বোধন - ঝুমা দত্ত || Bodhan - Jhuma Dutta || গল্প || ছোট গল্প || Story || Short Story || Prose || বড় গল্প
বোধন
ঝুমা দত্ত
রামচন্দ্র চ্যাটার্জী, মাত্র ১২ বছর বয়সে তাঁকে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভিভাবকহীন যন্ত্রণার মোকাবিলা করতে হয়। তবে ভাগ্যক্রমে অভিভাবকহীনতা সঙ্গ দেয় নি বেশিদিন। সে গ্রামের এক নিঃসন্তান কৃষক পরিবার তাকে বুকে টেনে নেয় এবং বড় স্নেহে তাকে লালন পালন করে।
রামচন্দ্র তাঁর বাবার থেকে যেটুকু পুজোর কাজ শিখেছিল তা দিয়ে অল্প বিস্তর এখনো পূজো করে। তবে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাঁ হাতের একটি আঙ্গুলে খুঁত থাকার কারণে সারা বছর পুজোর কাজ খুব একটা জোটে না, তাই কৃষি কাজটাই এখন তার প্রধান জীবিকা।
বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর যে স্নেহের বৃক্ষটুকু আঁকড়ে বড় হয়, সে গাছের ছায়াও গত বছর সরে যায়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া স্মৃতিচিহ্ন স্বরুপ একটি আশীর্বাদী কাস্তে বড়ই যত্নে রেখেছিল। সেই কাস্তেটা আজ রামচন্দ্র ধান ক্ষেতে হারিয়ে ফেলেছে। তাই তাঁর মনটা আজ খুব খারাপ। গালে হাত দিয়ে এক মনে তার কথাই শুধু ভেবে চলেছে। এমন সময় পাশের বাড়ির সুদক্ষের পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠা কন্যা দুর্গা এসে হাজির।
বছর দশের দুর্গা, যেমন সাহসী, দস্যি তেমনি মনে অগাধ দয়া মায়া। রামচন্দ্র তাকে খুব স্নেহ করে, তার হাতে হাতে কত কাজ দুর্গা করে দেয়। উনান লেপা, সব্জি কাটা,দোকান সদাই আনা ইত্যাদি।
আজ মহাষষ্ঠী, মায়ের বোধন। লাল টুকটুকে একটা জামা, মাথায় লাল ফিতে, পায়ে আলতা পরে এসেছে কাকাকে দেখাতে, কিন্তু রামচন্দ্র কাকা তো তাকে দেখতেই পেল না। বেশ কিছুক্ষণ কাকার দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর কাকার হাত ধরে ডাকতে থাকে কাকা....ও.....কাকা। তারপর ছোট্ট মনের সব কৌতূহল ঢেলে দেয় কাকার উপর আর বলে,"কি গো রামচন্দ্র কাকা মুখটা এমন বেজার করে দুয়ারে বসে আছো কেন? "
রামচন্দ্র তখন দুর্গার দিকে তাকায় এবং বলে," আর কইস না দুগ্গা, আমার সাধের কাইস্তেটা আজ হারাইয়া ফালাইসি।"
শুনেই দুর্গা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, কি বলছো কাকা,সে তো বহু পুরনো। তোমার বাবা-মার স্মৃতি, কবে থেকে তোমার হাতে দেখছি।
রামচন্দ্র একটু উচ্চস্বরে বলে, "হ.......হ.....ঐ কাইস্তেটাই। ঐডা শুধু কাইস্ততে ছিল না রে দুগ্গা, ঐডা যে আমার পূর্বপুরুষের আশীর্বাদও আছিল। কই যে হারাইলাম, আর খুঁইজ্জা পাইলাম না। কাল আবার খুঁজুম।"
--- কাকা আমি খুঁজে এনে দিচ্ছি তুমি একটুকুও চিন্তা করো না।
--- না দুগ্গা তরে এখন আর যাইতে হইব না। কইলাম ত আমি কাল আবার খুঁজুম।
যাস না কইতাসি.....
দুর্গা ক্ষেতের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে,
--- আমি তোমার কাস্তেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে চলে আসব....
--- উফঃ!মাইয়াটার মাথায় ভূত চাপলে একডাও কথা শোনে না।
রামচন্দ্র বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
সে আবার বলে ওঠে, যাইতাসিস যখন সাবধানে যা মা, তাড়াতাড়ি ফিরা আসিস।
--- দুর্গা আবার চিৎকার করে বলে, একদম চিন্তা করো না, কাকা, কাস্তেটা নিয়েই ফিরবো....।
দুর্গা সারা ধানক্ষেত চষে বেড়ালো কিন্তু কাস্তেটা খুঁজে পেল না। কে যেন অদৃশ্য আঁচলে লুকিয়ে খেলা করছে। দুর্গাও সহজে হাল ছাড়বে না। সে আরও জোর দিয়ে খুঁজতে থাকলো। এদিকে বেলা শেষ হয়ে আঁধার চাদর জড়িয়ে নিল সবুজ ধানক্ষেত।
ওদিকে রামচন্দ্র উদগ্রীব হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে উঠলো আর সে ঘরে বসে থাকতে পারলো না। হেরিকেন আর লাঠি নিয়ে ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায় আর বিড়বিড় করে... " কত্ত বার কইলাম সন্ধ্যে নামার আগে চইল্যা আসিস। দস্যি মাইয়্যা, একটাও কথা শোনে না,আমারই ভুল আসিল। একা ছাইড়া দিলাম কি কইরা! সন্ধ্যে নামার পর আবার ঐ...."
ভাবতে ভাবতেই রামচন্দ্রের শ্বাস আরো দ্রুত গতিতে বইতে থাকে। মন যে তাঁর এখন আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে আর ঠাকুর কে ডাকতে ডাকতে ঝড়ের গতিতে পা চালায়।
এদিকে শুক্ল পক্ষের ভাঙ্গা চাঁদ ও জোনাকির আলোয় চারিদিক অস্পষ্ট, দুর্গা মাটিতে হাতড়ে হাতড়ে এক মনে কাস্তে খুঁজতে ব্যস্ত।
এমন সময় কে যেন পিছন থেকে তার মাথায় আঘাত করে আর দুর্গা তখনই মাটির কোলে নুইয়ে পড়ে। শুধু শুনতে পায় কতগুলো অসুরের অট্টহাসি ও ললুপ্ত জিহ্বার লেলিহান। দুর্গা তার সমস্ত শক্তি একত্র করে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, প্রতিবাদ গড়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না।
রক্তে স্নাত ছোট্ট দুর্গা মাটির কোলে ঢুলে পড়ল। অবনী যেন তাকে সবুজ মাটির আঁচলে আড়াল করার সমস্ত চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ...
এমন সময় অস্পষ্ট চোখে রামচন্দ্র কাকাকে দেখতে পায় দুর্গা। রামচন্দ্র যে পরিস্থিতির কল্পনা করে এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিল সেই দৃশ্যই তার সামনে। ভয় না পেয়ে শক্ত করে লাঠিটা ধরে আর চিৎকার করে বলে," ওঠ আমার দস্যি দুগ্গা, ওঠ... এখন ঘুমাইবার বা দুব্বল হওয়ার সময় নাই, জাইগ্যা তরে উঠতেই হইবো মা দুগ্গা।" এই বলতে বলতে দুটোর মাথা গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেয়। সে লড়াই বেশ কিছুক্ষণ চলতে থাকে আর চলতে থাকে রামচন্দ্রের বোধন মন্ত্র উচ্চারণ....
রামচন্দ্র আবার চিৎকার করে বলে, "মা দুগ্গা তরে জাগতেই হইবো,আর ঘুমাইয়া থাকিস না, ওঠ মা ওঠ...তরে উঠতেই হইবো।" অনবরত দুর্গার কানে রামচন্দ্রের জাগরণ মন্ত্র ধ্বনিত হতে থাকে।দূর থেকে শঙ্খ, উলু ধ্বনি, ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে। বাতাস ও জোরে জোরে বইতে থাকে।
দুর্গা তার ভিতরে এক অদ্ভুত নারী শক্তির অনুভব করে। সে তার সমস্ত শক্তি একত্র করে এবং মাটিতে হাত ছড়াতে থাকে, আর খুঁজে পায় সেই রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষের আশীর্বাদী কাস্তে। সেই কাস্তে নিয়ে দুর্গা তাদের সামনে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক যেন দেবী স্বয়ং, মৃন্ময়ী চিন্ময়ী রূপে সামনে দাঁড়িয়ে। শত জোনাকির মিটিমিটি আলোয় রামচন্দ্র দুর্গার রূপ দেখে হতবাক। আপাদমস্তক মাটিমাখা, রক্তে স্নাত লাল রং, দু চোখে আগুন আগুন। তার ক্রোধাগ্নি যেন শুধুই অশুভের ধ্বংস চায়।
সেই আশীর্বাদী কাস্তেটা নিয়ে দুর্গা ধেয়ে যায় তাদের দিকে এবং শুরু হয় অসুর বধ। রামচন্দ্র জোড়হাতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। দুর্গা রাগে যেন উন্মাদ হয়ে ছুটছে আর বলছে," নারী শক্তিকে তোরা দুর্বল মনে করিস! নিরীহ মনে করিস! অসহায় মনে করিস! তোরা জানিস না এ নারী শক্তি যখন জাগে তোদের ছিঁড়ে ফেলতে পারে, ধ্বংস করে ফেলতে পারে। একে জাগাস না, জাগলে তোদেরই বিপদ। এবার দেখবি একে একে সব শক্তি জাগবে.... জাগবে সব নারী শক্তি..... জাগবে....."
একে একে সব অসুর বধ করে, কিন্তু তবুও দুর্গার রাগ থামে না, রামচন্দ্র করজোড়ে দুর্গাকে প্রণাম করে এবং শান্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর দুর্গা মাটির কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।
গ্রামবাসীরা চিৎকার, চেঁচামেচির আওয়াজে সেই স্থানে উপস্থিত হয় এবং দুর্গা ও রামচন্দ্র কে ঘরে ফিরিয়ে এনে চিকিৎসা করায়। দুর্গা আস্তে আস্তে চোখ খোলে আর বলে রামচন্দ্র কাকা তোমার কাস্তেটা ফিরিয়ে এনেছি আমি...
ওদিকে বোধন শেষ মা আলো করে বসে আছেন আসনে।
Comments