Wednesday, October 23, 2024

মধ্যবিত্ত প্রেম - সুতপা সোঽহং || Moddhobitto Prem - Sutapa Sohong || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 মধ্যবিত্ত প্রেম

        সুতপা সোঽহং



তানি জোর করে আমার কবিতার খাতা টেনে পড়তে শুরু করেছে। মাথা নিচু করে এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে যে ওর ওড়না যে মাটিতে গড়াচ্ছে সেদিকে নজর নেই। কচি কলাপাতা রঙের ওড়না। ওঠাতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ও লজ্জা পেতে পারে। থাক। ওকে ওড়না ছাড়া দেখিনি কখনো। তাকাব না তাকাব না করেও চোখ গলা পেরিয়ে বুকের খাঁজের দিকে গেছে। তৎক্ষণাৎ শরীর যেন জানান দিল আমি বছর কুড়ির ছেলে। সামনে বৈশাখে একুশে পড়ব। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। চোখ মনের সাথে পাল্লা দিয়ে অবাধ্য হচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। মার লাগানো স্হল পদ্মের কুড়ি দু একটা করে ফুটতে শুরু করেছে। গাছটা আছে। মানুষটা নেই। থাকলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হত। এতটা উদাসীন, এতটা ছন্নছাড়া হয়তো হতাম না। কিংবা হয়তো আরো খারাপ হতাম। কে বলতে পারে! যা নেই তা নিয়ে আমাদের আফশোষ করার স্বভাব। যা আছে তার মূল্য আমরা কখনো দিই না। এই যেমন এই তানি মেয়েটা সবসময় খেয়াল রাখে কোথায় যাচ্ছি, কী খাচ্ছি। কিন্তু আমি তো খবর নিই না কখনো ওর। কখনো চোখে চোখ পড়লে মনে হয় ওর কী যেন এক দাবি আছে আমার উপর। অলিখিত, অনুচ্চারিত। দরজা দিয়ে তানিকে দেখা যাচ্ছে। খাতাটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এসময় ঘরে ঢোকা যাবে না। কবিতা পড়লে কী এক ঘোর, মায়া কাজ করে। এসময় মানুষ আবেগে যা খুশি করতে পারে। উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পকেট হাতড়ে একটা বিশ টাকার নোট পেলাম। আজকের মতো চলে যাবে। সিগারেটও আছে একটা। আর কি চাই! নিজেকে রাজা রাজা মনে হচ্ছে। বল্টুদার চায়ের দোকানে ভিড় নেই আজকে। বসলাম। বল্টুদার বৌ চা করছে। পাশে মেয়ে বস্তা পেতে বই নিয়ে বসে আছে। কিন্তু মন তার পরোটার দিকে। হয়তো সকাল থেকে তার পেটে কিছু পড়ে নি। হয়তো খরচ বাঁচাতে একেবারে দুপুরে খাওয়া হয়। একদিন দুপুরের দিকে এসেছিলাম এদিকে। সে সময় বল্টুদা মেয়ে বউ নিয়ে খেতে বসেছে। বসা মানে ওই একহাতে থালা নিয়ে বেঞ্চে খাওয়া আর কি। পরোটার জন্য বানানো তরকারি আর ভাত। কিন্তু তাতে কী! খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল অমৃত বোধহয়। থালায় এক কণা ভাত তরকারিও পড়ে ছিল না। আসলে খাওয়ার জিনিসের স্বাদ কী তা না খেতে পাওয়া মানুষের কাছেই জানা যায়। মেয়েটার একমাথা তেল না দেওয়া রুক্ষ চুল। একটা নোংরা চিমড়ানো কলমের মুখটি চিবুচ্ছে থেকে থেকে।বল্টুদা দক্ষ হাতে পরোটায় মাখন লাগাচ্ছে। সে গন্ধে ম ম করছে চত্বর। চাটায় দিয়ে ঘেরা দেওয়া দোকান। ভিতরে আরেকটা চাটায় দিয়ে ঘেরা। চৌকির একটা কোণ দেখা যাচ্ছে। ইতস্তত নোংরা কাপড় ঝুলছে। এখানেই একটা সংসার গড়ে তুলেছে। খেতে খেতেই বিষম খায় পল্টু দা। ব‌উটি তড়িঘড়ি জল দেয়, পিঠে হাত বুলায়, কী জানি এক মন্ত্র পড়ে মাথায় ফুঁ দেয়। আমি বসে বসে দেখি। বড় ভালো লাগে।অভাবী কিন্তু ছোট্ট সুখী সংসার। এই ব‌উটির কাছেই শোনা বল্টুদা অনাথ। ভিটে টুকুও নেই। বড় কষ্ট করে এই ছোট্ট দোকান টুকু দাঁড় করিয়েছে।

আমি শুধু ভাবি এই যে এতো কোটি কোটি মানুষ প্রত্যেকের জীবনের গল্প আলাদা, জীবন সংগ্রামের গল্প আলাদা। এ যেন অসীম সংখ্যা নিয়ে প্রবাবিলিটির খেলা। কোন সজ্জার সাথে কোন সজ্জার মিল নেই। অথচ উপাদান সংখ্যা গুলো একই। বল্টুদা চায়ের কাপ নিয়ে এল। পরোটার কথা জিজ্ঞেস করে না এখন আর। জানে আমি খালি চা‌ খাই। আসলে খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু টাকা থাকে না অত। পরের মাসে টিউশনের টাকাটা পেলে একদিন খাব। এই মাসের আরো তিনদিন চালাতে হবে একশো টাকায়। ঘরে চিড়া, লবন আছে। চিন্তা নেই। ঘরে ফেরা যাক। তানি এতোক্ষণে কী করছে কে জানে। ঘর পাহারা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। বলেও আসি নি। পা চালালাম। এক মিষ্টির দোকানের সামনে কিছু জটলা। এক পাগলীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। মিষ্টি চুরি করার নাকি তালে ছিল। এ এলাকার সে না। সমানে 'খিদা খিদা। পেট জ্বলে গেল। খেতে দে না ও বাবারা' বলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠে মুখ খিস্তিও। ডানহাতে এক বড় ঘা। তাতে মাছি ভ্যানভ্যান করছে। দোকানের এক ছোকরা কী এক অশ্লীল ইঙ্গিত করল। পাশে বসা দুই কাস্টোমার হো হো করে হেসে চোখ দিয়েই পাগলীর শরীর যেন চেটে খেল। বেঁধে রাখার পিছনে কোন খারাপ মতলব নেই তো? কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু সাধারণ জনতার মতো কিছু করলে তার উল্টো ফল হতে পারে। বর্তমান সময়ে কার্যকরী শুধু টাকা আর ক্ষমতা। যেদুটোর একটাও আমার নেই। জামাটাকে যথা সম্ভব ঠিক করে একেবারে দোকানের মালিকের সামনে। হুংকার দেওয়ার গলায় বললাম 'এঁকে কে বেঁধে রেখেছে? মানবাধিকার কমিশন থেকে আমাকে পাঠানো হয়েছে। মলয় দত্ত বলে কেউ এখান থেকে ফোন করে জানিয়েছে।' ওরা একে ওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমাকে পা থেকে মাথা জরিপ করে বলল ' কী কমিশন বললেন দেখে তো মনে হচ্ছে না। আর মলয় দত্ত কে তাও জানি না। প্রমান ছাড়া তো ও মাগীকে ছাড়া যাবে না।' আমার কোঁচকানো শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। জানি বিশ্বাসযোগ্য না। তারপরেও মুখে, গলায় গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম 'আমি এই এলাকায় থাকি। এতো সকালে কমিশন থেকে ফোন পেয়েই এলাম। দোষ করলেও এমন‌ ধরনের মানুষের উপর শারীরিক কিংবা মানসিক অত্যাচার আইনবিরোধী। '

"Don't judge a book by it's cover"

প্রবাদটা নিজে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। কিন্তু ওরা তো করে না। ফোনটা বের করে মিছামিছি কারোর সাথে কথা বলার অভিনয় করছি। পুলিশ, জেল ইত্যাদি শব্দ গুলো দুতিন বার জোরে জোরে উচ্চারণ করলাম। মালিকের মুখের অভিব্যক্তি খুব একটা বদলালো না। এবার অন্য কারোর সাথে ফোন করে কথা বলছি ভাণ করে ইংলিশে কথা বলা শুরু করলাম। এবারও জেল, পুলিশ বললাম। হুম এবার ওষুধে কাজ দিয়েছে। মালিক চোখের ইশারায় দড়ি খুলতে বলল।

হায়রে ইংরেজ গেছে কবে দেশ ছেড়ে। কিন্তু দাসত্ব আর ফুরোলো না। মাতৃভাষা যা পারে নি ইংরেজি ভাষায় তা সম্ভব। তুমি ইংরেজি পারো মানে এলেমদার লোক। অফিসার কেন সবই হতে পারো যদি নাক সিটকিয়ে বলতে পারো ' shit, fuck.....' তারমানে তোমার লেবেল আছে ভাই।


যাহোক এখানে তো একটা ভালো কাজ উদ্ধার হল। পাগলী ছাড়া পেতেই দৌড়ে একটা ভাতের হোটেলে গিয়ে ঢুকলো। ও বোধহয় খেয়াল করছিল এদিকে। আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম। একশো টাকাটা বের করে পাগলীটাকে খেতে দিতে বললাম। অতো সকালে রান্না হয় নি। শুধু ভাত উপুড় দিয়েছে। বললাম 'বাসি তরকারি আছে নাকি কিছু? থাকলে তা দিয়েই দিয়ে দাও'। পাগলীর সামনে বাসি ডাল দিয়ে থালায় ভাত বেড়ে দিল। আগুনের মতো গরম ভাত। হাত দেওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু পাগলীর যেন তর সইছে না। ওমনই গরম ভাত মুখে নিয়ে আঃ উঃ করে খেতে শুরু করল। ভীষণ কান্না পেল। তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় হোটেলের মালিক টাকা ফেরত নিতে বলল। অবাক হলাম। মালিক লোকটা একটু হেসে বলল 'দাদা আমরাও গরীব মানুষ। মন চাইলেও ফ্রি তে খাওয়াতে পারি না। তবুও এটার দাম নিতে পারব না।' ভাতের দোকানটাতে চোখ বুলিয়ে দেখলাম মিষ্টির দোকানদার এর থেকে অনেক বেশি বড়োলোক কিন্তু তাতে কী! মনের দিক দিয়ে বড় গরীব।


তানি বোধহয় রেগে গেছে এতোক্ষণে। ঘটনা শুনলে রাগ কমতে পারে কিন্তু বলার সুযোগ দিলে তো। না বলে বেরোলে রাগ করে খুব। কিন্তু আমি সে অধিকার দিতে চাই না। চাই না আমার এই রকম একটা টানাটানির সংসারে ও নিজেকে জড়াক। এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি আসলাম। এসে দেখি তানি রান্নাঘরে। খুন্তি নাড়ছে। রান্নার সুন্দর গন্ধ বেরিয়েছে। মেয়েটা করে কী! আমার পায়ের আওয়াজে পিছন ফিরে বলল "কিছুই খুঁজে পেলাম না। চিড়া পেলাম শুধু। তাই দিয়েই পোলাও বানাচ্ছি। বাদাম, কিশমিশ ছাড়া। জানি না খেতে পারবে কিনা। হয়ে গেছে। ঘরে যাও। দিচ্ছি।"


বিনা বাক্যব্যয়ে ঘরে আসলাম। পেটে ছুঁচোর ডন চলছে। প্লেটে করে দিয়ে গেল। কী অসাধারণ হয়েছে খেতে। ইস্ মেয়েটাকে সত্যিই যদি ঘরের বউ করে আনতে পারতাম! কিন্তু আমারই চলে না। ওর দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে পারব না।


"কী ব্যাপার চোখ মুখ বুজে তো খাচ্ছো। খুব কী অখাদ্য হয়েছে?

" না না চমৎকার হয়েছে। তুমি খাবে না? "

"না আমার পেট ভরা। খেয়েই এসেছি। তুমি খাও।"


আমি জানি ডাহা মিথ্যা কথা। ওদেরও টানাটানির সংসার। বাবা দর্জি। তিন ছেলেমেয়ে। তানিই বড়ো। টিউশন করে সারাদিন। কখন যে নিজের পড়া পড়ে কে জানে! কিন্তু খাওয়া নিয়ে জোর করে লাভ নেই। খাবে না কিছুতেই। বড্ড জেদী। বহুদিন এমন হয়েছে নিজের খাবার আমাকে এসে দিয়ে গেছে। নিজে খালি পেটে থেকেছে। কিন্তু ওকে আর এসব করতে দেওয়া যাবে না। এখন থেকে কঠোর হতে হবে। নাহলে দুজনের কষ্ট বাড়বে বই কমবে না। জিজ্ঞেস করলাম " শোনো, বাড়ি যাও। আর এভাবে হুটহাট করে এসো না। রান্না করো না। মিলির বাড়ির লোক জানলে আর আমার সাথে বিয়ে দিবে না।"


"মিলি কে?"


"বান্ধবী। ওর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করা আছে।"


"হতেই পারে না। তুমি হবে বিয়েতে রাজী!!!! তাহলেই হয়েছে! তোমাকে আমি চিনি না?"


"না রাজী হওয়ার তো কোন কারণ নেই। বিয়ে করলে ওর বাবার অর্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিবে। সেই টাকায় একটা ব্যবস্যা শুরু করতে পারব।"


"টাকার জন্য বিয়ে করবে? যদি গরীব বাবার মেয়ে হয় তবে করবে না?"


"নাহ গরীব মেয়েকে বিয়ে করে কী করব? "


"যদি মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে তাহলে?"


"তাহলেও না। ভালোবাসা দিয়ে কি ব্যবসা করতে পারব? টাকা চাই টাকা। মিলিকে বিয়ে করলে যেটা পাব। যাহোক তুমি আর ঘনঘন এসো না। আমার বিরক্ত লাগে।"


"বিরক্ত লাগে?!!! এটা তো কখনো বলো নি। বেশ আর আসবো না।" অন্য দিকে তাকিয়ে কথাগুলো কোনরকমে বলে তানি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি জানি ওকে আজ জন্মের কষ্ট দিয়েছি আর সেইটার পিছনে গরীব হওয়াকেই দোষ ঠাউরেছি। অথচ এই দোষের শাস্তি বা কষ্ট চিরকাল আমিও পেয়ে আসছি। মেয়েটা বোধহয় আজ সারাদিন কাঁদবে। রাতে শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি এমন সময়ে দরজায় গুম গুম করে আওয়াজ হলো। আমার দরজায় কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই অন্তত এ সময়ে। উঠে দরজা খুলে দেখলাম তানির বোন রুপু। রীতিমত হাঁফাচ্ছে।


 'কীরে তুই এতো রাতে?'


'দা শিগগির চলো। দিদি ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার লোক নেই।'


আমার পায়ের নীচের মাটি দুলে উঠলো। ওকে মিথ্যা বলার পরিণাম যে এমন হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন আর ভাবার সময় নেই। দৌড়ালাম। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যখন ইমারজেন্সি থেকে বেরিয়ে এলাম মনে হলো অনেক ম্যাচিওর হয়ে গেছি এই কয়েক ঘন্টায়। এখনো বোধহয় প্রেম বলে কিছু আছে। এখনো বোধহয় সবাই শুধু টাকার পেছনে ছোটে না। এই কাঠখোট্টার শহরে এখনো কিছু মানুষ ভালোবাসার জন্য নিজের জীবন দিতেও পিছপা হয় না। 

সারা রাত যমে মানুষে টানাটানি। ভোরের দিকে ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন রোগী বিপদমুক্ত। পূর্ব দিকে লাল সূর্য উঠছে নতুন একটা দিনের আশা নিয়ে। ঘরে গিয়েই চাকরির ব‌ই গুলো খুঁজে বের করতে হবে। হার মেনে নিলে চলবে না। জিততে আমাকে হবে আমার জন্য, তানির জন্য, আমাদের জন্য!

বিদ্রুপে - তুষার দেবনাথ || Bidrupe - Tushar Debnath || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

বিদ্রুপে                                   

   তুষার দেবনাথ 


   একটি ট্রেন এসেছিল প্লাটফর্মে, লোকজনের আনাগোনা একটু কম,শেষ ট্রেনটা হুইসেল বাজিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে তার যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে,জ্যোৎস্না রাতের পর অষ্টমীর চাঁদ খানা ক্ষয়ে গেলেও তার আলোতে স্টেশনখানা এক অদ্ভুত অনুভূতিতে জড়িয়ে রয়েছে। স্টেশনখানা রে বড়ো খুব এমন নয়,

মাঝারি গোছের, তবে দিনমানে লোকজন চলাচল করলেও রাতের দিকে বেশ ফাঁকা ফাঁকা।

                 

                            বছর দশেকের একটা মেয়ে, এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল কিছুক্ষন ধরে, দেখে সাধারণ বাচ্চাদের মতো হলেও তার চাহনির মধ্যে দীর্ঘ 

প্রশান্তি, মেয়েটির সামনের কোঁকড়ানো চুল কপালের দুদিকে ঝুলে রয়েছে।সরু কপালের দুপাশ দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো চোখের ওপর এসে পড়ে।

     

                                শেষ ট্রেনটা যখন স্টেশনে পৌছালে,ট্রেন থেকে নামলো ঋত্বিক, পুরো নাম ঋত্বিক চক্রবর্তী।আজ অনেকদিন পর সে ট্রেনে ভ্রমণ করেছে,

সাধারণত নিজস্ব দুটো বিলাসবহুল গাড়িতেই সে কাজে যায়‌। তাছাড়া ছয়, সাতটা শখের বাইক তো পড়েই থাকে। আজ কী হঠাৎ মনে হলো ট্রেনে করে

রশ্মিতার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করলো।রশ্মিতা সদ্য কলেজে প্রবেশ করেছে, অবশ্য তার আগে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে তিনবছর, কিন্তু তার বরাবর ইচ্ছে শিক্ষিকা হবে, সমাজ সংস্কৃতি বাঁচাবে। রশ্মিতাকে বাড়িতে সবাই রাধিকা বলে ডাকে।তার সাথে ঋত্বিকের পরিচয় হয় কলেজেই, ঋত্বিক ওদের কলেজে কোনো একটা অনুষ্ঠানে গিয়েই,রশ্মিতাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু প্রথম দেখাতেই কিছু বলতে পারেনি,তারপর ফেসবুকে তার নাম খুঁজে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়, অবশেষে সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ব হয়, বন্ধুত্ব দৃঢ় হলে পৌছায় সম্পর্কে, অবশ্য রাধিকা মানে রশ্মিতা ঋত্বিককে প্রথমে ঠাট্টা করে ঋত্বিকদা বলেই ডাকতো।

                    

                                      "বাবু , দুটি টাকা দেন না, কিছু খাবো!",,,,,,,,

কথাটি শুনে চমকে ওঠে ঋত্বিক,তার পায়ের কাছে বসে একটা ১০ বছরের বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটির করুণ চোখে চিত্রিত এক দীর্ঘ ক্লান্তি। ঋত্বিক সাধারণত একটু কড়া ধাঁচের,সে মনে করে সমাজে মানুষ ইচ্ছা করেই ভিক্ষা করে কাজ করার বদলে।সে এরকম অনেকেই দেখেছে,তাই সে এইসব দান ধ্যানের ব্যপারে উদাসীন।

তাই সে মেয়েটিকে কিছু বলতে যাবে, এমন সময় ট্রেন থেকে নামলো রশ্মিতা।সে তার ব্যাগ থেকে একপ্যাকেট বিস্কুট মেয়েটিকে খেতে দিল, তাতে ঋত্বিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই রশ্মিতার ইশারা ওর ইশারাকে গিলে নিয়ে ওকে শান্ত করে দিল। এদিক থেকে ঋত্বিক দুর্বল, আসলে তার সাধনার ফল তো,তাই। আসলে রশ্মিতার এই ভালোমানুষি গুলোই ঋত্বিককে বেশী আকর্ষণ করে,সে নিজে রুক্ষ মানুষ হলেও। আবার রশ্মিতাও জানে ঋত্বিকের এরকম হোওয়ার কারণ। আসলে যারা দরিদ্রতা স্পর্শ করে বড়ো হয়,যারা ছেলেমানুষি, খুনসুটি করার বয়সে দুবেলা অভুক্ত থেকেও বাঁচার স্বপ্ন দেখে, তাদের মনের বাইরে এক ঢাল তৈরী হয়ে যায়,যেই ঢাল তাদের মনের মধ্যে আর কষ্ট পৌঁছাতে দেয় না। কিন্তু ঝিনুকের শক্ত খোলশের মধ্যেই যে মুক্তোর সন্ধান মেলে, সেই মুক্তোটাই খুঁজে পেয়েছিল ঋত্বিকের মধ্যে।

                    ঋত্বিক এবার একটু শান্ত থাকে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।রশ্মিতাই কথা বলুক বরং মেয়েটির সঙ্গে।রশ্মিতা মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলো-"তোমার নাম কী,?"

মেয়েটি জবাব দেয় না, আবার রশ্মিতা জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি জবাব দেয়"অপরাজিতা"

মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় রশ্মিতা।সে বুঝতেই পারছে মেয়েটি অনেক সময় ধরে ক্ষিদের জ্বালা সয়েছে, এবার যখন ভাগ্যবলে খাবার পেয়েছে তখন তা না খেয়ে কী অপেক্ষা করা যায়। মেয়েটি খাওয়া শেষ হলে রশ্মিতা তার জলের বোতলটা এগিয়ে দেয়, মেয়েটির দিকে, মেয়েটি ঢকঢক করে জল খায়,এক চরম প্রশান্তির ছোঁয়া পেয়ে মেয়েটির চোখ যেন ঘুমে জড়িয়ে যায়।

রশ্মিতা এবার তাকে আবার প্রশ্ন করে-"তোমার বাবা মা কেও নেই"

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে প্রশ্নটি শুনে, তারপর জবাবে সে দুদিকে ঘাড় নেড়ে জানায় নেই।

রশ্মিতা বলে "আচ্ছা তুমি খাবার না পেলে কী করতে"

প্রশ্নটি যেন আচমকা ঝটকা দেয় ঋত্বিকের মনে।

বাচ্চাটি জবাব দেয় -"ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মাকে বলতাম,মা আমার না খুব ক্ষিদে পেয়েছে, কিছু খেতে পাইনি মা, তারপর ওই স্টেশনের কল থেকে জল খেয়ে শুয়ে পড়তাম।"মেয়েটিকে আরো একপ্যাকেট বিস্কুট দিয়ে রশ্মিতা বলে কালকে সে তাকে নিতে আসবে,তার থাকার ব্যবস্থা করার জন্য। মেয়েটি খুশিমনে বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিয়ে স্টেশনের ছাউনির তলায় শুতে যায়।

এরপর রশ্মিতা ঋত্বিকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বলে,"কী ঋত্বিক মশাই, বাড়ি যাবেন না এখানেই রাত কাটাবেন?"


       প্রশ্নটি শুনে ঋত্বিকের হুশ ফিরলে সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়‌, অন্ধকারে ঋত্বিকের চোখ থেকে কয়েকফোঁটা জল খসে পড়ে অজান্তেই। মেয়েটির শেষের কথাগুলো যেন তার বড়োই চেনা, বড়োই চেনা।

তার বাবার মুখে সে শুনেছে,যখন তার বাবা খাবারের শেষটুকু ঋত্বিকের পাতে তুলে দিতেন, এবং ঋত্বিক তাকে খেতে বললে,তার বাবা হাসতেন,আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলতেন ----

               " ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় 

                 পূর্ণিমার চাঁদ যেনো ঝলসানো রুটি"‌।

রুদ্র গায়ত্রী কথা - মৌসুমী সরকার || Rudra Gayatri kotha - Mousumi Sarkar || বড় গল্প || Story || Bengali story || Big story || Bengali audio story || Short story

 রুদ্র গায়ত্রী কথা 

          মৌসুমী সরকার 



১ম পর্ব  


চিতোর হইতে একটি টি ঘোটক উদয়পুর যাইতেছে , অপরাহ্নের প্রখর রৌদ্র , শুস্ক , কঠিন তাপ চারিপাশে বিকীর্ণ হইতেছে , , রুদ্র নিজ গৃহে ফিরিতেছে । তাহার পিতা উদয়পুরের প্রতিষ্ঠিত বস্ত্র ব্যবসায়ী , রুদ্রর বয়স ২২ হইবে , তাহার বাটি তে মাতা ও দুই ভ্রাতা রহিয়াছে , সে আসিয়াছে , ভগিনী কে দেখিতে । তাহার ভগিনীর চিতোরে বিবাহ হইয়াছে , নাম তারা । মহা রানা প্রতাপের কল্যানে তাহাদের রাজপুতানায় শান্তি তে দিবস কাটিয়া যায় । শত্রূ দিগের লোলুপ আঁখি রাজ পুতানার ওপর পড়িলেও , মহা রানা শক্ত হস্তে দমন করিয়াছেন, আপাতত নিরুপদ্রবে দিন কাটিয়া যাইতেছে । কিছু দিবস ভগিনী কে না দেখিয়া মাতা উতলা হইয়াছিলেন , মাতার আদেশে সে তারা কে দেখিতে আসিয়া দুই দিবস থাকিয়া ফিরিয়া যাইতেছে । তাহার ভগ্নিপতির ও চিতোরে বৃহৎ বস্ত্র বিপনী রহিয়াছে । ভগিনী ভালো আছে , স্বামী , শ্বশুর শশ্রু মাতা সবাই ভারী ভালো মানুষ , তারা সৌভাগ্য বতি । কিন্তু রুদ্র নিজে ভারী চিন্তিত ! তাহার চিন্তার কিছু কারণ রহিয়াছে ! 


২ পর্ব 

  তারা একমাত্র পুত্র বধূ , তাহার দেওর বা ননদ নাই । পারিবারিক সম্পত্তি যাহা রহিয়াছে , তাহাতে তাহার বা তাহার স্বামীর স্বচ্ছন্দে কয়েক পুরুষ চলিয়া যাইবে । এক কিশোরী আসিয়াছে তারা দের গৃহে , তাহার নাকি পরিবারে কেহ নাই , অল্প বয়সে পিতৃ মাতৃ হীনা । তারার শ্বশুর , শাশুড়ি যথেষ্ট ভালো মানুষ , তাহাকে যত্ন করিয়া আনিয়া কন্যার মতন রাখিয়াছেন । কন্যাটি র গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না বলিলেই চলে , কেহ না জানিলে মনে করিবে ও বোধ করি বোবা ! কথা জিজ্ঞেস করিলে উত্তর পাওয়া যায় , কিন্তু নিজে হইতে কোনো কথা কহে না ! এই স্বভাবের কথা তারাও তাহাকে হাসি মুখে বলিয়াছে , অর্বাচীন , প্রগলভা তারা ! পিতা , মাতা না থাকিবার বেদনা তে কিশোরী টি এরূপ , একথা সে আর ভগিনী কে বুঝাইতে যায় নাই ! এমন তো কত আছে সংসারে ,পিতা মাতা থাকে না , সাধ্য মতো সবাই সবাই কে দেখিয়া রাখে হয়তো , হয়তো বা দেখেও না ! তাহার মাতাও কত সময় উদয়পুরের পিতৃ হীন বা মাতৃ হীন বা অনাথ শিশুদিগকে সাহায্য করেন , সে জানে ! রুদ্র কে বাণিজ্য সূত্রে দিল্লি , ও উদয়পুর যাওয়া আসা করিতে হয় । তবে চিতোর সে বিশেষ আসে নাই ! সে সবার বড়ো , পিতা মাতার দুঃখ বুঝে চিরকাল , একাই যাতায়াত করে , কোনোরকম ভীতি দুশ্চিন্তা তাহার অন্তরে স্থান পায় না , তাহারা’ যে রাজ পুত ! বীরের জাত , কাহাকে ভয় ? কিসের ভয় ? পৃথিবীতে আসিয়াছি , বীরের মতো বাঁচিতে , অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করিতে , পিতা মাতা গুরুজন দিগকে শ্রদ্ধা করিতে , ভ্রাতা ভগিনী দিগকে স্নেহ করিতে , আর , আর কি ? ভাবিতে গিয়া তাহার কর্ণ মূল রক্তিম হইয়া ওঠে , কাহাকেও নিজের মতন করিয়া ভালো বাসিতে ! সেও প্রাপ্ত বয়স্ক হইয়াছে , তাহার মাতা কন্যা প্রায় স্থির করিয়া ফেলিয়াছেন তাহার জন্য , উদয়পুরেই এক বৃহৎ ব্যবসায়ীর কন্যার সহিত তাহার তিলক অনুষ্ঠান হয়তো হইবে কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু এই কিশোরী গায়ত্রী কে দেখিয়া তাহার কি হইলো ? 

 

পর্ব ৩


 কিশোরী টি যে অপূর্ব সুন্দরী তাহা নহে , গাত্রবর্ণসম্পূর্ণ হরিদ্রার ন্যায় তাহা বলা যায় না , এমন কি তাহাদের রাজস্থানে , নারী রা যেরূপ সু স্বাস্থ্য বতি , তাহাও নহে , কিন্তু তাহার আঁখি ? সে যেন সমুদ্র ন্যায় গভীর , তাহাকে কিছু বুঝাইয়া বলিতে হয় না , সে আপনি বুঝিয়া লয় । রক্তিম ওষ্ঠ , সুন্দর নাসিকা , বিশাল চক্ষু লইয়া সে যেন এক স্নিগ্ধ চিত্র , কোঁকড়া কেশ রাশি বৃষ্টি স্নাত পুষ্পের ন্যায় শান্ত , মুখশ্রী কে জড়াইয়া রহিয়াছে । তাহাকে দেখিলে মনে হয় উহার যেন এই জগতের উপর আর বিশেষ কোনো দাবি দাওয়া নাই ! তাহার পিতা , মাতার সহিত সব কিছু চলিয়া গিয়াছে । উহাকে দেখিয়া রুদ্রের বুকের মধ্যে কি যে চলিতেছে , তাহা সেই জানে , না কাউকে বলিতে পারিতেছে , না পারিছে নিজে হইতে নিজে কে লুকাইতে । এক অদ্ভুত দোটানার মধ্যে পড়িয়াছে সে ! তাহার বিপণির কর্মে ভুল হইয়া যাইতেছে !! মাতার সহিত সর্বদা ই চিরকাল তাহার সব কিছু আলোচনা হয় । মাতা তাহাকে জিজ্ঞাসা ও করিয়াছেন সে এত অন্য মনা কেন ? সঠিক উত্তর কিছু দিতে পারে নাই রুদ্র ! 


পর্ব ৪

 ওদিকে গায়ত্রী ! সে তো কিশোরী , পিতৃ , মাতৃ হীনা , যে গভীর আঘাত সে অন্তরে পাইয়াছে এই স্বল্প বয়সে , তাহা যে চির দিনের ! তাহার অন্ন সংস্থান রাখিয়া পিতা মাতা অসুখে , কিছু দিবসের ব্যবধানে স্বর্গে গিয়াছেন । নিরাপত্তার কারণে তাহাকে কাকিমা , কাকাবাবু একা বাটি তে রাখেন নাই । সে তারা দিদির বাটিতে থাকে । সবাই তাহাকে ভালোবাসে । সে , তারা দিদির দাদা , , জামাই বাবু র সহিত চিতোরে ভগবানের মন্দির দর্শনে আসিয়াছিল । ছোট হই তেই সে এখানে আসে , কি অপূর্ব প্রস্তরের কারু কার্য , দেখিলে চক্ষু জুড়াইয়া যায় ! ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মন্দির , দিবারাত্র সেখানে ভগবানের ভজনা হয় , মীরা বাই যে তাহার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন ! একমাত্র ভগবানের মন্দিরেই তাহার যেন একটু ভালো লাগে ! পিতা মাতা নাকি ঈশ্বরের কাছে চলিয়া গিয়াছেন , সে কবে যাইবে ? রাত্রি দিন এই কথা তাহার মনে আন্দোলিত হয় ! সে কি করিয়াছিল ঈশ্বর তাহাকে এত বড়ো শাস্তি দিলেন ! সে বিশেষ কথাও কহে না কাহারো সহিত , প্রতিদিন পিতা মাতার কথা ভাবিয়া তাহার আঁখি অশ্রুসিক্ত হইয়া যায় । নানা কথা ভাবিতে ভাবিতে সে মন্দিরে চলিতেছিল , ভগবানের মন্দিরে আসিয়া সে আর অশ্রু ধরিয়া রাখিতে পারে নাই ! কেহ দেখে নাই , তারা দিদির দাদা, রুদ্র নাম 

  বোধ করি , সে দেখিয়া ফেলিয়াছে ! ছি , ছি , কি লজ্জার কথা ! সে কাহাকেও তাহার বেদনা দেখাইতে চাহে না ! এ বেদনা তাহার একান্তই নিজের , এত বড়ো পৃথিবীতে এই বেদনার সহিত ই তাহাকে থাকিতে হইবে ! মন্দিরে কত লোক পূজা দিতেছে , প্রসাদ বিতরণ হইবে একটু পরেই , প্রতিদিন কত গরিব লোকের ও অন্নভোজন হয় , মহারানার নির্দেশে , চিতোরে কেউ যেন অভুক্ত না থাকে ! চিতোর ! আহা ! তাহাদিগের স্বর্ণের ন্যায় অপরূপ চিতোর ! তাহার জন্ম ভূমি !গভীর রাত্রি তে যখন বিশ্ব চরাচর নিদ্রা যায় , সে মধ্যে মধ্যে তাহার শয়ন গৃহের বৃহৎ জানালা খুলিয়া বাহিরে তাকাইয়া দেখে , কি বৃহৎ প্রকৃতি , সব কিছু যেন একাকী , দূর দূরান্তের তারা গুলি ও একাকী শান্ত , তাহাকে যেন আকাশের চন্দ্র , এই পৃথিবীর চিতোরের মৃত্তিকা , দূর মন্দিরের চূড়া সবাই .. বলিতে থাকে … তুমি আমাদেরই কন্যা , আমাদের ছাড়িয়া কোথাও কোনো দিন যাইয়ো না । এই বিশাল নিঃসীম প্রকৃতির কাছে ই সে যেন নিজেকে সমর্পন করিতে পারে , একাত্ম করিতে পারে ! কুন্দ পুষ্পের সু ঘ্রান ভাসিয়া আসে , দূরে নীলকণ্ঠ মন্দিরের পুরোহিতের রাত্রি কালীন আরতি র শব্দ ধ্বনিত হয় , সে নিকষ অন্ধকার গগনের দিকে তাকাইয়া , তারা দের দিকে তাকাইয়া তাহার পিতা , মাতা কে খুঁজিতে থাকে , আঁখি দিয়া বারি বহিতে থাকে । তারা দিদি তাহাকে সহজ করিবার চেষ্টা করিয়াছে অনেক দিন ! কিন্তু হইতেছে না কিছুতেই , সে নিজেও বোঝে তাহার এই কঠিন মানসিক পরিস্থিতির কথা ! সে বিবাহ করিবে না , ওই মীরা বাইয়ের মতন ঈশ্বরের ভজনা করিয়া জীবন কাটাইয়া দেবে স্থির করিয়াছে !কিন্তু একটি মুশকিল হইয়াছে তাহার এই ঝড় বিধস্ত ছোট্ট জীবনে ! 


পর্ব ৫


, রুদ্র কে দেখিয়া তাহার কি যে মনে হইয়াছে , তাহা সে কাহাকেও বলিতে পারিতেছে না ! মনে হইতেছে সে যেন তাহার বহু দিনের চেনা , সব দুঃখ কষ্ট ইহাকে বলা 

 যায় ! না , না সে ইহাদের পরিবারে আসিয়াছে , অসময়ে উহাকে কাকিমা সহ সবাই আপন করিয়া লইয়াছেন ! সে কেন জানিয়া , বুঝিয়া ক্ষতি করিবে কাহারো ? সে নাকি মাঙ্গলিক কন্যা ! ইহার অর্থ সে জানিত না , পরে তাহার কিছু বিশেষ হিতাকাঙ্খী র কল্যানে সে জানিয়াছে , ইহার অর্থ ! তাহার ভাগ্য খারাপ তো বটেই , বিবাহ পূর্বেই যাহার পিতা মাতা ইহলোক ছাড়িয়া চলিয়া যায় , সে কাহার কাছে পাইবে আদর যত্ন ? বহু কাঁদিয়াছে সে , কান্নার এখনো শেষ হয় নাই তাহার , কাকা বাবু সু পাত্র খোঁজ করিতেছেন , বয়স যে বাড়িয়া যাইতেছে  

    , তাহাদের সমাজে তো বিবাহে বিশেষ দেরি হয়না ! কিন্তু , সে যে সারা জীবন অবিবাহিত থাকিবে স্থির করিয়াছে , ইহা তো সবাই এর অজানা । মন্দিরে দিদিরা একটু আগাইয়া গিয়াছিল , সে ঈশ্বরের কাছে মনে মনে দুঃখের কথা বলিতে ছিল , তাহার অশ্রু সিক্ত আঁখি দেখিয়া ফেলিয়াছে তারা দিদির দাদা ! সে দৃষ্টিতে যে কত বেদনা ছিল ! তাহার মনে হইতে লাগিল এই যেন সেই মানুষ , যাহার কাছে শান্তিতে কাঁদা যায় ! না , সে কোনো কথা ভাবিতে চাহে না আর ! সে তো মাঝে মধ্যেই কাকিমার সহিত , দিদির সহিত মন্দিরে আসিয়া বসিয়া থাকে, পুরোহিত মহাশয় তাহার চেনা, সে একদিন তাহার ইচ্ছার কথা উহাকে জানাইবে , পুরোহিত নিশ্চয়ই তাহার কথা শুনিবে , তাহাকে মন্দিরের কাজে নিযুক্ত করিয়া দিবে ! আচ্ছা ,তাহার গাত্রে কি মাঙ্গলিক লেখা ছিল জন্মের সময় ? জানিতে ইচ্ছা করে !!


পর্ব ৬

রুদ্র ভাবিতেছে কিছু কথা তাহার মাতা কে জানাইয়া দিবে ! তিলক অনুষ্ঠান করিয়া যে বিবাহ হইবার কথা তাহার , সেই বিবাহ সে করিবে না ! কন্যা কে সে দেখেও নাই , পিতা মাতা যাহা ঠিক করিবেন , সেই বিবাহই হইবে , তাহাই রীতিও বলা চলে , কিন্তু এখন তাহার মানসিক অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা । বিবাহ করিলে সে গায়ত্রী কেই করিবে , নচেৎ করিবে না ! অপর কোনো রমণী কে সে ঠকাইতে পারিবে না ! তারা আবার হঠাৎ আসিয়াছে বাপের বাড়ি , এই তো সে গিয়াছিল ! প্রগলভা , নির্বোধ নারী ! বুদ্ধিহীনা চিরকালই ছিল , এখন যেন আরো হইয়াছে ! ইচ্ছা করে কেশ ধরিয়া শাসন করিতে ! কিন্তু সম্ভব হয় না যে ! ক দিন পর তারা চলিয়া গিয়াছে । রুদ্র মাতা কে বলিয়া দিয়াছে সে এখন বিবাহ করিতে পারিবে না ! পিতা হয়ত অসন্তুষ্ট হইয়াছেন , শুনিয়া মাতা কিছু বলেন নাই !


কর্মে মন বসাইতে পারে না রুদ্র ঠিক ! দিন বহিয়া যাইতেছে ! একদিন গৃহে আসিয়া শুনিতেছে তারার শশ্রু মাতার নাকি একেবারেই শরীর ভালো নহে , কে চিতোর গিয়াছিল , আসিয়া খবর দিয়াছে । চিতোর ! সেই অপরূপ নগরী . . সেই কন্যা ! যাহাকে ভুলিতে পারে নাই রুদ্র , বলিতেও পারে নাই কিছু পরিবারে ! বেশ ! পুনরায় যাইতেই হইবে ! মাতৃ আদেশ ! মাতার কথা তো আর ফেলিতে পারিবে না । সে পরের দিন আবার চিতোর পৌঁছিয়াছে ! পৌঁছিয়া দেখে কোথায় কি ? শশ্রু মাতা দিব্য আছেন ! তারাও হাসিয়া আল্হাদে গলিয়া পড়িতেছে ! একি ! তাহাকে হঠাৎ করিয়া এরূপ ভাবে চিতোর পাঠাইবার মানে কি ? রুদ্রর মাতার ওপর রাগ হইতে লাগিল খুব । শীঘ্রই সে ফিরিয়া যাইবে উদয়পুর , থাকিবে না ! প্রগলভা তারা ! কি বলিতে কি বলিয়াছে ! সন্ধ্যা কাল উপস্থিত ! একটি দুটি করিয়া নক্ষত্র ফুটিয়া উঠিতেছে গগনে । তাহার ঘরে পিদিম দিতে আসিয়াছে সেই কিশোরী ! রুদ্র র গলা কেমন শুকাইয়া উঠিয়াছে উহাকে দেখিয়া ! “আমাকে বিবাহ করিবে গায়ত্রী ? “ , মনের কথা সোজা বাহির হইয়া গিয়াছে তাহার ! “না , আপনি চলিয়া যান ! আমি 

   মাঙ্গলিক কন্যা , অমঙ্গল হইবে আপনার !” জোরে কথা বলিতে গিয়া আবার যেন কিশোরীটির আঁখিতে অশ্রু ! বেশ ! আর রুদ্র কোনো দিন কিছু বলিবে না কাহাকেও ! প্রত্যুষ হইলেই সে উদয় পুরের উদ্দেশে বাহির হইবে ! সবে সূর্যালোক ছড়াইয়া পড়িতেছে চিতোরের গগনে , মনুষ্য দিগের সাধারণ জীবন যাত্রা শুরু হইয়াছে , শুধু রুদ্রের ই মনে শান্তি নাই ! তারা তাহাকে বারংবার আরো কিছু দিবস থাকিয়া যাইতে অনুরোধ করিয়াছিল , সে কর্ণ পাত করে নাই ! সেও কাহারো জীবনে অশান্তি বহিয়া আনিতে চাহে না ! দ্রুত বেগে ঘোটক চলিতেছে তাহার , জীবনে আর হয়তো চিতোর আসিবে না সে ! এ জীবনে ভিক্ষা যাচিতে পারিবে না কোনো দিন সে কাহারো কাছে ! … কি হইবে ? সবাই কে কি গৃহী হইতেই হইবে ? সে ও পারিবে একা জীবন কাটাইতে ! পিতা হয়তো রাগ করিবেন , কিন্তু তাহার তো আরো পুত্র আছে .. দিন কাটিয়া যাইবে ! একি ! তাহার সহিত নির্দিষ্ট দূরত্বে দুই টি অশ্বারোহী কেন চলিতেছে ? সে কি দস্যুর কবলে পড়িল ? অস্ত্র আছে ঠিকই , কিন্তু ইহা তো চিন্তার বিষয় হইলো ? এক পুস্করিণী দেখা যাইতেছে , বারি গ্রহণ আবশ্যক , দূরে এক মন্দির ও দেখা যাইতেছে ! বোধ করি ভীত হইবার কারণ নাই । রুদ্র নামিল বারি গ্রহণের জন্য । মন্দির হইতে ঘন্টা ধ্বনি আসিতেছে ! কিন্তু একি ! সে বারি গ্রহণ করিয়া ফিরিতেই দস্যু গুলি তাহাকে পিছমোড়া করিয়া বাঁধিয়া ফেলিয়াছে ! কি সর্বনাশ ! কোথায় লইয়া যাইবে তাহাকে ! অস্ত্র সব কাড়িয়া লইয়াছে ! কি মুশকিল ! তাহাকে মন্দির দিকে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে ! ইহা কি চিতোরের দস্যু দিগের মন্দির ?    


শেষ পর্ব  

দস্যু দুটি  

 তাহাকে ধরিয়া পার্বতী মাতার মন্দিরে হাত বাঁধিয়া বসাইয়া রাখিয়াছে , অত্যাচার কিছু করে নাই । আশ্চয তো ! কি চায় উহারা ? আর এক কান্ড দেখিতেছে , একটি কন্যা কেও উহারা পালকি করিয়া আনিয়াছে । কে কন্যাটি ? যেন গায়ত্রীর র মতন চলন ! মুখশ্রী দৃশ্য মান নহে ! মন্দিরের সাজানো উপকরণ দেখিয়া বোধ হইতেছে কন্যাটির যেন বিবাহের আয়োজন চলিতেছে বৃক্ষের সহিত ! তাহাকে লইয়া ইহারা কি করিবে ! পরিষ্কার করিয়া কেহ কিছু বলিতেছেও নহে । আরো কিছু পরে আরো একটি পালকি আসিয়াছে , দুইটি ঘোটক ও আসিয়াছে । স্বর শুনিয়া সে বুঝিতেছে তাহার মাতা , পিতা , তারারশশ্রূ মাতা , জামাই ও আসিয়াছে । জামাই তাহাকে হাসিয়া বলিতেছে , মাঙ্গলিক বলিয়া গায়ত্রীর  


র প্রথমে বৃক্ষের সহিত বিবাহ দিয়া পরে তাহার সহিত বিবাহ এখনই দেওয়া হইবে ! সব নাকি তারা পূর্বেই বুঝিয়াছিলো , বুঝিয়া মাতা কে জানাইয়াছিলো । মাতার কোনো আপত্তি হয় নাই , এমন কি পিতারও আপত্তি নাই ! জীবন ! একটি মাত্র ছোট্ট জীবন ! কয় দিনেরই বা ? কি লাভ অশান্তি করিয়া ? মাঙ্গলিক হইলো তো কি হইলো ? বাধা যেমন আসিবে জীবনে , বাধা কাটাইয়া চলিতেও হইবে ! পুরোহিত বলিয়াছেন , কোনো অসুবিধা নাই !আজ নাকি খুব ভালো তিথি ! পরে আবার উদয় পুরে বড়ো করিয়া অনুষ্ঠান হইবে । এই দস্যু দিগকে নাকি জামাইই ঠিক করিয়াছে , তারা ও তাহার পিতা মাতার অনুরোধে । বলিতে গিয়া জামাই আর হাসি চাপিয়া রাখিতে পারিতেছে না ! তাহার সব আচরণ তাহা হইলে তারা সহ সবার কাছে ধরা পড়িয়া গিয়াছে ! দূর হইতে ভগিনীর ও হাসির শব্দ পাওয়া যাইতেছে ! গায়ত্রী কি চাহিল তাহার দিকে মৃদু হাসিয়া ? কে জানে ! রুদ্রর বক্ষ মধ্যে কেমন যেন আওয়াজ হইতেছে , কর্ণ দুটি কি রক্তিম হইয়া গেছে ? বোধ বুদ্ধি কেবল পুরুষ দিগেরই নহে , নারী জাতিও কিছু রাখে তাহলে ! রুদ্র কি পুস্করিণী তে যাইয়া ডুব দিবে ? নাকি গায়ত্রীর আঁখিতে তাকাইয়া থাকিবে ? নাকি প্রগলভা ভগিনীর কেশ ধরিয়া টানিয়া তাহাকে শাস্তি দিবে ? সন্ন্যাসি হইবার আশা যে একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গেল এ জীবনে !!


পাঠক, রুদ্র , গায়ত্রী এবার যাহা পারে বুঝিয়া চলুক , আমরা দূর হইতে উহাদের জীবনের মঙ্গল কামনা করিয়া নিজ কর্মে মনোনিবেশ করি !!

আদরী - দিলদার সেখ || Adari - Dildar sekh || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

         আদরী

     দিলদার সেখ 



কোনও শিশু অন্ধকারে আচমকা আমার বড়ো ফুপুকে দেখলে যে সে ভালো মতোই ভয় পেয়ে যেতে পারে, – সেকথা আমার বড়ো ফুপু নিজেও জানত। ছোটবেলায় আমরাও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। সারাক্ষণ গায়ে যেমন ধপধপে সাদা শাড়ি তার, – গায়ের রং তেমনই তার বিপরীতে। যেমন লম্বা তেমনই চওড়া তার গায়ের গঠন। ছোটবেলায় ফুপু যখনই আমাদের বাড়ি আসত, তার গায়ের সেই একই সাদা শাড়ি দেখে মাকে জিজ্ঞেস করতাম, মা, ফুপু সবসময় অমন সাদা শাড়ি পরে থাকে কেন?

     মা বলত, তুর ফুপা যে মারা গেছে। কোনও বিবাহিত মেয়ের স্বামী মারা গেলে তাকে যে অমন সাদা শাড়ি পরেই থাকতে হয় বাকিজীবন!

     মায়ের এই উত্তর শুনে মাকে আবার পাল্টা প্রশ্ন করতাম, তাহলে আদরী কেনে সাদা শাড়ি পরে না? 

     মা কথাটা এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলত, অর কথা বাদ দে। খেপী ও অ্যাকটা!

     আদরী আমাদের গ্রামের এক আদ বয়স্কা বিধবা। লোকে তাকে এক ডাকে আদরী খেপী বলে চেনে। বিধবা হলেও আদরী কিন্তু আজ অব্দি একটাবারের জন্যও গায়ে সাদা শাড়ি তোলেনি। বরং উল্টে তাকে দেখা যায়, চার আঙ্গুল চ্যাপ্টা পাড়ওয়ালা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে ঘুরতে। আবার এই রং শুধুই লালেই শেষ নয়, – কখনো লাল, কখনো নীল, কখনো গোলাপী, কমলা, হলুদ! বিয়ের কয়েক বছর পর বিধবা হয়ে আদরী আজ প্রায় পনেরো কুড়ি বছর ধরে এই গ্রামেই আছে।

     আদরীর বাপের পুরনো কয়েক কাঠা খালি জায়গা পড়ে ছিল আমাদের পাড়াতে। তার ভাইরা সেখানেই আদরীকে একটা ছোট্ট খুপরি বানিয়ে দিয়েছিল থাকার জন্য। তিনটে ভাইয়ের তিন তিনটে পাকা দালানবাড়ি থাকতেও তাদের একমাত্র বিধবা বোনের জায়গা হয়নি সেখানে। মনে জায়গা ছিল কি না, সেই সন্দেহ! গ্রামের কোনও লোকে কিছু বললে তারা জবাব দেয়, ও পাগলকে কে বাড়িতে রাখবে! 

     আদরীকে যে খুপরিটা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল থাকার জন্য, – তার ছাউনী নেই বললেই চলে। আদরীর ভাইপোরা শুধু নতুন করে তালপাতা কেটে চাপিয়ে দিয়ে যায় পুরনো তালপাতাগুলো ঝড়ে উড়ে গেলে। আর তাছাড়া, ছাউনী থাকলেই বা কী, আর না থাকলেই বা কী? আদরী নিজেই তো থাকে না সে খুপরিতে। তাকে দেখা যায় কখনো মল্লিকপাড়াতে, কখনো উত্তরপাড়াতে, – কখনো তালতলাতে, কখনো বা বেলতলাতে। কখনো তার সকাল হয় আমতলায় আমগাছের গোঁড়ায় ধুলোতে শুয়ে থেকে। পুরো গ্রামের যেকোনও পাড়ার যেকোনও গলিতে যেকোনও সময়ে তার দেখা মিলে যেতে পারে। সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার পেছন ধরে। ডাকতে থাকে, আদরী খেপী আদরী খেপী করে। আদরী ঘুরে দাঁড়ায় তাদের দিকে। বলে, তু খেপী। তুর মা খেপী। তুর চোদ্দগুষ্ঠী খেপী।

     বলেই আদরী ছোট ঢিল তোলে হাতে। ছেলেমেয়েগুলো অমনি ছুটে পালিয়ে যায়। লুকিয়ে পড়ে যে যেখানে। আদরী হাঁটতে শুরু করলে আবার বেরিয়ে আসে তারা। পেছন ধরে আদরীর। কোনও বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে বাড়ির মেয়েরা যদি ডাকে আদরীকে, – আদরী যায় সে বাড়ি। গিয়ে বসে। আবার হুট করে উঠে চলে আসে যেকোনও মুহূর্তেই। ডাকলেও আর রা দেয় না সে তখন। আবার কখনো কখনো সে নিজে থেকে চেনা কোনও বাড়িতে ঢুকে। বসে থাকে কিছুক্ষণ। এটা সেটা কথা তুলে নিজে হয়ে।

     আদরীর গায়ে থাকে একটা টকটকে রঙিন শাড়ি। কখনো যদি সে গ্রামের কোনও বাড়িতে ঢুকে, – সে বাড়ির কোনও বউয়ের গায়ে থাকা কোনো শাড়ি যদি তার পছন্দ হয়, – কিংবা বাড়ির আঙিনায় টানানো কোনও রঙিন শাড়ি যদি তার চোখে ধরে, – সে চেয়ে বসে শাড়িটা তখনি। বলে, ও বউ, ও বউ, তুর শাড়িটা আমাকে দিবি? অ্যাঁ? আমাকে দিবি? আমার খুব পছন্দ। আমার খুব পছন্দ। দে না, দে। আমাকে দে। 

     অনেকে বাহানা করে এটা সেটা। আবার অনেকে দিয়েও দেয় তাকে। আদরীর কথায়, গ্রামের প্রায় সকলেই তাকে খাতির করে, – শুধু তার নিজের ভাই ভাবীরা ছাড়া। আদরী ঘেঁষেও না সেদিকে। আদরীর মাথায় এক খাবল চুল। তাও তেলে চুবচুবে হয়ে থাকে সারাক্ষণ।। বিকেলে মল্লিকপাড়ার কোনও বাড়িতে ঢুকে সে আবদার করে, আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে তো বউ। দে না, দে। আমার চুলে খানিক ত্যাল দিয়ে দে। খারাপ হয়ে আছে চুলগুলো। দে না, দে। 

     দিয়ে দেয় তারা তার চুলে তেল। চিরুনি চালিয়ে দেয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আদরীর খুশি হয় খুব। ছুটে বেরিয়ে যায় সে বাড়ি থেকে। আর এক মুহূর্ত থাকে না সেখানে।

     কোনও বাড়িতে আবার পুরুষ মানুষ থাকলে আদরী সে বাড়িতে ঢুকতে ভয় পায়। পুরুষ মানুষটিকে দেখিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, মারবে না তো? আমাকে ও মারবে না তো? অ্যাঁ?

     সে বাড়ির মেয়েরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে, বসিয়ে, গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে, মারবে কেন, আদরী? কেউ মারবে না তুকে। কে মারবে? কেউ কি মেরেছে কখনও তুকে?

     আদরী তখন ভয়ে ভয়ে কাঁপা গলায় বলে, রতন। রতন। রতন মেরেছিল আমাকে। অনেক মেরেছিল। অনেক মেরেছিল। এই দেখ, এই দেখ, আমার পিঠে দাগ দেখ। আমার হাতে দাগ দেখ। ভালো না। ভালো না। ওরা ভালো না।

     এই রতনই আদরীর মৃত স্বামী। আদরী বলে, বিয়ের পর প্রথম যেদিন সে তার শ্বশুর বাড়ি গেছিল, – প্রথম যে রাতে সে তার স্বামীর ঘরে, – যে রাতে তার সারা শরীরে ভালোবাসার ছোঁয়া নেওয়ার কথা ছিল স্বামীর থেকে, – তার স্বামী তাকে উপহার দিয়েছিল অসহ্যকর আঘাত। তার সারাশরীরে এঁকে দিয়েছিল আজকের এই মারের চিহ্ন।

     কারও হাতে হাতভর্তি চুড়ি দেখলে আদরী তার হাতকে খপ করে ধরে। ধরে বলে, আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে দিতে পারিস না, হা লো? দিস কেনে আমাকে অ্যামন সুন্দর চুড়ি কিনে! দিবি? অ্যাঁ? দিবি আমাকে অ্যামন চুড়ি কিনে?

     – তুর চুড়ি পড়তে ভাল্লাগে আদরী?

     – হ্যাঁ, লাগে তো। আমার অনেক ভাল্লাগে। আমা চুড়ি পরব। আমি দুইহাতে অ্যাত্ত করে চুড়ি পরব।

     – রতন বুঝি তুকে অনেক চুড়ি কিনে এনে দিত? অনেক সাজিয়ে রাখত তোকে?

     – কে? কে? রতন? না না না না..... দ্যায়নি। দ্যায়নি। সে আমাকে চুড়ি কিনে দেয়নি। একটাও চুড়ি কিনে দ্যায়নি। আমি অনেক কেন্দেছিলাম। সে আমাকে চুড়ি কিনে দ্যায়নি। মেরেছে। সে আমাকে অনেক মেরেছে।

     সেবার উরসের মেলা হচ্ছিল খুব বড়ো। আদরী তখন নতুন বউ। অনেক বায়না করে সে রতনকে রাজি করিয়েছিল তাকে নিয়ে মেলাতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। রতনকে বাধ্য হয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল শেষে। মেলায় লাল হলুদ চুড়ি দেখে আদরী মেতে উঠেছিল চুড়িগুলোর জন্য। রতনকে বলেছিল কিনে দিতে। রতন কিনে দেয়নি। পরে আদরীর মান করায় তাকে মেলাভর্তি লোকের সামনে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে এসেছিল রতন। আদরীর মান তখন জল।


     পর পর তিনটি পুত্র সন্তানের পর আদরীর বাপ মা বড়ো করে আশা করছিলেন একটা কন্যা সন্তানের জন্য, – আদরীর জন্ম ঠিক সেই সময়ে। জন্মের পর পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলে তাকে দেখতে এসে বলে গেছিল, সোনা কপালী মেয়ে। বাড়িতে এই প্রথম মেয়ে সন্তান। তিন তিনটে বড়ো ভাইয়ের আদরে সোনার থালায় ভাত খাবে তাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন। ছিলও সে সবার বড়ো আদরের। সেই জন্যই কিছুটা বড়ো হলে সকলের আদরে তার নাম পড়ে গেল আদরী। আসল নাম যা রাখা হয়েছিল, তা গেল চিরকালের মতো ঘুঁচে। কিছুটা বড়ো হলে আদরীর কাজে কামে গুন দেখে অনেকে বলেছিল, বড়ো গুনবতী মেয়ে। এই মেয়ে পারবে সুখে সংসার করতে বটে। মায়ের চেয়েও কাজে কামে তার পরিপাটি বেশি। যুবতী অবস্থায় তার রূপ দেখে বলাবলি করেছিল অনেকেমিলে, মেয়ের যেমন গুন, রূপও তেমনি চোখ ধাঁধানো। বিয়ের পর এই মেয়ে স্বামীর ভালোবাসায় ডুবে থাকবে সারাক্ষণ। স্বামী ঘুরবে বউয়ের আঁচল ধরে ধরে। 

     যথা সময়ে আদরীর বিয়ে হল। খিজিরপুরের জমিদার বাপের একমাত্র ছেলে রতনচাঁদ একশোর উপরে বরযাত্রী নিয়ে বিয়ে করতে এসছিল আদরীকে। যদিও বরযাত্রী আসার কথা হয়েছিল ষাটটে। পঞ্চাশে না মানতে চায়লে আদরীর বাপ আরও দু চারজনকে বাড়িয়ে শেষে ষাটে কথা পাকা করেছিলেন। রতনচাঁদ এনেছিল একশোর বেশিজনকে। এবং সেটাই ছিল তার শেষবারের মতো শ্বশুরবাড়িতে আসা। দুপুরে জোহরের নামাজের পর বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছিল ঠিকঠাকভাবে। আদরীর বাপ তাঁর একমাত্র আদরের মেয়েকে সঁপে দিয়েছিলেন রতনের হাতে। গোল বেঁধেছিল খাওয়া দাওয়ার সময়। একশোটা লোক একটা জায়গায় একসাথে থাকলে সেখানে নানারকম ভালো মন্দ কথা হবে। হবেই। পাত্রপক্ষ থেকে আসা কারও কারও মুখ থেকে আদরীর বাপের ভোজ আয়োজন নিয়ে কিছু খারাপ মন্তব্য শুনে পাত্রীপক্ষের কয়েকজন উত্তর করেছিল। পাত্রপক্ষের ‘পাত্রপক্ষ’ হয়েও কেন যাচ্ছেতাই বলার অধিকার থাকবে না, – এবং পাত্রীপক্ষরা ‘পাত্রীপক্ষ’ হয়েও কেন পাত্রপক্ষের সাথে তর্ক করবে, এই ছিল পাত্রপক্ষের রাগ। রতনের রাগ। আর এই রাগ এক সময়ে হাত চালাচালিতে পরিণত হয়। অবশ্য খেতে খেতে উঠে এসে হাত উঠিয়েছিল সবার আগে রতন নিজেই। শেষে বিয়ে করা বউকে শ্বশুর বাড়িতেই ফেলে রেখেই রতন তার বরযাত্রীদের নিয়ে ফিরে গেছিল বাড়ি। তিনদিন পর রতনের বাপ লোক পাঠিয়েছিলেন পুত্রবধূকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সোহাগীর বাপ মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোককে বড়ো খাতির যত্ন করে মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন তাদের সাথে।

     আদরী বলে, তার শ্বশুরের ছয়চালা মস্ত বড় মাটির বাড়িতে থাকার লোক বলতে ছিল শুধু রতন এবং রতনের বাবা। মা মারা গেছিলেন বহুদিন আগে। মা মরা ছেলে রতনের বিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সে কখনই আদরীকে বিয়ের করার জন্য রাজি ছিল না। তবে আদরী বলে নয়, সে নাকি সেই সময়ে বিয়েই করতে রাজি ছিল না কাউকে। বিয়ের আগে রতনের নিত্য অবাধ যাতায়াত ছিল পাশের গ্রামের রঙ্গপাড়ায়। সেখানে গিয়ে রতন মদ গিলত বোতলের পর বোতল। পড়ে থাকত বেহুঁশ হয়ে কোনও কোনওদিন। রাত হয়ে গেলেও তার হুঁশ আসত না। শেষে ও পাড়ার লোকেরা তুলে ধরে দিয়ে যেত তাকে বাড়িতে। আদরী বিয়ের পর গিয়ে কত শুনেছে, কত মেয়ের সাথে ধরা পড়ে রতন কত্তবার মার খেয়েছে! রতনের বাবা কোনওদিন বাড়িতে না থাকলে, রতন সুযোগ বুঝে মেয়েদের টাকা, গয়না কিংবা ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসত। অগুণতি টাকা পয়সা খরচ করত তাদের পেছনে। রতনের বাবা ঠিকই শুনতে পেতেন সব। তবুও বহু চেষ্টা করে তিনি রতনকে এসব পথ থেকে ফেরাতে পারেননি। শেষে ভেবেছিলেন, ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে হয়ত বা ছেলে শুধরে যাবে। তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে সে রাস্তা থেকে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টে রতনের মনে হত, আদরী যেন তার পথের বাধা, – তার সমস্ত সুখ ও শান্তির বিঘ্ন শুধুমাত্র ওই আদরী। আদরীকে হয়ত সে একটা দিনের জন্যও নিজের সুখ তো দূরের কথা, – দুঃখের সঙ্গী বলেও মেনে নিতে পারেনি। আদরীর কথা তার কেবলই ঘ্যানঘ্যানানি প্যানপ্যানানি মনে হত। সে সারাক্ষণ সমস্তরূপে বিমুখ থাকত আদরীর উপর। পরিবর্তে আদরী পেত শুধুই লাথি আর কিল, কিল আর মার। অসহ্যকর যন্ত্রনা!

     এখন গ্রামের কোনও বিধবা বুড়ি যদি আদরীকে ডাকে, – ডেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, এই আদরী, বিধবা মানুষকে যে অমন রঙচঙে শাড়ি পরতে হয় না লো! আমাদেরকে দ্যাখ, – আমাকে দ্যাখ, আজ ষোলো সতেরো বছর হয়েছে রাঁড় হয়েছি। একটিবারও রঙিন তেনা গায়ে ওঠাইনি। সেই যে সতেরো বছর আগে আমার সেই সোনার হরিণ শাড়িখানা খুলে ছুড়ে দিয়েছি আগুনে, – ওই শ্যাষ। রতন যে আর নাই লো। তু বিধবা মানুষ অ্যাখন। ফেলে দে ওই শাড়ি খুলে। অমন রঙচঙে শাড়ি পরিস না আর। ভেঙে দে তুর ওই হাতের চুড়ি। পরতে নেই। পরতে নেই। খুলে দে।

     আদরী সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে সেই কথায়। বলে, না না না.....! কে রতন? কে সেই ছোঁড়া? কবে কোন কালে মরে ভূত হয়ে গেছে সে। শাউনতলার মাটিতে পুঁতে দিয়েছে তাকে। আমি দেখেছি। আমি দেখেছি। মরে ভূত হয়ে গেছে সে। তার জন্য আমি কেনে সাদা শাড়ি পরব? কিসের জন্য আমি আমার অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা ফেলে দিব আগুনে? সে কি আমাকে এই শাড়ি কিনে দিয়েছে নাকি? সে কি আমাকে অ্যামন সুন্দর শাড়ি কিনে দিয়েছিল কখনও? দ্যায়নি। দ্যায়নি। আমি বলিনি? আমি কান্দিনি নতুন শাড়ির জন্য? দ্যায়নি। সে আমাকে শাড়ি কিনে দেয়নি। এই দ্যাখ, এই শাড়িটা আমাকে ওই মল্লিকদের বউ দিয়েছে। ও মাগী খুব ভালো। আমাকে শাড়ি দিয়েছে। কত্ত সুন্দর শাড়িটা দ্যাখ। আমি কেনে পরব না অ্যামন সুন্দর শাড়িখানা? আমি পরব। বেশ করব। আমি আরও করে রঙিন শাড়ি পরব। আরও করে চুড়ি পরব হাতে।

     বলতে বলতে আবার কোথায় উধাও হয়ে যায় সে, – কেউ দেখতে পায় না।

     অনেকে আদরীকে একা একা বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে দেখেছে অনেক সময়। সে কোনও এক মোটা গাছে নিচে হেলান দিয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকে একা একা। চোখ মুছে নিজের শাড়ির আঁচলে। পেছনদিক থেকে গিয়ে কেউ ঘাড়ে হাত রাখলে আদরী অমনি নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করে। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আদরীর মনে যে কষ্ট লুকিয়ে আছে, যে কষ্ট তাকে কাঁদায় আজও, – তা সে বলে না কাউকে। বলতে চায় না। শুধু মনে করে বসে বসে। আর কাঁদতে থাকে একা একা। 

     আদরীর মনে পড়ে, রতনের লাথি ঝাঁটা, ঘরে কুলুপ লাগিয়ে মার কিংবা পায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়াতেও কোনওদিন ততটা কষ্ট পায়নি, যতটা কষ্ট সে সেদিন রতনের না মারাতে পেয়েছিল। রতন সেদিন তার গায়ে হাত তোলেনি। আদরীর শ্বশুর সেদিন বাড়িতে ছিলেন না। সন্ধ্যার পর রাত করে মদ গিলে রতন টলতে টলতে বাড়ি ফিরেছিল। আদরী ভেতর থেকে ঘরের দরজা খুলতেই রতন ঢলে পড়েছিল আদরীর উপরে। কাঁধে হাত দিয়ে টলমলে গলায় বলেছিল, আমি রোজ রোজ অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, ফুর্তি করি বলে তুর খুব হিংসে হয়, তাই না? খুব যে ঘ্যানঘ্যান করিস! হ্যাঁ হ্যাঁ, হিংসে হবেই তো! হিংসে হওয়ারই তো কথা! তা আজ থেকে আর হিংসে হবে না যা। আমি য্যামন অন্য মেয়েদের সাথে শুয়ে থাকি, – তুও অন্য পুরুষের সাথে শুয়ে থাকবি সারারাত। আনন্দ করবি। ফুর্তি করবি। তাহলেই তো হল! তাহলে আর হিংসে হবে না তুর। কী রে, থাকবি না? দ্যাখ আমি কাকে নিয়ে এসেছি তুর জন্যে। ওই দেখ, ওই দেখ, – কী রে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনে? ভেতরে আই। এই এই এই দ্যাখ, – এই দ্যাখ আদরীকে – আমার বউ। যা যা। ভেতরে যা।

      বলে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারই মতো এক মদ গেলা মাতালকে আদরীর সাথে। কুলুপ এঁটে দিয়েছিল রতন বাইরে থেকে হয়ত বা সামান্য কিছু টাকার পরিবর্তে।

     হয়ত এমন আরও অনেক কথা আছে, যা আদরী বলে না কাউকে। এড়িয়ে যায়। বলতে চায় না। নিজে একা একা বসে মনে করে আর কষ্ট পেতে থাকে। কাঁদতে থাকে লুকিয়ে লুকিয়ে। কথায় কথায় যদিও বা বলে ফেলে কিছু কথা কারও কাছে, – বলতে বলতে জিব কেটে ছুটে পালায় সেখান থেকে।

     রতন কবে কিভাবে মারা গেছিল, সেকথা সকলেই জানে। তবুও যদি জিজ্ঞেসা করা হয় আদরীকে, আদরী, রতনের কী হয়েছিল রে? কী করে মারা গেছিল সে?

     আদরী এড়িয়ে যাওয়ার মতো করে বলে, অসুখ হয়েছিল। অসুখ হয়েছিল। কঠিন অসুখ হয়েছিল তার।

     – মিছা কথা কেনে বলছিস, আদরী?

     – না না, মিছা লয়। মিছা লয়। জ্বর হয়েছিল তার। হ্যাঁ, জ্বর হয়েছিল।

     – ও মা! জ্বর হয়েছিল? কিন্তু রতন তো বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল রে! বল না, কী হয়েছিল? কেন আত্মহত্যা করেছিল সে?

     – না না না.....!

     বলতে বলতে ভয়ে কাঁপতে শুরু করে সে। উঠে দৌড় মারে খোলা রাস্তাপানে। দৌড়াতে দৌড়াতে বলতে থাকে, আমি তাকে বিষ দিইনি। আমি তাকে বিষ দিইনি। রাত্রিবেলা আমি তার ভাতে বিষ মিশাইনি। না না, আমি তাকে বিষ খাওয়াইনি। আমি তাকে মারিনি।

     রাস্তার ধারের দুয়েকজন যারা তার এসব কথা শুনতে পায়, – কোনও গুরুত্ব না দিয়ে হেসে বলে, খেপী কোথাকার! কি সব যে মনে মনে বলতে থাকে, ওই জানে আর উপরওয়ালাই জানে! 


     

আকাশে মায়ের মুখ - সামসুজ জামান || Akashe maaer sukh - Samsuz Zaman || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 আকাশে মায়ের মুখ

              সামসুজ জামান


সাইকেলটা চালাতে চালাতে পা ধরে যাচ্ছিল নির্মলের। এমনিতে খুব একটা অভিজ্ঞ বা পরিপক্ক নয় সে সাইকেল চালানোয়। কিন্তু চাপে পড়ে তাকে সাইকেল জোগাড় করতে হয়েছিল।

মালিকের কাছে কাজ করতে করতে হঠাৎই অন্য সকলের সাথে সেও শুনল কাল থেকে সারাদেশে লকডাউন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী টিভিতে ভাষণ দিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই আদেশ ছড়িয়ে দিয়েছেন যেটা অমান্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। কিন্তু অন্যদেরকে তার অবস্থাটা বোঝানোর মতো পরিবেশ বা ক্ষমতাও তার নেই। কাকে সে বোঝাবে আর কেমন করে বোঝাবে তার মনের অবস্থা!

এমনিতেই নির্মল বড় মা অন্ত প্রাণ। পাড়ার অন্য ছেলেরা যখন দলবেঁধে হৈ-হুল্লোর, মৌজ-মস্তিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, তখনও কিন্তু নির্মল মায়ের কথা ভেবে বাড়ির বাইরে বেশিক্ষণ থাকত না। বন্ধুরা ক্ষ্যাপাতো তাকে অনেক। কিন্তু মায়ের ভালবাসার কাছে বন্ধুদের খ্যাপানোর কোন তুলনায় হয় না।

তিন দিন আগে পাশের বাড়ির ফোন পেয়ে সে জেনেছিল মায়ের সংকটজনক অবস্থার কথা। তারপরে আর কাজে মন বসে না তার। মালিকের সাথে অনেক বাদানুবাদ করেও যখন সমস্যার সমাধান হয়নি তখন অগত্যা কাজ ছেড়ে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে। মালিক তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল – দেখ, কী ছাই লকডাউন-মাউন, এসব ব্যপার তো বাপের জন্মেও শুনি নি। এই মুহূর্তে হঠাৎ তোমার হাতে দেওয়ার মত কোন টাকা-কড়িই আমার কাছে নেই। শেষে অনেক চেঁচামেচির পর অল্প কিছু টাকা দিয়েছিল মালিক।

বাড়ির ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি এজেন্টের কাছে ছুটেছিল নির্মল এবং পরের দিন রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটও পেয়ে গিয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে। তাতেই তার বাড়ি ফেরার কথা। বাড়ি ফিরতে তার লাগবে সতেরো ঘন্টা। নির্মল পাগলের মত শুধু ভেবে যাচ্ছে এই সতেরো ঘণ্টা কি করে তার কাটবে? আর এমন অবস্থায় আজ হঠাৎ এই লকডাউনের ঘোষণা!

 কিন্তু বাস, ট্রেন সমস্ত কিছু যখন বন্ধ, তখন ফেরার রাস্তা তো আর নেই। অন্য অনেকের সঙ্গেই আলাপ-আলোচনার পরেও ফেরার রাস্তা কিছু না পেয়ে নির্মল অগত্যা সাইকেলে চড়ে ফেরার মত সিদ্ধান্ত নিল মনে মনে। একমনে এই দুশ্চিন্তার কথা ভাবতে ভাবতে তার নজর পড়ে হাতের দুর্বল আংটির দিকে। কারণ সামান্য কিছু অর্থের মধ্যেও আবার যদি সে বাজে খরচ করে ফেলে এইসময়, তবে তো মায়ের অপারেশন করার খরচ ই পাবে না। তখনই মাথায় মতলব আসে অন্ততপক্ষে এই সোনার আংটিটুকু বিক্রি করলে একটা পুরনো সাইকেল কেনার মত পয়সা তার হতে পারে। আর তারপরই যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সেই টাকা দিয়ে অনেক কষ্টে অনেক দরদাম করার পর সাইকেলের দোকান থেকে পুরনো সাইকেলটা কিনে তার ভরসা হয়। যখন রাস্তাঘাটের গাড়িঘোড়া সব বন্ধ তখন সাইকেলে চড়ে এই দীর্ঘ পথ ফিরতে তার অন্তত কোন অসুবিধা হবে না বলেই তার মনের জোর।

 রাস্তায় লোকজন তেমন নেই কিন্তু নির্মল সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন। নির্মলের পাখির চোখ তার মায়ের মুখ। পাশের প্রতিবেশী মারফত মাকে সে খবর পাঠিয়েছিল সে গিয়েই মায়ের অপারেশন এর যাবতীয় বন্দোবস্ত করবে। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী। রাস্তায় পুলিশ বারবার তাকে আটকে কত যে হয়রানি করেছে কতবার। কতভাবে পুলিশকে বলে, বুঝিয়ে, টাকা-পয়সা খরচ করে তবে সে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত।

 অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ওড়িশা সীমান্ত দিয়ে ঢোকার মুখেই বিপত্তি গেল বেড়ে। পুলিশ কিছুতেই তার কথা শুনবে না। অবশেষে নিজের একমাত্র সম্বল পকেটের কম দামী মোবাইলটা পুলিশকে দিতে, তবে সে মুক্তি পেল। পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যাচ্ছে ক্ষিদে আর তেষ্টায়। সেসবের তোয়াক্কা না করেও অন্তহীন সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে নির্মল।

অবশেষে একসময় নির্মল মাতালের মত টলতে টলতে কোনরকমে সাইকেলটা নিয়ে তাদের নিজেদের গ্রামের বড় নদীর ব্রিজ পার হচ্ছিল। সকালের নতুন সূর্যটা কি সুন্দরভাবে উঠছিল আম বাগানের পাশ দিয়ে। ওপারে বড় আম বাগানের পাশেই এলাকার শ্মশান। কিন্তু শ্মশানে হঠাৎ ভিড় কেন? খুব অসহায় লাগছে তার। সাইকেলটা কোনরকমে থামিয়ে মাটিতে পা রেখেছে নির্মল আর ছুটতে ছুটতে এলো রঘু। বলল- নির্মল কাকু তুমি এলে? কিভাবে এলে? এখনতো চারিদিকে লকডাউন। তোমার মোবাইল তো সুইচড অফ বলছে। কেউ যোগাযোগ করতেই পারেনি। জানো কাকু, ঠাকুমা........ কাল সন্ধ্যেয়...... মারা গেছে পেটের যন্ত্রনায়! ভোরে ভোরে এসে সবাই এইমাত্র ঠাকুমার দাহকার্য শেষ করল।

কি বলছিস রে রঘু? তুই ঠিক বলছিস? বলতে বলতেই মাথাটা ঘুরে গেল নির্মলের।

হ্যাঁ গো কাকু, এই কথা কি আর মিথ্যে করে কেউ বলে? জবাব দিল রঘু।

 সহসা চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাটিতে পড়ে গেল নির্মল আর চিৎকার করে উঠল তীব্রভাবে -- মা! মাগো! আমি যে এসে গেছি মা, তোমার অপারেশন করাব বলে কিছু টাকাও জোগাড় করেছি।

 আমবাগানের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা এসে পড়ছিল তার মুখের উপর। নির্মলের হঠাৎ মনে হল - ওই তো? ভোরের আকাশের সূর্যের মধ্যে থেকে মা চেয়ে আছে তার পানে। দুটো হাত সূর্যের দিকে প্রসারিত করে নির্মল চিৎকার করে উঠল – মা, মাগো! দাঁড়াও মা তুমি ওইখানে। আমি আসছি তোমার দিকে, তুমি চলে যেও না মা, আমি আসছি। আমি যে এত কষ্ট করে ছুটে এলাম, সে তো তোমার অপারেশনের জন্যেই। তুমি চলে যেও না মা।

মাটিতে দু’ হাতে ভর দিয়ে নির্মল প্রাণপণ শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে চেষ্টা করল সামনের দিকে, কিন্তু পা দুটো আর তার এগোল না। দু’ পায়ে জড়িয়ে আছড়ে পড়ে গেল সে মাটিতে। সামনে পড়ে থাকা ভাঙ্গা একটা ইটের উপর মুখটা লাগতেই গর গর করে রক্তস্রোত বয়ে যেতে লাগল তার জামা-কাপড় বেয়ে।

ছোট্ট রঘু এই কাণ্ড দেখে হাও মাও করে চিৎকার করতে করতে লাফালাফি করতে লাগল – ও সুদীপ জ্যেঠু, ও অমর দাদু, তোমরা শিগগির ছুটে এই দিকে এসো গো। দেখে যাও নির্মল কাকুর কি অবস্থা...

কিন্তু নির্মলের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে তার ছোট ব্যাগটা খুলে তার অনেক কষ্টের সঞ্চয়ের টাকাগুলো ছেলেখেলার ভঙ্গীতে বাতাসে উড়িয়ে দিতে দিতে অভিমানে বলতে লাগল – কিচ্ছু দরকার নেই এগুলো আর আমার। এ টাকা-পয়সা আমার আর কোন কাজেই লাগবে না – বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল নির্মল।

নিবারণবাবু ও পিকনিক - অভীক মুখার্জী || Nibaronbabu o picnic - avik Mukherjee || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 নিবারণবাবু ও পিকনিক

                অভীক মুখার্জী




শীতকাল এলেই নিবারণবাবু একটু আতঙ্কে থাকেন এই বুঝি পিকনিকের প্ল্যান হল। কেন?  নিবারণবাবু কি পিকনিক পছ্ন্দ করেন না? নাকি উনি সোস্যালি অকওয়ার্ড? কোনোটাই নয়,উল্টে পিকনিকের হইচই নিবারণবাবু খুবই ভালোবাসেন।তাহলে আতঙ্কে ভোগেন কেন?কারণ আছে,একটা ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক আগে, আর তারপর থেকেই গুটিয়ে গেছেন নিবারণবাবু।কি ঘটনা?বলি শুনুন তাহলে।


নিবারণবাবুর একটা বন্ধুদের গ্রুপ আছে।সব একদম ছোটোবেলাকার বন্ধু,প্রায় প্রত্যেকেই একই স্কুলে পড়েছেন প্রায় বছর দশেক একসাথে।তারপর কলেজ জীবনে ছড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জায়গায়।পরবর্তীতে কর্মসূত্রে আরও দুরবর্তী জায়গায় এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে গেছেন অনেকে।কিন্তু বন্ধুত্বের সূত্র পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়নি।স্মার্টফোন আসার পর সোশ্যালমিডিয়ার দৌলতে অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আবারো যোগাযোগ হয়েছে।এই সব বন্ধুদের গ্রুপে সাধারণত কয়েকজন খুব এ্যাকটিভ থাকে। নিবারণবাবুদের গ্রুপে সুমিত সেইরকমই একজন।মূলত তার উদ্যোগেই ১৯৯৪ উচ্চমাধ্যমিক পাস ব্যাচের বন্ধুদের পিকনিক শুরু হয় ২০০৯ সালে। নিবারণবাবু তখন কর্মসূত্রে মুম্বইনিবাসী।সুমিতের কাছ থেকে জানতে পারতেন সেই সব পিকনিকের কথা আর ভাবতেন তিনিও কবে যোগ দেবেন সেই পিকনিকে। ২০১০ সালে যখন নিবারণবাবু কলকাতা ফিরলেন তখন সুমিত আবার কর্মসূত্রে গুয়াহাটিতে।সে কলকাতায় ব্যাক করার পর আবার পিকনিকের আয়োজন হল ২০১২ ডিসেম্বরে।নিবারণবাবুর আনন্দ তো আর ধরে না।কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে।কয়েকজনের সঙ্গে ফেসবুক মারফত যোগাযোগ থাকলেও বেশিরভাগের নম্বরটাও নেই নিবারণবাবুর কাছে। তাদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় উত্তেজনায় ফুটছেন নিবারণবাবু। সুমিতের কাছ থেকে জানতে পেরেছেন প্রায় জনা ত্রিশ কনফার্মড আসছে। এমন অনেকের নাম রয়েছে সেই লিস্টে যাদের সঙ্গে স্কুলের শেষ দিনের পর আর দেখাই হয়নি। পিকনিক ঠিক হওয়া ইস্তক নিবারণবাবুর মুখে খালি বন্ধুদের গল্প। প্রথম প্রথম বেশ মন দিয়ে শুনলেও ওঁর স্ত্রী শেষপর্যন্ত বিরক্ত হতেই লাগলেন। কিন্তু  নিবারণবাবুর কিছু এসে যায়না তাতে।তা সেই বন্ধুদের ভালো নামগুলো আসলে কী ছিল সেগুলো আর ওনার মনে নেই।লম্বু,মোটা,কালু,রাঘো,বোদো,কি আজব নাম সব! এই সব অদ্ভুত নামগুলো শুধু বন্ধুদের মধ্যেই নয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে তৎকালীন শিক্ষকমহলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।এখন পিকনিকের লিস্টে ভাল নামগুলো দেখে নিবারণবাবু তাঁদের মুখগুলো মনে করার চেষ্টা করছিলেন। 

অবশেষে এসেই গেল সেই বহুপ্রতিক্ষিত দিন।রবিবার সকালে যেখানে নিবারণবাবু নটার আগে বিছানা ছাড়েননা , সেদিন সকাল সাতটায় চানটান করে এক্কেবারে রেডি।তর সইছেনা তাঁর আর। উত্তরপাড়ায় এক বন্ধুর কাকার একটা বাড়ি আছে অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়ার,সেই বাড়িতেই হবে গেটটুগেদার।আর এক বন্ধু যাকে গুন্ডা বলে ডাকতেন সকলে, তার এখন ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা। সেই কস্ট টু কস্টএ খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। আর এক বন্ধু “কাগা”, যে এখন নামকরা শিশুচিকিৎসক, সে ভেনুর ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছে।বাকি সকলের কান্ট্রিবিউশন ধরা হয়েছে পার হেড ৩০০ টাকা করে।সকালে জলখাবার দিয়ে শুরু, দুপুরে লাঞ্চ আর বিকেলে চা এর সঙ্গে স্ন্যাকস। নিবারণবাবু অবশ্য মেনুর থেকেও বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবার সম্ভাবনায় বেশি খুশী।সকাল দশটায় সবার একসঙ্গে মিট করার কথা।জায়গাটাও নিবারণবাবুর বাড়ি থেকে মেরেকেটে পনেরো মিনিট। তবু নিবারণবাবু সকাল নটার সময়েই বেরিয়ে পড়েন।না না, নিবারণবাবুতো নন, বেরোলো তো নিবু । নিবারণবাবুকে তাঁর বন্ধুরা তো ওই নামেই ডাকত। খালি সেদিনের সেই রোগা প্যাংলা নিবু,যার মাথায় ছিল ঢেউখেলানো ঘন চুল,সময়ের অভিঘাতে সে এখন রীতিমত মোটাসোটা এক মধ্যবয়স্ক মানুষ, মাথার চুল পাতলা হতে হতে টাক দেখা দিয়েছে পরিষ্কার।নিবু সাইকেল ছাড়া এক পা বেরোত না, আর এই নিবারণবাবু রিকশা আর গাড়িতেই বেশি স্বচ্ছন্দ।নিবুর সাইকেলটা তাই অযত্নে আজো পড়ে আছে সিঁড়ির তলায়।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিবারণবাবু একটা রিকশা নিয়েই নিলেন।প্রথমে ভেবেছিলেন হেঁটেই চলে যাবেন। কিন্তু তারপর আবার ভাবলেন হাঁটতে সময় লেগে যাবে বেশী। উত্তরপাড়ায় ঢোকার মুখেই সেই “ঢাকা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”।স্কুল জীবনের সেই ছোট্ট দোকানটা এখন বিরাট বড় হয়ে গেছে।নিবারণবাবুর মনে পড়ে যায় নিবু এখান থেকে কত সিঙারা আর পান্তুয়া খেয়েছে তার দৈনিক হাতখরচার ২টাকা দিয়ে।নিজেকে সামলাতে পারেন না নিবারণবাবু। ঢুকেই পড়েন দোকানে।ঝাঁ চকচকে শোকেসে রকমারি মিষ্টি সাজানো থাকলেও অর্ডার দিলেন সেই সিঙারা আর পান্তুয়া।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এক প্লেট মুসেলি খাইয়ে দিয়েছেন স্ত্রী,কিন্তু আজকের দিনটাতো একটু অন্যরকম। ছোটবেলার সেই সিঙারা পান্তুয়ার স্বাদ না পেলেও নিবারণবাবুর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।

মিষ্টির দোকান থেকে পিকনিকের ভেনু কাছেই। যত কাছাকাছি পৌঁছন, নিবারণবাবুর উত্তেজনার পারদ ততই বাড়তে থাকে।ইতিউতি দেখতে থাকেন,যদি কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।ঠিক তখনই চোখে পড়ে এক ভদ্রলোক, বেশ লম্বা,এক মাথা কাঁচা পাকা চুল,তাঁর দিকে একই ভাবে দেখছেন উল্টোদিকের পানের দোকান থেকে।খুব চেনা চেনা মনে হয় ভদ্রলোককে। চকিতে সব কিছু মনে পড়ে যায়।

“আরে লম্বু না ?চিনতে পারছিস?”নিবারণবাবু প্রায় চিৎকার করে ওঠেন। ‘নিবু মনে হচ্ছে। আরে। কত মুটিয়েছিস রে!’ সেই ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন নিবারণবাবুকে।ঠিক সেই সময় একটা বাইক এসে দাঁড়ায় তাঁদের ঠিক পাশে। বাইকারোহী হেলমেট খুলে কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে দুজনকেই।নিবারণবাবু এই বন্ধুর নামটা কিছুতেই মনে করতে পারেন না, অয়ন না সায়ন?যে হবে হোক, আজ সবাই শুধু বন্ধু, নামটা বড় কথা নয়।লম্বু পানওলাকে অর্ডার দেয়, ‘তিনটে গোল্ডফ্লেক’। জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না বাকি দুজন সিগারেট খায় কিনা। তিন বন্ধু সিগারেট ধরিয়ে পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই শুরু করে দেয় গল্প।বহুদিনের বহু গল্প যে জমা হয়ে রয়েছে।দেখতে দেখতে আরো দু তিন জন এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে। নিবারণবাবু যথারীতি নামগুলো কিছুতেই মনে করতে পারছেন না, না চেহারাগুলো মেলাতে পারছেন ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে। গল্প করতে করতেই সবাই পৌঁছুলেন সেই বাড়িটায়।ভেতরেও অনেকে এসে গেছে ততক্ষণে।নিবারণবাবুদের ঢুকতে দেখে সবাই হই হই করে ওঠে।

‘আরে নতুন লোক এসেছে রে।কিরে ব্যাটা নিবু? যা মোটা হয়েছিস চিনতেই পারা যাচ্ছে না।’কেউ একজন নিবারণবাবুর পিঠে একটা বিশাল থাপ্পড় কষিয়ে বলে।পেছন ফিরে নিবারণবাবু নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেন না। এক সময়ের বেস্ট ফ্রেন্ড নিরুপম ওরফে মামা। সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত পাশাপাশি বসা, টিফিন শেয়ার, একসঙ্গে নীলডাউন, কত শত স্মৃতিতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায় নিবারণবাবুর। “কেমন আছিস মামা?” নিবারণবাবু জড়িয়ে ধরেন বন্ধুকে।আর একজন কেউ বলে ওঠে “শালা আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? ব্যাস তারপর যেটা হল সেটা আমেরিকান ফুটবলে যে হাডল হয় তার দেশি ভার্সন।এরই মাঝে কেউ একজন চিৎকার করে “থ্রি চিয়ার্স ফর নাইনটিফোর ব্যাচ।” বাকি সবাই ধুয়ো ধরে “ হিপ হিপ হুররে”। ঠিক কুড়ি বছর আগে যেমন হত।

প্রাতমিক পুনর্পরিচয়ের পালা সাঙ্গ করে সবার এবার  মনে পড়ে জলখাবারের কথা। আবার যেন স্কুলের দিনগুলো ফিরে আসে।লম্বু মামার প্লেট থেকে দুটো লুচি তুলে নিতে নিতে বলে “ তোর না পেটে গন্ডগোল? আবার লুচি খাচ্ছিস তার পরেও।” স্কুলের টিফিনের লুচি তুলে নেওয়া নিয়ে লম্বু আর মামার মারামারি ছিল নিত্যকার ঘটনা।এখন অবশ্য সে সব কিছুই হলো না।উল্টে মামা লম্বুর পাতে খানিকটা তরকারি তুলে দিয়ে বলল “গেল গেল, আরও গেল, এ্যাতো গিলিস তবু তোর গায়ে মাংস লাগে না কেন বলত?” ওদিকে দিবাকর মানে ব্যাঙ মুখে দুটো রসগোল্লা ঠুসে চোখ বুজে যেন জাবর কাটছে। নিবারণবাবুর মনে পড়ে এই ব্যাঙ মাঝে মাঝেই টিফিনের দরবেশ চুরি করত ঠিক এই ভাবেই।সময় বোধহয় সব কিছুকে চেঞ্জ করে দেয় না।

জলখাবারের লুচি আলুরদম মিষ্টি শেষ হতে নাহতেই সুমিত এককোণে রাখা একটা বড় ব্যাগ থেকে বের করে ফেলল দুটো বড় বোতল,একটা হুইস্কি অন্যটা ভদকা।তাদের বন্ধু শিবাশিষ এখন এক বিদেশি মদ কোম্পানির বড়কর্তা।সেই স্পনসর করেছে এই পানীয়।ব্যাস শুরু হয়ে যায় নরক গুলজার। নিবারণবাবুও বাদ জাননা ।বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় স্ত্রী যদিও পইপই করে মদ্যপানে না করেছিলেন, কিন্তু নিবারণবাবু নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না।বন্ধুদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করতে করতে উড়ে যেতে লাগল গ্লাসের পর গ্লাস।পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকল ভেজ আর চিকেন পকড়ার প্লেট।দেখতে দেখতে দু বোতল শেষ।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শেষ হলে হবে কী করে? নিমেষে হাতে হাতে বেশ মোটা চাঁদা উঠে যায়।মানস বাইকের পেছনে শান্তনুকে বসিয়ে ছুট লাগায় বটব্যালের দোকানের দিকে।দোকান বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।

এদিকে হুইস্কি আর ভদকার মিক্সচার খেয়ে নিবারণবাবু সামান্য, না না, বেশ একটু বেসামাল হয়ে পড়েছেন।কখনো মনটা ফুরফুরে লাগছে তো কখনো চাপা দুঃখগুলো গুড়গুড়িয়ে উঠছে।পাশে বসা মামার সঙ্গে সে সব কথাই চলছে।মামার অবস্থাও খুব একটা স্বাভাবিক নয়।সেও কেমন যেন গুম মেরে রয়েছে।নিবারণবাবু অনেক দুঃখ নিয়ে তাঁকে বলতে গেলেন “ দ্যাখ মামা, যত দিন যাচ্ছে তত ফুলে যাচ্ছি।কোথায় মাথায় চিরুনি চলত না ! এখন দ্যাখ, টাক চকচক করছে, ছোটবেলাটাই ভালো ছিল রে , এত চিন্তা ছিল না”।ব্যাস, শোনা মাত্র মামা যেন ফেটেই পড়ে “আব্বে নিবু, তোর বুদ্ধিটা কি এখনো হাঁটুতেই আছে?এখন কি খারাপ আছিস শুনি? মদ গিলছিস, হুল্লোড় করছিস,আর কি চাই?আমায় দেখ, এমএসসি ফার্স্টক্লাস পেয়ে এখন লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক। কিন্তু তোফা আছি।কম্প্রোমাইস গুরু, পুরো লাইফটাই কম্প্রোমাইস”।পাস্ থেকে ব্যাঙ ফুট কাটে “তা যাই বল ভাই, মাল খাবার ব্যাপারে কিন্তু কোন কম্প্রোমাইস নয়।” এইরকম টুকরোটকরা কথাবার্তা চলতেই থাকে। মানস ফিরে এসেছে ততক্ষণে, সঙ্গে এক ক্রেট বিয়ার। আসতে না আসতে সেগুলোও শেষ।

নিবারণবাবু পুরো আউট ততক্ষণে।একে তো এত বছর বাদে বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে দেখা, তারওপর হুইস্কি, ভদকা আর বিয়ার এর বিচিত্র ককটেল।কী বলছেন কী করছেন কোনও কিছুর ওপরেই নিবারণবাবুর আর কোনো কন্ট্রোল নেই।অন্যান্যদের অনেকের অবস্থাও প্রায় একই রকম।খালি জনা পাঁচেক যারা জলবিহার করেনি তারাই সোবার আছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে হুড়হুড় করে।দুপুরের লাঞ্চও রেডি ইতিমধ্যে। যারা স্বাভাবিক আছে তারা প্রায় ধরাধরি করে বাকি বন্ধুদের বসিয়ে দেয় খেতে।দুপুরের লাঞ্চের মেনুটাও বেশ জমকালো।পোলাও, তোপসে ফ্রাই, মাটন কষা, চাটনি, পাঁপড় আর রাজভোগ।যে টেবিলে সুশোভন মানে মোটা বসেছে তাকে ঘিরে বন্ধুদের একটা জটলা তৈরি হয়।শোনা যায় ক্লাস ১২ এ পড়ার সময় মোটা কোনো এক বন্ধুর দিদির বিয়ের নেমন্তন্নে ২১টা ফিশ ফ্রাই, এক বালতি মাটন আর ৫০টা রসগোল্লা খেয়েছিল।এত বছর পরেও সুশোভন সেই একই রকম আছে।তার বিশাল বপু বিশালতর হয়েছে।কিছুদিন আগে এক বৃষ্টির রাতে রেনকোট পরে অন্ধকার রাস্তায় বাইক চেপে আসার সময় রাস্তার ধারে কয়েকজন মহিলা তাকে নাকি অটো ভেবে ভুল করেছিল।সেটা আবার তার নিজের মুখ থেকেই শোনা।এক পেট মদ খাওয়ার পরও সুশোভন নিজের ফর্ম বজায় রাখছিল লাঞ্চের টেবিলে।সেই সুশোভনের পাশে বসে নিবারণবাবু সঙ্গ দোষে বা গুণে যাই হোকনা কেন, স্বাভাবিক দিনের প্রায় দ্বিগুণ খেয়ে ফেললেন।খেয়ে তো ফেললেন, কিন্তু উঠতে আর পারেন না।এঁটো হাতেই গুম মেরে বসে রইলেন।দেখতে দেখতে থুতনিটা প্রায় বুকে ঠেকে গেল।মাঝে হালকা করে একটু নাক ডাকার শব্দও শোনা গেল যেন।তখন বাকি বন্ধুরা খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত ছিল বলে বিশেষ নজর দিল না কেউ।

সবার যখন খাওয়া শেষ হল তখন বিকেল প্রায় সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।টানা গল্প করতে করতে বন্ধুরাও যেন একটু হাঁপিয়ে গেছে,বিশেষ করে হেভি লাঞ্চের পরে।সুমিত হটাৎ হাঁক পাড়ে “ওরে কেউ একটু মিউজিক চালা কেউ, নাচ না হলে পিকনিক হয় নাকি?” কেউ একটা হিন্দি গান চালিয়ে দিল মোবাইলে। শুরু হল নাচ। চটকা ভেঙ্গে নিবারণবাবুও সোজা নাচতে শুরু করেন। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, নিবারণবাবু নাচছেন। জীবনে নিবারণবাবু কোনওদিন নাচেন নি, এমনকি পুজোর ভাসানেও নয়। কিন্তু এখন জনা পনেরো বন্ধু মিলে এক অদ্ভুত নাচ জুড়লেন যেটাকে নাচ না বলে আবোলতাবোল লাফালাফি বলাই ভালো।এই যে নিবারণবাবু , ১০ মিনিট হাঁটতেও যাঁর প্রবল অনীহা, সেই তিনিও প্রায় আধঘণ্টা টানা নেচে নিলেন মানে লম্ফঝম্প করলেন। হচ্ছিল সবই, হটাৎ কী হল, নিবারণবাবু নাচ থামিয়ে গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে পাশে বসা মামাকে বললেন, “শোন আমি এখন আসি বুঝলি, নেশাটা একটু বেশী হয়ে গেছে, এরপর বাড়ি পৌঁছনো মুশকিল হয়ে যাবে”। ‘দাঁড়া, সুমিতকে বলছি একটা রিকশা ডেকে দিতে’, মামা বলে। “না না কোনো দরকার নেই, নিবারণ এইটুকু মাল খেয়ে টাল খায় না”, বলে নিবারণবাবু সোজা দরজার দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু কি হল? এত কল এলো কোথা থেকে? সকালবেলা তো ছিলনা। আরে দূর, এটা তো বাথরুমের দরজা, ভুল শুধরে নিবারণবাবু ঠিক দরজা খুঁজে বাইরে এলেন। ভাগ্য ভালো, একটা রিক্সা যেন তাঁর জন্যই ওয়েট করছিল।

বাড়ির দরজায় নেমে গম্ভীরভাবে বেল দিতে গেলেন নিবারণবাবু।কিন্তু কী মুশকিল, নাগাল পাচ্ছেননা কেন? এই কয়েক ঘণ্টায় দরজাটা উঁচু হয়ে গেল নাকি? আজব ব্যাপার তো? ওই যা:, দরজাটা আবার খুলেও যাচ্ছে নিজে থেকে। তিনি তো বেল দেননি।একজন বয়স্ক মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে। নাঃ, নেশাটা একটু বেশি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। “ সরি, ভুল বাড়িতে এসে গেছি’, বলে নিবারণবাবু পিছন ফিরে চলে যেতে চান।কিন্তু সেই বয়স্ক মানুষটি খপ করে তাঁর জামা ধরে ভিতরে টেনে নেন,“ঘরে ঢোক ড্রাঙ্কার্ড কোথাকার, বউমা, মাতালটাকে ভেতরে নিয়ে যাও”। ভদ্রলোকের গলার সঙ্গে বাবার গলার খুব মিল পান নিবারণবাবু।উনি আরও কি সব বললেন গন্ধ নিয়ে, কিন্তু নিবারণবাবু ভালো করে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বয়স্ক মানুষের কথার উত্তর না দেওয়াটা অশোভন, আন্দাজেই নিজের হাতঘড়িটা একটু শুঁকে গম্ভীরভাবে নিবারণবাবু বলেন “সরি স্যার, আপনি ভুল বলছেন, এটায় কোনো গন্ধ নেই”। এটুকু বলে নিবারণবাবু আর পারলেননা, ধপ করে বসে পড়লেন সিঁড়ির তলায়।আউট হয়ে যাবার আগে খালি কানে এল তাঁর ক্লাস টু তে পড়া মেয়ের গলা “ বাবা বড়দের কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছে, কী মজা, কী মজা”!

তারপর যা হল সেটা অন্য গল্প। নিবারণবাবু সেই থেকে পিকনিক একটু এড়িয়ে চলেন। কে জানে আবার কী হয় ।



প্রচ্ছন্ন আততায়ী - গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য || Prachanno Atotai - Gayatri Bhattacharya || Golpo || ছোট গল্প || short story || Bengali story

 প্রচ্ছন্ন আততায়ী 

         গায়ত্রী ভট্টাচার্য্য 




জানালা খুলতেই নন্দিনী দেখলো চাপচাপ কুয়াশা গোটা আকাশটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। খুব কাছাকাছি মানুষকেও দেখা যাচ্ছে না। সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর হতে চললো, কিন্ত কুয়াশা আর কাটতেই চাইছে না। জানুয়ারি মাসের শেষের দিক, যেমন ঠান্ডা, তেমনই কুয়াশা। মুসৌরিতে অনেক বছর হলো নন্দিনীর বাস, তাই শীতকালে মুসৌরিতে ঠান্ডার হাল- হাকিকত তার জানা। কলকাতার ঠান্ডা এর ধারেকাছে আসতেই পারে না। এই কুয়াশার সময় জানালা খুলে রাখলে ঘরের ঠান্ডা আরও বেড়ে যাবে। এখানে তার নিজের ছোট্ট একটা বাড়ী।বছর পঞ্চাশের নন্দিনী এখানকার একটি বেসরকারী অফিসে চাকরি করে। আজ নেহাতই ছুটির দিন, তাই জানালা বন্ধ করে ফের শুয়ে পড়লো।


একটু বেলার দিকে নন্দিনীর মনে হলো কুয়াশার চাদর একটু হালকা হয়েছে, সূর্যদেব মাঝে মাঝে উঁকি মারছেন। কি মনে হতে জানালা খুললো নন্দিনী। বাইরের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে।  ঠিক তার ব্যালকনির নীচে এক ছায়া মূর্তি। ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। নন্দিনী উচ্চৈস্বরে বলে উঠলো,

“—কে! কে ওখানে?”

নাঃ,কোনো সাড়া নেই! তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখলো কেউ কোত্থাও নেই! কদিন ধরেই নন্দিনীর  যেন মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে।কিন্ত কাউকে যে দেখতে পেয়েছে এমনটা নয়। তবুও সন্দেহটা মনে খচখচ করে জানান দিচ্ছে। যদিও সে যে কোনও ঠোস প্রমাণ বা সাবুদ পেয়েছে,তা নয়। 

দূর, কি যে ভেবে চলেছে নন্দিনী।কেন কেউ তার পিছু নেবে! মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে নিশ্চিন্ত হলো।


বেশ কিছুদিন কেটে গেল নন্দিনীর নিস্তরঙ্গ জীবন। একদিন তার মনে হলো মুসৌরি লেক আর কেমপ্টি জলপ্রপাত ঘুরে আসবে। কেমপ্টি ফলসের ওখানে প্রচুর লোক আর দর্শকদের ভীড়। তার চেয়ে  মুসৌরি লেক অনেকটা বেটার, নিরিবিলি। মুসৌরি লেকের ধারে একটা জায়গায় চুপচাপ বসেছিল। আনমনে তার জীবনের পুরোনো কথাগুলো রোমন্থন করে যাচ্ছিল। যত ভাবে সেই ঘটনা মন থেকে মুছে দেবে, কিন্ত বারেবারে সেই স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে,ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তার শরীর -মনকে। গা গুলিয়ে ওঠে নন্দিনীর। 


আনমনা মন সচেতন হয়ে পড়লো যখন নন্দিনীর দুই চোখ কিছুটা দূরে একজনকে দন্ডায়মান দেখলো। কালো ওভারকোট আর টুপি পরা একটা লোক,সে একদৃষ্টে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে! ব্যাপারটা নন্দিনীর খেয়াল হতেই তার বুকটা কেমন চ্যাঁৎ করে উঠলো। স্বগতোক্তি করে উঠলো ,

“—কে! কে ওখানে?”

কোনোরকম কাল বিলম্ব না করে সেই স্থান ত্যাগ করলো। নিজের বাড়ীতে ফিরে এসে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল। সারা শরীরটা কেমন যেন করছে। একটা চাপা উত্তেজনা গোটা শরীরকে বিকল করে দিচ্ছে, তার রেশ ছড়িয়ে পড়ছে তার মস্তিষ্কে।

সেদিনের তার ঘরের ব্যালকনির নীচে দেখা ছায়ামূর্তিটা আর আজ লেকে দেখা লোকটা হুবহ এক! সেদিনের লোকটাকে ভালোভাবে দেখতে পায় নি,চারদিক কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল বলে। আজ দিনের আলোতে পরিস্কার তাকে দেখেছে। কিন্ত সে কেন হবে! তার পক্ষে এখানে আসা কিছুতেই সম্ভব নয় । না না! ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না! নন্দিনীর চেয়ে আর কেউ বেশী জানে না, ‘সে’কিছুতেই নয়। ভুল,সব মনের ভুল। রাত হতে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো, নাহলে তার ঘুম আসবে না।


দু- তিন দিন পর অফিসে জয়েন করল নন্দিনী। তার বস নন্দিনীকে ছুটি দেন তাই,নাহলে কি যে হতো। অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নামলো, পাহাড়ে মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামে। ছাতা সঙ্গে রাখতেই হয়। ছাতা থাকলেও সামান্য ভিজে গেল। বাড়ী এসে সদর দরজা খুলে নিজের রুমে ঢুকতেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,

“—নন্দিনী “

“—কে ! আমার ঘরে কে?” নন্দিনী জোরে বলে উঠলো।

“—আমি নন্দিনী।“ 

নন্দিনী এবার লক্ষ্য করলো তার ড্রয়িংরুমে কালো ওভারকোট, আর টুপি পরা লোকটা একটা সোফায় গা এলিয়ে বসে রয়েছে। ভয়ে আতঙ্কে তার শরীর কাঁপতে থাকলো।

নন্দিনী পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই সোফায় বসা লোকটি তাকে ধরে ফেললো ,

“—সেকি নন্দিনী ! তুমি যে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলে!”

নন্দিনী একটু ধাতস্থ হতে বললো , 

“—কে আপনি ! কি প্রয়োজন আপনার!  কেনই বা এসেছেন এখানে আমার বাড়ীতে! আর কি আশ্চর্য আমি তো দরজা লক করে বেরিয়েছিলাম,  কি করে আমার ঘরে ঢুকলেন! আপনার সাহস তো কম নয়! আমি এক্ষুনি পুলিশ ডাকছি,তারপর  কি শাস্তি হয় দেখছি।“ ত্রাস মিশ্রিত কন্ঠে কথাগুলো বললো নন্দিনী।


“—হাঃ হাঃ হাঃ, তাই নাকি!  তুমি পুলিশ ডাকবে! আমাক ধরিয়ে দেবে! পারবে পুলিশ ডাকতে! “ 

“—খুব পারবো, একজন অচেনা অজানা লোক আমার ঘরের চাবি চুরি করে কি মতলবে আমার ঘরে ঢুকেছে, সেটা পুলিশ জানতে পারলেই সোজা শ্রীঘরে।” খানিকটা জোরেই কথাগুলো বললো নন্দিনী।

লোকটি আবার হেসে উঠে বললো,

“—সে কি! তুমি জোরে কথা বলছো! ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছি! এতো গলার জোর দেখিয়ে বোঝাতে চাইছো যে তুমি আমাকে চেনো না! হাঃ হাঃ ,তাই নাকি!  আমি অবাঞ্ছিত আর তোমার ঘরে চুরি করে ঢুকেছি তাই পুলিশকে খবর দেবে!বেশ,ডাকো পুলিশ।”


নন্দিনী পুলিশ ডাকার কথা মুখে বললেও সত্যিই সে ডাকতে পারবে না,  এই কথা তার চেয়ে বেশী কেউ জানে না। কিন্ত এতদিন পর কিভাবে তার উদয় হলো! নাঃ ভুল ভাবছে নন্দিনী, এই লোক ‘সে’কিছুতেই হতে পারে না।  তাকে যে নিজের হাতে  .....। কিন্ত তাই বা কি করে হয়! লোকটি অবিকল তারই মতো দেখতে! সেই লম্বা, চোখে মুখে হিংস্র কুটিলতা,যেমনটি সে ছিল। শুধুমাত্র গলার স্বরটা একটু অন্যরকম। গলার স্বরের সেই হিমশীতল  বর্বরতার ভয়ে সবসময়ই কাঁটা হয়ে থাকতো নন্দিনী, সেইটা যেন নেই !  এতোদিন পর বলে গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে হয়তো ! কিন্ত কি ভাবছে নন্দিনী! ‘সে’ হতেই পারে না! তাকে নন্দিনী নিজের হাতে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। 

“—এতক্ষণ ধরে কি এতো ভেবে চলেছো মেরে জান, আমার নন্দিনী! ভাবছো যে, এতোদিন পর আমি কিভাবে তোমার বাসায় এলাম! একজন মৃত মানুষ কি করে আসতে পারে, যে মানুষকে তুমি নিজের হাতে খুন করেছিলে! তাহলে আমি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে এলাম কি করে!” 

এই কথাগুলো কঠিন কন্ঠে বলে লোকটি ধীর পায়ে নন্দিনীর কাছে এগিয়ে এলো।

নন্দিনী আঁতকে উঠে দূরে ছিটকে সরে গিয়ে বললো ,

“—আসবে না,আসবে না তুমি আমার কাছে। তুমি একটা পিশাচ, বন্য পশুর থেকেও ভয়ঙ্কর, তোমার মতো নোংরা পাপী লোক একদম আমার কাছে আসবে না। সাবধান বলে দিচ্ছি।“

“—এই তো ম্যাডাম!যাক্ আমাকে চিনতে পারলে তাহলে! হাঃ হাঃ।”

এইরকম সাংঘাতিক নরাধমকে না চেনার উপায় কি আছে নন্দিনীর!  এই মানুষকে একদিন ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিল সে, সারা জীবনের মতো বাবা মাকে পর করে দিয়েছিল।নন্দিনীর বাবা- মা, দাদা কখনও চাননি, নন্দিনী পলাশের মতো বাজে  ছেলেকে বিয়ে করুক। কিন্ত প্রেমে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। বয়স তখন কম ছিল নন্দিনীর। তাই প্রেমিক পলাশের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল,ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সুরক্ষিত নিরাপদ আদরে ঘেরা বাবা মায়ের ভালোবাসার বন্ধনকে। সেই সময়ে পলাশকে ভেবেছিল পরম আপন, আর বাবা মা শত্রু। ভুল ভাঙ্গতে সময় লাগেনি নন্দিনীর।  কিছুদিন পরেই টের পেয়েছিল পলাশের বিকৃত মানসিকতার আচরণ, কি ভয়ানক,কি ভয়ংকর রূপ।মনে পড়তেই গোটা শরীরের তীব্র কষ্ট হতে শুরু করে নন্দিনীর। একদিন সব সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে নিজের হাতে পলাশকে .....

“—পলাশ! তুমি কিভাভে আবার ফিরে এলে ! না ,না, তুমি পলাশ নও,তুমি অন্য কেউ!” ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলো নন্দিনী।

“—কেন বিশ্বাস হচ্ছে না ম্যাডাম, আমিই পলাশ,  আমাকে তুমি খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলে ! সেই আমি কি করে এতোদিন পর বেঁচে উঠলাম! বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার! কি বলো ?”

“—পলাশ তুমি !! কিভাবে ....! তোমাকে আমি যে যে নিজের হাতে মেরে ফেলেছিলাম! “ 

কথাগুলো অস্পষ্ট ভাবে বলে সোফায় ধপ্ করে বসে পড়ল। হঠাৎই ঘরের চারদিকের আলোগুলো জ্বলে উঠলো। নন্দিনী  খেয়াল করলো প্রায় আলো- অন্ধকার মেশানো ঘরে পলাশের সঙ্গে কথা বলছিল।  কিন্ত এখন সারা ঘর আলোকিত হয়ে গেল! তার আশ্চর্য হওয়ার রেশ কেটে গেল এক গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজে! পাশ থেকে কে বলে উঠলো,

“—তাহলে নন্দিনী ম্যাডাম,স্বীকার করছেন যে আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরীকে নিজে হাতে খুন করেছেন? বাই দ্য ওয়ে, আমি নির্মল বসু গোয়েন্দা বিভাগ লালবাজার, কলকাতা থেকে এই কেসের ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্বে আছি। আর যাঁকে আপনি আপনার স্বামী পলাশ চৌধুরী মনে করেছেন,তিনি আসলে আমার সহকারী প্রচেৎ অধিকারী।”

নন্দিনী এবার দেখলো, প্রচেৎ মাথা থেকে উইগ খুলে ফেললো, তার সঙ্গে নকল গোঁফ দাড়ি। এতক্ষণ যাকে পলাশ বলে ভুল করছিল,সে এখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ।

“—ম্যাডাম আপনি বাড়ী বিক্রি করে দেওয়ার পর মুসৌরী চলে আসেন। পরে ঐ বাড়ী হাতবদল হয়ে যায় প্রায় একবছর আগে। বাড়িটি কেনেন এক পুলিশ অফিসার। নতুন নির্মাণের জন্য খনন করতেই বাগানের একপাশে মাটির তলা থেকে একটি কঙ্কাল বেরোয়। ঐ অফিসার ডি.এন. এ. টেষ্ট করাতে জানা যায় উনি পলাশ চৌধুরী। তারপর 'পলাশ চৌধুরী মিসিং' ফাইল রি – ওপেন হয়। এবার আপনি বলুন।”

কথাগুলো শোনার পর নন্দিনী কঠিন স্বরে বলে,

“—আমি পলাশ বিয়ে করার পর বুঝতে পারি সে একটা অমানুষ, সাইকো, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় নি। আমাকে অদ্ভুত রকমের যন্ত্রণা দিয়ে যৌনসুখ পেতো। সে কষ্ট, যন্ত্রণা আর লজ্জার কথা আপনাদের বলতে পারবো না। আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল, আমি আস্তে আস্তে পঙ্গু  এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। একদিন এক দুর্যোগের রাত এলো, পুরো কলকাতাকে সুপার সাইক্লোন তছনছ করে দিচ্ছিল। প্রচন্ড ঝড়, প্রশাসন থেকে সতর্ক করে দিয়েছিল। সেই রাতে মদ্যপ পলাশকে ক্ষুর দিয়ে আক্রমণ করি ,সে মদ্যপ ছিল তাই প্রতিহত করতে পারে নি। ক্ষুর দিয়ে আমি ওর শ্বাসনালী কেটে দি। ও বুঝতে পেরেছিল আমি ওর কাছ থেকে শেষ হিসেব চেয়ে নিচ্ছি।  নরপশুটা ছটফট করতে করতে মারা যায়। তারপর বাগানে নিয়ে গিয়ে একটা গর্তের মধ্যে ওকে এবং সমস্ত প্রমাণ মাটি দিয়ে বুজিয়ে দি।ঐ গভীর গর্ত পলাশ তৈরী করেছিল বাগানে সুইমিং পুল বানানোর উদ্দেশ্যে। ঝড়ের রাতে কেউ দেখার মতো ছিল না,তাছাড়া আমাদের বাড়ীটা ছিল উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

দুদিন পর দুর্যোগ কমলে, থানায় গিয়ে’পলাশ চৌধুরী নিখোঁজ’ ডায়েরি করি। সাইক্লোনে গাড়ী চাপা,গাছ চাপা এইসব কারণে বহু মানুষ মারা যায়। আরও দু দিন পর থানা থেকে আমাকে ফোন করা হয়,একটি লাশকে সনাক্ত করার জন্য। একটি ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে চেনার উপায় ছিল না,আমি সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করি। সেই লাশকে আমি পলাশ বলে সনাক্ত করি,তারপর নিয়ম মাফিক সৎকার করি। আরও বছরখানেক থাকার পর সমস্ত ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, আর বাড়ী বিক্রির টাকা নিয়ে চলে আসি মুসৌরিতে। সে প্রায় কুড়ি বছর আগে। এতদিন পর আপনারা .....ভাবতেই পারি নি আমাকে ধরে ফেলবেন!! যাইহোক আমার কোনো আক্ষেপ নেই।  যেখানে নিয়ে যাবেন চলুন...।“


নন্দিনী ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।