অন্ধজনে দেহো আলো - সংযুক্তা পাল || গল্প || ছোটগল্প || Short story || Bengali Short story

 

অন্ধজনে দেহো আলো

        সংযুক্তা পাল



-‘টিকিট টিকিট। টিকিট’টা দিন দিদি’। কন্ড্যাক্টর হাতটা বাড়িয়ে টাকা চাইল।

আদিরার সম্বিত ফিরল কন্ড্যাক্টরের ডাকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। বসার সিট পায়নি আজকে। ভাবছিল অন্ধ মানুষটার কথা।কি করে যে প্রতিদিন রাস্তা পার হয়, কার ভরসায় যে বেরোয় কে জানে! ভাবতে ভাবতেই ব্যাগের মধ্যে হাত ঢোকায়।পার্সটা বড় ব্যাগটাতেই রাখে। এদিক ওদিক হাতড়ালো। নাঃ পার্সটা তো হাতে আসছে না। চলন্ত বাসে ঠিকমতো একহাত দিয়ে ব্যাগ ফাঁক করে দেখতেও পাচ্ছে না। বাসটা প্রচুর স্পিডে ছুটছে। দাঁড়িয়ে থাকাই দায়। তাও এভাবেই সে প্রতিদিনের যাত্রায় অভ্যস্ত। পিছন দিকের জেনারেল সিটে বসে থাকা প্রায় তারই বয়সী একটি ছেলে বলে উঠল, ‘আপনার ব্যাগটা কিন্তু বাঁ দিক দিয়ে বেশ কিছুটা কাটা। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না কাঁধে রয়েছে বলে। মনে হয় কেও ব্লেড দিয়ে কেটেছে’। আদিরা এবার আৎকে উঠল। সেরেছে। পার্সে তার এটি.এম.কার্ডগুলো,টাকা পয়সা মিলিয়ে চারশো-পাঁচশো টাকা ছিল। কী হবে এখন? কাঁদো-কাঁদো মুখে কন্ডাক্টরের দিকে তাকাল। রোজই যায় এই টাইমের বাসটাতে। কন্ড্যাক্টর তাকে চেনে। হাত নেড়ে আশ্বস্ত করল,’কাল দিয়ে দেবেন’। তবুও আদিরা সৌজন্য দেখাতে বলল, সে নেমে যেতে চায়। মোবাইল থেকে কল করে অফিসের এক বান্ধবীকে বলবে স্কুটি নিয়ে আসতে। কন্ড্যাক্টরটি ভদ্র গোছের। সে বলল,’আপনি আপনার নির্দিষ্ট বাসস্টপেই নামবেন দিদি। তবে রাস্তাঘাটে এত অন্যমনস্ক হয়ে থাকবেন না’ আদিরা অপ্রস্তুত হয়ে হমম বলল।


     টাকা পয়সা নিয়ে আদিরা এতটা ভাবছে না। চিন্তা এ.টি.এম কার্ডগুলোর জন্য। বাস-স্টপে নেমেই আগে এ.টি.এম কার্ডগুলো ব্লক করবে ঠিক করল। মাথাটা'কে যথাসম্ভব ঠান্ডা করে চিন্তা করল,এই বাসে শুধু সে বসার জায়গা পায়নি,তাই বলে এমন কিছুই ভিড় নেই যে কেউ তার ব্যাগ কেটে পার্সটা তুলে নেবে। তবে কি সেই অন্ধ লোকটা? যাকে বাসে ওঠার কিছুক্ষণ আগে সে রাস্তা পার করিয়ে নিয়ে এসেছিল! না না। এমা। ছিঃ। সন্দেহের বশে এইসব সে কী ভেবে চলেছে? কিন্তু আর নতুন অন্য কারো সাথে ওর তো কথাও হয়নি বা গা ঘেষে দাঁড়াতেও হয়নি। নাঃ। আর এসব ভেবে লাভ নেই। যেদিনই ও মানুষকে সাহায্য করার জন্য এগোয় সেদিনই ভুলভাল কিছু একটা হয়। এটা মনে হয় আদিরার কপাল।


     বাস থেকে নেমে তার যা যা করণীয় ছিল তাই করতে করতে অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। মোবাইলের থ্রুতে এ.টি.এম কার্ড ব্লক হয়ে গেল। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত। মা ফোন করেছে। মাকে এসব ব্যাপার কিছুই বলল না।একগাদা প্রশ্ন করবে আর বাড়ি বসে বসে দুশ্চিন্তা করবে।


       অফিস পৌঁছে নয়নাকে সব ঘটনাটাই বলল। নয়না বলল,‘কি আর করবি! তোর সেই অন্ধ লোকটাই হোক আর অন্য কেউ, টাকাটা গেল।আর কতগুলো দুশ্চিন্তা সঙ্গী করলি’। ‘লাঞ্চ আওয়ারে একটা ডায়েরী করিয়ে নিস’ পাশের ডেস্কের অর্পণের নির্দেশ। আদিরা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে কাজে ব্যস্ত হল। কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধ লোকটার মুখটা মাঝে মাঝেই ভেসে উঠছিল। তার মানে সত্যি যদি উনি অন্ধ না হন,কি সুন্দর নিখুঁত অভিনয়! এইভাবে গা ঘেঁষে চলার সময় মানুষ ঠকানো! আর ভাবতে পারেনা আদিরা। কাজেও ভালোভাবে মন বসছে না। তাও চেষ্টা করে যথাসম্ভব মনঃসংযোগ আনতে। অফিস আওয়ার শেষ হলে অর্পণ, নয়না আর আদিরা একসাথেই বেরোয়। মাঝে অর্পণের সাথে বেরিয়ে থানায় একটা ডায়রী করে এসেছে ও। এখন সব কিছুতেই ঝামেলা। থানার বড়বাবু কাঁইকুঁই করে বলছিল,আদিরার বাড়ির এলাকার থানাতে ডায়েরী করতে। ওনাকে অনেক অনুরোধের পর কাজ হয়েছে।


   পরদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়েছিল আদিরা। একটা লোককে দেখে চোখ আটকে গেল। ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ঠেস দিয়ে বিড়ি টানছে। পরনে কালকের সেই জামা-কাপড়। না আদিরার ভুল তো হয়নি। শুধু কালকের কালো চশমাটা চোখে নেই। উল্টো দিক করে দাঁড়িয়ে পাশের দোকানটা থেকে বিড়ি কিনছিল। তার মানে লোকটা ফ্রড। নয়না ঠিক বলছিল আর তার মনেও তো সন্দেহ উঁকি মেরেছে প্রথম থেকেই। ওদিকে আদিরার নির্দিষ্ট বাস এসে গেল। আর লোকটা রয়েছে উল্টো ফুটে। কি করা যায়! বাস ছেড়ে দিয়ে লোক জড় করে লোকটাকে চেপে ধরবে? নাহ। আদিরা বরাবর শান্তশিষ্ট। এসব একা সে পারবেনা। তাছাড়া লোকটার সাথে যদি ছুরি,চাকু থাকে! পকেটমারদের কাছে ওসব থাকতেই পারে। এরা তো প্রফেশনাল সব! আদিরা বাসে উঠে পড়ে।


     কিন্তু মনের মধ্যে কী ভীষণ এক কাঁটা খচখচ করছে সেই জানে। অফিস পৌঁছে নয়না আর অর্পণকে সবটা বলে। নয়না বলে,’বলিস কি রে? আর তুই ওটাকে দেখতে পেয়ে বাসে উঠে চলে এলি’! আদিরা এবার প্রায় কেঁদে ফেলল।অর্পণ বলল, 'আর কাঁদিস না।আমি দেখছি কী করা যায়'। সারাদিন আদিরা অফিসে উসখুস করে সময় কাটালো। বিকেলে অর্পণের সাথে বাড়ির জন্য রওনা হল। অর্পণ যেতে যেতে বলল, 'শোন আদিরা। আগামীকাল তোর বাড়ির কাছের বাসস্টপে আমি দু'জন বন্ধু নিয়ে তুই আসা অবধি অপেক্ষা করব। তোকে দেখে তোর সাথে কথা বলব না। দূরে থাকব। শুধু ইশারায় আমাদের ওই লোকটাকে চিনিয়ে দিবি। আর আগামীকাল যদি লোকটাকে না দেখতে পাস তাহলে আর কিছু বলার নেই। তোর ভাগ্য খারাপ'। আদিরা আশ্বস্ত হয়ে অর্পণের হাতটা ধরে বলল, 'তোর মতো বন্ধু ও সহকর্মী থাকতে আমার চিন্তা কী? তবে কথা দে খুব বেশি বাড়বাড়ি করবি না। মানে ওই মারধর আর কি। যদি পার্সটা নিয়েও থাকে হয়তো এটি এম কার্ডগুলো ফেলে দিয়ে ওই কটা টাকা আত্মস্থ করেছে। তবু ক্রাইম। সেটা অনস্বীকার্য'। অর্পণ বলল, 'বাপরে তোর তো দেখছি চোর বাটপারের ওপর হেভি সিমপ্যাথি। ঠিক আছে দেখা যাবে। আর জ্ঞান দিতে হবে না। বাড়ি যা। অফিসে এসে কেঁদে কেঁদে জ্বালাবে আবার দরদ উথলেও উঠবে। যা বাড়ি যা'। আদিরা নরম গলায় বলল, 'আসি রে। রাগ করিস না। তুইও সাবধানে যা'।


      পরদিন আদিরা পৌঁছনোর আগেই অর্পণ ওর দুই বন্ধুকে নিয়ে পৌঁছে গেল। আদিরাও চলে এল সময়মতো। আদিরা একটার পর একটা বাস ছেড়ে চলেছে। অর্পণরাও অধৈর্য্য। এমন সময় আদিরা ইশারা করল অর্পণকে। ওরা তিনজন লোকটার কাছে গিয়ে বলল আপনার সাথে বিশেষ দরকার। ওই ওদিকটায় একটু চলুন দয়া করে। বন্ধ কারখানার গলিতে নিয়ে গিয়ে অর্পণ ওনাকে চেপে ধরল। 'আপনি অন্ধ নন তবু অন্ধ সেজে পকেটমারী করছেন। পার্স চুরি করছেন। ততক্ষণে আদিরাও এসে দাঁড়িয়েছে'।লোকটা বলেই চলেছে সে পার্স নেয়নি। অর্পণ বলছে 'আপনি স্বীকার করুন। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে'। লোকটা তবু অস্বীকার করে বলছে উনি নাকি এরকম কাজ কখনোই করেননি। এত অবধি ঠিক ছিল। অর্পণের এক বন্ধু ক্ষেপে গিয়ে লোকটাকে সজোরে এক ঘুষি মারল আর লোকটা টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। লোকটা জ্ঞান হারাল। আদিরা এবার এক ধমক দিয়ে সবাইকে বলল, 'অনেক করেছিস তোরা। এবার যা। এখন আমি কী করি এনাকে নিয়ে'? অর্পণ বলল,'এই তুই অফিসে চল। অনেক হয়েছে তোর চোর-বাটপারের ওপর মায়া দেখানো। 'ওটা' এখানেই পড়ে থাক'। আদিরা যেতে চাইছিল না। অর্পণের জোরাজুরিতে অফিসের দিকে রওনা দিল।

      আদিরার মনটা বরাবর নরম প্রকৃতির। সারাদিন অফিসে আর কোনো কাজেই মন বসল না। ও আজ কাওকে না বলে একাই বেরিয়ে পড়ল। বাসে উঠল, নিজের বাড়ির ষ্টপেজে নামল। বাসস্টপ থেকেই যে গলিটার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই অন্ধকার গলিটার দিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ির রাস্তায় ঢুকে গেল।


   আগামীকাল অফিস না গিয়ে ব্যাঙ্কে যাবে ভাবল। বাড়ি থেকে বের হল ওর মায়ের আর ওর পাশবইটা নিয়ে। ব্যাঙ্কে যাবার পথে আবার সেই অন্ধ লোকটাকে দেখতে পেল। চোখে সেই কালো চশমা। আর পাশে.....পাশে হুবহু এক দেখতে যে লোকটা তাকে ধরে নিয়ে চলেছে তার ঠোঁট আর মুখটা ফোলা। কালকের 'শাস্তি'র চিহ্ন। হে ভগবান এরা যমজ ভাই। ভাইয়ের কথা লোকটা তার মানে বলেনি আবার যদি ভাইকে হেনস্থার শিকার হতে হয়!


       মাথা নীচু করে আদিরা হাঁটতে হাঁটতে চায়ের দোকান থেকে গুঞ্জন শুনতে পেল 'কি দিনকাল পড়ল। দুই ভাই ভাড়া থাকে। একে অপরের ভরসা। আর ওদের গায়ে হাত তুলল! ওদের মতো সৎ কেও আছে'? আর একজন বলল, 'সততার জন্য আবার একজন অন্ধ হয়েছে। সত্যি ভালো মানুষগুলোর জন্য ভগবান এত কষ্ট কেন লেখে কে জানে'!

           আদিরা দৌড়ে বাঁচল।কিন্তু নিজের থেকে বাঁচবে কিভাবে!





Comments

Popular posts from this blog

শারদীয়া সংখ্যা ১৪৩০ || সম্পাদকীয় ও সূচিপত্র || World Sahitya Adda Sarod sonkha 1430

TATA Steel Job Recruitment 2024 || টাটা স্টিল কোম্পানিতে নতুন করে 6000 শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ || TATA company job

মাধ্যমিক পাশেই ভালো মাইনের চাকরি,জলের ট্যাঙ্কি দেখাশোনার স্থায়ী কাজ || Jal Jeevan Mission Registration 2024