গল্প || কালু ডাকাতের গল্প ও তার আবেদন || আব্দুস সাত্তার বিশ্বাস
কালু ডাকাতের গল্প ও তার আবেদন
এক
যে কাজটা করে মানুষ খায় ওটাই হল তার পেশা।কালু এখন ভিক্ষা করে খায়,সুতরাং ভিক্ষা করাটাই হল তার পেশা।তার আগে সে একটা দুর্ধর্ষ ডাকাত ছিল।নাম ছিল 'কালু ডাকাত'।
তার নামের সঙ্গে চেহারার দারুণ মিল ছিল।এই বড়ো বড়ো গোঁফ ছিল।আর তা পাক দিয়ে সে সবসময় খাড়া করে রাখত। তার ওই গোঁফ দেখেই মানুষ তাকে ভয় পেত।তাছাড়া তার শরীরে ছিল জোড়া মোষের শক্তি।কোনো মানুষকে সে পরোয়া করত না।মুরগি কাটার মতো করে সে মানুষ কাটত।জীবনে কত মানুষ যে সে কেটেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।যার জন্য তার নাম শুনলেই মানুষের হৃদস্পন্দনের ধুকপুক বেড়ে যেত।ছেলে-বুড়ো,নারী-পুরুষ কাউকেই ছেড়ে কথা বলত না।যে তার সামনে এসে দাঁড়াত,তার কাজে বাধা সৃষ্টি করত,তাকেই মেরে কাফাত করে দিত।তার কাছে গুলি ভর্তি একটা পিস্তল আর ধারালো একটা ছুরি সবসময় থাকত।তার যে তখন ওটাই পেশা ছিল।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালের নিয়মে তার শরীরে যখন নানারকম পোকামাকড় ঢুকে গেল বিক্রম হারিয়ে ফেলে সে তখন ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়ে ভিক্ষা করা ধরল।না হলে এই বয়সে ডাকাতি করতে গেলে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ে গিয়ে যে বেঘোরে মারা পড়ে যাবে।সেদিক থেকে এই কাজটা বেছে নিয়ে সে এক রকম ভালোই করেছে বলা যায়।কারণ,এখানে নো রিস্ক,নো পুলিশ।ঝোলাটা শুধু ঘাড়ে নিয়ে বেরোলেই হল।
কিন্তু শুধু কি এই জন্যই সে ভিক্ষা করা ধরেছে?না।তার ভিক্ষা করার পিছনে আরও অনেক কারণ রয়েছে।সে গুলো কী,তা জানতে হলে আমাদের আরও একটুখানি পথ হাঁটতে হবে,আরও একটুখানি পথ।
দুই
ডাকাতি করে জীবনে সে অনেক কিছু করেছে।যা তার বসে খেলেও জীবনে ফুরোত না।কিন্তু তার নিজের বলতে এখন কিছুই নেই।সব তার ছেলেদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে।
কারণ,সে তখন একটা দাগি আসামি ছিল।পুলিশ যেকোনো মুহূর্তেই তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে দিতে পারত। সেটা যাতে না হয় তার জন্য সে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি তার ছেলেদের নামে করে দিয়েছে।
ফলে তার ছেলেরা এখন সবাই প্রতিষ্ঠিত,ভালো আছে।সবার বাড়িতে খাট,পালঙ্ক,ফ্রিজ,টিভি ও আরও কতরকম মূল্যবান শখের জিনিস রয়েছে।সবাই সমাজে পাঁচটা দশটা মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করে। সামাজিক জ্ঞান সবার আছে।পুণ্যের আশায় সবাই মসজিদে যায়।
তবু তার নিজের নজরে তার ছেলেরা কেউই প্রতিষ্ঠিত নয়;সবাই দীন।না হলে দুটো ভাতের জন্য তাকে আজ ভিক্ষা করতে হয়?বৃদ্ধ বয়সে ভিখারি সাজতে হয়?তার নিজেরই এটা খুব খারাপ লাগে;খুব খারাপ।
তিন
যাইহোক,লাল্টু তার একটা নাতির নাম। বড়ো ছেলের ছেলে।বয়স তার খুব বেশি হলে দশ-এগারো বছর হবে।তার বেশি হবেনা। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে। পড়াশোনায় খুব ভালো।মাস্টাররা যেটা শেখায় সেটাই শিখে নেয়।স্কুলের হেড মাস্টার নিরঞ্জন বাবু তাকে ধরে একদিন বলেছেন।
যেকারণে সে যাতে উচ্ছন্নে না যায় তার জন্য প্রতি রাতে সে তাকে একটা করে গল্প শোনায়।না,অন্য কোনো গল্প নয়।যে গুলো শুনে উপকার হয় এমন অনুপ্রেরণা মূলক গল্প।যা থেকে সে নিজেকে তৈরি করতে পারে।
কিন্তু রোজ রোজ একই রকমের গল্প শুনতে লাল্টুর ভালো লাগেনা।যার জন্য সে আজ একটা অন্য রকমের গল্প শুনতে চায়।
"অন্য রকমের কী গল্প?"কালু জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলে সে বলল,"দাদু,তুমি বলে আগে একটা ডাকাত ছিলে গো!"
কালু বলল,"হ্যাঁ,ডাকাত ছিলাম।"
"কী রকম ডাকাত ছিলে?"
"বিরাট ডাকাত ছিলাম।'কালু ডাকাত' আমার নাম ছিল।"
"তাই নাকি?"
"হ্যাঁ।"
"তোমার ডাকাতির একটা গল্প শোনাও তাহলে।"লাল্টু আবদার করল।
"আমার ডাকাতির গল্প শুনে ভয় করবি না?আমার ডাকাতির গল্প খুব ভয়ানক হবে কিন্তু।"
"না,শোনাও "
"বেশ,শোন তাহলে।"
চার
কালু তার ডাকাতির একটা গল্প শোনাল,"আমরা একদিন মাদলপুরে ডাকাতি করতে গেলাম।বিশটা ডাকাত।মাদলপুর হল,নদী পারের একটা গ্রামের নাম এবং যে বাড়িটায় গেলাম ওই বাড়িটা হল দোতলা বাড়ি আর তার বাউন্ডারিটা হল বিরাট উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।শুধু তাই-ই নয়,বাউন্ডারির পুরো পাঁচিলটা আবার তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা।যা টপকে ভেতরে ঢোকা আমাদের কারুর পক্ষেই সম্ভব ছিল না।বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হলে আমাদের সদর দরজা ভেঙে ঢুকতে হতো।কিন্তু কাজটা আমাদের পক্ষে তখন খুব সহজ ছিল না।কেননা,সদর দরজা ভাঙতে হলে যে কুড়ুল দরকার।অথচ আমাদের কাছে কুড়ুল বা ওই জাতীয় কোনো জিনিস ছিল না।ফলে একরকম বাধ্য হয়েই আমরা সেদিন বাড়ি ফিরে এলাম এবং পরেরদিন রাতে আবার গেলাম।যাকে বলে এবার একেবারে প্রস্তুত হয়ে।কুড়ুল,শাবল,হাতুড়ি,ছেনি নিয়ে।তারপর আমরা সদর দরজা ভেঙে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলাম। গিয়ে দেখলাম,নিচের তলায় কোনো মানুষ নেই।একটা গোয়ালে শুধু কয়েকটা ছাগল আর কয়েকটা গরু বাঁধা রয়েছে।শুয়ে শুয়ে তারা জাবর কাটছে।আমরা তো আর গরু বা ছাগল ডাকাতি করতে যাইনি।আমরা গিয়েছি বাড়ির অর্থ ভাণ্ডার ডাকাতি করতে।কিন্তু ওটা রয়েছে ওই উপরে,দোতলায়।আমাদের খুঁজি এমনটাই আমাদের জানিয়েছে।খুঁজে খুঁজে কোনো গোপন জিনিসের সন্ধান ডাকাতদের যে এনে দেয় ডাকাতরা তাকে 'খুঁজি' বা 'খুঁচি' বলে।ওটা ডাকাতদের নিজস্ব ভাষা।যার ব্যাখ্যা হল ওটা।
সুতরাং,আমরা এবার সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলাম।উঠে দেখলাম,দোতলার সিঁড়িটা উপরে গিয়ে যেখানে শেষ হচ্ছে ওখানেও একটা দরজা রয়েছে।লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের এই দরজাটাও ভাঙতে হবে। আমরা এই দরজাটাও ভাঙলাম।বাড়ির মানুষ সবাই তখন জেগে গিয়েছে।গিয়ে আমাদের ঢাকা মুখ আর পরনের কালো পোশাক দেখে তারা জোরে চিৎকার আরম্ভ করে দিয়েছে,"ডাকাত!ডাকাত!ডাকাত!কে কোথায় আছো,তাড়াতাড়ি এসো গো,আমাদের বাঁচাও!বাঁচাও!বাঁচাও!বাঁচাও!..."
যাশ্শালা!মুখ বন্ধ করার জন্য আমাদের তখন তাদের কষে একটা ধমক মারতেই হল,"চোপ!"
কিন্তু তারা চুপ করল না।তাদের চুপ করানোর জন্য আমাদের তখন একটা কাজ করতেই হল।না হলে যে তাদের চিৎকারে গ্রামবাসীরা চলে এলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ে যাবো,তাদের হাতে ধরা পড়ে যাবো। তাই,কাজটা আমাদের করতেই হল।আমরা তাদের মেরে দিলাম।ছুরি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নলি কেটে ভীষণ কষ্ট দিয়ে।দিয়ে আমরা তাদের উপর দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম।উরিব্বাস!কী জিনিস!কাঁসার হাঁড়িকুড়ি,থালাবাসন থেকে শুরু করে সোনাদানা ও টাকা পয়সা।কী নেই!ফলে আমরা আগে কোনটা নেবো আর পরে কোনটা নেবো ভাবনা চিন্তা না করে সব বস্তায় ভরে নিলাম।নিয়ে বাড়ি চলে এসে পরের বছর দশ বিঘা জমি ও চারটে পুকুর কিনলাম।যে গুলো তোর বাপ-চাচারা এখন করে খাচ্ছে।আর আমি দূর থেকে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।যাইহোক,লাল্টু?"
"বলো,দাদু!"
"বলছি,বড়ো হয়ে তুই কী হতে চাস?"
কয়েক মুহূর্ত ভেবে লাল্টু বলল,"আমিও তোমার মতো বড়ো ডাকাত হতে চাই। তোমাকে যেমন সবাই ভয় করত,আমাকেও তেমনি সবাই ভয় করবে।"
অমনি কালু বলল,"না লাল্টু,না।আমার মতো তুই ডাকাত হতে যাসনে!"
"কেন,হলে কী হবে?"
"কারণ,ডাকাতরা কেউ মানুষ হয় না,প্রচুর পাপী হয়।জানিনা,আমার পাপের কোনোদিন ক্ষমা হবে কিনা।তাইতো,তোর কাছে আমার একটাই আবেদন,ভালো করে লেখাপড়া শিখে বড়ো হয়ে তুই একটা মানুষ হোস,বড়ো মানুষ।"
Comments