উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -38
আমার মন মেজাজ যে খারাপ তা কদিন ধরে প্রকাশ পাচ্ছে। তথাপি কাজ কর্ম কোন প্রকারে করতাম। দুপুর বেলায় রামায়ণ পাঠ করতাম মনের সুচীতাকে অটুট রাখার জন্য। অনেকে বলেন, 'পাপীরে কোরো না ঘৃণা, ঘৃণা করো পাপে।'
এই মনোবৃত্তি বিশ্বসংসারে কজনেই বা গ্রহণ যোগ্য মনে করেন। আমি যে পাপী তা দেবীদাস জানে, কিন্তু এই পাপ পথে তো আমি স্বেচ্ছায় আসতে চাইনি। তাহলে আমি কেন পাপী? যারা জোরপূর্ব্বক পাপ কুঞ্জে আমার মতো মেয়েকে নিক্ষেপ করছে তারা কি তাহলে সৎ? আমি হতে পারি পাপী তবে সমাজের চক্ষে। মন আমার অপবিত্র নয়। কিন্তু স্বেচ্ছায় যখন এই পথ গ্রহণ করিনি তখন নিজেকে পাপী বলে মানতে পারবো না। ধর্ম গ্রন্থের বাক্য পালন করে মনকে পবিত্র করার অধিকার আছে। রামায়ন পড়ি প্রতিদিন। শ্যামলীদি অন্তর্ধান করার কয়েক দিন পর পুনরায় রামায়ন পড়তে শুরু করলাম।
ধীরে ধীরে শ্যামলীদির কথা ভুলতে থাকলাম। দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় ঐশ্বর্য্য ও প্রাচুর্য্যেও বিলাসিতার মধ্যে ডুবে থেকেও ধিকৃত জীবনের ঘৃণ্য কাহিনী স্মরণ করে নিজেকে খুব ছোট বোধ করতাম। এখন আমাদের উভয়ের মানসিক অনৈক্য নেই। সামাজিক নিয়ন্ত্রণে স্বামী-স্ত্রীর যে আদান-প্রদান, আচার-আচরণ তা রেজেষ্টারীর পূর্বেই আমার জীবনের পাণ্ডুলিপিতে লিপিবদ্ধ হলো। অবশ্য সীমান্তে সিঁদুর নেবার পূর্বেই দেবীর শয়ন কক্ষে প্রবেশ করার অধিকার পেলাম।
সেদিন ভুলবশতঃ হোক আর ভালোবাসার টানে হোক দেবীর শয়ন কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম। যখন শুনেছিলাম দেবী মাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, কোন প্রকারে নিজেকে শান্ত করতে পারিনি। তখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেবীর দুই হস্তের মধ্যে কখন বন্দী হয়েছিলাম খেয়াল ছিল না। ওর দুই হস্তের বন্দী থেকে মুক্ত হতে পারিনি।
এরপর থেকে দেবীকে জীবনসাথী রূপে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছি। এরপর যদি আমার জীবনে ভাগ্য বিপর্যয়ের কালো ছায়া নেমে আসে তাহলে সে দোষ আমার অদৃষ্টের। তবে দুঃসহ, শোক, দুঃখ যে উপস্থিত হয়নি তা নয়, বহু উত্থান
পতনের পর এক বারবনিতা সমাজের সুপ্রতিষ্ঠিত রূপে ঠাঁই হয়েছে। কলহাস্য মুখ্য জীবন স্রোত বয়ে যেতে লাগল।
এই সময়ে এক শুভ কার্য্যের নিমন্ত্রণ নিয়ে এলো দেবীর বন্ধু বিকাশ। তাকে কোন দিন দেখিনি। হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো। বারান্দায় কপাট খুলতেই নজরে পড়লো এক গৌরবর্ণ মুখশ্রী মন্ডিত তরুণ যুবক। যুবক এক দৃষ্টে আমার মুখপানে তাকিয়ে আছেন। লজ্জায় মুখ নত করে বললাম, কাকে চাইছেন?
সে লজ্জা কাটিয়ে বলল, দেবীকে। দেবী আমার বন্ধু। আমার নাম বিকাশ। কোন ভয় নেই বৌদি আপনার সম্বন্ধে আমি অবিদিত নই ভাববেন না। আমি খুবই খুশী ভেতরে যেতে বলবেন না ?
আসুন ভেতরে। বিকাশ ভেতরে প্রবেশ করে ওকে বৈঠকখানায় বসিয়ে লৌকিতা করার জন্য রান্না ঘরে হাজির হলাম। অল্প সময়ের মধ্যে জলযোগের ব্যবস্থা করে ওর কাছে হাজির হয়ে বললাম, এগুলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন ভাই, তারপর আপনার সাথে গল্প করবো।
বিকাশ খোস মেজাজে বলল, আপনি যথাসময়ে জলযোগের ব্যবস্থা করেছেন নইলে ক্ষিদের জ্বালায় কষ্ট পেতাম। কিন্তু এতো খাবার আমি খেতে পারবো না বৌদি, আপনাকে ভাগ বসাতে হবে। বারবার আপত্তি করা স্বত্ত্বে কোন কথা শুনলো না। সরল, সহজ ও সংবেদনশীল বলে মনে হলো।
আমার মনে যে ভয় ছিলো তা কেটে যাওয়াতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওর সাথে গল্প করতে মজে গেলাম। আমার অতীত জীবনের পদস্খলনে কিছু সান্ত্বনা দিয়েছিল। বিশেষ করে দাদা যে ওর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও উপকারী বন্ধু ছিল তা অকপটে স্বীকার করলেন।
বিকাশ বললেন, আপনার দাদা যেভাবে ডাক্তারী পড়ছিলো তা কোন দিন জানতে পারিনি। দারিদ্রের মধ্যে সংগ্রাম করে অন্ধকার জীবন হতে নব দিগন্তের সূর্য উদয়ের প্রতিক্ষায় ছিলে তা জানতাম না। বৌদি একথা কি সত্য ?
উত্তর দেবার আগে চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। গোপনে সামলে মাথা নেড়ে বললাম, দেবী যা বলেছে মিথ্যে নয়।
বিকাশ ওকথা শোনার পর কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, আমি কোন দিন কল্পনা করিনি সুমন্তকে অকালে মরে যেতে হবে। কার দোষ দেবেন, নিষ্ঠুর নিয়তি তার প্রতি অবিচার করে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলো। দেবীর দোষ দিয়ে কি লাভ, তার অকাল মৃত্যু হেতু স্বরূপ। আফশোষ করবেন না বৌদি। কোন ভয় নেই বৌদি। আমি ও আমাদের পরিবারের লোক সকলেই আপনাকে ভালোবাসি।
তাছাড়া এও অনুরোধ করছি দেবীর প্রতি কোনরূপ অবিশ্বাসের ছায়া ফেলবেন
না। খাদ মুক্ত সোনা অগ্নি দহনে পরিশুদ্ধ হয়। আমি মৌন থেকে ওর কথাগুলো শুনছিলাম। কখন যে দেবী আমার পিছনে হাজির হয়েছে জানতে পারিনি। আমার চোখ দুটো চাপা দিতেই বুঝতে পারলাম দেবী ছাড়া কেউ নয়। মরনা স্কুলে গেছে। দেবী কে বললাম, এই হাড়ো না? দেখতে পাচ্ছ না কে সামনে বসে আছে?
দেবী বললে, ও আমার শত্রু নয় যে বিদ্রুপ করবে। হাত সরালো, বিকাশ কখন এলি ?
প্রায় ত্রিশ মিনিটস্। তোর অফিসে গিয়েছিলাম, ওখানে না পাওয়ার জন্য বাড়ীতে আসতে বাধ্য হাম। তাছাড়া নতুন বৌদিকে দেখার প্রবল বাসনা ছিল তাই লুকিয়ে দেখতে এলাম। কিরে রাগ করলি বুঝি?
দেবীদাস বলল, তোর বিয়ের খবর ? আমি সে সময় বললাম, আপনারা গল্প করুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করি। আমি পিছন ফিরতেই বিকাশ বলল, চা তো খাবই, তার আগে আপনাকে একটা
ভাষা চেঞ্জ করতে হবে। আমি প্রথমতঃ বুঝতে পারিনি, তাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বললাম, কোন অন্যায় করলাম বুঝি ?
নিশ্চয় অন্যায় করছো। এবার আপনি না করে তুমি দিয়ে কথা বলতে হবে। ঠিক আছে এরপর তুমি বলেই কথা বলবো।
রান্না ঘরে হাজির হলাম। বিকাশ বৌদি বলে আমাকে অলংকারে ভূষিত করেছে। তাহলে সে আমার ঠাকুরপো। গার্হস্থ্য জীবনের আত্মীয়তার বন্ধন নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। কিসের চিন্তা সে কথা বারংবার প্রকাশ করা নিরর্থক। শুধু এইটুকু জানবো আমি ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছি আমার স্বপ্নকে, আমার নারী মনের আশার আলোকে উজ্জ্বল করতে।
চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলাম ওদের সামনে। বিকাশ চায়ের কাপ হাতে ধরে বলল, সামনের মাসের ৯ তারিখে আমার বিয়ে, বারবার মা বলেছেন তোমাকে হাজির হতেই হবে। না গিয়ে থাকলে আমার সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না। লজ্জা ঘৃণা সব কিছু ত্যাগ করে তোমাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বৌদি।
প্রথমে আমি ভেবেছিলাম আমি তোমার সাথে পরিচয় করবো না। কিন্তু আমার পরিবারের একজন আমার চক্ষুর অন্ধকারাচ্ছন্নকে আলোকিত করলেন। আমাদের বাড়ীতে গিয়ে বুঝতে পারবে। আমি কোনরূপ যেন আঘাত না পেয়ে থাকি।
দেবী এই কার্ডটা নে, এই কার্ড দিয়ে তোকে নিমন্ত্রণ করা হলো। এখানে আর
ওয়েট করবো না ভাই। পিসিমারা শ্যামবাজার থাকে। তোমরা সকলে যেও বৌদি আসি কেমন?
বিকাশ বিদায় নিল । আমি ওর পিছন পানে তাকিয়ে এক স্বপ্ন রাজ্যে গিয়ে হাজির হলাম । আমি যাব না আমার সিদ্ধান্ত। আমার মত মেয়ে কি ঐ পরিবেশে যেতে পারে। কারণ আমার পিছনের ইতিহাস আমি বিস্মৃত হইনি। তখনও পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে হীনমন্যতা ভাব চলছিল। যাকে বলে Inferiority complex |
মৌন হয়ে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে ভাবছি ওকথা। বিকাশের আরেকটা কথা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো। বিকাশ যাবার সময় এই কথা বলে গেল। জানো বৌদি এই দুনিয়ায় একই চেহারার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন মাতৃ জঠরে জন্ম গ্রহণ করে তা আমার জানা ছিল না। অপরূপ মিল তোমার। কেউ বলতে পারবে না চন্দ্রা বৌদির সাথে কোন বিষয়ে অমিল আছে। কে চন্দ্রাদির বাবা! যদি দেবীকে বলে, হঠাৎ দেবীর ডাকে ভাবনা বাধা পড়লো।
Comments