গল্প || আন্না || রঞ্জিত মল্লিক

 আন্না 

  

     

    

    " বিহুর ও লগন ....   

    আকাশে বাতাসে ... .....

    .... .... ...

    চম্পা ফুটিছে .... ...

    তার সুবাসে ...... ... "


   গানটা এক কাস্টমারের মোবাইলে শুনেই আন্নার বুকের ভিতরটা ধরাস করে উঠল। পুরানো স্মৃতি গুলো আবার জট পাকিয়ে উঠছে। সেই সাথে অনবরত চোখ দিয়ে জল ঝরছে।


    বেশ কিছু বছর আগের কথা। আসামে বিহু উৎসব উপলক্ষ্যে রোজলিনের একটা নাচের অনুষ্ঠান ছিল। এটা ছিল বিরাট উচ্চতার একটা অনুষ্ঠান। আন্নাও প্রেজেন্ট ছিল সেখানে। অনুষ্ঠান বেশ ভালই হল। রোজি অল্পের জন্য সেকেণ্ড হল। এরপর ন্যাশনাল লেভেলের কমপিটিশন হবে দিল্লীতে।


   ফেরার পথে রোজিদের গাড়ি একটা বাঁকের কাছে টার্ন নিতেই একটা ভারী লরিকে ধাক্কা মারে। একটা প্রাণান্তকর এক্সিডেন্ট। আন্নার যদিও অল্প চোট লেগেছিল। রোজলিনের এই প্রাণনাশক এক্সিডেন্টে শরীরের নিন্মাংশ পুরো অবশ হয়ে যায়। আর চির জীবনের মত বোবা হয়ে যায় ও।


    শোকের ছায়া নেমে আসে গোমস পরিবারে। রোজি আর কোনোদিনই পায়ে ঘুঙুর পড়তে পারবে না এটা ভেবেই আন্নারও মন আর শরীর কোমাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।



           বাবা মা মারা যেতেই তামিলনাড়ু থেকে গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে খুব ছোটতে কলকাতায় চলে আসে আন্না শিবলিঙ্গম রাধাচন্দন। ফুটপাতে ধোসা ইডলির স্টল থেকেই আস্তে আস্তে বিজনেসটা ডালপালা ছড়ায়।


           রোজি প্রায় আন্নার স্টল থেকে ধোসা, ইডলি খেত।একদিন বৃষ্টির দিনে রোজির পুল কার অটোর সাথে ধাক্কা লাগাতে রোজি পিছলে ম্যানহোলের ভিতরে ঢুকে যায়। জীবনে প্রথমবার এই প্রাণান্তকর এক্সিডেন্ট থেকে আন্নায় ওকে বাঁচায়। তখন থেকেই সম্পর্কের শুরু। ভালবাসার উত্থান।


            ঐ গানের তালে নেচেই রোজলিন আসামে মঞ্চ কাঁপিয়েছিল। তারপর থেকেই সব ঝাপসা লাগে আন্নার। 


                   ........... .......... ...........


             আজ গানটা বহুদিন পরে শোনার পর একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছে আন্না।


            ডাক্তার ডেরিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি। রোজি আবার ডান্স করতে পারবে। ডেরিয়ার সেটাই অভিমত। তবে একটা মেজর অপারেশন করতে হবে।


            টাকার দরকার। রোজির বাবা একজন সামান্য বেসরকারী চাকুরীজীবি। চিকিৎসার অত টাকা উনি জোগার করতে পারবেন না। আন্নাকেই সব করতে হবে।দুবার সম্বন্ধ ভাঙ্গার পর ওর দিদির বিয়েটা না হয় একটু পিছলো! দিদির জন্য কেনা গহনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এই চিকিৎসার পিছনে। 


           আসিফ করিমের মেয়ে সাইরার একটা কিডনির খুব প্রয়োজন। আন্নার সাথে গ্রুপ ম্যাচও করেছে। আন্না আসিফ করিমের মেয়ের কিডনি নষ্টের খবরটা পেপারেই পড়েছে। পড়া মাত্র আর সময় নষ্ট করেনি। করিম সাহেবের সাথে দেখা করে উনার সাথে সব কথা বলেছেন। 


            করিম সাহেব রাজী হয়েছেন। আন্নার একটা কিডনি মৃতপ্রায় মেয়েকে যেমন বাঁচাবে , তেমনি বিনিময়ে উনি রোজলিনের চিকিৎসার সব ব্যয় সারাজীবন বহনও করবেন। রোজিও তো উনার মেয়ের মত। রোজির মধ্যে উনি সাইরার শুকিয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পাচ্ছেন। 


           আন্না টাকার জন্য নিজের দোকানঘরটাও বিক্রি করে দিল।দুটো প্রাণনাশক সিদ্ধান্ত ওকে নিতেই হল। তা না হলে আদরের ভালবাসা রোজলিনকে বাঁচানো যেত না। 


                  .......... .......... ............


           অপারেশন পুরো সাকসেসফুল।


           তিন বছর পর.....


           ওড়িশাতে আন্তর্জাতিক ওডিশি উৎসব। রোজলিন রবারের পা দিয়ে সুন্দর নৃত্য পরিবেশন করল। বোবা মুখে ফুটে উঠল ঘুঙুরের ছন্দ। সবাইকে চমকে দিয়ে রোজলিন নৃত্যে শেরার শিরোপা পেল। আনন্দে চোখের কোণ বেয়ে নামছে অতি ক্ষীণ কংসাবতীর শ্রাবণ পূর্ণিমার ভরা কোটাল। 


      আন্না সবটাই দেখল। আকাশের ঠিকানাতে বসে।


         কিডনি প্রতিস্থাপনের পর আন্না আর বাঁচেনি। কয়েক মাস পরেই ও চলে যায় না ফেরার দেশে। তবে রোজলিন, সাইরা সেটা মানতে পারেনা। ওদের বিশ্বাস আন্না আজও বেঁচে আছে ওদের সকলের মনের অলিন্দে। 


           আরো দুই বছর পর ......


        সেন্সাস আধিকারিকেরা সেন্সাসের ডাটা কালেকশান করতে এসে এক চরম সত্যের সন্মুখীন হল। সেন্সাস আধিকারিকদের সাথে রোজি আর সাইরার বাবার তীব্র ঝগড়া। ওদের দুজনেরই দাবি তাদের তিনটে করে সন্তান - আন্না, রোজলিন, সাইরা।


       আন্নার দিদিরও একই অভিমত। তাদের এক ভাই ,আর দুই বোন আছে ; আন্না, রোজলিন সাইরা। 

     

          সেন্সাস আধিকারিকেরা তিন পরিবারের কাছ থেকে একই তথ্য পেয়ে বেশ হতভম্ব। কিছুতেই ঐ পরিবারগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পাল্টাতে পারছেন না। বারবার বলা স্বত্তেও উনারা একই তথ্য খাড়া করতে চাইছেন। 


           সব কিছুই ঠিক আছে। শুধু পরিবারের সদস্য, সদস্যাদের নামের জায়গাতে ঐ তিন পরিবারের তিনজনের নাম বার বার উঠে আসছে। আর তা হল, আন্না শিবলিঙ্গম রাধাচন্দন, নাতালিয়া রোজলিন মারিয়া গোমস, আখতারা সাইরা মেহেবুবা।


          সেন্সাস আধিকারিক দলের একজন হেড সেদিন নিজেই এলেন সব কিছু স্বচক্ষে যাচাই করতে। রোজলিন আর সাইরার পরিবার যা বিবৃতি দিলেন তাতে উনি রিয়েলি স্পেলবাউণ্ড। 


           রোজলিনের পরিবার থেকে আন্না আর সাইরারকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। সেই রকম সাইরার পরিবারেও রোজলিন, আন্না সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। 

         

            সমস্ত ঘটনা শোনার পর আধিকারিকদের মধ্যেও একটা মারাত্মক নিস্তব্ধতা অনুভূত হল।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024