প্রত্যাবর্তন - চন্দন চক্রবর্তী || গল্প || ছোটগল্প || বড় গল্প || অনুগল্প || Story || Short story

 প্রত্যাবর্তন

চন্দন চক্রবর্তী


রঞ্জনা প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই,আবেগ তাড়িত হয়ে,ওকে বুকে টেনে নিলাম । আমার দুই বাহুর বাঁধনে,ভীত কবুতরের মত,ও এখন কেঁপে কেঁপে উঠছে ।


সকালেই খবর পেয়েছি রঞ্জনার শিক্ষকতার চাকরিটা হয়েছে । পাঁচ ছটা বছর ওকে টিউশান দিয়েছি । সেই যেদিন ও হায়ার সেকেন্ডারি পাস করল,ওর বাড়ি গিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম,ওকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াবো । প্রথমে রাজি হয়নি । তার গভীর কারণ ছিল । ওর জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তাতে মাথা তুলে দাঁড়ানোর মত পরিস্থিতি ওর ছিলো না ।


রঞ্জনা পাড়ার মেয়ে । শুধু মেয়ে বললে একটা মেয়েকে আর কতটুকু বোঝানো যায় ! ওকে যারা আগে দেখেছে,এক কথায় স্বীকার করবে,চলন,বলন,আচার,আচরণ সব মিলিয়ে,ভীষণ মিষ্টি একটি মেয়ে । যে কোন যুবক ওকে একবার দেখলেই ওর প্রতি ভালোবাসা জন্মে যাবে । কিন্তু এখন,এখন ঠিক তার বিপরীত । মানুষেরও বলিহারি,কি করে এত নির্দয় হয় ! কৌতুহলী দৃষ্টি,কটূক্তি ওকে সর্বত্র উত্যক্ত করে মারে । জীবন মানেই সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নায় মোড়া । সব জীবনেই থাকে,কিছু হেরফের হয় । কিন্তু জীবনে যদি শুধু কান্নাই থাকে,যদি হাসি না থাকে ?


রঞ্জনা মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর,ইলেভেন ক্লাসে ভর্তি হল । মনে তখন অনেক আশা,অনেক স্বপ্ন । বাবার অবস্থা ভালো নয় । ওর ইচ্ছা দিদিমণি হয়ে বাবাকে সাহায্য করবে,গরিব ছাত্রীদের কথা ভাববে । মানুষ ভাবে এক,আর হয় আর । সেতো সবার জীবনেই সত্যি । কিন্তু রঞ্জনার ? প্রেম ভালোবাসা ছাড়া জীবন ভাবা যায় না । ভালোবাসা জীবনের পরম পাওয়া । দুটি হৃদয় তখন এক হয়ে যায় । কিন্তু জোর করে ভালোবাসা আদায় ? ভালো করে ফুল ফুটলে তবেই তার নির্যাস পাওয়া যায় । ফুল ফোটার সময়টুকুতো দিতেই হবে,সেইতো ভালোবাসার সাধনা ।


রঞ্জনার জীবনে এক তরফা কেউ এসেছিল । রঞ্জনার সায় ছিল না । বছর ঘুরে তার তখন বারো ক্লাস,পড়ার ভীষণ চাপ,সন্ধ্যাবেলা কোচিংয়ে যায় । সেই সুযোগে কোন এক অভিশপ্ত দিনে রঞ্জনা আর আগের সেই মেয়ে থাকে নি । অসুখে ভুগে,দুর্ঘটনায় মানুষের অঙ্গহানি হয়,আগুনে পুড়ে বীভৎস রূপ ধারণ করে । সেখানে মানুষ নিরুপায় । কিন্তু কেউ যদি কারো রোষানলে দগ্ধ হয়ে কদাকার রূপ ধারণ করে,তেমন পাশবিক কাজের কোন ক্ষমা হয় কি ? অপরাধীর শাস্তি হলেও সমাজকে যে সেই কদর্য ঘটনার সাক্ষী থেকে সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় !


অ্যাসিডে মুখ পোড়া রঞ্জনা হসপিটাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে প্রায় একটি মাস পরে । মুখে, ঘাড়ের চামড়ায় আদিম হিংসা,লালসার ক্ষত চিহ্নগুলো তখন অ্যাসিড শিকারের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে । আর তখন থেকেই রঞ্জনা হয়ে উঠল সবার চোখের বিষ । তারই মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী যারা,অনেক বুঝিয়ে তাকে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় বসাতে চেষ্টা করেছে । 


সেদিনের সেই ঘটনা জানার পর হসপিটালে গিয়ে সেই প্রথম ওর সামনে হাজির হয়েছিলাম । ও যখন ছোট,স্কুলে যাওয়া-আসা করত,তখন থেকেই ওকে দেখছি । নেচে নেচে কথা বলে এমন মাতিয়ে রাখতো,আট-দশটা মেয়ের মধ্যে ওকে আলাদা করে চোখে পড়ত । আমিও ওকে চোখের দেখা দেখবো বলে জানালায় বসে থাকতাম । মনে মনে আমারও কি ওর প্রতি ভালোবাসার জন্মে ছিল,কে জানে ! তবে ওকে দেখলে মনে পুলক জাগত,এটা সত্যি । মনে দ্বিধা ছিল,বয়সে ও আমার থেকে অনেকটাই ছোট । মেয়েটার ঝলসে যাওয়া মুখটা দেখে অনেকক্ষণ বোবা হয়ে বসেছিলাম ।


হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর রঞ্জনা আবার বেঁকে বসল । আর পড়বে না । রাস্তাঘাটে ওকে দেখে অনেকে বাজে মন্তব্য করে । ওর কদাকার রূপ দেখে নাকি শিশুরা ভয় পাবে,তাই মায়েরা শিশুর চোখ হাত দিয়ে ঢেকে সরে যায় । কেউ কেউ এমনও বলেছে,ওর মরে যাওয়াই ভালো । 


হসপিটালে রঞ্জনার বাবা,মায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওরা আমাকে এমন করে আপন করেছিল সরে আসতে পারিনি । ধীরে ধীরে রঞ্জনার সমস্যাকে নিজের সমস্যা ভাবতে শুরু করেছি । প্রথম প্রথম দরজা বন্ধ করে থাকতো । কতদিন যে ফিরে আসতে হয়েছে ! কিন্তু ওকে যে মনে মনে ভালোবাসতাম সে ভাবনা তখন আমার ছিল না । 


ধীরে ধীরে রঞ্জনা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে । রঞ্জনাকে টিউশান দিয়ে কলেজ,ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করলাম । রঞ্জনা আবার রাস্তায় স্বাভাবিক চলাচল শুরু করলো । কিন্তু হাসি ছিল না ওর মুখে । আমার পণ ছিল ওর মুখে হাসি ফোটাবো । কিন্তু রঞ্জনা যত স্বাভাবিক হয়ে উঠছে,আমার প্রতি ওর এবং ওর পরিবারের নির্ভরতা আরো বেড়ে চলেছে । এরপর রঞ্জনা বিএড পাস করেছে,এসএসসি পরীক্ষায় বসবে, তার প্রস্তুতি চলছে । আর এই সময় হঠাৎ আমার ভাবনা অন্যদিকে মোড় নিল । 


বারবার মনে হয়েছে সরে যাই । যে ভাবে আমার ওপর ওর নির্ভরতা বাড়ছে ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়ালে তখন সামাল দিতে পারব না । মনকে বুঝিয়েছি ওকে ভালবাসা যায় কিনা । কিন্তু ওর মুখটা মনে করে,মন বেঁকে বসেছে । কিন্তু বিবেক বারবার আমাকে বুঝিয়েছে,ক্ষণস্থায়ী রূপ নিয়ে আমার এত ভাবনা কেন ! এখন যদি আমি সরে আসি কোন অঘটন ঘটবে না তো ! ভয়ে আমি শিউরে উঠেছি । রাত্রিবেলা শুয়ে এমন বিক্ষিপ্ত ভাবনা ভেবে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম । শেষে রঞ্জনাকে একদিন বলেই দিলাম,আমি ওকে ভালোবাসি । আর কি আশ্চর্য,কথাটা উচ্চারণ করার পরেই মনে হল আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি । কিন্তু রঞ্জনার দিক থেকে কোন সাড়া পেলাম না । তাতেই যেন আমার আরও রোখ চেপে গেল । কিন্তু যতই বোঝাই রঞ্জনা নিরব ! হয়তো ওর ধারণা,আমি ওকে দয়া করছি,হয়তো আমাকে যাচাই করে নিচ্ছিল । সেটা বুঝলাম যখন এসএসসির রেজাল্ট জেনে ওর ওখানে গেলাম । রেজাল্ট নিয়ে কথা বলতে বলতে ও আমাকে প্রণাম করতে যেই নিচু হয়েছে,কি যে হল,এই প্রথম আবেগে তাড়িত হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । ও কিন্তু একটুও প্রতিবাদ করল না । 


রঞ্জনা পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে জয়লাভ করেছে,জীবনের চাওয়া ওর পূর্ণ হয়েছে । রঞ্জনা হাসছে,এই প্রথম রঞ্জনা আগের মত হাসছে,চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে,তাও রঞ্জনা হাসছে । আর ওর হাসি দেখে আমার চোখেও জল,এতদিনে আমার সাধনাও যে পূর্ণ হল । 


আমাদের আর কোন ভয় নেই,কোন সংশয় নেই । আমরা পেরেছি এতবড় একটা যুদ্ধে জয়লাভ করতে । বললাম,চলো রঞ্জনা ঘুরে আসি । সঙ্গে সঙ্গে ও রাজি হয়ে গেল । দুজনে হাত ধরাধরি করে আমরা পথে নামলাম,যে হাতের বন্ধন কোনদিন খুলবে না ।

Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024