! আমার পায়ে হাত দিলে যে আমি মহাপাতকিনী হবো। ঠিক আছে আমি আর যাবো না। তোমারই থাকবো।
Comments