মনের আমি মনের তুমি - স্নেহাশিস মুখোপাধ‍্যায় || প্রবন্ধ || নিবন্ধ || Article writing

 মনের আমি মনের তুমি 

           স্নেহাশিস মুখোপাধ‍্যায়



 


মন নিয়ে লিখতে বসে একটা সক্ষমতা এবং অসক্ষমতার প্রশ্ন খুব বড়ো হয়ে উঠছে। ‘দুই পাখি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ খাঁচার পাখি এবং বনের পাখির ভেতরে যে মিল এবং পার্থক্য তৈরি করে দেখিয়েছিলেন, তার শেষে অসামর্থ্যের প্রশ্নটি বড়ো হয়ে দ্যাখা দিলো। খাঁচার পাখি নিরিবিলিতে থাকে, কিন্তু তার ভেতরে বাইরের পৃথিবীর স্বপ্ন রয়েছে। বনের পাখি অনেক খোলামেলা এবং উদার হলেও এবং তার সঙ্গে আকর্ষণীয় হয়ে উঠলেও, খাঁচার পাখির পক্ষে সেই দামালপনার সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতি দান করা মোটেই সম্ভব নয়। ফলে তার ভেতরে সুখ এবং দুঃখ দুই-ই সময়ে সময়ে মুহূর্ত তৈরি করে ফেলছে। আধুনিককালের মনস্বী মানুষেরা মানুষের মনোস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যে পর্যবেক্ষণগুলোকে সামনে রাখার চেষ্টা করেন, তার ভেতরে স্বপ্ন একটি অন্যতম বিষয়। ফ্রয়েড সাহেব তাঁর ‘স্টাডিস অন হিস্টিরিয়া’তে বাস্তব মানুষের জীবনে স্বপ্নের ধারণাকে ভ্রান্ত বলে ধরে নেননি। বরং তাকে বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার ভেতর দিয়ে একটা রুপ দিতে চেয়েছেন। দুজন মানুষের মনের আলো-অন্ধকারের দিক যে আসলে সাফল্য এবং ব্যর্থতার দিক এবং তার বৈচিত্র্য, ফ্রয়েড বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগীর মানসিক অবস্থার রোগজনিত টানাপোড়েনের আলাদা আলাদা দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।


মন নিয়ে দু-কথা লেখা আর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলা খুব সমার্থক নয়। কিন্তু মনের সঙ্গে মনস্তত্ত্বের একটা মিল থাকে বলেই লেখাটা সাহস করে লিখছি। মন নিয়ে কথা উঠলেই, মনের স্থিরতা এবং অস্থিরতা নিয়ে কথা ওঠে। তখন সময় তুল্যমূল্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সকলই ক্ষণিক, খণ্ড, ছিন্ন’...। অর্থাৎ সমস্ত কিছুই একটা মেয়াদের ভেতরে আবদ্ধ হয়ে থাকে। সেইজন্য অনেক বিষয় নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও মেয়াদী। তাহলে চিরন্তন বলে কি কিছুই নেই? কিছু হয় না? এক্ষেত্রে খণ্ড এবং ছিন্ন হওয়ার নিমিত্তকালটিকেই চিরন্তন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, এর ভেতরে ধারাবাহিকতার উপাদান রয়েছে। দেশ, কাল, ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারার মধ্যে এই চিন্তাটাই হয়তো একমাত্র সত্য। কিন্তু মানুষের মনের ধারার বয়স, মানে একক মানুষের ক্ষেত্রে সময় অনেক কম থাকার জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদী বিচ্ছিন্নতা যা দীর্ঘদিনের ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত, তাকে খুব বেশি ছুঁয়ে যায় না। একক মানুষের জীবন তো তাঁর মতোই হবে। ফলে, তাঁর মন এবং মনের গঠনের মেয়াদ আরো কম হওয়াই স্বাভাবিক। অথচ এই মানুষটিও ইতিহাসের বিরাট ব্যাপ্তির একটা অংশ। এবং খণ্ড ও বিচ্ছিন্ন। ফলে চিরন্তনের সেও একজন অংশীদারই হয়ে উঠছে। মানুষটি কিম্বা ব্যক্তিটির ভেতরে প্রত্যেকদিনের চিন্তার ঢেউ এবং শূন্যতা নিয়েই তাঁর নিজস্ব মনোজগৎ এবং মনোস্তত্ত্বের বোধটি তৈরি হয়ে চলেছে। এই মনোস্তত্ত্বকে একটি উন্নততর বিজ্ঞান বলেছিলেন মনোস্তত্ত্ববিদ নিৎসে। ফরাসী কবি বোদলেয়ারের কবিতায় খুব স্পষ্টভাবে ভালো এবং মন্দ চিন্তার মানুষের মন নিয়ে লেখা আছে, যা মানুষের ভেতরের অন্তর্গত ধারণা সম্পর্কে একটা রুপ তৈরি করতে কিম্বা বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। বুদ্ধধর্মের চর্চার ভেতরেও এই ‘পজিটিভ’ এবং ‘নেগেটিভ’ চিন্তার কথা বলা হয়ে থাকে। উপনিষদের অনেক শব্দই পরবর্তীকালে তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। কিম্বা সেই চর্চারও একটা ধারাবাহিক ইতিহাস তৈরি হয়ে উঠেছে। এই সামগ্রিকতা ব্যক্তির জীবন আর সামাজিক কিম্বা আরো বড়ো কোনো জীবনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অংশীদার হয়ে মানুষের মনের আকার এবং রুপকে একটা বিবর্তনের ভেতর নিয়ে চলেছে। একেও একধরণের যান্ত্রিক প্রক্রিয়াই বলা যায়। বিবেকানন্দ মানুষের জীবনে দুঃখের বোধ তৈরি হওয়ার কারণ হিসেবে জ্ঞান কিম্বা অনুসন্ধিৎসার অভাব বলেই আলোচনা করেছিলেন। এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ খুব সাধারণ স্তরের মানুষের কথা বলেননি। ‘কুয়োর ব্যাঙ’ বলতে বিবেকানন্দ যা বুঝিয়েছিলেন, তাকে আজ হয়তো সর্বজনীন বলে দ্যাখাই যায়। কিন্তু একটা সময় এই কথাটিরও একটা সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র ছিলো।


সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকার কতোগুলো শর্ত থাকে। সাধারণ বলতে, সমস্ত মানুষের কথাই এখানে বলা হচ্ছে। বিজ্ঞান বলতে একটা সময় মানুষ বিশেষ জ্ঞানকেই বুঝতো। এখন বিজ্ঞান বলতে ব্যবহারিক জ্ঞানের দিকে মানুষের আগ্রহ বেশি তৈরি হয়েছে। এখানে অবশ্য সাধারণ এবং অন্য স্তরের মানুষের ভেতরে একটা শ্রেণীবিভাগ করাই যায়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যে অর্থে একজন বিশেষ জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষ ছিলেন, সেই অর্থ ফলিত সত্যের আরো অনেক দূরবর্তী আলোর কথা ভাবতে পেরেছিলো। 


কিন্তু অন্য স্তরের মানুষরাও বিজ্ঞানের এই ব্যবহারিক জ্ঞানের উপযোগীতার বাইরে থাকা মানুষ নন। সাধারণ মানুষের প্রত্যেকদিনের দুঃখের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে অর্থের উপযোগীতার কথা মনে হয়। অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী মানুষের চাহিদা প্রাথমিক শর্ত মিটিয়েও খানিকটা লোকাচারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। হয়তো সেই অর্থে ততোটা লোকাচারও নয়। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার এই বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্যের বাইরে খুব কম মানুষ বাস করেন বলেই আমার ধারণা। ফলে উদ্দীপনার তারতম্যজনিত কারণে মানুষের মনে সুখ এবং দুঃখের জন্ম এবং লালনপ্রক্রিয়ার কাজে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে যেতে পারে।


 


একজন মানুষ অনেক কারণে দুঃখী হতে পারেন। সাধারণ স্তরের মানুষরা তাঁদের আর্থ-সামাজিক কারণেই সুখী কিম্বা দুঃখী হন। বিশেষ কোনো সিদ্ধান্তের সংশয়ের কারণেও তাঁদের মনে সুখ কিম্বা দুঃখের জন্ম হতে পারে। এবং কম-বেশি সমস্ত মানুষই এই সংশয়ের ভেতরে অবস্থান করেন। একটি পুজোর উৎসবে চাহিদা মতো পোশাক কিনতে না পারার জন্য মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হওয়াও কোনো আশ্চর্য ঘটনা নয়।ছোটোবেলায়, নিজেদের মনেও এমন দুঃখ কিম্বা সুখের বোধকে অনুভব করতে পারা যায়। রবীন্দ্রনাথ ‘কাঙালিনী’ কবিতায় ধনী এবং দরিদ্রের ভেতরে যে পার্থক্যটি শব্দের মধ্য দিয়ে এঁকেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো যথেষ্ট পরিমানে থেকে গেছে। এখান থেকে মানুষের মনে সুখ কিম্বা দুঃখের একটা চিরজাগরুক ছবিও মনের ভেতরে থেকে যেতে পারে। ছোটোবেলায় ঘটে থাকা বিশেষ কোনো আদর কিম্বা অনাদরের ঘটনাও একজন মানুষের মনস্তত্ত্বের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে। যদিও সবটাই নির্ভর করে, মানুষটি তাঁর পরবর্তী জীবনে সেই বিষয় নিয়ে কি ভাবছেন, তার ওপরে। স্বাধীন-ব্যক্তিসত্তার যুগে, মনস্তত্ত্বের একটা বিরাট অবদানের কথা বহুলভাবেই স্বীকৃত হয়ে উঠেছে। এককভাবে একজন মানুষের জীবনের বৈশিষ্ট্য যে এক এবং একক নয়, অর্থাৎ সমভাববিশিষ্ট মানুষও যে পৃথিবীতে বাস করেন, তা অনেকেই জানেন। মানুষে মানুষে মিলমিশের সেটাও একটা কারণ হিসেবেই ধরা হয়। আবার অমিল কিম্বা সংঘাতের কারণ হিসেবেই সেটাই প্রধান আলোচ্য হয়ে ওঠে। কথা শোনা এবং না শোনার পক্ষে এবং বিপরীতে মানুষ তার অবস্থান সম্পর্কে ঠিক কতোটা সচেতন, মনোস্তত্ত্ব তার ওপরেও খানিকটা নির্ভর করে।


 


অন্তর্মনোজগতে যেকোনো চিন্তাই একটা গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। ফুলের বাগান দেখে কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিমোহিত হয়ে পড়ার ঘটনাকে মনোস্তত্ত্বের অংশ বলেই হয়তো এখন ধরে নেওয়া হবে। ফ্রয়েডও এই ধরণের একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেই সম্পর্কে এটাও স্বীকার করে নিতে হবে যে, মনোস্তত্ত্ব একটি স্নায়বিক কর্মপদ্ধতিরই অংশবিশেষ। আমাদের ভাব, ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা প্রভৃতি মানবিক এবং অমানবিক কাজকর্মের সাথে স্নায়ু ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত। ঠিক এখান থেকেই জীবনে বেঁচে থাকার শুদ্ধতার বোধ কিভাবে পাল্টে যায়, সেটাও একটা আলোচনার বিষয়। যে স্নায়ু প্রাণের অন্যতম ধারক, সেই স্নায়ুই তো রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। কিম্বা বলা যায় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যশালা থেকে অন্য ফলাফলও তৈরি হচ্ছে। একক মানুষের জীবনে মনোস্তত্ত্ব এই এতোগুলো কাজে অংশগ্রহণ করে না হয়তো, কিন্তু তাঁর সুখ এবং দুঃখের বোধের ওপরে একটা প্রভাব রেখে যায়। কিম্বা করে ওঠে, সেকথাও বলা যায়। কারণ, একক মানুষটির গুরুত্বের পরিমাপ সামাজিক হলেও, তার একটি ব্যক্তিগত সাপেক্ষও থেকে যায়। সামাজিকভাবে অনেক বেশি সচেতন মানুষের ভেতরে এর সূক্ষ্মতা কখনো কখনো ব্যাধিরও সৃষ্টি করতে পারে। ব্যাধি বলতে সামান্য কিম্বা অনেকখানি অপ্রকৃতিস্হ অবস্থাকেই ধরে নেওয়া হয়। শারীরিক অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা একটা স্পষ্ট রুপ থাকে। কিন্তু মানসিক অবস্থাটির রুপ সবসময় আকার পেয়ে ওঠে না। এখানে অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা কি বিশেষ কোনো মনোনিবেশের ফল হিসেবেও আসতে পারে? ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর রামকৃষ্ণ দেবের ভেতরে একটা মিল কি তবে খুব প্রকট? মোহিত এবং বিমোহিত হয়ে যাওয়ার মিল? রামকৃষ্ণদেব তাঁর কথামৃতের আলোচনাগল্পগুলোর ভেতরে একাধিক পৌরাণিক অবতারের কথা বলেছিলেন। এর থেকে খানিকটা বোঝা যায়, তাঁর ভেতরে একজন কল্পলোকের বাসিন্দাও বসবাস করতেন। মোহিত হয়ে পড়ার দৃশ্যকে অনেকেই উন্মাদের আচরণ বলে মনে করেছেন। খানিকটা অসংযত রুপের পরিচয় পাওয়াও গেছে। বিশেষ করে পঞ্চবটী বনের ভেতরে ঈশ্বর-আরাধনার বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপকে তাঁর নিকট আত্মিয়েরা অনেকেই উন্মাদের আচরণ বলে মনে করেছিলেন। আমাদের ভারতীয় ধর্মের ভেতরে সমাধিস্থ হওয়ার অভ্যেসকে যতোটা স্নায়বিক প্রক্রিয়া বলা যায়, ততোটাই তা মনোস্তত্ত্ব হয়ে ওঠে কি না, জানা নেই। শূন্য অবস্থান কি মনোস্তত্ত্বের কোনো প্রক্রিয়ার ভেতরে পড়ে না? বলা খুব মুশকিল। তাহলে মানুষের ভেতরে নিশ্চেতন হয়ে পড়ার ভাবটিকেই বা কি বলে ব্যাখ্যা করবো? এক নয় অলসতা, এক নয় গভীর মনোযোগ, এক নয় স্বার্থপরতা, আর নাহলে কঠিন কোনো অসুখ বলেই ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই সব কটি ক্রিয়ার সঙ্গে মনোজগতের একটা বিরাট সম্পর্ক কি নেই? এমনকি, যাকে আমরা অবচেতন বলি, অনেক সময় ঘুমের ভেতরে স্বপ্নের মতো যা আমাদের আলোকিত কিম্বা অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে তার ভেতরেও এই ধরণের নিশ্চেতনার ভাবটিকে কি মনোজগতেরই একটা অংশ বলে ধরে নেওয়া যাবে না? বারট্রাণ্ড রাসেলের দর্শন এবং চিকিৎসক এবং মনোস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েডের মনোবিশ্লেষণের সমীক্ষার ভেতরেও এই চেতনা এবং অচেতনার অবস্থা একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলো। এবং এক ধরণের অতিমনোনিবেশ যে ঈর্ষার জন্ম দেয়, সেকথা রাসেল উদাহরণ দিয়েও আলোচনা করেছিলেন। ফ্রয়েডের ক্ষেত্রে সেটা রোগজনিত নিশ্চেতনার কারণ হিসেবে আলোচ্য হয়েছে। কিন্তু ফ্রয়েড সাহেব নিজেও কি এই অতিমনোনিবেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হননি? মানে অন্যের অতিমনোনিবেশের কারণে? তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ও পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। এও তো মানুষের অন্তর্মনোজগতের বিরাট একটি কার্যপ্রক্রিয়া। আপাতভাবে তা খুব সরল এবং শিশুসুলভ। কিন্তু সমুচিত বয়স পেরিয়ে যাওয়ার কারণে, তাই-ই বিশেষ সমস্যার হয়ে ওঠে। একভাবে দেখতে গেলে এই অতিমনোনিবেশনও এক ধরণের রোগ। কখনো কখনো তার ভেতরে একটা প্রকট অভিপ্রায় তৈরি হয়ে থাকে। সেটা মানুষ হিসেবে মনের গঠনের দিক থেকে একজন ব্যক্তির মানসিকতা এবং ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। জীবনের প্রতি মারাত্মক লিপ্সা কিম্বা বিশেষ কোনো অবদমন অথবা তার প্রক্রিয়াও বিরাটভাবে একটা জাতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিশ্বযুদ্ধ কিম্বা পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া ইতিহাস এবং খানিকটা কাল্পনিক কাহিনীতেও এমন বিভিন্ন চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায়, যাঁরা অনেকেই মানুষ হিসেবে খুব স্বাভাবিক ছিলেন না। ট্রয় যুদ্ধের নায়ক এগামেমননের মেয়ে ইলেকট্রার ভেতরে এক ধরণের বিশেষ জটিলতা পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছিলেন, যা খানিকটা তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। ইলিয়াডে এগামেমনন এবং একিলিসের কথোপকথন থেকেও এগামেমননের মানসিকতার একটা পরিচয় আমরা পাই। অথচ দুজনেই বীর যোদ্ধা ছিলেন। গ্রীক বীর ঈদিপাস কিম্বা সুন্দরী নার্সিসাসের ভেতরেও প্রতিশোধমুখ এবং অবদমিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং এক ধরণের জীবনবিমুখতার ভাবনাচিন্তা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। মনোজগতে এর অনেক রকম প্রভাব থাকলেও, মনোস্তত্ত্ব এর একটি ব্যাখ্যা দিতে পারে। সাধারণভাবে শারীরিক পীড়ায় আচ্ছন্ন না হলে, এর কোনোটিকেই রোগ বলে ধরা হয় না। অর্থাৎ, এক ধরণের ক্লান্তি ঘনিয়ে না উঠলে, তাকে রোগ বলা এবং তার চিকিৎসা করা সম্ভবপর নয়।


 


পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্য এবং মহাকাব্যের অংশ বিশেষেও মানুষের অন্তর্জগতের একটা রুপ পাঠক নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন। অবদমন এবং তার প্রক্রিয়া এই অন্তর্মনোজগতে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে বলেই ধারণা করা হয়। অনেক সময় একটা বিশেষ তত্ত্বকেও প্রায় না বুঝেও মানুষকে তার প্রভাবে প্রভাবিত করার খারাপ অভিপ্রায় থেকেও একটা প্রজাতির ক্ষতিসাধনের কাজ সঙ্ঘটিত হতে পারে। তবে, সবাই ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করেন, তা বোধহয় নয়। ব্যক্তিজীবনের ঠাট্টা, কিম্বা উপহাসের বোধ এক একজন মানুষের কাছে এক এক রকম মানে হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যায়, যে মানুষ ভীত কিম্বা অতিভীত, সেই মানুষের মনোজগতের ওপর বেশ কঠিন চাপ পড়ে। এই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা, যার ভেতরে থাকা এবং না থাকার মানে একই, অর্থাৎ, অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া, তা শিশু এবং কিশোরদের পরবর্তী জীবনে কঠিন এবং গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেরই মনে হয়েছে। যদিও তাও ব্যক্তি বিশেষের শারীরিক এবং মানসিক গঠনের ওপর নির্ভর করে। ছোটোবেলায় স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখেছি, এক এবং একাধিক ছাত্র দু-এক ঘণ্টা ছাত্রসারিতে দাঁড়িয়ে থেকে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলো ছাত্ররা যাতে বসে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হতো। শারীরিক শক্তি বা ক্ষমতা যে মানুষের মানসিক অবস্থার গঠনে খানিকটা প্রভাব ফেলে, একথা স্বীকার না করে উপায় নেই।


একজন প্রতিবন্ধী মানুষের মনের জগৎ আর সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের মনের জগতে একটা তফাৎ নিশ্চই তৈরি হয়। বিশ্ববন্দিতা হেলেন কেলার খুব কঠিন পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে এই বাধা দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ধরণের সমস্যায় মানুষ যে রোজই যুদ্ধের পৃথিবীতে জন্ম নিচ্ছে, তা আরো ঘনিষ্ঠভাবে বোঝা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে হেলেন কেলার নিজে জাপানের মানুষের কাছে গিয়ে সৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতো বড়ো জাগতিক ভালবাসার এবং বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের নায়িকা নিজে কিন্তু কঠিন কষ্টের মধ্যে থেকে অন্যতম মানুষ হয়েছিলেন, যা আমাদের সবার শিক্ষণীয়। এবং সেই কষ্টের বেশিরভাগটাই তাঁর শরীরজনিত। পাকস্থলী এবং মস্তিষ্কের রোগে হেলেন তাঁর নতুন জীবন পেলেন, একথা তাঁর আত্মজীবনীতে পড়ে, আপাতভাবে একটি কাব্য পড়ছি বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু সেই সঙ্কট একজন মানুষের জীবনহানির একটা প্রচ্ছন্ন রুপ ছিলো, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না। হেলেন লিখেছিলেন, “Gradually I got used to the silence and darkness that surrounded me and forget that it has ever been different…” . দেহের এই কঠিন পীড়ার ভেতরে যে দমচাপা আর্তনাদ থাকে, তা একটা যুক্তক্ষয়ের স্মারক ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? অন্য মানুষের ক্ষেত্রে মনের অবদমনই হয়তো শারীরিক পীড়ার কারণ হয়ে উঠতে পারে। কিম্বা সাংঘাতিক রুপের আকার নিতে পারে, যা একধরণের রুপক্ষয় বলেই ধারণা করা যায়। কিন্তু হেলেন কেলার এই সমস্ত প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে একজন বিজয়িনী। হেলেন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর জীবনে শিক্ষক আসার আগেই জীবনের বেঁচে থাকার এই আলাদা সত্তা সম্পর্কে তিনি খানিকটা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু সেই অনুভূতির কোনো ভাষা তৈরি করা হেলেনের পক্ষে তখনো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ যেন গাছের ভাষা, কিম্বা পৃথিবীর যেকোনো প্রাণের অবদমনের ভাষা। যে ভাষা তৈরি হতে হতে হেলেনের চরিত্রে সামগ্রিক যে রুপ সৃষ্টি হয়ে চলছিলো, তা সম্পূর্ণ অন্য একটি ভাষার জঠর কিম্বা আশ্রয়স্থল। তাতে রাগ আছে, অভিমান আছে, দুষ্টুমি এবং আফশোস মিশ্রিত অনুভূতি আছে। হেলেনকে দেখভাল করা নার্সের সঙ্গে তার সময় কাটানোর অভিজ্ঞতার কাহিনী পড়তে পড়তে এই ধারণাটিই বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। রাসেলের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের ইচ্ছে অসীম নয়। কিন্তু ইচ্ছের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ধারণাটিকে আমরা অসীম বলতে পারি। ভালোত্বের একটা ব্যক্তিগত মালিকানা বোধ কিম্বা সত্তা থাকে এবং রাসেলের লেখার বিশ্লেষণে পাই, যে সেটি সর্বজনীন হওয়াই উচিৎ। কিন্তু ফলিত জীবনে তা যে হয়ে ওঠে না, তাই বোধহয় দুঃখের আর একটি অন্যতম কারণ। কারণটি খুব জৈবিক, আগেই বলা হয়েছে। এর ভেতরে অর্থনীতির বণ্টন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কিন্তু তা যে অনেকক্ষেত্রেই সাধারণের সীমার মধ্যে আসে না, তা সত্যি। জৈবিকভাবে তা যে মনের জগতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে তা আগেই বলা হয়েছে। এখানে ‘জৈবিক’ শব্দটি অনেক ব্যাপ্ত। কারণ খাদ্যের সঙ্গে তার ওতোপ্রতো সংযোগ রয়েছে। মানুষ খানিকটা ইচ্ছের অধীন হলেও, ইচ্ছে শব্দটিকে যদি আমি অবস্থা কিম্বা অনুভূতি বলেই ধরে নিই, তবে তারও তো একটা ঘর আছে, তাকেই কোথাও পুষ্ট হতে হয়। এখানে সাধ্যের ঘর খুব ছোটো হওয়ার জন্য ইচ্ছের আকার কম হয়, এমন কথাও কি খুব অনিশ্চিত? স্বাভাবিকভাবেই বারট্রাণ্ড রাসেলের আলোচনায় শিক্ষা অংশগ্রহণ করেছে। কারণ, আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষা একই সঙ্গে কাজ, রোজগার এবং অনুভূতি এই তিনটি প্রক্রিয়ারই সহায়ক। এবং সেক্ষেত্রে ইচ্ছে একটা বিরাট ভূমিকা পালন করলেও অর্থনীতির বাধাকে অতিক্রম করা বিশেষ শ্রম এবং সময়সাধ্য হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ একটা সময় বিলেতে গিয়েছিলেন (নোবেল পাওয়ার পর) এবং বিশ্বভারতীর জন্য কিছু অর্থসংগ্রহের তাগিদে আমেরিকার কথাও ভেবেছিলেন। শেষপর্যন্ত তাঁর ভেতরের আবেগ যথেষ্ট ভরসা পায়নি। অর্থাৎ, আমি বলতে চাইছি, শিক্ষার প্রসারও অনেক ক্ষেত্রে কিম্বা কিছু ক্ষেত্রে বা সাময়িক অথবা পাকাপাকিভাবে নিরুপায় হয়ে পড়ে। রাসেল শিক্ষা নিয়ে আলোচনায় জানিয়েছেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার্থীর কোনো দেশ নেই। উন্নত মানুষের মনের গঠনে তা একটা গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রাসেল শিক্ষাব্যবস্থায় চার্চের প্রভাব খানিকটা খর্ব করার কথা বলেছিলেন। এখানে অবধারিতভাবে সক্রেতিসের কথা উল্লেখ করতে হয়। যদিও সক্রেতিস এবং তাঁর অনুগামীদের আলোচনা কতোটা কাজের মুখোমুখি দাঁড়াতে সক্ষম ছিলো, এই নিয়ে সেই সময়ে বোধহয় অনেকেই দ্বিধায় ছিলেন। তাঁরা নিজেরাও সেই দ্বিধা সমসাময়িককালে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। সক্রেতিস এবং অ্যালসিবায়োডিসের কথোপকথনে ‘লজিক’ বলে যে বিষয়টিকে ধারণা করা হয়, তা আসলে দ্বিধারই এক সমন্বিত রুপ। যেহেতু সক্রেতিসের আলোচনায় দ্বিধা একটা অন্যতম বিষয় ছিলো। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে কিম্বা তার পরবর্তী ফল হিসেবে যে শব্দটি তৈরি হতে পারে, তার নাম দ্বন্দ্ব। সেটা কোথাও শ্রমের স্বপক্ষেই বোধহয় কথা বলে যাচ্ছিলো, যা সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মারাত্মক হয়ে উঠেছিলো। তবে, মানুষের ইচ্ছে যে কাজ করার আগের একটা প্রক্রিয়া, এটা রাসেলের আলোচনার বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়। রাসেল এই ইচ্ছেকে স্বার্থপরতার বিপরীতে থাকা একটা উপাদান বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু আধুনিককাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর মনে হয়, স্বার্থপরতাও এক ধরণের ইচ্ছেরই দাসত্ব করে। আরো সূক্ষ্ম এবং গভীরভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, মানুষের মন এবং মস্তিষ্কের এক বিশেষ ধরণের অলসতার নাম স্বার্থপরতা। যা শেষ পর্যন্ত ইচ্ছে হয়েই ওঠে। সাধারণভাবে উন্নত মানুষের জীবনেই এই উপাদানটি অত্যন্ত প্রকট। উন্নত মানুষের পৃথিবীতে স্বার্থপরতা একটি বিচিত্র আকার নিতে পারে।


যুদ্ধের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক একটা শরীরের রক্তচলাচলের মতো। পরিপূরক। অথবা বলা যায়, সমার্থক হয়ে ওঠার কাছাকাছি। যুদ্ধ মানুষের জীবনে একটা অবশম্ভাবী নৈকট্য। মানুষ এবং গণ্য প্রাণীরা প্রায় সবাই বেড়ে ওঠার সময় প্রায় কাছ থেকেই তাদের মা, বাবার শ্রমের জীবনের পরিচয় পেয়ে বড়ো হয়ে ওঠে। তাদের জীবনে স্বার্থপরতা এবং পরার্থপরতার শিক্ষাও খানিকটা শৈশবমুখী। একে অপ্রাসঙ্গিক বলা যায়, কি যায় না, তাও নির্ভর করে ওই ধরণের আচরণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ কিম্বা প্রাণীটির আচরণের ওপর। সেই যুদ্ধ যখন বিরাটভাবে ঘনীভূত হতে শুরু করে, তখন বোঝা যায় যে, খুব সূক্ষ্ম এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের নির্মাণকাজটি আগেই হয়ে গেছে। যুদ্ধ তারই অবধারিত ভবিষ্যৎ। ফলে এই সামগ্রিকতার ওপরে জাতিগতভাবেও একজন মানুষ আচরণ করতে পারেন।


 


মনোস্তত্ত্ব শব্দটি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে, ‘পাগল’ কিম্বা ‘উন্মাদ’ শব্দটিকেও একটু নজরে রাখতে হয়। পাগলামি, কিম্বা অতিরিক্ত উন্মাদনাকেও একটি বিশেষ অবস্থাই বলা হয়। কোনো মানুষের অতিরিক্ত জাতিবিদ্বেষও মারাত্মক পাগলামো হয়ে উঠতে পারে। রাসেলের শিক্ষা নিয়ে আলোচনার ভেতরে সবচেয়ে বড়ো যে দ্বন্দ্ব খুঁজে পাই, তার নেপথ্যে সৎ এবং অসৎ হওয়ার ধারণা যে কাজ করে যাচ্ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সক্রেতিস কিম্বা যিশুর সঙ্গে সমসাময়িক প্রতিষ্ঠানের সংঘাত একটা ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছিলো। মিলনোৎসবও বলা যেতে পারে। অর্থাৎ একটি কাজের দ্বিমুখী প্রতিফলন, কিম্বা প্রভাবের কথা লিখতে চাইছি। কিন্তু এঁরা দুজনেই বেশ খানিকটা সংগঠকও ছিলেন। ফলে নিজেদের গোষ্ঠির ভেতরে তাঁরা সবসময় খুব নরম হয়ে থেকেছেন, এমন বোধহয় হয়নি। সক্রেতিস খানিকটা বন্ধুভাবাপন্ন হলেও, প্লেটো অনেকটাই কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। সুতরাং, প্রাতিষ্ঠানিকতার ভিত যতো শক্ত, তার ভেতরের ঘুণপোকারাও ততোটাই প্রবল, অন্যভাবে এ কথাটা বলাই যায়। প্লেটোর স্বপ্নের গণতন্ত্রে কবিদের প্রবেশ চিরস্থায়ি হওয়া উচিৎ নয়, এমন একটা ধারণাও তাঁর হয়েছিলো। কিন্তু অ্যারিষ্টটল তা মনে করেননি। তিনি অস্তিত্বের দিক থেকেও কবিসত্তা এবং অন্য মানুষের সত্তা যে আলাদা, সেটি বুঝতে এবং বোঝাতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, একটা ভারসাম্যের বোধ, যা গণতন্ত্রের মূল কথা হওয়া উচিৎ, তার কথা বলেছিলেন। প্লেটো নিজেও কবিতা লিখতেন। তবে কবিতায় উচ্চ আদর্শ থাকাই রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক, এই কথা জানিয়ে তিনি সক্রেতিসের বিপরীত মতই পোষণ করে বসলেন। কবিতার যে একটা শিল্পগত দিকও থাকে, ভাব এবং কাজের ভেতরে একটা ফারাক যে থাকে, তাকে বেশ খানিকটা অস্বীকার করেছিলেন প্লেটো। প্লেটো কবি এবং কবিতাকে নতুন কোনো সম্ভাবনা বলে মনে করেননি। কিন্তু প্লেটোর চিন্তাও কি খুব নতুন ছিলো? কারণ, এ বিষয়ে আগেই সক্রেতিস ভাবনা-চিন্তা করে গেছেন। মানুষের মনোস্তত্ত্বের ভেতরেই অনুকরণ করার অভ্যেস নিহিত থাকে। তাহলে কবিই কেন দোষের ভাগী হবেন? প্লেটোর মারাত্মক সম্পৃক্ততাই হয়তো এই ধরণের বিদ্বেষের একটা কারণ বলে মনে হতে পারে। এটা অবশ্য জাতিগত আলোচনা বলে মনে হতে পারে। উদার মানুষের কাছে গোটা পৃথিবীই আত্মিয়। একথা তো আমাদের দেশের শাস্ত্রেই লেখা আছে। শব্দ সত্য কিন্তু তার মহিমা সবসময় প্রকট হয়ে ওঠে না। এর সঙ্গে কাছের কিম্বা দূরের সম্পৃক্ততা কতোটা সরল কিম্বা জটিল, তার ওপরে নির্ভর করেও একজন মানুষের মনের গঠন রুপ পেয়ে বড়ো হচ্ছে। সক্রেতিস এবং সমকালীন প্রতিষ্ঠানের দ্বন্দ্বের সঙ্গে ঈজিপ্টের একটি ছোটো প্রচলিত গল্পের সামান্য মিল পাই। রাজা অ্যাপোফিস আর সেকনেনারের সংঘাতের সঙ্গে সক্রেতিসের মিল এবং তফাতও অনেকখানি। এখানেও ঈশ্বরবাদ প্রকট এবং বিরাট। অন্যদিকে সক্রেতিস দরিদ্র। এবং তাঁকে খুব পরিহাস করেও সমকালে দ্যাখা হয়নি। সমকালীন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে কোনো ভালো দিক খুঁজতে চাইলে, এই বিষয়টিকেই একমাত্র বলে ধরতে হবে। সেখানেও ধারণাটি অসীম। মানে অস্তিত্বহীন। ইনফিনিটি। তার মানে মানুষের মনের নিরন্তর দ্বন্দ্বেরও দুটো দিক আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। ধন এবং দারিদ্র্য, যার ভেতরের কথা হলো পারগতা এবং অপারগতা। এইভাবে দেখলে আমাদের আবার সেই ধর্মের কাছেই ফিরে যেতে হয়। তখন সক্রেতিস আমাদের কাছে কতো মহান হয়ে ওঠেন। কারণ সক্রেতিস দ্বন্দ্বমূলক আকাঙখার ভেতর দিয়ে ইনফিনিটির তত্ত্বকে চিনিয়ে গেলেন। মুসোলিনি তাঁর ‘ডকট্রিণ অফ ফ্যাসিজিম’-এ লিখেছিলেন, Fascism wants man to be active and to engage inaction with all his energies; it wants him to be manfully aware of the difficulties besetting him and ready to face them. শ্রমের প্রাথমিক কথাই তিনি লিখেছিলেন। প্রায় সংবিধানের মতো করে একটা চিন্তার ভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন মুসোলিনি। জন্মগতভাবে একজন কাঠমিস্ত্রিরির সন্তান ছিলেন। ফলে ছোটোবয়স থেকেই তিনি শ্রমকে খুব কাছ থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু ‘অ্যাবসলিউট’ হওয়ার জন্য যে ধর্মীয় বোধ থাকার দরকার ছিলো, মুসোলিনি তা রপ্ত করে উঠতে পারেননি। হিটলারের সঙ্গে সম্পর্কে যথেষ্ট টানাপোড়েনও ছিলো। ‘higher personality becomes a nation’ এই ধারণাটি আর গোপন রইলো না। ফলে মুসোলিনিকে চেনা পর্যবেক্ষকদের কাছে খুব সহজ হয়ে উঠলো। কিন্তু শুধুমাত্র মুসোলিনি অথবা হিটলার নন, বিশ্বের যে কোনো প্রতিষ্ঠানই যখন সর্বাধিনায়ক হয়ে উঠতে গেছে, বিপদ এসেছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা খুব সহজে চিহ্নিত করা গেছে। প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার মেয়াদ বাড়িয়েছে। কিন্তু মনের জগতে যখন বিচার করতে বসার ইচ্ছে কিম্বা অবকাশ তৈরি হয়, তখন বুঝতে পারি যে, অধিকার করার প্রবণতা খুব সাধারণ একটা প্রক্রিয়া এবং অভ্যেস। অথচ সেই প্রবণতা থেকেই পৃথিবীতে আজীবৎকাল জুড়ে যুদ্ধ হয়ে চলেছে।


 


আধুনিক পৃথিবী শেষ হয়ে যাওয়ার পর, মানুষের মন অধিকার করে নিয়েছে এক বিশ্রী ধরণের শীতলতা। ব্যক্তিজীবনে একজন মানুষ নিজেই নিজের কাছে গুপ্তচর হয়ে ওঠেন। বার্তোলুসির ছবিতেও এই ভয়ঙ্কর শীতলতার গন্ধ পাই। একে একটু অন্য রকম ভাষায় নাগচক্র বলা যেতে পারে। বুদ্ধ নিজেও হীন ধর্মকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব দিতে চাননি। একমাত্র ব্যক্তির দর্শন ছাড়া, সামগ্রিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তারও আপত্তি ছিলো। এটি সম্ভবত তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন। অর্থাৎ এই দর্শনও পরম্পরার দাবী রাখে। রামকৃষ্ণ দেবও একই কথা স্বামীজিকে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাষ্টার’ গল্পের পোস্টমাষ্টার আর রতনমণির সম্পর্ক যে সামগ্রিক হয়ে উঠতে পারে না, এবং তার ভেতরে যে আবহমানকালের ব্যথা লুকিয়ে আছে, তা বুঝে ওঠার কাজটি শুরু হয়। অথচ জ্ঞানের ক্ষেত্রে এই চক্রই কতো সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আমাদের কালে বাংলা ভাষার অন্তত: দু-জন জীবিত কবির আধুনিকতম লেখার ভেতরে এই মনস্ত্বত্বের গ্রাসটি খুঁজে পাই। একে সামগ্রিক লেখকসত্তা ভেবে ভুল করলে সাহিত্যের পাঠক হওয়া অসম্ভব। 


 


একজন একক মানুষের বেড়ে ওঠার ভেতর দিয়ে রাজকীয় পৃথিবীকে সে অনুভব করতে পারছে, এর ভেতরে ক্লান্তিও আছে। আবার টানও আছে। সাপের জৈবিক ক্রিয়া আছে। ফ্রয়েড ‘প্যারানোইয়া’ বলতে যা বুঝিয়েছেন, ভারত এবং এশিয়ার ধর্মগুরুরাও প্রায় একই কথা বলেছিলেন। চ্যাপলিনের 'The great dictator' ছবিতে দুই রাষ্ট্রনায়ককে বাতুল বলেই দ্যাখানো হয়েছিলো। মানে একটা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছিলো। কিন্তু ফ্রয়েডের তত্ত্বটি ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে অনেকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। একই কারণ, অস্বাভাবিকতা। এবং সেই অস্বাভাবিকতার সঙ্গে থাকতে থাকতে মৃত্যুজনিত কোনো ভয় অন্য মানুষকেও গ্রাস করতে পারে, মানে তার পাশের মানুষকে। সেটা বোঝা অনেক সহজ হয়ে ওঠে। যেহেতু ঘর অনেক বেশি 'ক্লোজ'। সংকীর্ণও বলা যায়। আবার ঘর সোপানও। আবার একই সঙ্গে একটু একটু করে তা সহ্যের আয়ত্তের ভেতরেও চলে আসে। জাতিগত ক্ষেত্রে সেটাই একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে সন্দেহের বাতাবরণ থাকা এবং তৈরি হওয়ার কারণও থেকে যেতে পারে। আন্দামানের তিরন্দাজ- আদিবাসীরা ইতিহাসের বিচারে কি সত্যি সত্যিই তিরন্দাজ? কিন্তু স্থানিক বিচারে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছে এই সেন্টিনেলিজরাই তাঁদের খর্বকায় চেহারা নিয়েও অতিকায় হয়ে ওঠেন। একটা বিরাট সংঘাতের মুখে পড়ে জাতি কিম্বা সভ্যতা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, এমন ঘটনা ইতিহাসে খুব বিরল নয়। কিন্তু ব্যক্তিজীবনই বলি, আর সামগ্রিক জীবনই বলি, অপ্রকৃতিস্থতার একমাত্র কারণ অবদমন। তার সঙ্গে স্মৃতিজনিত সংঘাত একটা বড়ো উপাদান হয়ে উঠতে পারে। রোগ কিম্বা দুর্ঘটনা এক ধরণের অবদমনের প্রক্রিয়াই। দুর্ভিক্ষ, কিম্বা মহামারীজনিত কারণে খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের অভাব এক ধরণের অবদমন। মনের ভেতর ঘটে বলে অবদমন শব্দটি মনের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে অবদমনের পারস্পরিক এবং বিপরীতমুখী কার্যকলাপও লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। আবার ব্যক্তিজীবনে এর বিপরীত ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। নাহলে, মানুষ কি করে মহৎ শিক্ষা পেলেন? পরিবেশ থেকে কিছুটা শিখলেন, কিছুটা শিক্ষা এবং বাকিটা নিজের মানসিকতা তাঁকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। তাতে তিনি যে খুব সফল হলেন, এমন নয়। কিন্তু সফল শব্দটিও তো আপেক্ষিক।  



 


গল্পচ্ছলে লিখছি। সত্য ঘটনা। এক ভদ্রমহিলা রোগজনিত কারণে মস্তিষ্কের রোগে আচ্ছন্ন ছিলেন। তাঁর বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপের ভেতরেও মন এবং শরীরের পাল্টে যাওয়া ক্রিয়াগুলোর ছাপ খুব স্পষ্ট ছিলো। বেশ কিছু সময় তিনি সুস্থ মানুষের মতো স্বাভাবিক থাকেন। কিছু সময় তিনি মারাত্মকভাবে পাল্টে যান। একদিক থেকে দেখলে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সেটা খুব মারাত্মক আকার নিতো। মানে স্বাভাবিকতার অনেক ওপরে সেই সূচকের মান ছিলো। তাঁকে যিনি দেখভাল করতেন, তিনি দু-একবার কঠিনভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক জোরও তুলনামূলকভাবে কম ছিলো। অথচ মধ্যবিত্ত সংসারে খুব কাছের মানুষকে দেখভাল করার জন্য সমসময় ভাড়া করা কিম্বা মাইনে দিয়ে রাখা লোকজন নিয়োগ করা খুব শক্ত হয়ে ওঠে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায়। তিনি মনের দিক থেকেও অত্যন্ত নম্র ছিলেন। রোগী স্বয়ং তাঁর মা। মেনিঞ্জাইটিস বা ওই ধরণের কোনো রোগ থেকে বিকারের জন্ম হয়েছিলো। তার ওপরে স্বাস্থ্য বেশ উন্নত মানের ছিলো। সংসারে অনেক সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি শারীরিকভাবে বেশ শক্ত মানুষ ছিলেন। মেয়েটি একদিন সাঙ্ঘাতিকভাবে আহত হয়েছিলেন। মাথা ফেটে রক্তারক্তি অবস্থা। তাছাড়া মনের দিক থেকেও তিনি বেশ নম্র, সেকথা আগেই লিখেছি। উত্তর কোলকাতায় বসবাস করতেন। ইঞ্জেকশন দেখলে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, এতোটাই তাঁর স্নায়বিক দুর্বলতা ছিলো। তাঁর ওপরে এই রোগীণীটিকে দ্যাখার ভার দেওয়া হয়েছিলো। যদিও তিনি একজন সুস্থ এবং সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন বলেই হয়তো তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু একদিন এই ধরণের একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে গেলো। তারপর মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। রোগীণী ভদ্রমহিলারও বয়স একটু একটু করে বাড়ছে। কিন্তু ওই ধরণের ঘটনার কথা আর শোনা যায়নি। নতুন যাঁরা দেখভাল করতেন, তাঁরা মাঝে মাঝেই প্রখর হয়ে উঠতেন। আর তিনিও কখনো হেসে, কখনো মৃদু দুঃখ পেয়ে বসে থাকতেন। কাগজ পড়তেন। আতিথেয়তারও চেষ্টা করতেন। মাঝে মাঝে একা একা বসে বসে কথা বলতেন, যাকে আমরা ভুল বকা বলি। নিজের ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা। রোগিণী আমার দিদা। আর আমার মা ছিলেন সেই মেয়েটি। মায়ের মুখে যেভাবে কাহিনী শুনেছি, তাতে মনে হয়নি, কাহিনীটি খুব ভয়ংকর গোছের কিছু ছিলো। যদিও আমার মা খুব যন্ত্রণা পেয়েছিলেন। আমার ঠিক এই কারণেই দিদার ওপর বাড়তি সহানুভূতি ছিলো, এটা খুব সাধারণ একটা কথা। সবারই হবে। কিন্তু নিত্যকালীন যাঁরা, তারা তো দু-একদিনের মেহমান নন। ফলে মৃদু কথা কাটাকাটি চলতো। মানুষটি অন্ততঃ একজনকে মেনে চলতেন। নাহলে খুব সংঘাতের একটি সময়ের ভেতরে কোলকাতার বাড়িতে(মামার বাড়ি) তাঁর থেকে যাওয়ায় আরো বাড়তি সমস্যা ছিলো। অবশ্য মেনে চলার মতো মানুষটি সংঘাতের অনেক পরে বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু অমন আচমকা আঘাত পাওয়ার পর অনেক সময়তেই, বহিরঙ্গে, মানুষটির ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে, কিম্বা আসতে পারে। মা শারীরিকভাবে আরো অনেকবার পীড়াচ্ছন্ন হয়েছেন। আমাদের যৌথ পরিবারের নিত্য সমস্যার ভেতর দিয়ে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এতো শুদ্ধ প্রাণ তিনি কি করে ধরে রাখতেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। প্ল্যাটফর্মের ওপর কয়েকজন ছিন্তাইকারিণী তাঁকে ঘিরে তাঁর হাত থেকে গয়না কেড়ে নিতে চাইছে, আর তাঁর কোলে তখন একটা ছোটো বাচ্চা...সেই দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়েও তাঁর ভেতরে কোনো প্রতিশোধের চিহ্ন দেখিনি। মনোস্তত্ত্বের কঠিন কঠিন পাঠ তাঁর আয়ত্তে ছিলো না। কিন্তু এতো ধৈর্য তিনি পেলেন কোত্থেকে? ওই সামান্য একটু ভেঙে পড়া, তারপর আবার রোজকার জীবনকে আঁকড়ে ধরে একজন মানুষ সত্যি সত্যিই নারী হয়ে উঠলেন। মানুষ হয়ে ওঠা কথাটা কিভাবে দেখবো, এটা আবার ভাবাতে শুরু করে। মানুষের মোটিভ কি হওয়া উচিৎ, এটাও আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করে। স্বার্থপর মানুষের কাছে অন্য সমস্ত মানুষ দোষী হয়ে ওঠেন। কিম্বা এভাবেই তাঁরা বাঁচতে শেখেন। এই শিক্ষা কিম্বা বোধ মানুষ খুব ছোটো গণ্ডি থেকে উপলব্ধি করতে পারে। নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বোধের একটা চূড়ান্ত রুপ সে চর্মচোখে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য কিম্বা দুর্ভাগ্য অর্জন করে। শেষ পর্যন্ত মানুষের সাফল্যই তাঁর বেঁচে থাকার উপায়। কিন্তু সাহিত্য অথবা মনোস্তত্ত্ব এর খানিকটা বিপরীতমুখী হয়ে মূল স্রোতে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। মনে রাখতে হবে সাহিত্য কিম্বা মনস্তত্ত্ব। সাহিত্যিক কিম্বা মনোস্তাত্ত্বিকেরও একটা নির্দিষ্ট গণ্ডী থাকে। সাহিত্য কিম্বা মনোস্তত্ত্ব জীবনের কথাই বলতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাও সম্পূর্ণ জীবন হয়ে ওঠে না। ‘নিত্য নব দিবসের মৃত্যুঘণ্টা’ বাজার মধ্য দিয়ে জীবন এবং বেঁচে থাকার বিভিন্ন উপায়ের উপাদানগুলোরও আকার এবং ভাবনা চিন্তায় বিবর্তন দ্যাখা দেয়। ‘The interpretation of dreams’ অধ্যায়ে ফ্রয়েড একজন মানুষের আশেপাশে থাকা বিভিন্ন সম্পর্ক এবং সমকালীনতার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছে যে প্রতিফলিত হচ্ছে, একটি ট্রেন যা একইসঙ্গে সৃষ্টি এবং ধংসের কারণ, তার সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি হয়ে ওঠার কথা আমাদের জানায়। হাইনরিখের কবিতাতেও ট্রেনের কথা বলা আছে। হাইনরিখ জার্মানির কবি ছিলেন। হিটলারের জীবনেও ট্রেন একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর ট্রেন আপাতভাবে তো একটা সৃষ্টিরই প্রকাশ। কিন্তু দুর্গার মৃত্যু এবং ঘটনাচক্রে অপুর জীবন স্থান, কাল এবং পাত্র ভেদে পাল্টে যাওয়ার মুহূর্ত এবং বিভূতিভূষণের লেখায় নিশ্চিন্দিপুরের কুঠির প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে আসা ইতিহাসই যেন নাগচক্রের মতো মানুষের মন এবং মনোস্তত্ত্বকে ঘিরে ধরে। এই তার নিত্যকালের ছোটো এবং বড়ো গণ্ডির সীমার পটচিত্র এবং প্রেক্ষাপট হয়ে ওঠে।


 


 


 


প্রেম আর প্রেমের বাধাও এক ধরণের আনন্দ কিম্বা অবদমন। আবার চিরন্তন শান্তি বলেও তো একটা ধারণার কথা মানুষই তাঁর জীবদ্দশার ভেতরে অক্ষয় করে রাখতে চেয়েছে। সেখানে চলিষ্ঞু কিম্বা অবিচল থাকা কতোটা এক কিম্বা আলাদা, তার ভারসাম্যের একক কিম্বা সূচকের আকারে কতোটা তারতম্য ঘটবে তার ওপরে নির্ভর করে যা গড়ে ওঠে, তাকে খুব প্রবীণ এবং বিজ্ঞের মতো করে বলতে ইচ্ছে করে ব্যক্তিকাল। কিন্তু ততোটা প্রবীণ এবং বিজ্ঞ নই। অসীমের ধারণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষ যে পরিসমাপ্তির কথা ভাবে, এবং ভেবে আপাত নিষ্কৃতি পায়, নিজের কাজের জগতে সেটা বোঝার সুযোগ হয়েছিলো। প্রেমের ক্ষেত্রে মানুষ বিপরীতমুখী ফলই আশা করে। মানে, প্রেম সম্পর্কে একটা সাংঘাতিক দ্বিচারিতায় আমরা প্রায় সবাই আচ্ছন্ন। প্রেমের শুধু উপযোগীতাই থাকবে, এটা ধরে নিয়েই আমরা একটা কাল্পনিক পৃথিবীর নির্মাণ করে যাই। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবো, সেখানেও লেনদেনটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এই প্রক্রিয়াটি সর্বজনীন বললে ভুল বলা হয় না। অর্থাৎ, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সাধারণভাবে মনোস্তত্ত্ব শব্দটা নিয়ে ভাবলে তার ভেতরে একটা প্রকট যৌনতার কথা ভাবা আমাদের একটা অভ্যাস। সেটা অনেক ক্ষেত্রে সত্যিও। কিন্তু সেটাই অনেকটা ব্যক্তির সামাজিক, রাজনৈতিক এবং জাতিগত অবস্থানের ক্ষেত্রেও একটা সাহায্যকারি বিষয় হয়ে ওঠে, সেদিকে খেয়াল না রাখলে যৌনতার আসল মানে অনেক নিঃস্পৃহ হয়ে পড়ে। প্রেম জীবনের জরাজীর্ণতার ওপর একটা প্রলেপ বলেও অনেক কাজের মানুষেরা মনে করতে পারেন। আমার ধারণা, এটি একটি প্রক্রিয়া। কারণ, প্রেম না থাকলে কোনো কাজই ভালোভাবে করা যায় না। অনীহাও তো দুঃখের অন্যতম কারণ! প্রেম আর রাজনীতি খুব সম্পৃক্ত হওয়া উচিৎ কি উচিৎ নয়, সেটা আর একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। প্রেমকে যেদিক দিয়েই ভাবি, তার একটা সামাজিক ভূমি থাকে। কল্পলোকের সুবিধার মাহাত্ম্য বোধহয় এখানেই। সেখানে জৈবিক প্রেমও জাগতিকতার বাইরের একটা অবস্থান বলে মনে হতে পারে। যেমন মীরার প্রেম। এই নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু ভগবানের প্রতি ভক্তের প্রেমে, একাকীত্বকে কি অবকাশ বলেও ধরে নেওয়া যায়? স্থিরভাবে বলা খুব মুশকিল। তবে প্রেম এবং বিচিত্র প্রেম যে, মানুষের স্বাধীনতার বোধের একটা সূচক, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ‘সুখের সন্ধানে’ বইটিতে রাসেল সাহেব জানিয়েছিলেন, ভালোবাসা যা দেওয়া হয়, তা থেকে নয়, যা পাওয়া যায় তা থেকেই নিরাপত্তার বোধ জন্ম নেয়। তাহলে বাকি কি থাকে? না, অপরাধবোধ। খুব সুস্থ প্রেমেও এই বোধের কাজ এবং পদ্ধতি অন্যরকম চেহারা নিতে পারে। মানুষের ভালোবাসা না পাওয়াই যে আত্মকেন্দ্রিকতার একটা অন্যতম কারণ, রাসেল সাহেব এই কথাটি মেনে নিলেও, তার কোনো সর্বজনীন সত্তা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়ে ওঠেনি। ফলে, মানুষ ভাববাদী হন। কারণ, তাই-ই তাঁকে কিম্বা তাঁদের সাময়িক শান্তি কিম্বা স্বস্তির ক্ষেত্রে সহায়ক। ঠিক সেই কারণেই আজকের পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম এবং ধর্মের দ্বিচারিতার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা থাকলেও, ঈশ্বর নামক একজন অলৌকিক ব্যক্তি ঠিক এই কারণেই মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠেন। এক কথায় একজন ভালো মনোস্তত্ত্ববিদ কিম্বা মনের চিকিৎসক তাঁর রোগীকে সেই কাজটির ভেতরেই রাখার চেষ্টা করবেন, কিম্বা পরামর্শ দেবেন, যা তাঁকে মানসিকভাবে তৃপ্তি দেবে। এবং একই সঙ্গে অন্যের ক্ষেত্রেও তা পীড়াদায়ক হয়ে উঠবে না। সেটা ঈশ্বরের ভাবনা ছাড়াও অন্য কিছুও হতে পারে। মোট কথা, রোগী হলে, তাঁর সামাজিক কর্তব্য অনেকটাই কমে যায়।     


 


 


মনই তো সব কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রক। স্নায়ুর একটি কাব্যিক উপমা কিম্বা অংশ হিসেবেই মনকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সুকুমার রায়ের ‘গোঁফচুরি’ ছড়াটিকে একটু অন্য রকম করে শেষে এও বলা যেতে পারে, মনের আমি, মনের তুমি, মন দিয়ে যায় চেনা।  






 


 


 


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024