গল্প || ইন্দিরা গাঙ্গুলি || কৃপটে বুড়ো
কৃপটে বুড়ো
হারাধন খুঁড়োর মতোন কৃপটে বুড়ো ভূ ভারতে পাওয়া যাবে না। হারাধন খুঁড়ো রেলে চাকরি করতো। বরাবরই খুব হিসেবী লোক। হারাধনের বাবা, মা,মারা যাবার পরে একাই থাকতো হারাধন। তখন হারাধনের তিরিশ বছর বয়স ছিলো যখন হারাধনের বাবা, মা দুজনেই পথ দূঃঘটনায় মারা গিয়েছিল। পাড়ার ই একটি মেয়ের সাথে বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল তখন হারাধনের। বাবা, মা কে নিয়ে একটা বিয়ে বাড়ি গিয়েছিল হারাধন। হারাধনের মাসির মেয়ের বিয়ে ছিলো। বিয়ে বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিলো ওরা। একটা অটো করে ফিরছিলো। হঠাৎ একটা মালবাহী লড়ি ধাক্কা মারে অটোতে। পুরো অটো টাই উলটে যায়। আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে ওদের হাসপাতালে ভর্তি করেছিলো। হারাধনের হাতে, পায়ে চোট লেগেছিল। হারাধনের বাবা স্পটে ই মারা গিয়েছিল। হারাধনের মা হাসপাতালে ভর্তি হবার ঘন্টা খানের পরে মারা গিয়েছিল। অটোর চালক ও মারা গিয়েছিল। সেই থেকে একা হারাধন। পাড়ার সেই মেয়ে টির সাথে ই বিয়ে হয়েছিলো হারাধনের। হারাধন আর মীরা সুখে শান্তিতে সংসার করছিলো। বিয়ের পরে বছর খানেক বেশ ভালো ই কেটেছিলো। কিন্তু বিধিবাম। হারাধনের কপাল টা-ই খারাপ। বিয়ের বছর খানেক পরে ই মীরা অসুস্থ হয়ে পরে। মাঝে মাঝেই মীরার জ্বর আসতো। হারাধন জ্বরের ওষুধ কিনে আনতো দোকান থেকে। ওষুধ খেয়ে সাময়িক কমতো মীরার জ্বর। কিন্তু আবার পরের দিন সকালে জ্বর আসতো। হারাধন টাকা খরচার ভয়ে ডাক্তার দেখাতো না মীরাকে। এ-ই ভাবে মীরা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো। বাধ্য হয়ে হারাধন মীরা কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার মীরাকে ভালো করে পরীক্ষা করে তিন রকম ওষুধ লিখে দিলো। হারাধনের অনেক গুলো টাকা খরচা হয়ে গেলো সেদিন। ডাক্তারের ফিস ২০০ টাকা, তার উপর ওষুধ কেনার খরচা। হারাধনের গা জ্বালা করছিলো। ডাক্তারখানা থেকে বাড়ি ফিরে হারাধন মীরা কে বলেছিলো ঃ " আজকে অনেক গুলো টাকা খরচা হয়ে গেলো। ওষুধ যেগুলো কিনেছি সবগুলো একটা করে খাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি ওষুধ গুলো মাঝখান থেকে ভেঙে ভেঙে দেবো। তাহলে চারদিনের ওষুধ আট দিন চলবে। " মীরা বলেছিলো ঃ " তুমি যা ভালো মনে করো । আজকে আমার জন্য তোমার অনেক টাকা খরচা হয়ে গেলো। " হারাধন মীরার এ-ই কথার কোনো উত্তর দেয় না। ওষুধ গুলো দুই ভাগ করে রাখে। মীরা স্বামীর কথা মতো ই ওষুধ খেতো। কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। মীরার শরীর খারাপ হতে লাগলো দিন দিন। একদিন দূপূরে সব শেষ হয়ে গেলো। হারাধন তখন অফিসে ছিলো। বাড়ি ফিরে দেখলো মীরা ঘুমাচ্ছে। অনেক ডাকাডাকি করে ও সারা না পেয়ে পাড়ার লোকজন কে ডাকে। শেষে পাড়ার লোকেরা ই ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার দেখে বলে মীরা ঘন্টা খানের আগেই মারা গেছে। ডাক্তার এসে দেখেছিলো সামনের টেবিলের উপর টুকরো করা ওষুধ পরে আছে। হারাধনের কাছে সব কথা শুনে ডাক্তার বলেছিলো ঃ " এটা আপনি কি করেছেন? ওষুধ গুলো টুকরো করে খাইয়েছেন? যার ফলে ওনার মৃত্যু হয়েছে। " তারপর থেকে হারাধন সম্পূর্ণ একা। এখন হারাধনের অনেক বয়স হয়ে গেছে। এবার সওর বছরে পা দিলো হারাধন। রিটায়ার্ড করার পরে সব সময় বাড়িতে ই থাকে। বাড়ির সামনে একটা বাগান করেছে হারাধন। একবার পাড়ার ছেলে রা এসে হারাধনের কাছে সরস্বতী পূজোর চাঁদা চেয়েছিলো। হারাধন ওদের বলেছিলো ঃ " ওরে হা হাফাতের দল। তোরা পূজো করবি কর না। আমি কেন চাঁদা দিতে যাবো? " কালু বলেছিলো ঃ " হারাধন খুঁড়ো অন্তত দশটা টাকা দাও। বেশি দিতে হবে না। " হারাধন ওদের দিকে ঘরের কোনে রাখা মুড়ো ঝাটা ছুড়ে মেরেছিলো। ওরা ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল ওখান থেকে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে চালাক ছিলো লালু। লালু সবাই কে বলেছিলো ঃ " ও-ই কৃপটে বুড়োর থেকে আমি টাকা বার করবো। তোরা দেখ আমি কি করি? " কালু বলেছিলো ঃ " কি করবি তুই? " লালু বলেছিলো ঃ " সেটা তোরা কালকে জানতে পারবি। " পরের দিন সকালে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সবাই অবাক। কাগজে পাএ চাই বিজ্ঞাপনে হারাধনের নাম দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলো। হারাধন নিজের বিয়ের জন্য ভালো পাএী চায়। হারাধনের বাড়িতে একজন ঘটক এসে হাজির হলো। হারাধন বলেছিলো ঃ " আমি কাগজে কোনো বিজ্ঞাপন দিই নি। কেউ বদমায়েশি করেছে। " ঘটক বলেছিলো ঃ " কেউ কেন এরকম করবে? আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? খুব ভালো একটা মেয়ের সন্ধান আছে আমার কাছে। " হারাধনের তখন মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে ঘটকে বিদায় করেছিলো হারাধন সেদিন। পরের দিন সন্ধে বেলায় হারাধন উনুন ধরাচ্ছিল। সেই সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজে দরজা খুললো হারাধন। হারাধন দেখলো একজন লোক আর একটা মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। লোক টি বলেছিলো ঃ " নমস্কার। আমি পাশের পাড়ার থেকে এসেছি। একটু কথা বলতে চাই আপনার সাথে। " হারাধন ওদের ঘরে এসে বসতে বলেছিলো। লোক টি ঘরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে পাশের চেয়ারে মেয়ে টি কে বসতে বলেছিলো। লোক টি একটা খবরের কাগজ দেখিয়ে বলেছিলো ঃ " আপনি কি পাএ? আমি কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে ই এসেছি। " হারাধন বলেছিলো ঃ " এ-ই বিজ্ঞাপন আমি দিই নি। কেউ আমার নামে মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়েছে। বিয়ে আমি করবো না আর। আপনারা এখন যেতে পারেন। নমস্কার। " লোক টি বলেছিলো ঃ " কিন্তু আপনার এই কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? আমার মতে আপনার বিয়ে করাই উচিত। নইলে আপনাকে অনেকে বিরক্ত করবে। আমার মেয়ের স্বামী মারা গেছে এক বছর আগে। আপনি যদি ওকে বিয়ে করেন? " হারাধন ভাবলো সত্যি ই তো বিজ্ঞাপন থেকে বাঁচতে গেলে বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে টি ও দেখতে বেশ ভালো। হারাধন বলেছিলো ঃ " ঠিক আছে । আমি রাজি। " লোক টি বলেছিলো ঃ " কাল রাতে একটা শুভ লগ্ন আছে। কালই মন্দিরে বিয়ে হয়ে যাবে। আমি সবকিছুই ঠিক করে রেখেছি। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আমি মেয়ে কে নিয়ে রাতের বেলা তোমার বাড়ি চলে আসবো। তারপর একসঙ্গে মন্দিরে যাওয়া যাবে। " হারাধন কাউকে কিছু না বললেও পাড়ার মন্দিরের পুরোহিতের কাছ থেকে লালু খবর পেয়ে গেলো। পরের দিন রাতে কালু আর লালু হারাধনের বাড়ি গিয়ে কারো কান্না কাটির আওয়াজে হারাধনের ঘরে ঢুকে দেখলো হারাধনের হাত,পা দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে খাটের সঙ্গে। দুজন লোক আলমারি খুলে টাকা বার করছে। কালু লোক দুটো কে দেখে চিৎকার করে উঠলো ঃ " এ-ই তোমরা কে? খুঁড়ো কে বেঁধে রেখেছো কেন? পালাও তাড়াতাড়ি। নইলে পুলিশ ডাকবো। " পুলিশের কথা শুনে ওরা ভয়ে ওখান থেকে পালিয়ে গেলো। লালু হারাধনের হাতে, পায়ের দড়ি খুলে দিলো। কালু বলেছিলো ঃ " হারাধন খুঁড়ো আমাকে মাপ করে দাও। আমি ই তোমাকে জব্দ করার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। " হারাধন বলেছিলো ঃ " তোরা আজকে আমার অনেক উপকার করলি। আমি সরস্বতী পূজোর চাঁদা দেবো। পাঁচশ টাকা নিয়ে যা। " তারপর থেকে হারাধন আর কৃপটেমী করে নি কোনো দিন ও।
Comments