উপন্যাস - পদ্মাবধূ || বিশ্বনাথ দাস || Padmabadhu by Biswanath Das || Fiction - Padmabadhu Part -39
কি ভাবছো রমা? বিকাশের বিয়েতে আমরা সকলে যাবো। হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো - না, আমি যাবো না ।
দেবীর প্রশ্ন কেন যাবে না?
বললাম, আমি সমাজের কাছে পরিত্যক্তা। বিকাশদের মতো ভদ্র পরিবেশে মিশতে আমার কোনরূপ সংশয় বাধা থাকতো না যদি আমি -
দেবী ওর কথাকে লুফে বলল, পতিতা না হতে এইতো? তোমার ঘৃণ্য জীবনের স্বরূপ উৎঘাটিত হয়ে যায় সেইটাই ভয়। কোন সভ্রান্ত বংশের ছেলে যদি তোমাদের নোংরা বস্তীতে তাদের কু-অভিপ্রায় চরিতার্থ করতে আসা-যাওয়া করতো, হয়তো তাদের মধ্যে নিমন্ত্রিত কেউ তোমাকে দেখে ফেলে তাহলে বিকাশকে পরে গোপনে অনেক কথা হয়তো শুনতে হতে পারে
কিন্তু রমা তুমি আমার স্ত্রী কারো ক্ষমতা নেই আমার কাছে তোমাকে অপমানিত করার। তুমি কেন মন থেকে মুছে ফেলতে পারছো না তোমার অতীতকে। আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো, আমি তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদার থেকে কোনদিন দূরে সরিয়ে দেব না। এমন কি আমার পিতাও যদি তোমাকে স্বীকৃতি না দিয়ে থাকেন তা ও তোমার প্রতি অবিচার করবো না। আমি প্রমাণ করবোই একজন পতিতা, সম্ভ্রান্ত বংশের ও ধনী ব্যবসায়ীর বধূ হতে পারে।
দৌড়ে গিয়ে দেবীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অন্তস্থল হতে কান্নাকে ঠেলে আনতে চাইলো, বহু কষ্টে সংবরণ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু কপেলি দিয়ে ঝরতে শুরু করলো।
ঈশ্বরের কাছে বার বার কামনা করলাম আমরা এই কপোত-কপোতী যেন চিরদিন এই বাহু বন্ধনে আবদ্ধ থাকি।
বিয়ের দিন দেবীর সাথে বিকাশদের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলাম। মানার ভীষণ আনন্দ। বিকাশরা ধনী ব্যক্তি তা আভাসে বুঝতে পারলাম। বিশাল অট্টালিকা বিভিন্ন কারু ও শিল্প কলায় বেষ্টিত। অনেকটা জনকপুরের রাজা জনকের রাজ বাড়ীর মতো। খুবই মনোরম পরিবেশ। বিকাশের মা আমাকে আপন বৌমার মত ভালোবাসতে শুরু করলেন।
তিনি আমাকে বললেন, তুমি আসাতে আমার অনেক কাজ হালকা হবে। তুমি বিশ্রাম নিয়ে আমার সাথে কাজে মনোনিবেশ কর মা।
আমি বিশ্রাম না নিয়ে বিকাশের মা অর্থাৎ মাসীমার সাথে কাজ করতে থাকলাম। বৌমা, বৌমা করে অতীষ্ট করে তুললেন। মনে হলো তার ভালোবাসা পেয়ে আমার গ্লানি কিছুক্ষণের জন্য তলানিতে গিয়ে ঠেকালো। মাসীমার বৌমা ডাক শুনে পরম তৃপ্তিতে আমার মন ভরে গেলো সত্য, কিন্তু ভয় হচ্ছে যতদিন না পর্যন্ত দেবীদাস আমার সিঁথি সিঁদুরে রঞ্জিত না করে ততদিন পর্যন্ত আমার মনে ভয় ও সন্দেহ দূর হচ্ছে না।
তিনি বললেন, এ তোমাদের কেমন ধারা বৌমা, এতো রূপ, এতো সুন্দর তোমার চেহেরা, মুখের শ্রী, আর সিঁথিতে সিঁদুর নাওনি কেন বৌমা। আজ কালের বিবাহিতা মেয়েরা মাথায় ঘোমটাও নিতে জানে না। সিঁদুর সিদুর ও যে কেন নেয় না ভাবতে পারি না। এসো আমার সাথে। এই শুভদিনে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বিবাহ উৎসবের মাঙ্গলিক ক্রিয়া কর্মগুলি তুমি পবিত্র ভাবে সম্পন্ন করবে।
মাসীমা কোনরূপ দ্বিধা না করে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন ড্রেসিং টেবিলের কাছে। লাল টকটকে সিঁদুর রাঙ্গিয়ে দিতে উদ্যত হলেন আমার সিঁথিকে। আমি কোন প্রকারে বাধা দিয়ে সিঁদুরের কৌটাটা হাতে নিয়ে বললাম, আমাকে দিন আমি নিচ্ছি।
তিনি জানেন না আমি তখনও পর্যন্ত দেবীর বিবাহিত স্ত্রী নই। বিবাহের অনুষ্ঠান তখনও বাকী ছিল। বিকাশ তার মার নিকট পরিচয় দিয়েছ দেবী আমাকে বিয়ে করেছে। এ অবস্থায় সিঁথিতে সিঁদুর কি করেই বা নিই। এ সম্ভব নয়, সিঁদুরের কৌটা হাতে নিয়ে ভাবছি কি করবো। এই সময় আমি মর্মে মর্মে অনুভব করলাম সিঁথি সিঁদুর বিহীন অবস্থায় বিবাহ উৎসবে আসা মহা ভুল হয়েছে।
যাক ঈশ্বর রক্ষে করলেন। বিকাশের বোন অনিতা মাসীমাকে কোন কাজের জন্য ডেকে নিয়ে গেল। বিলম্ব না করে দৌড়ে গিয়ে একেবারে বাড়ীর উপর তলায় এসে।। উপস্থিত হলাম। বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। হঠাৎ দেখি দেবী উপর তলায় একটা চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
আমি ততক্ষণাৎ ওর কাজ গিয়ে বললাম, আমাকে রক্ষা কর দেবী। প্রথমতঃ দেবী ওর ব্যাকুলতা দেখে হক চকিয়ে গেল। বলে উঠল, কি ব্যাপার এতো হাঁপাচ্ছো কেন? কি হয়েছে তোমার?
আমার এখানে থাকা চলবে না। কারণ মাসীমা আমার সিঁথিতে সিঁদুর নেই বলে - দেবী এই পর্যন্ত শুনে হো হো করে হেসে বলল, এই জন্য তোমার এতো ভয় ? তোমার সিঁথিতে সিঁদুর নেই বলে বোকা বোকা করবেন এইতো
ঠিক তাই ।
চলো আমার সাথে।
কোথায় যাবো সিঁদুরের খোঁজে। হাতের কৌটটা দেখিয়ে বললাম, এই নাও সিঁদুর। দেবীদাস হাত বাড়িয়ে সিঁদুরের কৌটাটা হাতে নিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বাম হাত দিয়ে বন্ধন কার আমার সিঁথিকে সিঁদুর দিয়ে বৈঠক মন্ত্র উচ্চারণ করল, “যদিং হৃদয়ং মম। তদিং হৃদয়ং তব।” তিন বার সিঁদুর দিতে দিতে এই মন্ত্রখানি তিনবার উচ্চারণ করলো।
আর একথাও বলল, আজ এই শুভদিনে আকাশ-বাতাস ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও প্রজাপতি ঋষিকে সাক্ষী রেখে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে তোমাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করলাম। আমাদের দুটি হৃদয় যেন এক হয়ে সুখী হতে পারি।
দেবী আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিতেই ওর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। মন যে আমার কতখানি হালকা হলো তা নিজেই অনুভব করলাম। মনে হলো কোন প্রবিষ্ট অগ্নিশলাকা আমার বুক থেকে বেরিয়ে এলো আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দেবী বলে উঠল, বিকাশের শুভদিনে আমাদের শুভদিনের কাজটাও সমাপ্ত হলো। মন্ত্র উচ্চারণ করে বা জ্বলন্ত অগ্নিকে সাক্ষী রেখে বিবাহ উৎসবের বাহ্যিক অড়ম্বরটাই জীবনের বড় কথা নয়। হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের বিনিময় হলো সুস্থ জীবন যাত্রার লক্ষণ। যাও মাসীমাকে প্রণাম করবে।
দেবীর কাছ হতে সরে গিয়ে আয়নার সামনে এসে বার বার লাল টকটকে সিঁথিটা দেখতে থাকলাম। তবুও খেদ মিটল না।
হঠাৎ মাসীমার ডাকে আমি চমকে উঠলাম। তিনি বললেন এখনো তোমার সিঁদুর নেওয়া হয়নি?
সত্যিই দেরী হলো মাসীমা চলুন।
আমার সিঁথির দিকে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখতো বাছা সিঁদুর নেওয়ার পর লাবণ্যময়ী মায়ের মুখখানি লাবণ্যে ভরিয়ে তুলল। জানো মা সিঁথির সিঁদুরে স্বামীর পরমায়ু বাড়ে। চলো বৌমা তোমাকে কয়েকটা কাজের জন্য ব্যস্ত থাকতে হবে। তিনি আমাকে পাশের রূমে নিয়ে গেলেন।
বিকেল বেলা বিকাশের বৈঠকখানা ছেলে মেয়েতে কিলবিল করতে থাকলো। কেউ কেউ বিকাশের পাশে বসে অসম্ভব কৌতুকে মেতে আছে। দেবীর মারফৎ জানতে পারলাম ওরা সকলেই বিকাশের বন্ধু । অবশ্য কলেজ গন্ডী সকলেই বেরিয়ে গেছে।
বিকাশ আমাকে চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলতেই সাদর অভ্যর্থনা করে ওর পাশে বসার জায়গা করে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। যে বাক্যাংশ আমার সর্বদা, বারংবার ব্যক্ত করা উচিত নয়।
প্রথমতঃ ভয় পেয়েছিলাম, যদি ছেলের মধ্যে কেউ বস্তীর আগত ব্যক্তি হয়ে থাকে। সে ভয় কাটলো। প্রতিটি ছেলে ও মেয়ের সাথে পরিচয় হলো। কিন্তু ওর মধ্যে একটি বিকাশের সমবয়সী ছেলের দৃষ্টি দেখে আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম। তার চোখ দুটোকে স্থির করে একইভাবে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। ওর চোখ দেখে মনে হলো আমার মধ্যে কাকে যেন খোঁজ করছে। তবে সে চোখ কোন লালসা বহ্নির নয়।
Comments