গল্প || আমি পাহাড়িয়া মেয়ে || নীতা কবি মুখার্জী

আমি পাহাড়িয়া মেয়ে



আমি ধনিয়া। কাশ্মিরের পাহাড়িয়া অঞ্চলের একটা ছোট্ট পার্বত্য-গ্ৰামের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। বাবা রামহরিহর দাস, মা লছমী। দুটো ছোট ভাই আছে সুকুর আর মুকুর। কষ্টের স্ংসার, কোনো রকম দিনগত পাপক্ষয় করে চলে যায়। বাবা সামনের একটা টুরিষ্ট লজে কেয়ারটেকারের কাজ করে। আমি তাদের একমাত্র মেয়ে,তাতে বড় মেয়ে । তাই শত অভাবের মধ্যেও আদর সোহাগের কোনো কমই ছিলো না। বাড়ীতে অনেক গুলি ছাগল ছিল। পাহাড়ী জঙ্গলে ঘাস কেটে, পাহাড়ী ঝর্ণা থেকে জল এনে দিয়ে, হাসতে খেলতে ধীরে ধীরে শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করলাম। গ্ৰামের সরকারী স্কুলে কাজ চালানো মতো কিছু শিক্ষাদীক্ষাও পেটে গেল। অভাবের তাড়নায় আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। এখন মাঝে মাঝে বাবার জন্য খাবার নিয়ে টুরিষ্ট লজে দিয়ে আসি। বন্ধু-বান্ধবীরা প্রায়ই ঠাট্টার-ছলে বলে এই বেশী লজের দিকে যাস না। তুই খুব সুন্দরী হয়েছিস একেবারে কাশ্মীরের লাল আপেলের মতো। শহুরে বাবুদের প্রেমে পড়ে রাবি। আমি এসব শুনে লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওদের কথাগুলো মনে করে খুব খুশি হয়ে ভাবতাম কবে যে আসবে আমার স্বপ্নের রাজপুত্র, আপন করে, নিবিড় করে ভালোবাসবে।


ভাবতে ভাবতে একদিন যেন সত্যি হলো ভাবনা। বিজয় চৌধুরী নামে এক শহুরে বাবু নির্জনে ছুটি কাটাতে এলেন আমার বাবার টুরিষ্ট লজে। একদিন আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি, উনি গাড়ী নিয়ে বেরোচ্ছিলেন। হঠাৎ আমি তার গাড়ীর সামনে এসে পড়াতে তিনি ভীষন বিরক্ত হয়ে আমাকে এই মারি কি সেই মারি করে তেড়ে এলেন। আমিও পাহাড়িয়া গ্ৰামের সাহসী মেয়ে। ওসব চোখ রাঙ্গানির ধার না ধেরে দু-চার কথা শুনিয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে প্রথমে রাগারাগি, তারপর চোখা, তারপর নাম জানতে চাওয়া, একটু একটু ভালো লাগা হতে হতে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের বশবর্তী হয়ে আমরা দু'জনের এতো কাছে এসে গেলাম যে একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারার কথা ভাবতে পারলাম না। কিশোরীর প্রেম তো অল্পেই বিশ্বাস, অল্পেই খুশী। ঐ বয়সে মেয়েরা কিছুটা বোকা, কিছুটা আবেগপ্রবণ থাকে। হিতাহিত জ্ঞান অনেক কম। একদিন সেই বাবু জোরে হ্যাঁচকা মেরে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে স্বপ্নালু চোখে আমার দিকে অপলক চেয়ে রইল, কিছুক্ষণ পর আমায় বিয়ে করবে? আমি তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারব না গো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো চুপ করে রইলাম। সেদিনই সন্ধ্যায় দূরে টিলার উপরে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে গলায় মালা দিলো, সিঁদুর পরালো, ফুলশয্যাও হয়ে গেল। এভাবে প্রায় এক মাস পর তার বাবার হার্ট অ্যাটাকের খবর এলো। ও আমাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলো যে ওর সাথে আমার এখনি যাওয়া সম্ভব নয়। আমি গিয়ে সমস্ত বন্দোবস্ত করে তোমাকে নিয়ে যাবো, তোমাকে নিয়ে আলাদা এবং সম্পূর্ণ নিরালায় ঘর বাঁধবো যেখানে থাকবে শুধু তুমি আর আমি। আর কেউ না। সে জেনে গেল যে আমি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। চোখের জলে বিদায় দিলাম। বলেছিল কিছুদিন কষ্ট করে অপেক্ষা করতে। সেদিন বুঝিনি এ অপেক্ষা সীমাহীন, অন্তহীন। আজও পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি, কোলের খোকাকে বলি , দেখবি একদিন ঠিক এই পথে তোর বাবা আসবেন, তোকে আদর করবেন, আমাকে....


মা আর ছেলে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি পথপানে চেয়ে....



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024