তিল - রঞ্জিত মল্লিক || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

  তিল

কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)



               আজ সৌনকের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন ! তার অফিস এই প্রথম তাঁর ওপর এক বিরাট বড় কাজের দায়িত্ব দিয়েছে । এতদিন সহকারী হিসেবে প্রতিটা বড় বড় অপারেশন সামলেছে কিন্তু আজ সম্পূর্ণ নেতৃত্ব তাঁর কাঁধে । পারবে কি সৌনক ? মোবাইলে টুং করে শব্দ হয়ে আলোটা জ্বলে উঠতেই কম্পিউটারের মাউস ছেড়ে মোবাইলটা হাতে নিতেই মেসেজটা চোখে ভেসে উঠল । এবার বেরোতেই হবে ! জামাকাপড় পরে তার সবসময়ের সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৌনক । যাওয়ার আগে মা কালির ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল 


          "........আজকের দিনটা আমার পাশে থেকো মা !"


            মা কালিকে প্রণাম করেই সৌনক গাড়িতে উঠল। পিছনের সীটে গুটি শুটি মেরে লুকিয়ে পড়ল টম। সৌনকের পাশে থেকে থেকে টম অনেকটাই সৌনকের মতি গতি বুঝে নিয়েছে। আজকের কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সৌনকের চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও বেশ চিন্তিত। পাশের সহকারী দুজনের মুখও বেশ গম্ভীর।


             ঝিপ ঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির চাদর সরিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল বাইপাসের দিকে। মাঝে মাঝে মোবাইলে ফোন ভেসে আসছে।


          "সোনু , খুব সাবধানে কাজটা গোছাতে হবে কিন্তু। প্রতিপক্ষের নেট ওয়ার্কিং অনেক গভীরে। "

         "ওকে স্যার। সব ঠিক মতন হবে। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।" 

           "এবার ওদের দলে একজন মহিলাও আছেন। শুনেছি উনার তুখোড় ব্রেন। আমরা যে আসছি সেটা মনে হয় ওরা জানতে পেরেছে।একটু এলার্ট থেকো।"

           "রিয়েলি ?"

           "হ্যাঁ, তাই সাবধানে পা ফেলবে। একটু এদিক ওদিক হলেই বিপদ অনিবার্য। তোমার উপর আমার পুরো আস্থা রয়েছে।" 

       "স্যার , ডোন্ট অরি। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।" 


              বাইপাসের ধারে অনেক কটা ছোট বড় হোটেল। যে কোন একটাতে দুবাই থেকে একটা দল এসে উঠেছে। পাঁচজনের টিমে একজন মহিলাও আছেন। মহিলার ছবিটা স্যার বার বার দেখিয়েছেন। ভাল বোঝা যাচ্ছিল না কমপিউটারের মনিটরে। ছবিটা সাথেও আছে।


             সৌনক একবার বের করে দেখল। মুখটা বোরখাতে ঢাকা। তবে চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। মোবাইলে ছবিটা জুম করতেই বাঁ চোখের নীচে একটা ছোট্ট তিল ধরা পড়ল। তিল সমেত চোখদুটো যেন বহুকালের চেনা। বিশেষতঃ তিলটা। সুন্দর ঐ বিউটি স্পটটা কিছু যেন বলতে চাই। সৌনক গভীরভাবে ছবি আর চোখের নীচের কালো বিন্দুর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে উঠল,"সেই চোখ, সেই তিল...। কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে....। ঠিক মেলাতে পারছি না।"


              বাইপাস এসে গেছে। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সৌনক দুই সহকারীকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। টম গাড়িতেই থাকবে। সেই রকম বিপদ বুঝলে ও এগিয়ে আসবে। তিনজনে সোজা কফি শপের দিকে গেলো কফি খেতে। 


               তিনজন তিনটে হোটেলকে টার্গেটকে করে অন্ধকারে এগোতে থাকে। বৃষ্টির তেজ একটু হলেও কমেছে। একটা হোটেলের সামনে এসেই সৌনক থমকে দাঁড়াল। কিছু একটা ক্লু মনে হয় পেয়েছে। হোটেলে পার্টি চলছে। বেশ জোরালো। একটা জায়গাতে সুইমিং পুলের ধারে আসতেই এক জায়গাতে দৃষ্টি আটকে গেল।


              সন্দেহ ঠিক তাহলে। মোবাইলে দুজনকে ডেকে নিল। 


                দশ মিনিটের টানা অপেক্ষার পর শিকার আসল হাতের মুঠোয়। একটা মৃদু ধ্বস্তাধ্বস্তি। মুখের বোরখাটা সরতেই নিয়ন আলোতে যাকে দেখল তাকে দেখে সৌনক আঁতকে উঠল। এক দৃষ্টিতে দুজন দুজনকে দেখছে। পাঁচ সেকেণ্ড পরেই একটা গুলির আওয়াজ। গুলিটা সৌনকের মাথার পিছনে লাগতে পারত। লাগেনি। মেয়েটা সৌনককে ঠেলে সরিয়ে নিজে গুলিটা হজম করল।


             হালকা গুলির লড়াই চলছে। ততক্ষণে পুরো হোটেলটা ফোর্স ঘিরে ফেলেছে। পনেরো মিনিট লড়াইয়ের পর টিমের চারজন ধরা পড়ল। একজনকে অলরেডী এসকর্ট করে পাঠানো হয়েছে হসপিটালে।


                     ********* ***********


               সৌনক তিনদিন ধরে হসপিটালেই পড়েছিল। মৌবনী আগের থেকে এখন অনেকটাই ভাল। ছোট একটা অপারেশানের পর জ্ঞান ফিরেছে। বিপদ কেটে গেছে। সৌনকের দিকে তাকিয়ে শুধু বলল , "আমি খুশী তোমাকে বাঁচাতে পেরে। তা না হলে ওরা ......" কথা শেষ হয়না। গলা বুজে আসে।


             "রিল্যাক্স! এখন পুরো বিপদ কাটেনি। বেশী কথা বললে তোমার কষ্ট হবে জানি।" বলেই সৌনক মৌয়ের হাতদুটো চেপে ধরল। চোখের কোণে নোনা নিম্নচাপ। তার দুফোঁটা মৌয়ের হাতেও পড়ল। 


                দুজন দুজনের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে আছে। বহু বছর পরে দুজনের দেখা। তাও এক অপ্রত্যাশিত অবস্থায়। মৌবনী আবার কথা বলার জন্যে তৈরী হল....


                "কত বছর পরে আমাদের দেখা....."

                 "ঠিক বলেছ। সেই শেষবার যখন তোমাকে দেখলাম, তারপর....."


                 সৌনকের দু চোখের নিম্নচাপ গভীর হচ্ছে। বাড়ছে নোনা জোয়ারের তেজ। নিজেকে সামালানোর চেষ্টা করছে। মৌ হাতদুটো বুকের কাছে ধরে অস্ফুটে বলে উঠল....

 

              "আমার জন্যে তোমাকে এই ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে শুধু শুধু। জানি না কবে যে এই পাপের জীবন থেকে মুক্তি পাব.....


               কথা আবারও শেষ হয় না। ফ্যালফ্যাল চোখে সৌনকের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌনক ওর দু চোখের তারার গভীর মহাসাগরে যেন ডুব দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর মৌবনী একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতেই সৌনক বাইরে বেরিয়ে এসে সিগারেটে মোলায়েম টান দিল।


            দুদিন পরেই মৌ পুরো সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে রিলিজ নিল। 


              দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে গেছে। সেদিনের মৌবনী এখন অনেক পরিণত। কালো, অমসৃণ, এবড়ো খেবড়ো পথ ভুলে উজ্জ্বল জীবনের পিছনে ছুটছে। একটু স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দে বাঁচার আশায়। 


                      পাঁচ বছর পরে....


               মৌবনী কয়েক বছর জেল খেটে মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। দুবাইয়ের হীরে আর অস্ত্র পাচারকারীর মূল গ্যাংটা ওর সাহায্যে অনেক আগেই ধরা পড়েছে। পুরো অপারেশনের নেপথ্যের কারিগর সৌনক। ওর পদোন্নতি হয়েছে।


               ........... .......... ..... ........


            আজ মৌবনী, সৌনকের ফুলশয্যা। মৃদু আলোয় মৌবনীকে কাছে বুকে টেনে ওর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে সেদিনের মতন তাকিয়ে আছে। তিলটা বেশ সুচারুভাবে নজরে পড়ছে। চোখের ভিতরে নরম আলোতে ডুব মারতেই পুরানো দিনের কথাগুলো ভেসে আসল।


           বহুবছর আগে এই মৌবনীকেই ভালবেসেছিল। অনেক বছর ছিল দুজনের সম্পর্ক। কলেজে পড়ার সময় থেকেই ওর সাথে আলাপ। প্রথমে পরিচয়। তারপর আসতে আসতে......


            ওর বাবার বাইপাস সার্জারির সময় প্রচুর টাকার দরকার হয়। এদিকে টাকার অভাবে অপারেশানের ডেটটাও পিছোতে হল। টাকা জোগাড় করতে না পেরে শেষে নিরুপায় মৌ বাবাকে বাঁচাতে নোংরা পথে রোজগারে নামতে বাধ্য হয় । সেই শুরু। চেষ্টা করেছিল ফিরে আসতে, পারেনি।


         সৌনকের সাথে তারপর থেকেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। দুজনের দূরত্ব বাড়লেও মনের কোণে ভালবাসার ছোট্ট চারাগাছটা একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল।  


          সৌনক ভাগ্যচক্রে ক্রাইম ব্রাঞ্চের মস্ত বড় অফিসার হয়ে ওঠে। তখন থেকেই ওর উপর সোনা, হীরে, অস্ত্র পাচারকারী দলটাকে ধরার দায়িত্ব এসে বর্তায়। কাজের এসাইনমেন্ট পাবার পর থেকে ও দলটাকে ধরার জন্যে উঠে পড়ে লাগে। 


           মৌয়ের বাবা বাইপাস সার্জারি হবার পর সুস্থ হয়ে ফিরল বটে। তবে মৌ আর ফিরল না। ও নিজেই অসুস্থতার শিকার। সেই যে অবৈধ উপায়ে টাকার স্বাদ পেল, তারপর থেকে টাকার নেশা ওকে পেয়ে বসল। আর তাতেই ও ক্রমেই অবৈধ লেনদেনের পিছনে ছুটতে ছুটতে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ হারিয়ে অসুস্থ হয়ে উঠল দিনের পর দিন।


            ধীরে ধীরে ও বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। আর তার শিকড় ছড়াল বিদেশেও। দুবাইয়ের দামী রত্ন, অস্ত্র পাচারকারী দলেও নাম লেখানো শুরু হল। মৌবনী ছিল শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, স্মার্ট, ইংলিশে বেশ সড়গড়। দু একটা বিদেশী ভাষাও শিখেছিল।তাই ওর পক্ষে এই ধরণের কাজে হাত পাকানো বেশ সহজ হয়েছিল।  


            কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সৌনকের পাতা ফাঁদে ওকে পা দিতেই হল। সৌনক যে এই অপারেশনের মাস্টারমাইণ্ড সেটা মৌয়ের কাছে আগাম খবর ছিল। আর ওর ছবি দেখেই ও সিওর হয়।তাই ও জানত দলটাকে ধরার জন্যে সৌনক এই হোটেলেই আসবে। আর ওর ওপর আক্রমণও হতে পারে। তাই নিজের বুক পেতে ওকে বাঁচিয়ে দিল।


            দুজনের ভালবাসায় সব ফেরাল। ওর চোখের নীচে তিলটাই সব পরিষ্কার করল। ওটাই আইডেনটিফিকেশনের ক্ষেত্রে চরম পরীক্ষা দেয়। মৌবনীর পচ্ছন্দের পারফিউমের গন্ধ আগেই পেয়েছিল। সেটাও কাজে আসে....।


            বহু বছর পরে ওরা দুজন দুজনকে নতুন জীবন দিয়েছে। আজ ওরা দুজনেই তৃপ্ত, সুখী। 


            রাত বেশ গভীর। বাড়ির সব আলো নিভে গেছে। গোটা বাড়ি এখন নিস্তব্ধ। বিয়ে বাড়ির সেই কোলাহল আর নেই।


            সৌনক মৌবনীর ঠ‍োঁটে চুমু খেল। আবছা আলোয় সব কিছু অস্পষ্ট হলেও, ওর দু চোখের ভেজা নোনা আলোতে বহু পরিচিত ভালবাসার চিহ্ন তিলটা যেন আজ অনেক বেশী ঝলমল করছে।



            


Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024