গল্প || তিতলি || সত্যেন্দ্রনাথ পাইন

তিতলি





    মেয়ের নাম নিয়ে খোঁজ করে অনেক কষ্টে মিলেছে--তিতলি। সে যখন জন্মায় তখনই নাকি সে বুঝিয়েছিল- সে আলাদা। সে তোতা নয়-- তিতলি- একটু কেমন! 

   বাবা মা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়ে জানতে পেরেছে তাদের মেয়ের অবস্থা আর সাধারণের মতো নয়। সে অস্বাভাবিক। 

   সে কথা বলে না। ভালোভাবে কাঁদতে পারে না। কিন্তু সব বুঝতে পারে। মা তাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত তা-ও সে উপলব্ধি করে। ছোট্ট বয়েস থেকেই তার দাদার ওপর অত্যন্ত আদুরে ভালোবাসা ছিল তিতলির ---বাবা অন্ত্য প্রাণ। তবুও মা ছাড়া যেন কাউকেই চেনেনা। তাই সদাই অকারণে কেঁদে ওঠে। 

    মা নিলাদ্রি নিজেকে' পাপী" ভাবেন। কেননা মায়েরা কন্যাসন্তান কে নিজের অংশ ভেবে তার শারীরিক দিক, মানসিক দিক নিয়ে বেশি ভাবিত হয়। তাই নিজের গর্ভের ওপর দোষ দিয়ে ভাগ্য বিধাতার কাছে কঠিন প্রত্যাঘাত করতে সর্বদাই তৎপর হন। 

         বাবা, প্রতাপবাবু, নিলাদ্রি ওপর রাগে, বিতৃষ্ণায় যখন খুশি যত খুশি অশালীন কথা প্রয়োগ করেন। নিজেরও যে দোষ থাকতে পারে না ভেবে মেয়ে তিতলির যত্নের জন্যে বৌ নিলাদ্রি কে উদয় অস্ত যুদ্ধক্ষেত্র মনে করে শাসন করেন। দিগ্ বিদিক শূন্য হয়ে গায়ে হাত তোলেন। নিলাদ্রি মেয়ে তিতলির কথা ভেবে নীরবে সহ্য করে মহত্ত্ব দেখান। বাপের বাড়ির কাউকে জানতে বা জানাতে চান না। সে যেন একাই অপরাধী। এরকম সন্তান কেন এলো! সেতো সকলের মঙ্গল ই চায়। তবে তার ভাগ্যে এমন কেন? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও তার কথা ফোটে না। সে স্বাভাবিক সন্তানের মতো বেড়ে ওঠে না। শুধুই অনুভবে আচরণে নিস্তব্ধ প্রকৃতির মতোই অসীম উদার মনে মায়ের কোলে কোলেই বাড়তে চায়। তার চোখের ভাষা প্রমাণ করে সে ভালোবাসার কাঙাল। সে নীরব নদীতীরের একখানা প্রদীপ। সে বোঝে সবই, বোঝাতে পারেনা। মা নিলাদ্রি কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ করে। মেয়ে তিতলি যে তার কত্ত আদরের। শ্বশুর, শাশুড়ি, পাড়া প্রতিবেশী প্রত্যেকেই তিতলির জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে। নিলাদ্রি ক্রমশঃ পাথর হয়ে যেতে থাকে- গর্ভের কলঙ্ক ভেবে। অথচ মায়েরা মেয়ের বেড়ে ওঠা নিয়ে কতই না স্বপ্ন দেখে। শরীরের উন্নতিতে

চমকিত হয় আনন্দিত হয়। নিলাদ্রি, অবশ্য অন্য অনেক কিছু ভাবে। এই বৃহৎ প্র কৃতির মধ্যে যে একটা বিরাট মহত্ব আছে তা মেয়ে তিতলির মধ্যে অনুভব করে। 

       গ্রামটা পাটলি। পাশে দামোদর নদ। আগের সেই খরস্রোতা আর নয় বটে, তবে চাকরি জীবী মেয়েদের মতোও নয়। শান্ত গৃহবধূ। ঘোমটা মাথায় কোলাহল, পাখির কূজন, চাষীদের বোঝাই শালতি এবং দু' পার বাঁধা বাঁশের সেতু সবই সহ্য করে সে। কেউ তার ওপর খারাপ নজর দিতে না পারে সেজন্যেই যেন দু' পাশে অসংখ্য চিতার পোড়া কাঠ।। এখানেই তিতলি আর দামোদরের মিল। 

         তিতলি বড় হচ্ছে। পথে ঘাটে অসংখ্য নরখাদক নজর দেয়। তিতলি বোঝে, মাকেও বোঝাতে চায়। তবুও সে একা একা দামোদরের তীরে সময় কাটায়। প্রকৃতির

নীরবতার সাথে নিজের মিল খুঁজে ফেরে। কিন্তু নরখাদক পশুরা তিতলির এই একাকীত্বে হানা দেয়। " স্পেশাল " চাইল্ড হলেও নারী সুখ ভোগ করতে চেয়ে তিতলির পাশে ঘুরঘুর করে। যেন রুদ্র মহাকালের পদতলে বসে মধু পানের অদম্য ইচ্ছা বা প্রমত্ত বাসনা। ছাগল, কুকুর, বেড়ালের মতো তাকে কামনার যৌনতায় নিবদ্ধ করতে চায়। 

    এরপর একদিন দুপুরে শীর্ণ দামোদরের চরে তিতলি একটা ছাগল বাচ্চা নিয়ে খেলা করার সময় কয়েকটা দু'পেয়ে পশু তাদের যৌন ক্ষুধা মেটাতে তাকে ধর্ষণ করে। তিতলির বয়স তখন সবে এগারো। বাক্য হীন বোবা তিতলি তীর বেঁধা হরিণের মতো যন্ত্রনায় তাকিয়ে থাকে নদীর জলে। জীবন যে তার শঙ্কিত হয়ে ওঠে আরও। বোবা চোখে মাকে আর বিধাতার কাছে ক্ষমা চেয়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়লো-- কেউ জানতেও পারলো না। 

    বাবা প্রতাপ যখন জানলো তখন সব সব শেষ। মা নিলাদ্রি 

নিলাদ্রি অন্তর্যামী র কাছে নীরব চোখের জলে মেয়ের অন্ত্যেষ্টি করলো। 

     সানাইয়ের বাদ্যি যেন বোবা হয়ে গেল চিরদিনের মতো। মনুষ্যত্বহীন সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের চির বিদায় নিশ্চিত হলো। 

 



Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024