পরিবর্তনের দুর্গা পুজো - তন্ময় কবিরাজ || Poribortoner Durga Puja - Tanmoy Kobiraj || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article
পরিবর্তনের দুর্গা পুজো
তন্ময় কবিরাজ
দুর্গা পুজো নিয়ে যখন লিখবো ভাবছি তখন ভয় হচ্ছে। আবার কাকে হারাতে হবে? গত কয়েক বছর করোনা ভাইরাসে সেভাবে পুজো হয়নি। অন্যদিকে, পুজোর সময় চলে খামখেয়ালি বৃষ্টি। আর তাতেই বিপত্তি। মালদা, মুর্শিদাবাদে বন্যা, উত্তরবঙ্গে ধস। রেললাইন বসে যাচ্ছে। বুকিং ক্যান্সেল করে হা _হুতাশ চারদিকে। সরকার পুজোতে ছুটি বাড়িয়েছে তাই বাড়িতে থাকতে চায় না কেউ। বাঙালি এখন আর দিপুদা অর্থাৎ দীঘা পুরী দার্জিলিং এ সীমাবদ্ধ নেই। আবার কোভিদের আগে শারদীয়া মানেই মৃত্যুর প্রহর গোনা। পুজোতে হারিয়েছি দুই গাঙ্গুলিকে _সুনীল আর পীযুষ। তাতে বাঙালির সেন্টিমেন্টে ভাটা পড়েনি। বাঙালি জাতির হয়তো আলজাইমাস আছে নাহলে সারা বছরের সব কষ্ট ভুলে কি করে এত আনন্দ করে?যতই কষ্ট হোক জীবনের ইস্তেহার সব ভুলে আনন্দ উপভোগ করা। হ্যালো ব্রো বলে রাস্তায় নামবে মাইক্রো মিনি সিলিভলেস থেকে জিন্স টপ, ধুতি পাঞ্জাবি। তবে সময়ের স্রোতে পুজোর ধরন পাল্টে গেছে। লেগেছে কর্পোরেটের ফাগুন। তবে তার ঐতিহ্য আজও অমলিন। তাই সে ইউনিস্কো সম্মান অর্জন করেছে।
রসগোল্লার মত দুর্গা পুজো তুমি কার?_এটাও বিতর্কের। বাঙালি দুর্গা পুজোর গর্ব করলেও ওড়িশায় দুর্গা পুজো শুরু হয়েছিল অনেক আগেই খ্রি: পূ ৩০০ শতকে। প্রচলন করেছিলেন রাজা সুরাতা। বাংলাতে শুরু হয় মুঘল যুগে। আকবরের আমলেও দুর্গা পুজো হতো।১৫০০শতকে শুরু হলেও তার স্থান কাল নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেউ বলেন, দিনাজপুর মালদা জেলায় প্রথম পুজো হয়। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুজোর প্রচলন হয়। যদিও দেবীর মূর্তি ছিল একটু আলাদা। গোল চোখ, বাহন ছিল সাদা বাঘ আর সবুজ সিংহ। অন্য একটি মতে, তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ান বা নদিয়ার ভবানন্দ মজুমদার এই পুজোর প্রচলন করেন। তবে তখন পুজো হত নিজের বাড়িতেই। বারোয়ারী পুজোর ধারণা আসে অনেক পরে। ১৭৯০সালে গুপ্তি পাড়ায়। যার নাম ছিল বারোপল পুজো।
কলকাতায় প্রথম দুর্গা পুজো করে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০সালে। তখন সনাতন প্রথা মেনেই পুজো হতো। দুর্গা পুজোর মাধ্যমে স্বামী বিবেকানন্দ সমাজের কাছে বার্তা দিয়েছিলেন। পুনঃ প্রচলন করেন কুমারী পুজো ১৯০১সালে বেলুড়। সিন্ধু তথা দ্রাবিড় সভ্যতা মাতৃ তান্ত্রিক। দেবী বন্দনার কথা শোনা যায়। মানুষ ভক্তি নিষ্টা ভরে দেবীর আরাধনা করে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, মা সবার। সবাই কে নিয়ে পুজো করতে হবে। বিবর্তন ঘটলো। পুজো হলো সর্বজনীন। জমিদার থেকে আমজনতার। ভাবের আদান প্রদানে তৈরি হলো মিলন ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধু নরোত্তম কে হয়তো সবার মনে আছে ।
দেবী মহামায়া। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, এ মায়া আমারই। দেবী দুর্গাকে বলা হয় ভগবতী অর্থাৎ অর্থ, বীর্য্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগীর সমাহার।খুব যত্ন করে আরাধনা করতে হয়। যার সুন্দর বর্ণনা আছে মারকেন্দিও পুরাণে। ব্রহ্মবৈবত পুরান বলে, দুর্গা পুজো প্রথম করে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, পরে ব্রহ্মা, শেষে, মহাদেব।
দুর্গা পুজোতে যেমন ধর্ম কৃষ্টি আছে, বর্তমানে তেমনই পুজোতে মিশে আছে রাজনীতির মাইলেজ, তোষামোদের ইকুয়েশন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর পরে রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সম্মানে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর করেন। নাম দেন বিজয় উৎসব। মনোরঞ্জনের জন্য আনা হয় বিদেশ থেকে নর্তকী নিকি বাইকে। শুরু হয় সবেকের সঙ্গে আধুনিকতার পথে চলা। রাজনীতি।কে অনুদান পাবে আর কে পাবে না। ভক্তি উড়ে গেলো। বহরটা বড়ো হলো। ক্যাপশন তৈরি হলো, সবচেয়ে বড়ো দূর্গা। পুজোতে এখন কার্নিভাল।বিদ্যাপতির দূর্গাভক্তি তরঙ্গিনি তে যে ভাব ছিল তা থাকলো না। অথছ এ পুজোর কথা হুয়েন সং এর লেখাতেও আছে। কালিকা পুরাণে দুর্গা পুজোর সময় বসন্ত কাল। যদিও একথা কৃত্তিবাস স্বীকার করলেও বাল্মীকি স্বীকার করেননি। বঙ্গ জীবনে দুর্গা পুজো ঐক্যের প্রতীক। মানুষ আশীর্বাদ চায়,"মা বুদ্ধি দে।"ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, বোধন তো বোধ সূত্র।
সাবেক দুর্গা প্রতিমা থাকতো একচালাতে। পরিবার সম্বলিত। যা গ্রাম্য জীবনে একান্নবর্তি পরিবারের প্রতিফলন। বাবা মা ছেলে মেয়ে। পশু বাহন আর কলা গাছের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সহবস্থান। প্রকৃতির ভিতরে শক্তির বীজ লুকিয়ে। সবেক পূজো নস্টালজিয়া। বাড়ি ফেরার পালা।নতুন জামা। বালিশে নীচে জামা রেখে ঘুম। পুজোতে কবে কোনটা পরব তার প্ল্যান।ঘুগনি খাওয়া। শিউলি আর কাশে অপু দুর্গার ফ্যান্টাসি, দূরে ধোঁয়া উড়া রেল গাড়ী_এ যেনো চিরকালীন রোমান্স। পুজো প্রেম চিরকুটে।শালুকের বনে কৈশোর, রাত জেগে অপেক্ষা,কখন রঙ হবে , চোখ বসবে ঠাকুরের। মহালয়ার পর অস্থিরতা পারদ মন মানে না আর,আর কটা দিন মাত্র। মুড়ি, নাড়ু। তারাশঙ্করের লেখায় এ বঙ্গের শারদ রঙ্গ খুঁজে পাওয়া যায়।
২০০০ সালের পর থেকে অনেকটা বদলে গেছে ছবিটা। পুজোতে লগ্নি এলো, বাড়লো বিজ্ঞাপনের চমক। বিপনন সংস্থার চাহিদা মত বিগ্রহ পাল্টে গেল। দুর্গা পড়লো ভারী গহনা। বাজার অর্থনীতি বাঙালি মেনেও নিল। ধর্মকে ব্যবহার করে উস্কে দিল পণ্যের জাদু। পুজোর মাধ্যমে ক্লাবগুলো বার্তা দেয়। বাড়ছে থিম, প্রতিযোগিতা।ভালো হলে স্পনসর আসবে। তাই শুরুর আগেই কাউন্ট ডাউন। কখনও ফেসবুক, কখনও হোয়াটস অ্যাপে আপডেট।শিল্প না এলেও দুর্গা পুজোর শিল্পতে বাঙালি অনেক এগিয়ে। এগ রোলে কামড় বসাতে বসাতে রাত কখন যেন ভোর হয়ে যায়।লম্বা লাইনে তখনও। এখন গল্প নয়। বরং সেলফি বা রিল। ভিউস বাড়বে। হয়তো হোয়াটস অ্যাপেই কেউ টেক্সট করবে,"আই লাভ ইউ"।
পাল্টে গেছে অনেকে কিছুই। পরিবর্তন ভালো না খারাপ সে তো বলবে সময়। চোখে যা ধরা পড়ে তাই লিখলাম। শুধু ঠাকুর রামকৃষ্ণ কথাটা খুব মনে পড়ছে,"তোমাদের চৈতন্য হোক।"
২,
প্রবন্ধের নাম _মুছে যাওয়া দিন; হ্যারিকেন
কবি বলেছিলেন,"কেবল আরেকপথ খোঁজ তুমি;আমি আজ খুঁজি নাকো আর/পেয়েছি অপার শূন্যে ধরবার মতো কিছু শেষে আমারি হৃদয় মনে..."। বিবর্তন হয়েছে। উন্নত হয়েছে জীবন। চলার পথে গতি বাড়াতে এসেছে বন্দে ভারত। রাতের শহরে নিয়ন আলোয় যানের মিছিল। ভোটের প্রচারে ঘর ঘর বিজলি।সব আছে। তবু যারা তাদের শৈশব বা কৈশোর কাটিয়েছে নব্বইয়ে দশকে তাদের কাছে হ্যারিকেন সু পরিচিত। বিদ্যুতের একমাত্র বিকল্প। গ্রামের সন্ধ্যা প্রদীপের সঙ্গে পাল্লা দিত। বারিফেরত বড়বাবু যাতে সাবধানে বাড়ি আসতে পারে তার জন্য চৌকাঠ থাকতো হ্যারিকেন। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজে হ্যারিকেন। নতুন বউয়ের মুখ দেখতো হারিকেনের আলোতে। দিদিমা আক্ষেপ করতো,"আলোটা বাড়া। চাঁদ পানা মুখ যে দেখা যাচ্ছে না।"নাতি নাতনী তখন সলতে বাড়াতে ব্যস্ত। ভাড়ার ঘরে তেল দেওয়া হতো। কথা গল্প আড্ডা মজার ভেতর রাত যখন ভোর হয়ে যেত তখন আলোর অভাবে হারিকেনের আলো দপদপ করতে করতে নিভে গেল। কাঁচের গায়ে কালো কার্বন।সেদিন এখন অতীত। পৃথিবীর গভীর যে অসুখ সে তো এই দূষণ। হ্যারিকেন তার প্রভাব ছিল কম।তবু সে হারিয়ে গেলো।
শোনা যায়, ১৫০০শতাব্দীর পারস্যে নাকি ব্যাপক হারে হারিকেনের ব্যবহার বাড়ে। তারও আগে নবম শতকে পার্সিয়ান অ্যালকেমিস্ট আলরাজি তার আল_আসরার বইতে হারিকেনের বিবরণ দেন। যার নাম নাফাতাহা।তবে বঙ্গে হারিকেনের প্রচলন কিন্তু শুরু হয় মুঘল রাজাদের হাত ধরে।যার চরম ও শেষ সীমা হলো নব্বই দশক। হারিকেনের যুগে গ্রামীণ জীবন দুই ভাগে বিভক্ত _হ্যারিকেন আর চিমনি। হ্যারিকেন বড়োলোকের প্রতীক। তখন বিদ্যুৎ গেলে আসার বালাই ছিলো না।তাই কেরোসিন সংগ্রহতে চলতো গ্রামীণ কূটনীতি। গরীবের কার্ডে তেল তুলতো ধনীরা। গরীবের বাড়ীতে জ্বলতো চিমনি।গ্রামীণ অর্থীতিতে হারিকেনের অনেক অবদান। মুদির দোকানে খড় ঢেকে বিক্রি হতো কাঁচ আর সলতে। সংসারের খরচ কমাতে মহিলারা বার করলেন ফন্দি। সলতের জায়গায় এলো কাপড়ের সলতে আর ফাটা কাঁচে জড়ানো হতো শক্ত কাগজ। বালি দিয়ে যত্ন করে সে কাঁচ পরিষ্কার করা হতো। কাঁচের ওপর জমা কার্বনে চলতো ভুত ভূত খেলা। হ্যারিকেন জ্বললে বাড়ির মহিলারা ব্যবহার করবে না দেশলাই। কাগজ পাকিয়ে উনন জ্বলতো হারিকেনের আলোতে। অনেক সময় হ্যারিকেন নিভে গেলে গোলযোগ বেঁধে যেতো।
তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষনের লেখায় হ্যারিকেন এসেছে বারবার। সন্ধ্যার পরে উন্নত জীবন বলতে হ্যারিকেন। ভালবাসা বিরহ থেকে শুরু করে শৈশবের ফিস্টি। সন্ধ্যে হলেই হ্যারিকেন নিয়ে ছাত্ররা চলতো মাস্টারের বাড়ি। মাষ্টারমশাই আদেশ দিতেন,সবাই নিজের নিজের হ্যারিকেন আনবে। মায়েরা বিকাল থেকে হ্যারিকেন মুছে রেখে দিত। বিকাল শেষে বাচ্চারা হ্যারিকেন দোলাতে দোলাতে পড়তে যেত। ফলে অনেক সময় দুলুনিতে তেল পড়ে যেতো। মাষ্টারমশাই সমাধান করেদিতেন। একটা হারিকেনে দুজন পড়বে। তাতেও মারামারি।যার হ্যারিকেন সে আলো দেবে না। শেষমেশ যার হ্যারিকেন নেই সে অন্যর আলোর ছায়াতে পড়বে। অন্যদিকে দুষ্ট ছেলে হ্যারিকেনের কল নামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।আর মাষ্টারমশাই দেখতেই পিঠে পড়লো লাঠি। পড়ার শেষে অভিভাবকরা নিতে আসতো হ্যারিকেন নিয়ে। মাস্টার হুংকার দিত,"কে?" শ্রদ্ধার সঙ্গে উত্তর আসতো,"আমি মাষ্টারমশাই। পিন্টুর বাবা"। হ্যারিকেনটা মুখের উপর তুলে ধরতে পিন্টুর বাবা। চিনতে পেরে মাষ্টারমশাই বলতেন,"বসুন"। হ্যারিকেন নিভিয়ে শুয়ে পড়ত সবাই। রাতের আলো বলতে তখন চাঁদের জোৎস্না আর অমাবশ্যার রাতে জোনাকি। ছেলেবেলায় সেগুলি কৌটোতে ভরে রাখা হতো ।নাম দিতাম "টর্চ"।
চন্ডিতলার গল্প। চা মুড়ি তেলেভাজা। বুধবারের যাত্রাপালা। সবাই গোল হয়ে বসে শুনত। মাঝখানে হ্যারিকেন।পাশে রেডিও। পোকা আসতো। কেউ বলতো,"আলো টা কমা"। কেউ বলতো,"কমাতে হবে না"। ঝগড়া। যার হ্যারিকেন সে নিয়ে চলে গেলো। অন্ধকারে বসেই সবাই যাত্রা শুনলো। দিদিমা ছেলের বাড়ি যাবে। রাতে ছাড়বে গরুর গাড়ি। গাড়ির সামনে ঝুলানো হ্যারিকেন। নতুন বিয়ের পালকি বনের ভেতর দিয়ে যাবে। সঙ্গে সেই হ্যারিকেন। বাংলার অঙ্গ ছিল হ্যারিকেন। হ্যারিকেনের তাপে সেরে যেত হাঁটুর বাত। কাঁচের ওপর রাখা হতো কাপড়। কাপড় তেতে গেলে সেঁক দেওয়া হতো। ঠান্ডায় বুকের মাঝে আগলে রাখার রোমান্স হ্যারিকেন। সদ্য যুবতী হারিকেনের আলোয় তার ভালবাসার চিরকুট পড়তো গোপনে। হ্যারিকেন কমিয়ে কোলবালিশ চেপে ইচ্ছে করতো ঘনিষ্ট হবার বাসনা। বাড়ীতে চোর এলে হ্যারিকেন নিয়ে পালাতো। বেচে বিড়ি খাবে। সবই এদের বলতো ছিঁচকে চোর। কবির টেবিলে হ্যারিকেন জ্বলতো সারা রাত। হারানো শব্দের সন্ধানে উটানামা করতো হ্যারিকেনের সলতে। বিরক্ত গভীর হলে নিভে যেতো আলো।
হ্যারিকেন এখন ইতিহাস। হ্যারিকেনে লুকিয়ে প্রান্তিক জীবন। সবেক বঙ্গ।এখন তো হ্যারিকেন খেলনা, শোপিস। বোলপুরের সনাজুরির হাটে বিক্রি হয় হ্যারিকেন প্রতীকী। লোকে কেনে। নিয়ে যাবে বাড়ীতে। ছোটরা জানবে এই হ্যারিকেন কেটেছে তার বাবা দাদুদের জীবন যৌবন। অথচ এই হ্যারিকেন হাতে রানার দৌড়েছে একদিন।তাকে চিঠি দিতে হবে।সেই ডাকপিয়নের চরম বন্ধু ছিল সেদিন এই হ্যারিকেন। "হাতে লন্ঠন করে ঠনঠন জোনাকিরা দেয় আলো"।
Comments