বিদায় বেলায়
কাশফিয়া নাহিয়ান
আসুন আসুন...ঘরে আসুন।ঘরে এসে আমাকে উদ্ধার করুন।
এভাবে কেন বলছেন...
তো আর কিভাবে বলবো?গ্রামের বাড়ি গেলাম বাবা মা কে দেখতে...আর তারা কিনা জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। আমি আদিল মাহমুদ। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি।আর তাকে কিনা বিয়ে করতে হলো আপনার মত গেঁয়ো ভূতকে...আনবিলিভেবল..
দেখুন... আমি মোটেও গেঁয়ো ভূত নই।গ্রামে থাকি ঠিকই কিনতু আমি পড়াশোনা জানা মেয়ে... কলেজ পর্যন্ত পড়েছি... অনেক দূর পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছা ছিল। আমার বাবা মাও তো আমাকে জোর করে...
ব্যস ব্যস!ফাহিমা আমি আর আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না...ওই যে ওইদিকের রুমটা আপনার...আর এই দিকেরটা আমার। ভুলেও আমার রুমে আসবেন না।আমাকে একদম বিরক্ত করবেন না...
অবাক হয়ে রুমে ঢুকলো ফাহিমা।সে জানে না আদিল তার সাথে এমন ব্যবহার কেন করছে...তার কি দোষ?
এই নিন আপনার চা...
আমি কি আপনাকে চা আনতে বলেছি... এরকম গায়ে পড়া অভ্যাস আমার মোটেও পছন্দ না...
আমি তো শুধু...
মুখে মুখে তর্ক করবেন না... ফাহিমা আমার কোনো কাজ আপনি করবেন না।এই বাড়ি থেকে বের হবেন না... আপনার যা প্রয়োজন সব পেয়ে যাবেন.. কিন্তু বাড়ির বাইরে পা রাখবেন না। কথাগুলো মনে থাকবে?
ঠিক আছে...ফাহিমা সব কথা মেনে নিলো আদিলের।কারণ শুধু শুধু বাকবিতন্ডায় নিজেকে জড়ানো উচিত হবে না।
সে জানে না সে ভালো করছে না খারাপ করছে! আদিল তাকে কখনো মেনে নেবে কিনা তার সংসার টিকবে কিনা কিছুরই ঠিক নেই।
হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠলো...
আদিলের মোবাইল! ফোন ধরবে কি ধরবে না বুঝতে পারছে না সে। তবুও ফোনটা ধরলো ফাহিমা...
হ্যালো...
আদিল কোথায় তুই...এক সেকেন্ড... তোর আওয়াজটা মেয়েদের মত লাগছে কেন...
আমি..আদিল না ওনার ওয়াইফ ফাহিমা...
কে...
আ...মি...
হঠাৎ ফোনটা কেটে গেলো।সে বুঝতে পারলো না কে ফোন দিয়েছিলো... কিছুক্ষণ পর কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিলো আদিল।
এই তুই কোথায় ছিলি রে...আর একি শুনছি.. তুই নাকি বিয়ে করেছিস?
ইরফান তুই আ..মার কথাটা শোন...
কি শোনার বাকি আছে... তুই একা একা বিয়ে করে ফেললি...আমাকে জানালি না...হাউ মিন...
সব কিছু এত জলদি হয়ে গেলো যে...
আ..দিল কে এ..সে...ছে?
তো... আপনি.. আদিলের...
জ্বী... আপনি...
আমি ইরফান...আদিলের বেস্ট ফ্রেন্ড।
আপনি এখানে কি করছেন?যান নিজের রুমে যান...
ফাহিমা তার রুমে চলে গেলো।
এভাবে কেউ নিজের বউ এর সাথে কথা বলে...
আর বউ..গ্রামের মেয়ে...আমার সাথে ম্যাচ খায় নাকি?
এভাবে বলছিস কেন?দেখতে শুনতে তো বেশ ভালো...একটু সময় নে।সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেলো ইরফান...এক দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাটা বললো আদিল।
দিন পার হতে থাকলো।মাস পার হতে থাকলো।আদিলের ফাহিমার উপর অত্যাচার বাড়তেই থাকলো।কথায় কথায় তাকে অপমান করা হয়ে গিয়েছিলো আদিলের শখ।
আর এদিকে ইরফান যার প্রথম দেখাতেই ফাহিমা কে ভালো লেগে গিয়েছিলো...তার নিষ্পাপ চেহারা মায়াবী হাসি তাকে পাগল করে দিয়েছিলো। সবসময় কোনো না কোনো অজুহাতে ছুটে যেতো ফাহিমার কাছে।আর ফাহিমা সবকিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। ইরফানের মনে কি চলছে তা সে একটুকু আঁচ করতে পারেনি।
আজ বাইরের খাবার খেতে একদম ইচ্ছা করছে না তাই চলে এলাম...
বসুন... ইরফান ভাই...আমি এখনই আসছি...
ফাহিমা তখনই গোসল করে এসেছে।লম্বা ভেজা চুলে অপূর্ব লাগছে তাকে... ইরফান মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে।সে ভেবে অবাক হয়ে যায় এত সুন্দর একটি মেয়েকে কেউ ভালো না বেসে কিভাবে পারে...
আদিল আপনাকে কখনও মেনে নেবে না..
মানে?
মানে...ওর এত বড়ো একটা ইগো আছে...
ওই সেই বলয় থেকে কখনই বের হয়ে আসতে পারবে না।
এভাবে কেন বলছেন? আমি জানি ও আমার কাছে একদিন ঠিকই ফিরবে।
তুমি কেন বুঝতে পারছো না তুমি এর চেয়ে অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ব করো..আমাকে তোমার চোখে পড়ে না... আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! ফাহিমার হাত চেপে ধরে বললো ইরফান...
এসব কি বলছেন? ছাড়ুন আমাকে...
আমার চোখ দেখে বুঝতে পারো না... তোমার জন্য কতটা ভালোবাসা লুকিয়ে আছে...
আমি কিছু বুঝতে চাই না... আমি আপনাকে কখনও সেই চোখে দেখিনি... আপনার লজ্জা করছে না আমাকে এসব কথা বলতে?চলে যান এখান থেকে...
আমি কোথাও যাবো না...আজ তোমাকে বলতেই হবে তুমিও আমাকে ভালোবাসো...তাকে জাপটে ধরে বললো ইরফান...
ফাহিমা নিজেকে ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না...
ইরফান...
আদিলকে দেখে ফাহিমাকে ছেড়ে দিলো সে...
এখানে এসব কি হচ্ছে...
কেন এত অবাক হওয়ার কি আছে? তুই তো কখনও ফাহিমাকে নিজের বউ হিসেবে মেনে নিবি না...যদি আমি তাকে ভালোবাসি তো এতে ক্ষতি কি?
তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস ইরফান...
কেন তোর এত গায়ে লাগছে কেন? তুই তো কথায় কথায় ফাহিমাকে অপমান করিস...
তখনই তাকে এক ঘুষি মারলো আদিল...
দুই জনের মারামারি চরম পর্যায়ে চলে গেলো... হঠাৎ আদিলের চড় খেয়ে ইরফান টেবিলের সাথে ধাক্কা খেলো...তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়লো... রক্তে ভিজে গেলো চারপাশ...
ইরফান এই ইরফান?কি হলো তোর...আদিলের আর বুঝতে বাকি রইল না ইরফান মারা গেছে...
এ...টা কি হ..লো? কাঁপা কাঁপা গলায় বললো ফাহিমা...
ও...মা..রা গেছে...
আমরা...এখ..ন কি কর...বো? আমাদের তো পুলিশ...
চুপ একদম চুপ! কিছু হবে না আমাদের... নিজেকে সামলে নিয়ে বললো আদিল। কাউকে কিছু না জানিয়ে আমাদের এই লাশটা সরাতে হবে। নিজেদের বাঁচাতে হবে...
এসব আপনি কি বলছেন?
ঠিকই বলছি... এছাড়া আর কোনো উপায় নেই...
এক বড় স্যুটকেসে ইরফানের লাশটা ভরে ফাহিমাকে সঙ্গে করে নিজের গাড়ীতে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালো আদিল।
এক সুনসান জায়গায় গাড়ীটা থামিয়ে ইরফানের লাশটা পুঁতে দিলো সে...
আর ফাহিমা..তখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে..
চুপ করো..একদম কাঁদবে না। কিছু হবে না আমাদের...
সে কোনো কথা বললো না...শুধু কেঁদেই চললো...
কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না আদিল...গাড়ী ড্রাইভ করছে সে আর রাজ্যের চিন্তা তার মাথায়... হঠাৎ অসতর্ক অবস্থায় গাড়ীটা আ্যক্সিডেন্ট করলো...
আদিল যখন চোখ খুললো তখন সে হসপিটালের বেডে...
আপনি উঠবেন না প্লিজ...ইউ নিড রেস্ট।
আমি..কো..থা...য়?
আপনি হসপিটালে... তিন দিন পর আপনার জ্ঞান ফিরলো।আপনার একটা বড় আ্যক্সিডেন্ট হয়েছিলো... কিছু মনে পড়ে?
ফা..হি..মা..
কে? আপনার সাথে যিনি এসেছিলেন তিনি তো..
কি হয়েছে ফাহিমার... উত্তেজিত হয়ে বললো আদিল...
উনার অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল ছিলো...এখন উনি কোমাতে..
জ্বী...কি বলছেন ডক্টর...
ঠিকই শুনেছেন কখন ওনার জ্ঞান ফিরবে বলা মুশকিল...
আদিলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কিছুই বুঝতে পারছে না সে কি করবে...
নাওয়া নেই খাওয়া নেই...এখন তার একটাই কাজ ফাহিমার পাশে বসে থাকা...
তার হাত ধরে কান্নাকাটি করে। মনমরা হয়ে বসে থাকে।শুধু একটাই চাওয়া ফাহিমার যেন জ্ঞান ফিরে আসে...
প্লিজ একবার চোখ খোলো।আমাকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও।জানো অনেকবার জীবনকে প্রশ্ন করলাম। নিজেকে কাটাছেঁড়া করলাম। ফাহিমা আমি বুঝে গেছি তুমি ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি তোমার সাথে সূর্যোদয় দেখতে চাই। সূর্যাস্ত দেখতে চাই।তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে চাই। তোমার কোলে মাথা রেখে পরম শান্তিতে মরতে চাই। তুমি নেই তাই নিজেকে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে...খুব একা লাগে...আমার কিছু ভালো লাগে না... তুমি আমার জীবনে এসেছিলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আর আমি কিনা তোমাকে...
ফাহিমা চোখ খোলে না।কোনো রেসপন্স করে না... হঠাৎ করে গভীর রাতে রুমটা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে যায়...কারো গোঙানির আওয়াজ আসে...মনে হয় কেউ কাঁদছে। আদিল কারো উপস্থিতি টের পায়... কিন্তু ভাবে হয়তো তারই মনের ভুল...
কিন্তু আদিলের ভাবনা ভুল নয়।ফাহিমার শিয়রে বসে থাকে ইরফান...যে মরে গিয়েও ফিরে এসেছে তার ভালোবাসার টানে।যে এখনও বিশ্বাস করে ফাহিমা শুধু তার আর কারও না.. যে তাকে নিয়ে যেতে চায় তার জগতে...কারণ ফাহিমার নামই তো উচ্চারিত হচ্ছিলো ইরফানের বিদা
য় বেলায়.... পরিশেষে কার জয় হবে? ইরফানের মত অশরীরীর নাকি আদিল আর ফাহিমার ভালোবাসার?
No comments:
Post a Comment